01/09/2023
ঘটনা এক || স্থান: আল-বেরুনী হল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকে স্থাপিত হওয়া একটি হল। হলের উপরে যেই অংশে হলের নাম লেখা থাকে, সেই অংশ থেকে হলের নামটি রোদ-বৃষ্টির কারণে মুছে গেল। 'আল-বেরুনী' উধাও হয়ে গেলো, রয়ে গেল শুধু 'হল'।
ছাত্ররা অনেক অভিযোগ করলো, হলের নামটা নতুন করে লেখেন বা ঠিক করেন- যাদের কাছে অভিযোগ করা হলো, তারা তেমন কানে নিলেন না। "আরে! সবাই তো জানেই যে এটা আল-বেরুনী হল! এত ঠিক করার কি আছে? করব নে পরে!"-এমন একটা ভাব।
সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল যে বাঁকা করতে হয়- এই বুদ্ধি আসলো এই হলের একজন ছাত্রের মাথায়। গভীর রাতে গিয়ে তিনি একটি অদ্ভুত কাজ করলেন। পরের দিন সকালে সবাই দেখল, হলের নাম পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে "হুমায়ুন ফরীদি হল"।
উপরের মহল তো রেগেই আগুন! কে করেছে এই কাজ? ফরীদিকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নির্লিপ্ত গলায় বললেন- আপনারা তো ঠিক করলেন না, তাই আমিই ঠিক করে দিলাম! ফলাফল- এরপরেই হলের নাম ঠিক করে আবার "আল বিরুনি হল" রাখা হলো!
ঘটনা দুই
কুরবানি ঈদের সময়। হলের বেশিরভাগ ছাত্ররা বাড়িতে চলে গেছে। অল্প কয়েকজন হলে থেকে গেছে, কারণ ঈদের পরেই পরীক্ষা নামক 'যন্ত্রণা' শুরু হবে। এই ছাত্ররা দলবল মিলে গেল মরহুম প্রফেসর কলিমুল্লাহর বাসায়।
হুমায়ুন ফরীদি বললেন- 'স্যার! আমরা কয়েকজন ছাত্র হলে আছি, কুরবানির ঈদ স্যার, আমাদের একটা গরুর ব্যবস্থা করে দেন কুরবানি উপলক্ষে।' স্যার বললেন- তোমরা কয়জন? আমরা ২০- ২২ জনের মত আছি স্যার- উত্তর এলো। তাহলে তোমাদের গরু লাগবে না, এক কাজ করো, আমি খাসির ব্যবস্থা করছি তোমাদের জন্য।
ভগ্ন হৃদয়ে ছাত্ররা স্যারের বাসা ত্যাগ করল, তখনই স্যারের বাসার বাইরে কুরবানির জন্য কিনে এনে রাখা কালো গরুটা নজরে পড়লো। চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেল ফরীদির সাথে বাকি সবার। সেদিন রাতেই স্যারের গরু চুরি করে নিয়ে আসলেন, সকালে সাভার থেকে কসাই নিয়ে আসলেন। দেড় মণের মতো মাংস হলো, ফরীদি কসাইকে বললেন ১৫ কেজির মতো রান্না করেন আর বাকিটা রেখে দেন। এদিকে কলিমুল্লাহ স্যারের চক্ষু চড়কগাছ সকাল বেলায় নিজের গরুকে না পেয়ে! উপায় না দেখে সকালেই নয়ারহাট (সাভারের একটি বিখ্যাত বাজার এলাকা) থেকে গরু কিনের আনলেন, আর হলের ছেলেদের কাছে খবর পাঠালেন "তোমরা আমার বাসায় এসে সেমাই খেয়ে যেয়ো"।
সেমাই খেতে যাওয়া বালকেরা খালি হাতে গেল না, বেঁচে যাওয়া গরুর মাংস সব নিয়ে গেল স্যারের বাসায়। স্যার বললেন- এগুলা কি? ফরীদি মুচকি হেসে বললেন- আমরা স্যার একটা গরু কিনেছিলাম, আমাদের খাওয়া শেষ, তাই ভাবলাম বাকিটা আপনার জন্য নিয়ে আসি। স্যার সব বুঝে গম্ভীর মুখে বললেন- হ্যাঁ হ্যাঁ! বুঝলাম! রাখো এই মাংস, আর খেতে বসো!
ঘটনা তিন
নাটক আর থিয়েটার নিয়ে যেই মানুষ বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকবেন, তার পড়ালেখার নমুনা যে খুব একটা ভাল হবে সেটা আশা করা একটু বেশিই হয়ে যায়, ফরীদির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তার সহপাঠীরা যেখানে পাশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে, তিনি তখন থার্ড ইয়ার বা ফোর্থ ইয়ারে। তার এক সহপাঠী অর্থনীতি বিভাগের নূরুল ইসলাম পাশ করে বেরিয়ে গিয়ে সেই বিভাগেই শিক্ষক হিসেবে জয়েন করলেন।
একদিন নূরুল স্যার ক্লাস নিতে আসলেন, বোর্ডে বেশ কিছু লিখে ছাত্রদের বোঝার সময় দেয়ার জন্য থামলেন। হঠাৎ কে জানি একজন বলে উঠল- এই নুরুল! তিন নাম্বার লাইনের একদম বাম দিকে ঐটা কি লিখছিস, একটু বুঝিয়ে বল তো! পুরা ক্লাস চুপ, স্যার অবাক! স্যার ভাবছেন- আমাকে 'নুরুল' বলে ডাকার 'দুঃসাহস' কার এই ক্লাসে? ক্লাসের একজন বাদে বাকি সব ছাত্ররাও একই কথা ভাবছে! হঠাৎ সেই দুঃসাহসী ব্যক্তিকে দেখা গেল, "এই যে নুরুল, আমি এইদিকে, আরে এই দিকে! কীরে? চিনতে পারছিস না আমাকে? আরে আমি ফরীদি! তোর সাথে না পড়তাম? ভুলে গেলি পাশ করেই? হা করে তাকিয়ে না থেকে তিন নাম্বার লাইনের একদম বামে কি লিখেছিস আমাকে দয়া করা বুঝিয়ে দে! পাশ তো করতে হবে নাকি?"
ঘটনা চার
শীতের সময়। হুমায়ুন ফরীদি অনেক রাতে নিজের গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছেন। বিজয় সরণি মোড় পার হবেন, তখনই একটি দৃশ্য দেখে গাড়ি থামালেন। দেখলেন, একজন বৃদ্ধ মানুষ শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে, তার পড়নে লুঙ্গি ছাড়া আর কিছুই নাই। হুমায়ুন ফরীদি নিজের কোট আর শার্ট খুলে ঐ বৃদ্ধকে পড়িয়ে দিয়ে আসলেন, বৃদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। ফরীদি বাসায় ফিরলেন খালি গায়ে। এটা তো শুধু একটা উদাহরণ, সাভারে দুইটি এতিমখানা আছে যার যাবতীয় খরচ ফরীদি বহন করতেন, কেও জানতো না যে ফরীদি দুইটি এতিমখানা চালাচ্ছেন। নিজের দানের কথা জানাতে বিরক্ত বোধ করতেন তিনি।
ঘটনা পাঁচ
ফোন রিসিভ করার পরে আমরা সবাই সাধারণত প্রথমে "হ্যালো" বলি, কিন্তু ফরীদি হ্যালো বলতেন না । তিনি "কেমন আছ?" বলে কথা শুরু করতেন। অপরিচিত নাম্বারের বেলায় তিনি কি করতেন, তা আমার জানা নেই!
ঘটনা ছয়
একুশে টেলিভিশনে প্রচারিত জনপ্রিয় নাটক ভোলার ডায়রি খ্যাত অভিনেতা সাজু খাদেম হুমায়ুন ফরীদিকে এতটাই নিখুঁতভাবে নকল করতে পারতেন যে, একটা সময় বিরক্ত হয়ে ফরীদি সব জায়গায় ফোন করে বলতেন- হ্যাঁ, আমি সাজু খাদেম না, আমি আসলেই হুমায়ুন ফরীদি, আমি সত্যি বলছি!
ঘটনা সাত
সুবর্ণা মুস্তফার সাথে একবার তার প্রচণ্ড ঝগড়া হলো, রাগ করে সুবর্ণা অন্য রুমে গিয়ে দরজা আটকে শুয়ে পড়লেন। সকালে উঠে দরজা খুলে দেখেন, যেই রুমে ঝগড়া হয়েছিল, সেই রুমের মেঝে থেকে ছাদের দেয়াল পর্যন্ত একটি কথাই লিখে পুরো রুমকে ভরে ফেলা হয়েছে, কথাটি হল- সুবর্ণা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। এত ভালোবাসাও তাদের বিচ্ছেদ ঠেকাতে পারেনি, ২০০৮ সালে ডিভোর্স হয় তাদের। এক ইন্টার্ভিউতে ফরীদিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- আপনারা আলাদা হয়ে গেলেন কেন? উত্তরে বলেছিলেন- "এটা তোমার সুবর্ণাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। আমি তো সুবর্ণাকে ছাড়িনি। ও আমাকে ছেড়েছে।"
একজন প্রকৃত অভিনেতা মনে হয় তিনিই যিনি মঞ্চ, নাটক, সিনেমা- সব জায়গাতেই দক্ষতার সাথে অভিনয় করতে পারেন আর মানুষের মন জয় করতে পারেন। কানকাটা রমজান থেকে নব্বই দশকের একের পর এক ব্যবসাসফল বাণিজ্যিক সিনেমা- সব জায়গাতেই ফরীদি সফল। দহন, একাত্তরের যীশুর মতো ভিন্ন ধরনের সিনেমাতেও তিনি নিজের প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন। ছোটপর্দাতেও তিনি সমান জনপ্রিয়। নব্বই দশকে এমন অবস্থা ছিল যে, দর্শক নায়ক নায়িকা না দেখে শুধু তাকে দেখার জন্যই হলে আসতো। পরিচালক শহিদুল ইসলাম খোকন সম্ভবত এই কারণেই নিজের পরিচালিত ২৮ টি সিনেমার মাঝে ২৫ টিতেই ফরীদিকে রেখেছেন।
নিজে কখনোই হিরো হতে চাননি, "হিরো হওয়া তো সমস্যার! হিরোর কিছু নির্দিষ্ট কাজকর্ম করতে হয়, আমি সবসময়ই অভিনেতা হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মানুষ ভালোবেসে মনে হয় আমার মতো মানুষকে হিরো বানিয়ে দিয়েছে। যেখানেই যাই, অসংখ্য লোক চলে আসে। প্রিয় জায়গায় যেতে পারিনা, কিছুটা বিরক্ত লাগে। তবে এই ভালোবাসা ভাল লাগে অনেক, একদিন সকালে উঠে যদি আমি দেখি মানুষ আমাকে চিনতে পারছে না, তাহলে এর চেয়ে বড় দুঃখ আমি আর কোন কিছুতে পাব না। আমি চাই যে মানুষ আমাকে চিনবে।"
নব্বই দশকে তার একের পর এক দারুণ সিনেমা দেখে যতটা আনন্দ পেয়েছি আর মুগ্ধ হয়েছি, ততটাই আহত হয়েছি একসময় তার মানের চেয়ে অনেক অনেক নিচু সিনেমাতে তাকে অভিনয় করতে দেখে। "রাঙ্গা বউ" নামক সিনেমাতে ঋতুপর্ণার নাভি লেহনের দৃশ্যে তাকে অভিনয় করতে দেখে আহত হয়েছি। সিনেমাটা হিন্দি সিনেমা "অগ্নিসাক্ষী" এর কপি, নানা পাটেকরের চরিত্রে অভিনয় করেন ফরীদি, নাভি লেহনের মত কিছু আপত্তিকর দৃশ্য থাকলেও আই মাস্ট সে, অভিনয়ের কথা বললে নানার চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে ছিলেন না ফরীদি এই সিনেমাতে। সাথে তো ছিলোই তার সেই বিখ্যাত কলিজা কাঁপিয়ে দেয়া অট্টহাসি।
একটা কথা সবসময় বলতেন, "বাঁচো আর বাঁচতে দাও।" আরও বলতেন "জীবনটা অনেক দামি, এটার যত্ন কর। পৃথিবী নামক গ্রহে তোমার কোন অবদান থাকবে না, এটা কীভাবে হয়? হ্যাঁ, এই গ্রহে অনেক সমস্যা, কিন্তু সেটাই সব না। এই গ্রহে সবাই বুশ না, এই গ্রহে রবীন্দ্রনাথও আছেন"- সবসময়ে জীবন সম্পর্কে কথা বলা, বেঁচে থাকার উৎসাহ দেয়া লোকটা, নিজেই একসময় বেশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন, কেউ তার খোঁজ নেননি। নিয়মিত মদ্যপান করতেন, সেটা আবার স্বীকারও করতেন।
২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। সবার কাছে তিনি স্টার বা দারুণ অভিনেতা হলেও, আমার কাছে সবার আগে তিনি ক্যাম্পাসের বড় ভাই। ভাবলেই গর্বে বুক ফুলে যায় যে তিনি আর আমি একই জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটির। তিনি ৫ম ব্যাচের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র, আর আমি ৪০ ব্যাচের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের। মাঝের গ্যাপটা অনেক বড় হলেও, জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরা মানেই জানেন, জাবির সিনিয়র জুনির সম্পর্ক অন্যরকম। জাবির সিনিয়র জুনিয়র একসাথে আড্ডা দিতে বসলে- সময়, দেশ, জাতি কোনদিকে আর কারো খেয়াল থাকে না। চায়ের কাপের অর্ডার চলতেই থাকে অনবরত।
চায়ের কাপ থেকে মনে এলো- জাহাঙ্গীরনগরের এক চায়ের দোকানদারের কাছ থেকে ফরীদি একবার চা খেয়েছিলেন, কিন্তু বিল দেন নাই, হেসে বলেছিলেন- তোমার বিল আমি এই জীবনে দিব না! প্রতিবার এসে চা খেয়ে যাব, কিন্তু টাকা তুমি পাবা না। সে চা দোকানদার এখনও আছেন, তিনি কাঁদতে কাঁদতে এখন বলেন- আমার টেকা লাগব না গো স্যার! আপনে একবার চা খাইতে হইলেও আমার দোকানে আসেন, আপনে নাই এইটা হইতে পারে না। বিশ্বাস করেন আমি টেকার কথা বলব না।
বিশ্বাস আমারও হয়না যে এই মানুষটা নেই, ফাগুনের সময় তিনি চলে গিয়েছিলেন, ফাগুন আবারও এসেছে, আরও আসবে, ফাগুন আসলে কান পাতলেই আমি ফরীদির সেই হাসি শুনতে পাই। আমি বিশ্বাস করি তিনি এখনও আছেন, শুধু আমার চোখের সমস্যার কারণে আমি তাকে দেখতে পাই না। নিজের বাবার মৃত্যু ছাড়া এই জীবনে হাতেগোনা যেই কিছু মানুষের মৃত্যুতে চোখে আপনাআপনি পানি চলে এসেছে, তার মাঝে একজন হলেন ফরীদি। তবে খুব একটা চোখে পানি আনি না এখন, কারণ তিনি নিজেই বলে গেছেন "তেল গেলে ফুরাইয়া, বাত্তি যায় নিভিয়া, কি হবে আর কান্দিয়া?"
আমি বিশ্বাস করি, ক্রিস্টোফার নোলান যদি বাংলাদেশে জোকার চরিত্র নিয়ে সিনেমা বানাতেন, তাহলে ফরীদির চেয়ে সেই চরিত্র অসাধারণভাবে আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না। আল বিরুনি হলের ক্যান্টিনে তার ৩১৯ টাকা "বাকি" ছিল, এই জিনিসটা তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হলে তিনি বলতেন- আমি জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসের কাছে ঋণী থাকতে চাই, এই ঋণ আমি শোধ করতে চাই না! হুমায়ূন ফরীদির কাছে ঋণী তো পুরো বাংলাদেশ!