30/04/2024
"পাড়ের চিহ্ন"
(পর্ব ১-২)
.....✍️
"""" """"" """"""" """""""" """"
১.
⇨ আমি ঘুম থেকে উঠে আপনাকে দেখতে চাই, এবং ঘুমতে যাওয়ার আগেও। জেনে রাখুন, আমি ভালোবাসলে আপনি ভালো থাকবেন। আর না বাসলে? বেঁচে থাকবেন....
আপনাকে দেখার পর থেকে মনে হচ্ছে আমি কষ্টে আছি, যার অনুবাদ I am in love. যদিও আপনার মধ্যে হৃদয় বলে কোনো উপদ্রব নেই। তবুও আমি অক্ষত হৃদয় নিয়েই প্রেমের সাথে আপনার প্রেমে পড়েছি। নাহলে আমার একই মনে, নানা রকমের ইচ্ছে কেন জাগে? রোজ!
➤তোমাদের ডাক্তারী পড়ুয়া মেয়েরা বড্ড নির্লজ্জ হয় এতে কোনো সন্দেহ রইলো না আর। তোমাদের থেকে আমার শিশুতোষ জীবন অনেক শালীন, অনেক সাবলীল।
⇨শিশুই তো! আচ্ছা বলেন তো, আপনি কোনো মেয়ের সান্নিধ্য নিয়েছেন কিংবা পেয়েছেন কখনো?”
➤অশ্লীল অশ্লীল অশ্লীলতা... ?
⇨এবার হলো তো প্রমাণ?
➤মানে?
⇨মানে, আপনি একটা শিশু, কচি, কচি পোলা; আটাশ বছরের কচি পোলা৷
গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললাম, “আচ্ছা, গতরাতে ভার্জিনিটি বিষয়ক কিছু একটা বলছিলে….”
⇨“হ্যাঁ৷ আপনি তো জলজ্ব্যান্ত একটা ভার্জিন বস্তু! আপনি কোনোদিন সিগারেট স্পর্শ করেননি, উল্টাপাল্টা পানীয় পর্যন্ত খাননি; মানে, আপনার হাত-ঠোঁট-গলা সব— সবকিছুই ভার্জিন, এক্কেবারে ইনটেক! আচ্ছা, মেইনটেইন কীভাবে করেন?”
নিপুর হিউমার প্রয়োগটা বুঝতে পেরে বেশ গর্বিত আমি ছোট্ট করে হেসে দিলাম; যে হাসিতে অহংকার স্পষ্ট৷
কিন্তু অবাক করে দিয়ে নিপু বললো, “এ বুড়ো বয়সেও ভার্জিন থাকাটা যতটা না অহংকারের, তার চাইতে বেশি সন্দেহের৷”
কথাটা শুনে আমি খানিকটা অপ্রস্তুত৷
সেসব থোড়াই পরোয়া করে নিপু বললো, “যাকগে, আপনার হাতের ভার্জিনিটি তো গেছে, সিগারেট তো স্পর্শ করেই ফেললেন; আপনার ঠোঁটের অহংকারও আজ শেষ করে দেবো৷” আচ্ছা তার আগে বলুন তো, "আপনার কি বন্ধু বান্ধব নেই, থাকলে তো দুএকবার সিগারেট খাওয়াটা অন্তত হয়েই যেতো!"
➤বন্ধু বান্ধব থাকবে না কেন? আছে... একটা ঘটনা বলি শোনো,
আমাদের জে.এস.সি পরীক্ষার শেষ দিন আমরা বন্ধুরা ঠিক করলাম আজ সিগারেট খাবো। তারপর পরীক্ষা শেষে কোথায় খাবো, কোথায় খাবো.... শহরে জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।...
⇨হোয়া..ট..
➤হ্যা। তখন ফখরুদ্দীনের তত্বাবধায়ক শাশনামল কেবল শেষ হয়েছিল। কিন্তু তখনও আর্মি ক্যাম্পগুলো শহরে বেশ সক্রিয়। সামান্য পান থেকে চুন খসলেই বেধড়ক পিটুনি। আর আমাদের তখন দাড়ি-গোফ সবে উঠছিল। এমন নাবালকদেরকে সিগারেট হাতে দেখলে আর্মি কি যে করবে সেটা ভাবাটাই আহটের।
⇨তারপর?
➤আমরা আমাদের বাজারে এসে একটু সাহস পেলাম। কিন্তু সিগারেট কেনা নিয়ে বিড়ম্বনা, কেউ কেনার সাহস পায় না... শেষমেশ আমিই সাহস করে পা বাড়ালাম। দু প্যাকেট মেরিস সিগারেট কিনে টাকা দেওয়ার সময় দোকানদার মুখ দেখেই নানার নাম বললেন। আমি তখন নানার বাড়িতেই থাকতাম। দোকানদার টাকা ফেরত দিয়ে জিগ্যেস করলেন, "পরীক্ষা কেমন হলো!" ঘার বাকিয়ে চলে আসছিলাম, দোকানদার পিছন থেকে ডেকে টাকা ফেরত দিয়ে বললো, "টাকা লাগবে না, তুমি সিগারেট নিয়ে যাও। বিকেলে তোমার নানার কাছে টাকা নিয়ে নিব, তাছাড়া এখানে তোমার নানার নামে খাতাও খোলা আছে।"
⇨হা হা হা.....হা... তারপর...
➤তারপর আর কি, সিগারেটের প্যাকেট ওনার দোকানেই রেখে আমি দৌড়...
আবার নিপুর হাসি; এ হাসিটা কেমন যেন অন্য রকম বিশ্রী শুনতে, তবে মায়া আছে যে... এ হাসি অন্য কোনো জগতের সৃষ্টি৷ দুটো টানটান ঠোঁটের মাঝখানে শরতের শুভ্রতা; খেয়াল করলাম নিপুর ঠোঁটের সীমানা ভেঙে এক কোণে খানিকটা লিপস্টিক লেপ্টে আছে; খুব সামান্য, কেবল সুগভীর দর্শনে চোখে পড়ে৷ সাথে সাথে আমার সারা শরীরে এক অসম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো— আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় সেটা মুছে দেবো, না কি দেবো না?
দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টিতে আমার চোখ নিপুর ঠোঁটের কোণে৷ নিপু বললো, “আপনাকে একটা কথা বলি শুনুন; পৃথিবীর প্রায় সকল পুরুষই মনে করে তারা চোরাদৃষ্টিতে নারীশরীরের কোন দিকে তাকাচ্ছে সেটা সে নারী বুঝতে পারে না৷”
একটা বিশাল কথার ধাক্কা; নিপুর ঠোঁটের ওপর থেকে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম৷
নিপু বলতে থাকলো, “কিন্তু পুরুষের ধারণাটা একদম ভুল৷ আসলে একশো হাত দূর থেকেও পুরুষের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা মেয়ে বলে দিতে পারে পুরুষটি তার শরীরের ঠিক কোন অংশে তাকিয়েছে৷”
➤বেশিরভাগ পুরুষের আফসোস তো এখানেই৷
⇨মানে?
➤মানে, পুরুষ কোন দিকে তাকিয়েছে নারী এটুকুই কেবল বোঝে, দৃষ্টির ভাষাটা কখনোই বোঝে না৷
নিপু উচ্চতানে হেসে উঠলো; সে হাসিতে নিস্তরঙ্গ হাওয়ায় এক দারুণ সুরঝংকার খেলে গেল৷
➤হাসলে যে?
⇨কারণ, ছেলেদের এই এক সমস্যা, তারা চোখের ভাষা বোঝাতে চায়৷ শুনুন, চোখের কোনো ভাষা থাকে না; ওসব ভ্রম ৷
➤মানুষের চাহনির কোনো অর্থ থাকে না?
⇨না৷ কারণ প্রতারক ও প্রেমিকের দৃষ্টি সচরাচর একই রকম হয়৷
আমার উল্টো প্রশ্ন, “প্রেমিক আর প্রতারকের মধ্যে কোনো পার্থক্যই দেখতে পেলে না?”
⇨এই যে ধরুন, আজ আপনি প্রেমিকের অবস্থানে; কে জানে, এই আপনিই হয়তো কাল প্রতারকের বেশে৷ এখন আপনিই বলুন, এই মুহূর্তে আপনার যে দৃষ্টি, তাকে আমি প্রেমিকের চাহনি বলবো, না-কি সম্ভাব্য প্রতারকের?
নিপুর কথাবার্তায় আমি কিছুমাত্রও আহত হলাম না; কারণ আমি এতটুকু নিশ্চিত, নিপুর সৌন্দর্য এখানেই!
নিপু বললো, “ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন; বলুন তো একটা নারীর সৌন্দর্য বলতে আসলে কী বোঝায়?”
আচমকা হকচকিয়ে গেলাম; সৌন্দর্য বিষয়টা এইতো মনে মনে ভাবছিলাম, নিপু সেটা কীভাবে ধরতে পারলো? প্রশ্নসংকুল বিভ্রান্ত চোখে নিপুর দিকে তাকালাম৷
নিপু বললো, “এতে এত অবাক হবার কী আছে? আমি তো জানিই যে আমার সবকিছুই আপনার সুন্দর লাগে; আমার মুখ থেকে এমন কঠিন একটা কথাও আপনার সুন্দর লেগেছে— এটা খুবই সাধারণ একটা সমীকরণ৷ তাছাড়া সুন্দর মন যাদের, তারা অসুন্দরেও সুন্দর খুঁজে পায়৷”
কিছু একটা বলতে যাবো, এমন সময় নিপু থামিয়ে দিল, “থাক, সৌন্দর্যের সংজ্ঞা আপনার দেয়া লাগবে না; আপনি বরং সিগারেটটা একটু ধরান৷”
হাত বাড়িয়ে সিগারেটটা নিলাম৷ নিপুকে বেশ খানিকক্ষণ ব্যাগ হাতড়ে দেয়াশলাই বক্সটা বের করতে দেখে আমি বেশ কৌতুহলী হয়েই বলেছিলাম, “আমার কাছে এ পৃথিবীর সবচাইতে বড় রহস্য কোনটা, জানো? আমার কাছে সবচাইতে বড় রহস্য হলো….মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ৷”
শুরু করা বাক্যটি শেষ করলো নিপু৷
⇨কী এত থাকে ব্যাগের ভেতর?
➤একটা সমৃদ্ধ জাদুঘরে যা যা থাকে৷
নিপুর উত্তরে আমি পূনরায় প্রশ্ন জুড়লাম, “যেমন!”
⇨জী; আমাদের ভ্যানিটি ব্যাগ হচ্ছে রীতিমতো একটা জাদুঘর— নেইল কাটার থেকে আই লাইনার, টুথপিক থেকে লিপস্টিক— সব পাওয়া যায় এ জাদুঘরে৷
দেয়াশলাই বক্সটা হাতে দিয়ে সিগারেটটা নিয়ে নিল; এরপর সেটা ঠোঁটে ধরে নিপু বললো, “আগুনটা জ্বালান তো একটু৷”
আগুন জ্বাললাম; মুখটা এগিয়ে সে আগুনে সিগারেট ধরালো নিপু৷ তারপর দলা পাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো সরাসরি আমার মুখের ওপর৷
সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে ঠোঁট থেকে বের করে সেটা পুনরায় এগিয়ে দিলো আমার দিকে; বললো, “ধরুন তো একটু৷”
জ্বলন্ত সিগারেটটা হাতে নিলাম৷ নিপু কোনো কথা না বলে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো চোখের দিকে, মুখের দিকে; দারুণ একটা খেলা শুরু হয়ে গেছে৷
সিগারেটের দিকে তাকিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম— সেখানে লেগে থাকা ঠোঁটে কি ঠোঁট ছোঁয়াবো, না-কি মধুমাখা বিষপেয়ালার আকর্ষণ থেকে নিজেকে নিবৃত করে সারাজীবনের আফসোস কিনবো?
কয়েক মুহূর্তের ভাবনাপর্ব শেষে হাতে ধরা সিগারেটে লিপস্টিকের দাগ লক্ষ করে ঠোঁট এগিয়ে; ঠোঁটের সাথে মিলে গেল ঠোঁট! একটা টান দিতেই বুকের মধ্যে একটা ধাক্কার মতো লাগলো৷ প্রচণ্ড কাশিতে গলার শিরাগুলো রীতিমতো ছিঁড়ে যাবার জোগাড়৷
নিপুর লাল লিপস্টিকে হাসির দাগ৷ আমার চোখের কোণে রীতিমতো জল জমে গেছে৷
নিপু বললো, “থাক, আর খাওয়া লাগবে না; দিন আমাকে৷”
কোনো উত্তর না দিয়ে পুনরায় টান দিলাম; মাথা খানিকটা ঝিম ধরে এল৷ নিপু কাছে এগিয়ে এসে বাম হাতের উপর তার হাতটা রাখলো; বললো, “কী হলো? মাথা ঘোরাচ্ছে?”
মাথা খানিকটা তুলে বললাম, “একটু৷”
কথাটুকু বলেই খেয়াল করলাম আমার হাতের উপর নিপুর হাত; সমস্ত শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেল! চট করে সিগারেটে আরেকটা টান দিলাম; মাথার মধ্যে একটা চক্কর দিয়ে উঠলো৷ নিপু হাত থেকে সিগারেটটা কেড়ে নিল; আমার হাতটা শক্ত করে ধরে থাকলো, “খুব বেশি খারাপ লাগছে?”.....
হা হা হা.... অথচ এই মেয়েটাকে প্রথম যখন দেখতাম তখন এতোটা বিগ্রে যাওয়া কখনোই মনে হয় নি।
একদিন নিয়মমাফিক শেষ বিকেলে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছি। নানার বাড়িতে আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে। পরিশেষে অনেক তালগোল পাকিয়ে আমি মাস তিনেক যাবৎ তখন নিজের বাড়িতে স্থায়ী হয়েছিলাম।
চারালকাটা নদী। বর্ষার মৌসুম। ছোট্ট নদী কিন্তু বর্ষায় অনেক বড় হয়। স্রোত নেই তবে এখনও পানিতে ভরপুর। এখন এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য নৌকাই একমাত্র ভরসা। আসরের আজান অনেক্ষণ আগে হয়েছে, মাগরিব ছুঁই ছুঁই। আকাশে আলো ফুরিয়ে আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে। ওপার থেকে নৌকা নিয়ে আসছে যহর মাঝি। সারা বছর মোটামুটি সে ই পারাপারের একমাত্র ভরসা। নৌকা চালায় আর ভুট্টা লাগায় নদীর ধারের বালু জমিতে। নৌকার উপর দুটো ব্যাগ রেখে আয়েশ করে বসে আছে, নিপু। ডাক্তারি পড়ছে, এ গ্রামের বেশ সম্মানিত পরিবারের মেয়ে। নৌকা এপাড়ের কাছাকাছি আসলে, আধো অন্ধকারে এপাড় স্পষ্ট হয়ে উঠে। বড় তালগাছটার নিচে, বাসের মাচালিতে বসে আছে কেউ একজন। যহর মাঝি দেখেই চিনতে পারে। মুখে হাসি ফুটে ওঠে তার।
-আপা দেখেন, আমাগো বেনু ভাই। পাগল মানুষ।
নিপু তালগাছটার দিকে তাকিয়ে মানুষটাকে দেখতে পেল।
-পাগল কেনো?
-রোজ রোজ এইখানে বসে থাকে। কি যে দেখে আল্লা জানে!
-এখানে বসে থাকলে খারাপের কি হলো?
-আরো তো কারণ আছে আপা। আমারে ঠিক করছে তারে নৌকা চালান শিখাইতে হবে। রোজ তারে আমার নৌকা চালানো শিখাইতে হয়। রোজ পঞ্চাশ টাকা দেয়। তয় মাথা ভালা। শিখা ফালাছে প্রায়। অথচ জীবনে বৈঠা ধরে নাই।
ঘাটে নৌকা বেঁধে নিপুর ব্যাগ হাতে নিয়ে পিছনে পাড়ে উঠে আসে যহর মাঝি। নিপুকে তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত তার কাজ। তালগাছের সামনে এসে মানুষটার দিকে তাকায় নিপু। মাচালির উপর বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কি দেখছে সে ই জানে। সামনে আকাশ ভরে উঠছে অন্ধকারে।
মাচালির উপর মানুষটা আমি, বেনু।
গ্রামের সবার কাছে আমি এখনও অপরিচিত। মেশার মতো কেউ নেই। তাই শেষ বিকেলে নদীর ধারে আসি...
প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে বাজারে গিয়ে এককাপ চা খেয়ে নদীর দিকে হাটা শুরু করি। তারপর পারে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। এই সময়, আকাশ আর নদীর ঠান্ডা বাতাসটা ভীষণ ভালো লাগে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা পেরোয়, রাত নামে। রাতের আকাশে যখন তারায় তারায় ভরে উঠে, আকাশটাকে বিয়ে বাড়ির মাথার উপরের আকাশ মনে হয়। দাদীর ভীষণ ইচ্ছে ছিলো আমার বউ দেখার। বলতেন,
"নাত বউ হইবে ধলা,
রাইধবার দেইম হামার খ্যাতের মূলা।"
কিন্তু তিনি সে ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসতে পারেন নি। প্রায় তিন বছর হতে চলল, তিনি মারা গেছেন। মরার আগে বছরখানেক চোখে দেখতেন না। সামনে কেউ এলে, ভাঙা কন্ঠে বলতেন, কাঁয় তোমরা?
.. তো এমন করে নদীর ধারেই ৭দিন পর পর নিপুর সাথে আমার দেখা হয়ে যেত। এই হঠাৎ সাক্ষাৎ একসময় পরিচয়ে এবং আধো বন্ধুত্বে গড়িয়েছে। বন্ধুত্বের খোলস ছেড়ে পরবর্তীতে প্রণয়।
সে সিগারেট খায় সেটা তার সাথে পরিচয়ের ১০দিনের মাথায়ই আমাকে জানিয়েছে।
হঠাৎ রাত ১১টায় একদিন ফোন করে বললো, "সুরভী উদ্যানের আশপাশ আপনার কোন পরিচিত বন্ধুসূলভ কেউ আছে?"
আমার পরিচিত অনেকেই থাকায়, আমি সহজভাবেই সম্মতি দিলাম, "হ্যা অনেকেই আছে, কিন্তু কেন!"
সে গুরুতর সমস্যা জানিয়ে কাউকে তার হোস্টেলের সামনে পাঠাতে বললো এবং আমি তাৎক্ষণিকভাবে একজনকে পাঠালাম। পরবর্তীতে পাঠানো বন্ধুকে কারণ জিজ্ঞেস করায়, বন্ধু আমাকে বেশ রাগান্বিত উপস্থাপনায় জানালো : নিপুর সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছে এবং হোস্টেলের বাইরে যাওয়ার সময় শেষ হওয়ায় তাকে দিয়ে সিগারেট আনিয়ে নিতেই এমন গুরুতর কারণ দর্শানো।
নিপুর সাথে যখন আমার সম্পর্কের চার মাস বয়স তখন আমি "কিছু একটা করতে হবে" এই ভেবে ঢাকায় আসলাম। অপরদিকে নিপুও স্থায়ীভাবে মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে উঠলো।
আর আমি ঢাকায় উঠলাম নজরুল ভাইয়ের সাথে। একা মানুষ উনি, তাই আরেক পাগলরে রুমমেট বানিয়ে নিলেন। বাসাটা একটা সুন্দর জানালাওয়ালা পুরাতন রুমের। আমার রুমমেট নজরুল ভাই স্কুলের অংকের শিক্ষক, অংকের জাহাজ নামে খ্যাতি আছে তার। বেশ অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের ছেলে তিনি। প্রতি কুরবানির ঈদে দুইটা করে গরু কুরবানির সুনাম আছে তার পরিবারের। তবে তিনি তুলনামূলক কিঞ্চিৎ কৃপণ স্বভাবের হওয়ায় ভাড়া বাঁচাতে আমাকে রুমে তুলেছেন। আমাদের রুমে অনেক জিনিসপত্র, তবে আমার নিজস্ব সম্পত্তি বলতে একটা টেবিল আর একটা আলনা। চকি একটা কিনতে চেয়েছিলাম তবে নজরুল ভাইয়ের খাট থাকায় আর কেনা হয় নি।
..
২.
নিপুর সর্দি লেগেছে। বারবার নাক টানছে। আমি ফোনের এপাশ থেকে বুঝতে পারছি ওর দিনকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছেনা। হোয়াটসএ্যাপে খুব একটা ভালো কথা শোনা যাচ্ছেনা। আমি আবার মেসেঞ্জারে চেষ্টা করলাম কথা বলতে। নিপু বারবার বলছে, আমি ভালোবাসি। আমি তারপরও আরেকবার আরেকটু স্পষ্ট করে শোনার জন্য ওকে ফোন করেই যাচ্ছি। ও ১৪ তম চেষ্টায় ফোন ধরার পর আমাকে বললো, বেনু থামো। হবেনা তো ওমন? বুঝতে পারছোনা?
আমি মৃদু হেসে বলি, না হতে হবে। আমার ভালো লাগেনা। দিন কাটেনা। আমরা প্রতিবার যখন কাছাকাছি বসে থাকতাম, তুমি হাত ধরে যেভাবে ভালোবাসি বলতে ওভাবে বলতে হবে।
নিপু হাসে। আমি কল্পনা করতে পারি ও এখন ডান চোখের ভ্রু উচিয়ে মুখে হাত দিয়ে হাসছে। ওর হাসি প্রথম যখন শুনেছিলাম তখন মনে হয়েছিলো মেয়েটার ঠান্ডা লেগেছে। এখন মনে হয়, আচ্ছা এমন হতে পারে যে মৃত্যুর পর আমি খোদার সাথে একটা চুক্তি করলাম। চুক্তিনামায় একটাই চুক্তি। আমার প্রতিটা ভালো কাজের বিনিময়ে ওর খসখসে বিচ্ছিরি রকমের হাসিটা এক মিনিট করে শুনতে দিতে হবে।
নিপুর হাসি কমে আসলে আমাকে বললো, তুমি এমন পাগল পাগল করো মাঝে মাঝে। আমি তোমার থেকে এখন প্রায় ৪০০ কিমি দূরে তোমার প্রাক্তন শহরে বসবাস করছি। তোমার হাতটাও ছুয়ে দিতে পারছিনা।
আমি দীর্ঘশ্বাসটা টেনে আরেকটু বড় করে ওকে বললাম, এ আর কতটুকু দুরত্ব নিপু, আসল দুরত্ব তো আমার দারিদ্রতা। দারিদ্র্যতার কাছে একদিন যদি হেরে যাই, কিংবা তুমিই পরাজিত ঘোষণা করো!
নিপু খুব মনঃক্ষুণ্ন স্বরে এমনটা পরবর্তীতে না বলার অনুরোধ করলো, এবং ইতিমধ্যেই জয়ী ঘোষণার প্রবল আশ্বাস প্রদান করলো।
আমিও সেটা শুনে আপ্লুত কন্ঠে তাকে শোনালাম,.তুমি আমার মনে এসো
কাউকে না জানিয়ে, বৈশাখী ঝড় তুলে
খুব করে ভালোবেসো...
নিপু আবার হাসছে। আমি জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ওর হাসি শুনি। একটু পর বলি, বেশি সস্তা হয়ে গেছে লাইন ক'টা, আমি তো পারিনা জানোই।
নিপু আমাকে ফোনের ওপাশ থেকে বলে, তোমাকে অনেক ভালোবাসি।সত্যি, সত্যি, তিন সত্যি।
ফোনটা রেখে দেওয়ার পরও কানে বারবার ভালোবাসি কথাটা বাজতেই থাকলো। এমন কেন লাগে? যখন খুব ভালোবাসার মানুষটা তার মনটা মেলে ধরে, তখন এমন কেন লাগে? আমি উত্তর খুঁজিনা।
আমার মাঝে মাঝে কাঁদতে ইচ্ছা করে। এই যেমন এখন ইচ্ছা করছে। এই কান্নাটা আনন্দের। আনন্দটা হয় যখন মনে হয় নিপুর মত একটা অসাধারণ মানুষ আমাকে ভালোবাসে এটা ভেবে। মেয়েটা আমার থেকে গুনে গুনে ৭ বছরের ছোট। কিন্তু যখন কথা বলি মনে হয় ও আমার থেকে অনেক বড়, অনেক পরিপক্ব।
পৃথিবীতে সবচেয়ে জটিল সমস্যাটা আমার মত প্রেমিকদের। এরা হাজার লক্ষবার চেষ্টা করলেও বলতে পারেনা কাউকে কতটা ভালোবাসা যায়। আমিও পারিনি।
নিপুকে আমি বলি, তোমার নামটা নিপু রেখেছে কে?
নিপু হেসে বলে, তোমাকে আগেই বলেছি। নিপু শব্দের অর্থ হলো "নিশ্চিত"। আমার ফুফু, আমি হওয়ার পর আমাকে দেখে বাবাকে বলেছিলো, আল্লাহ এই মেয়ের তো কপাল অনেক বড়, নাকটায় কি শান, আর চোখ জোড়া দ্যাখ কেমন ডাগর কালো....। নিশ্চিত এই মেয়ে রাজ কপালে পয়দা। ভাই তুই এর নাম নিপু রাখ। নিপু নামটা শুনেই ছেলেরা সাবধান হয়ে যাবে। বুঝে যাবে, এ যেন তেন মেয়ে নয়। এ হলো রাজকুমারী।
আমি হাসি। যতবার এই গল্পটা ওর কাছে শুনি ততবার হাসি। নিপু তোমাকে হাজারটা জেগে থাকা রাতের জ্যোৎস্না উপহার দিলাম। তুমি আমার কবিতা হয়ে থেকো, সবচেয়ে প্রিয় কবিতা।
...
একদিন শুক্রবার সকাল বেলা বাসার বারান্দায় বসে আছি। হাতে এক কাপ চা। চিনি নেই ঘরে, চিনির ঠোঙ্গা ঝেড়ে দিয়ে আদা দিয়ে চা বানিয়েছি। খেতে ভালো হয়নি, আজকাল যাই মুখে দেই বিস্বাদ লাগে। মুখের সমস্যা নয়, বরং প্রয়োজনীয় উপাদানের অভাব। বন্ধু ছোটন সকালে ফোন করে বলে, দোস্ত ২০০ টাকা ধার দে।
আমি পিচিক করে বেসিনে থুথু ফেলে ওকে বললাম, দোস্ত আমাকে ১০০ টাকা ধার দিয়ে যা। তিনদিন ধরে দুইবেলা বনরুটি আর চা খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। মাসের স্যালারী পেয়ে টাকা দ্বিগুণে শোধ দিবো।
ছোটন ফোন কেটে দিলো দুটো অশ্লীল গালি দিয়ে। ছোটন আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। বর্তমানে সে একটি গরুর খামারে চাকরী করে। ক্যাশিয়ার টাইপ একটা কাজ। ওর একটু চোরা অভ্যাস আছে তাই বেশিদিন ওকে কেউ চাকরীতে রাখেনা। শেষ চাকরীতে তাঁকে রীতিমত গণপিটুনি দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছিলো। আমার মনে হয় তার বর্তমান চাকরীটাও এখন আর নেই। ওর বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। প্রায়ই তাঁকে স্কুলের হেডস্যার ক্লাসে এসে মারতে মারতে বলতো, আলিমের ঘরে জালিম হইছে। গতবছর ওর বাবা রিটায়ার্ড হওয়ার পর ২ লাখ টাকা পেয়েছিলো। কোন একভাবে ছোটন সেই টাকাটা চুরি করে পালিয়ে যায়। তিনমাস পর যখন বাসায় ফিরে তখন তার বাবার জানাযা পড়ানো হচ্ছে। ওর মা ছোটকালে পুলিশের এক হাবিলদারের সাথে ভেগে গিয়েছিলো। ভাই বোন নেই। সে খুব যত্ন করে বাবার কবরে হাত তুলে দোয়া পড়িয়েছিলো। রাতে আমার বাসায় ভাত খেয়ে সিগারেট ফুঁকে বলছিলো, একদিন অনেক বড় মানুষ হবো বুঝলি। তুলিরে বিয়ে করে গাড়িতে ঘুরাবো। তোরে ব্যাকসিটে চড়ায় আইসক্রিম খাওয়াবো।
আমি ওকে বললাম, দোস্ত তুই আর পড়াশোনা করবিনা?
সে খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলে, ধুর বাল। পড়াশোনা করে কে কবে বড় হইছে। আমি ব্যবসা করমু। টাকার ব্যবসা। নিজে টাকা ছাপায় মানুষরে বান্দি বানায় খাটামু।
আমি হাসিমুখে বলি, তুলি কে?
ও আমার দিকে তাকিয়ে রহস্য করে বলে, আছে এক মাইয়া। ঢাকায় পরিচয় হইছে। ১০০ টাকা লাগে ওরে খাইতে। কিন্তু আমার থিকা টাকা নেয়না। ভালো মাইয়া দোস্ত। মন অনেক ভালো। মেয়েটার অসুখ করছে। আমি ওরে এখন আমার থাকার জায়গায় আইনা রাখছি। বহুত ভালো মেয়ে। আমারে ভাজি ডাল রাইন্ধ্যা খাওয়ায়।
আমি যখন মায়ের শাকের পাটিতে পানি দিতাম আর মা আমাকে ১০/২০টাকা পারিশ্রমিক দিতো তখন ছোটনের জীবনটা আমার অনেক আকর্ষণীয় মনে হতো। তখন ওর কাছে অনেক টাকা পয়সা থাকতো।
একদিন রাতে ওরে আমার কাছে থাকতে দিয়েছিলাম, আর হারামিটা সেইরাতে আমার ঘরে চুরি করে পালিয়ে যায়। আহারে ছেলেটা আমার কাছে চাইলেই আমি আমার জমানো টাকা দিয়ে দিতাম। শুধু শুধু আম্মার জমানো টাকা নিয়ে গেলো। ছোটন অবশ্য চুরি করে লজ্জা পায়না। অনেকদিন পর ঢাকা শহরে আবার হঠাৎ আমাকে দেখা হলে বলে, দোস্ত সেদিন মিসটেক হয়ে গেছে। খালারে আমি নিজে হাতে একদিন সোনার চুড়ি কিনা দিয়া আসবো। একটু সবুর কর। ব্যবসা করতেছি।
ছোটন গালি দিয়ে ফোন কাটার পর, ১৯দিনের বিরতি ভেঙে সেদিন সকাল বেলা নিপুকে ফোন দিলাম। নিপুর শহরে তখন ঝকঝকে সকাল বেলা। ওর গলা ঠান্ডায় মনে হয় জমাট বেধে গেছে। নাক টেনে টেনে কথা বলছে। আমি একটু সন্দেহ হওয়ায় জিজ্ঞাসা করলাম, নিপু তুমি কি কান্না করছো?
নিপু চুপ করে থাকলো অনেকক্ষণ। আমিও নিশ্চুপ থাকলাম। স্থবিরতায় উত্তর খুজছিলাম, কিন্তু সব কেমন যেন শূণ্য হয়ে রইলো। ও আস্তে আস্তে বললো, জানো মাঝে মাঝে খুব একা লাগে। তখন কাউকে কাছে পাইনা। এমনটা হওয়া শুরু করছে এইবার আসার পর থেকে। কেমন যেন একটা স্তব্ধতা কাজ করে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে মনে পড়ে খুব?
নিপু অনেকক্ষণ পর ভেবে উত্তর দিলো, জানিনাহ! তুমি তো জানো আম্মু মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা কেমন যেন দূরের মানুষের মত হয়ে গেছে। খুব খারাপ একটা সময়ে তোমার সাথে পরিচয় হয়। তুমি কি সুন্দর করে আমাকে জীবন কি তা বোঝাতে। আমার খুব ভালো লাগতো তোমার জীবনদর্শন। আমি তোমার সাথে আমার চিন্তা মিলাতে পারতাম না। কারণ আমি তোমার মত না বেনু। কিন্তু আমার খুব ভালোবাসতে ইচ্ছা করতো। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসছি জানো তো?
আমি কিছু বললাম না। ওর সব কথা এতো ভালো লাগে কেন আমি জানিনা। আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, আমিও খুব শীঘ্রই চলে আসবো। আমি তোমার হাত ধরে পুরাটা শহর হেটে বেড়াবো। আল্লাহর কাছে প্রতিদিন ভিক্ষা চাইবো যেন আমার সবকয়টা ঘুমভাঙ্গা ভোরে তোমার জন্য নতুন করে ভালোবাসা হয়।
কিন্তু আজকে নিপু কাঁদছে। আমি জানি নিপু কাঁদছে। ওকে বললাম, কি হয়েছে বলো তো?
নিপু ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে, বেনু তুমি জানো তো আমি তোমাকে ভালোবাসছি অনেক। তুমি জানো তো তাই না? কিন্তু আমার মধ্যে একটা একাকীত্ব ছিলো, তুমি কি সেটা কখনো বুঝতে পেরেছো?
আমি ওকে আদর করে বলি, কি হইছে তোমার বলো তো? আমাকে বলো?
নিপু নিজেকে সামলে বলে, আমার কিছুই হয় নাই। আমি জানিনা তুমি বুঝবে কতটা। কিন্তু আমার নিজেকে কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে আমি আর সেই মানুষটা নেই যেই মানুষটাকে তুমি চিনতে।
আমি বললাম, তুমি কেমন ছিলে, এখন এই তুমিটা কেমন আমি হয়তো বুঝিনা। কিন্তু আমি জানি তুমি অনেক ভালো। তুমি আমার পরী, মেডিকেল এপ্রন পরা সাদা পরী। আমি খুব দ্রুত তোমার কাছে এসে পরবো দেখো। হয়তো একদিন তোমার হোস্টেলে তোমার রুমের দরজায় এসে হাজির হয়ে যাবো। আমাকে সেদিন রান্না করে খাওয়াবে তো? তোমার হাতের খিচূড়ি আর ডিম?
নিপু হাসছে। আমি ওর হাসির শব্দে নদীর শান্ত জলে মাছারাঙ্গা পাখির ডানার গল্প খুজতে থাকি।
চলবে(To be continue).....
"পাড়ের চিহ্ন"
(পর্ব ৩-৪)
......✍️
""" """""' """"" """"" """"''' """
৩.
এরপর কেটে গেছে অনেকদিন। এর মাঝে নিপুর সাথে আমার আর কথা হয়নি।
প্রেমের শুরুর গল্পগুলো সবার এমন মধুর হলেও ধীরে ধীরে সেটা ফিকে হতে থাকে। আবেগ গুলো ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণতা হারিয়ে ভোঁতা হয়ে যায়।
আমাদের ক্ষেত্রেও এমন হচ্ছিল। নিপুর পড়াশোনা, আমার অনটন, জীবনযুদ্ধ, নানান ব্যস্ততায় আমরা অনিয়মিত হতে থাকলাম। প্রতি ঘন্টার সোহাগ দিনে, দিনের সোহাগ গিয়ে ধীরে ধীরে সপ্তাহ পেড়িয়ে মাসে গিয়ে ঢেকলো।
এভাবে বছর পার হয়ে গেলো। আগের মতো না হলেও টুক টাক কথা হয় আমাদের। আমার পক্ষ থেকে "সে আছে, চিরদিন থাকবে, নিশ্চয়ই থাকবে" এই বিশ্বাসে ভর করেই যোগাযোগ না থাকলেও ভরসা কাজ করতো।...
শুক্রবার। সকাল সকাল উঠে খুব নিপুকে মনে পরছিল। একটু কথা বলবো ভেবে ফোনটা তুলতেই ছোটনের ফোন। আমার সাথে "জরুরি কথা আছে, দেখা করতে হবে" বলেই ফোন রেখে দিলো।
১০টার দিকে বাসা থেকে বেড় হতেই বাড়িওয়ালির সাথে দেখা। ওনারা পরিবার সমেত নাস্তা করছিলেন। আমাকে সুন্দর করে ডেকে নাস্তা খাওয়ার জন্য বসালেন। খুব ইতস্ততভাবে হাসিমুখে তার দেয়া এক কাপ চা আর বিস্কিট দুপুরের লাঞ্চ হিসেবে গ্রহণ করছিলাম আর মহিলার মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। আমাকে নাস্তা করাচ্ছেন বলে ওনাকে ভদ্রমহিলা ভাবার কোন কারণ নাই। আমাদের বাসা ভাড়াটা ঠিক ঠিক ভাবে নজরুল ভাই পরিশোধ করেন বলেই আমাদের প্রতি তার এতোটুকু সৌহার্দ্য। ওনার নাম সুফিয়া বেগম। বিশিষ্ট কবির নামে নাম। নাম সুফিয়া হলেও তার আচরণে কোথাও সুফি ভাব নেই। ভাড়া একটু দেরী হলে তিনি লোকজনের মান ইজ্জত সব খেয়ে হজম করে ফেলে দেন। একবার আফজাল ভাই তিনদিন দেরী করেছিলেন। উনার সাথে নিচে যাচ্ছিলাম চা খেতে। তখন দেখা হয়ে গেলো সুফিয়া খালার সাথে। আফজাল ভাই সিনিয়র মানুষ, বয়স ৩৫ এর কাছাকাছি। উনাকে সুফিয়া খালা দেখে সরাসরি বললেন, অফিসে বেতন দেয়না? ভাড়া দেন না ক্যান?
আফজাল ভাই থতমত খেয়ে আমার দিকে একবার তাকান। আরেকবার খালার দিকে। বিস্ময় কাটতে আমতা আমতা করে বললেন, আপনি এভাবে বলছেন কেন? আমি সাপ্তাহিক ছুটি পড়ে যাওয়াতে টাকা তুলতে পারিনি। আমি কালকে রবিবার দিয়ে দেবো।
সুফিয়া খালা আরো ভয়ংকর স্বরে বললেন, আমি কিভাবে কথা বলি মানে? পছন্দ না হইলে উঠায় দিবো। দিন রাত ছাদে যেয়ে বিড়ি টানতে তো ভুল হয়না। প্যান্ট টাইট দিয়ে অফিসে যাইতে তো ভুল হয়না। ভাড়া দিতেই খালি ভুল হয়, হাঁ?
আফজাল ভাই সেদিনই বাসা ছেড়ে দিলেন। ছেড়ে দেয়ার আগে একটা প্রেমপত্র লিখে আন্টির বাসার দরজার নিচে রেখে যান। সেখানে শুধু একটা ছোট্ট বাক্য লেখা ছিলো, আপনে একটা মহান মা*ী।
ছোটন আমার বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখেই পেটে হাত দিয়ে বললো, দোস্ত খুব ক্ষুধা লাগছে। নাস্তা খাওয়া।
আমি নিচের হোটেলে ওকে পরোটা ভাজি কিনে খাওয়ালাম। সে দাঁত খিলাল করতে করতে বললো, দোস্ত একটা ঝামেলা হইছে। আমার বউয়ের বাচ্চা হইছে আজকে। ভয়ে যাইতে পারতেছিনা হাসপাতালে। এক সপ্তাহ ধইর্যা ধান্দাবাজি করতে একটু বরিশাল গেছিলাম। আজকে সকালে ওর ফুপু ফোন কইর্যা বলে বাচ্চা হইয়া গেছে। হাসপাতালের বিল লাগবো। কিছু টাকা ধার দিবি?
আমি চিন্তা করলাম, আমার কাছে রংপুর ফেরার জন্য সামান্য কিছু টাকা আছে। রংপুর যেতে সামনের স্যালারী পর্যন্ত ঢের সময় আছে। টাকাটা দিলে খুব সমস্যা হয়তো আমার হবেনা কিন্তু ওর বড্ড উপকার হবে। আমি কিছুক্ষণ পর বললাম, দোস্ত আমি তো কয়েকদিনের ছুটিতে রংপুর চলে যাচ্ছি ০৯ তারিখ। কিছু টাকা আছে বাড়ির সবার কেনাকাটার জন্য। আমি তোকে টাকাটা দিতে পারি পাঁচ হাজারের মত।
ছোটন শিস বাজিয়ে বললো, আলহামদুলিল্লাহ। তাতেই চলবো। কিন্তু তুই হঠাৎ রংপুর যায়া কি করবি? এই টাকা পয়সা নষ্ট না কইরা ঈদে গেইলেই পারোস। বরং এই ৫/৭ হাজার থাকলে রাজার মত থাকতে পারবি। একটা কাম করোস না ক্যান, তোর যা টাকা পয়সা আছে ওইগুলা দিয়ে আমার সাথে বিজনেস কর। চাকরি বাকরি আর কতদিন করবি। মাসের শেষে ফকিন্নির মতন থাহস।
আমি হাসিমুখে ওকে নিয়ে হোটেল থেকে উঠে বাসায় গেলাম। ছোটন আমাদের বিছানায় শুয়ে বললো তার সাথে যেয়ে যেন তার সদ্য জন্মানো মেয়েটাকে দেখে একটা নাম দিয়ে আসি। আমি রাজী হয়ে ওকে বললাম, দোস্ত আমার নামের পছন্দ ভালো না। পুরানা আমলের নাম শুধু মনে হয়। মনে কর, বকুল ফুলি জবা। এইসব নাম তোর পছন্দ হবেনা।
হাসপাতালে ছোটনের মেয়েকে দেখে মনটা শান্ত হয়ে গেলো। জন্মের পর বাচ্চারা সাধারণত ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে থাকে। এই বাচ্চাটা অন্যরকম। সে বড় বড় গোল চোখে তাকিয়ে দেখছে সবাইকে। আমার ভুল না হলে তার সাথে মজা করলে সে হাল্কা করে ঠোট বাকিয়ে হাসিও দেবে। আমি ছোটনকে বললাম, নিপু। এক ভালোবাসা ভরা মানুষের সম্মানার্থে নামটা দিলাম। আমার খুব প্রিয় কেউ। তোর বউকে জিজ্ঞাসা কর রাজী আছে কিনা?
ছোটনের বউয়ের নাম তুলি(এই সেই "তুলি" যার কথা ছোটন আগে একবার বলেছিল)। মেয়েটার সারাটা মুখ জুড়ে ক্লান্তি। চোখ দেখে মনে হয় লজ্জায় কুঁকড়ে আছে নতুন আগন্তুক আসার অপরাধে। আমি তার পাশে যেয়ে বললাম, ভাবী আপনি কি খুব চিন্তিত? ছোটন সব ব্যবস্থা করে ফেলবে। টেনশন নিয়েন না।
তুলি কিছু বললোনা, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুধু। মেয়েটার বয়স আন্দাজ ১৭ কি ১৮ হবে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে এই অসহনীয় সমাজে সে হাজার বছরের বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দে যেন সে অনেকগুলো গল্প বলে ফেললো। এই দেশে গরীব ঘরের মেয়েরা গেরস্থের উঠোনে বিছানো পাটির মত। যখন প্রয়োজন শক্তিশালী সমাজ তাতে পা মুছে যলে যায়। ছিড়ে যাক ভেঙ্গে যাক, তার ব্যবহার কমবেনা। কিন্তু দিন শেষে কেউ সেই পাটিতে লেগে থাকা ময়লাটা মুছে দিয়ে যায়না, যত্ন তো দূরের কথা। মোসাম্মাত তুলির জীবনটা হয়তো এমনটাই ছিলো। তার চোখে আছে সামনে অনাগত ভবিষ্যতের ভয় আর হৃদয়ে ছোট্ট আত্রলিতার হামি দেয়া গুঞ্জনের অপ্রকাশিত আনন্দবার্তা।
ছোটন তার বউকে কিছুক্ষণ কথা বলার পর বললো, আমি হাসপাতালের বিল দিয়া আসতেছি। তু্মি একটু অপেক্ষা করো। আজকেই তোমারে নিয়া যামু।
তুলি কিছু বললোনা। ও চলে যাওয়ার পর হঠাৎ কান্না শুরু করলো।আমি কিছু না বুঝে বাহিরে দাড়িয়ে থাকলাম। একটু পর তুলির ফুফু এসে বললো, তোমার বন্ধু তো আর আইবোনা। হেয় কি টাকা পয়সা নিয়া আসছিলো? দুইদিন ধইর্যা মাইয়াটা এহানে আটকায় পইড়্যা আছে। ওই পোলা হইলো নেশাখোর। টাকা পাইলে নেশা ছাড়া আর কিছু করেনা।
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, আমি ওকে কিছু টাকা দিয়েছি। ও বিল দিয়ে এখুনি এসে পড়বে। আপনারা আরেকটু অপেক্ষা করেন।
বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমি। এরপর ছোটনের বউকে যেয়ে বললাম, ওকে কি একটা ফোন করবেন।
তুলির ফুফু বললো, অনেকবার ফোন দিছি। ধরেনা। আপনে একবার দেন। বাচ্চার গায়ে জ্বর আইছে।
আমি তুলির দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি এতো চিন্তা করবেন না। আমি ছোটনকে ফোন দিচ্ছি। ওর তো এতো দেরী করার কথা না।
আমি ছোটনকে তিনবার ফোন দিলাম। একবারও ফোন ধরলোনা। চতুর্থবার সে ফোন ধরে নেশাগ্রস্ত গলায় বললো, দোস্ত আমি আইতেছি তোর বাসায়। তুই কই?
আমি মেজাজ শান্ত করে বললাম, ছোটন তুই হাসপাতালের বিলটা দিয়ে তোর বউকে নিয়ে যা। একটু পর পর আয়া এসে জঘণ্য ভাষায় কথা বলছে বেড খালি করার জন্য।
ছোটন চুক চুক করে বললো, দোস্ত তোরে আসলে বলা হয়নাই। এই মাগীর পয়দা যেইটা হইছে ওইটা আমার না। আজকে চেহারা দেইখ্যা শিউর হইছি। এইজন্য রাগ কইর্যা আর আসিনাই। দোস্ত তুই চইল্যা আয়। এই মাগী ওর পুরুষরে ডাইক্যা বাচ্চা ক্লিয়ার কইর্যা দিবো।
আমি হতভম্ব হয়ে ওর কথা শুনছিলাম। একটু পর আবারও বললো, দোস্ত তুই একটা কাম কর। তুই মাগীরে ফোন দে।
আমি কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা দিলাম ওর বউকে। ওর বউকে কি বললো ও জানিনা। ওর বউ ফোনে অঝোরে কান্না শুরু করে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, তোর মত বেজন্মার বাচ্চা আমি রাখমুনা।
প্রায় ১৫ মিনিটের মত আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কি বলবো এই পরিস্থিতে বুঝতে পারছিলাম না।
আজ যদি নিপু ডাক্তার হয়ে এই হোমেই থাকতো বিষয়টা অন্যরকম হতে পারতো।
আমার কাছে আর কোন টাকা নেই। আমিও ছোটনের মতো কিচ্ছু না বলে নার্সিং হোমের পার্শ্ব গলি ধরে পালিয়ে আসি। আসার পথে বারবার বাচ্চাটার চেহারা চোখে ভাসছিলো। নার্সিং হোমের সাথে লাগানো ফ্ল্যাডলাইটের আলোয় যখন আমার দেহের ছায়া দেখলাম তখনও হলদেটে আলোয় বাচ্চাটার হাসির ছবিটা আমার কল্পনা থেকে মুছে যাইনি। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল আমার। ফোনটা বের করে নিপুর নাম্বার খুঁজতে লাগলাম, কল লিস্টের অনেক নিচে চলে গেছে নাম্বারটা। অনেকদিন কথা হয় না। নাম্বার বের করে খুব আশা নিয়ে কল করলাম, আজ অনেক কথা বলবো, মন খুলে একটু কাঁদবো, সে ডাক্তার হলে যেনো এমন পরিস্থিতি গুলো এতটা জঘন্য না হয় বলবো,...... ৪/৫ বার কল করলাম কিন্তু নিতু কলটা তুললো না। দুঃখের বোঝায় শরীরটা আরও ভারী হয়ে উঠলো। পালাচ্ছি ভেবে যতই দ্রুত হাটতে চাইছি, পা গুলো ততই নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে.....
৪.
ভোর ভোর সময় রংপুরে বাস থামালো, আমি নামলাম।
আধো-আলো আধো-অন্ধকারে সুরভী উদ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দুই মিনিট হাটলেই নিপুর হোস্টেল। আমার নিপু সেখানে আছে ভাবতেই আমি আনন্দিত হচ্ছিলাম।একটা ফুলের দোকানের বাহিরে দাড়িয়ে ভাবছিলাম ওর জন্য একটা বিশাল সাইজের বুকে নিয়ে ওর হোস্টেলের সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো। আরেকবার ভাবলাম, ওর বন্ধুরা তো অনেকেই আছে, তাছাড়া হোস্টেলের কেয়ারটেকার। বুকে নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা। একটু পর ওকে ফোন দিলাম। কিন্তু ও ফোন ধরতে পারলোনা। আমার খুব খিদে লেগেছিলো, কিন্তু প্রেমিকার জন্য অপেক্ষার উত্তাপটা আরো তীব্র করলাম। ওর সাথে দেখা হওয়ার প্রথম দিনগুলোর কথাগুলো বারবার মনে করছিলাম। নদীর ধার ধরে সন্ধ্যাবেলায় হাঁটা