24/11/2023
তথাগত বুদ্ধ পাঁচ প্রকার ছায়ার কথা বলেছেনে৷ যথা-
১! গাছের ছায়া,
২! জ্ঞাতির ছায়া,
৩! রাজার ছায়া,
৪! মাতা-পিতার ছায়া ও
৫! বুদ্ধের ছায়া।
গাছের ছায়া :
মানুষ প্রখর রােদ্রে দূর পথে যখন কোথাও হেটে যায়, তখন প্রচন্ড গরমে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সেই ক্লান্ত মানুষ তার ক্লান্তিকে দূর করার জন্য যেকোন ছায়াযুক্ত গাছে আশ্রয় খোঁজে। ক্লান্ত শরীরে ছায়াযুক্ত সবুজ বৃক্ষের নীচে বিশ্রাম নিলে মূহুর্তের মধ্যে গাছের সুশীতল ছায়ায় ও হিমেল হাওয়ায় ক্লান্তি দূর হয়ে দেহ-মনে একটা প্রশান্তি ও প্রীতিভাব জেগে ওঠে। কিন্তু সেই প্রীতিভাব দীর্ঘক্ষণ থাকে না। তাই গাছের ছায়া আপনাকে সাময়িক ক্লান্তি ও গরম দূর করে দিতে পারে এইটুকু মাত্র৷
জ্ঞাতির ছায়া :
প্রতিটি ব্যক্তির সফলতার, অগ্রগতির, এগিয়ে যাওয়ার বা সমাজে বেঁচে থাকার পিছনে কম-বেশি স্ব-জ্ঞাতির কিংবা আপন আত্মীয়দের সহযােগিতা ও অবদান থাকে। তা আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারবাে না। এই যে আমরা যারা ভিক্ষু-শ্রামণ হয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করছি—সবাই আপন জ্ঞাতি বা আত্মীয়দের দ্বারা পূজিত, পরিপােষিত হচ্ছি। তাঁরা আমাদেরকে চারি প্রত্যয় (পিন্ডু, চীবর, বিহার/কুটির ও ঔষুধ) দিয়ে সহযােগিতা করছে বলে আমরা বেঁচে আছি, ব্রহ্মচর্য পালন করতে পারছি। অন্য কোন মুসলিম, হিন্দু ও খ্রীষ্টান জাতিরা সেই চারি প্রত্যয়গুলাে দিচ্ছে না। স্ব-জাতিরা তা ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। প্রত্যেক ভিক্ষু-শ্রামণ স্ব-জাতির প্রতি চারি প্রত্যয় দানের উপকারের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে৷
স্ব-দেশ, স্ব-জ্ঞাতিদেরকে ফেলে বাইরে দূরে কোথাও কোন জায়গায় বেড়াতে গেলে সেখানে যদি একজন স্ব-জাতির মানুষ দেখি, আলাদা একটা অনুভুতি সৃষ্টি হয় এবং তাঁর কাছে যেতে ইচ্ছে করে, কথা বলার মনে হয়। তাকে দেখে কেন এমন অনুভুতি সঞ্জাত হয়? কারণ, তাঁরা আমাদের আপন জ্ঞাতি মানুষ৷ একই সমাজে, একই সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠার মানুষ। বিডুরক যখন শাক্যজাতিকে নিধন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন ভগবান বুদ্ধ তা জানতে পেরে তাদেরকে রক্ষা করার জন্য মাঝমানে দাঁড়িয়ে থাকতেন৷ যেন বিডুরক শাক্যজাতিদেরকে আক্রমণ করতে না পারে। কথিত আছে বিডুরক তিনবার শাক্যজাতিকে ধ্বংস করার জন্য আক্রমণ করতে গেছেন,প্রতিবারই বুদ্ধ বাধা হয়ে দাড়াতেন৷ বিডুরক বুদ্ধকে শ্রদ্ধা করতেন, মান্য করতেন। তাই বুদ্ধকে দেখে ফিরে আসতেন৷ কিন্তু চারবারে যখন বিড়রক আক্রমণ করতে গেছেন, তখন বুদ্ধ আর বাধা দেননি৷ কারণ, তথাগত বুদ্ধ জেনেছেন—সেটা শাক্যজাতির পূর্বজন্মের অকুশল কর্মবিপাক৷ কর্মশক্তির সাথে কোন শক্তি পেরে উঠতে পারে না। বুদ্ধও কর্মশক্তির কাছে অসহায়৷
বুদ্ধ কেন বারবার বিডুরকের হাত থেকে স্বজাতি শাক্যজাতিকে রক্ষা করতে যেতেন? কারণ, বুদ্ধ জানতেন জ্ঞাতির ছাঁয়া একটি সুখদায়ক। বৌদ্ধধর্মে যদিও জাতিবাদ, গােত্রবাদ নেই—তবু যে ভিক্ষু যেই জাতিতে জন্মগ্রহণ করে, সেই স্ব-জাতিকে রক্ষা করার জন্য, টিকে থাকার জন্য, উন্নতি-শ্রীবৃদ্ধি জন্য তাদের একটা ন্যস্ত দায়িত্ব থাকে এবং আদর্শবান ভিক্ষুরা বিনয় মােতাবেক স্বজাতিদেরকে সঠিক দিক-নির্দেশনা, উপদেশ, পরামর্শ দিয়ে থাকে। যেমনটা পূজ্য বনভান্তেও স্বজাতি চাকমাদের অগ্রগতির জন্য, এতদাঞ্চলে অস্তিত্ব টিঁকে থাকার জন্য আজীবন বুদ্ধের বিনয় অনুসারে সৎ উপদেশ, পরামর্শ দিয়ে গেছেন। তাই স্ব-জাতির প্রতি সবাই কৃতজ্ঞ থাকুন, স্ব-জাতিকে ভালবাসুন, উপকার করুন। কিন্তু অন্য জাতিকে ক্ষতি বা হিংসা করে নয়।
রাজার ছায়া :
রাজা বা প্রধানমন্ত্রীর ছায়াও একটি সুখদায়ক। যে ব্যক্তি রাজা/ প্রধানমন্ত্রী আশ্রয় কিংবা সাহায্য পায় তাঁর জীবন ধন্য হয়। রাজার ছায়ায় সে আজীবন অর্থ-সম্পদে ও ঘর-বাড়ী পরিপূর্ণ অবস্থায় সুখে-শান্তিতে জীবনটা কাটাতে পারবে। এযাবত ইতিহাসের পাতায় সেধরণের কাহিনী অনেক দেখে এসেছি, শুনেছি-রাজা, মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি সহায়তায় বহু অসহায় মানুষের দুঃখময় জীবন সুখময় হয়েছে৷ সেজন্য বলা হয়েছে রাজার ছায়াও একটি সুখদায়ক ছায়া।
মাতা পিতার ছায়া :
এই পৃথিবীতে যার মা-বাবা নেই, একমাত্র সে জানে মা-বাবা না থাকা জীবন কতটা দুঃখময়, কত যে যন্ত্রণাময়, কত অসহায়। যার মা-বাবা নামক ছাঁয়া জিনিসটি মাথা উপর থেকে চিরতরে উধাও হয়ে গেছে, কত যে সে পিতৃ-মাতৃহারা সন্তানটি একাকীত্ব ও অসহায়ত্ব অনুভব করে!!! সেটা কেবলমাত্র ভুক্তভােগীরা অনুভব করতে পারে। আমি পিতৃহারা, মাতৃহারা অনেক সন্তানদেরকে দেখেছি অপরের জীবিত মা-বাবাকে দেখে চোখের জল ফেলতে!!! পিতা-মাতা নামক স্নিগ্ধ ছায়াটি জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেলে সন্তানেরা কত অসহায় হয়ে পড়ে-যা আমরা এযাবত তা দেখে আসছি। মা-বাবারা সর্বদা সন্তানদেরকে ভাল-মন্দ দেখাশুনা করে, সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় পাশে থাকে অন্য কোন মানুষ সেভাবে দেখভাল করে না, পাশে থাকে না বা সাহায্য করে না।
আমি অনুরােধ করবাে তাদেরকে—যাদের মাতা-পিতা নামক পবিত্র ছায়াটি এখনাে বেঁচে আছে, তাঁরা যেন সেই পবিত্র ছায়াটি যত্ন সহকারে রক্ষণাবেক্ষন করেন। অবহেলা করলে ইহকাল-পরকাল ও জন্ম-জন্মান্তর অনুশােচনা করতে হবে৷ বৃক্ষের ছায়া শুধু ক্ষণিকের তরে আপনাকে ক্লান্তি দূর করে দেবে ; জ্ঞাতির ছায়া, রাজার ছায়া ও মা-পিতা ছায়া ত্রয়টিও কেবল এক জীবনের জন্য সুখ দিতে পারে। কিন্তু বুদ্ধের সুশীতল ছায়া আপনাকে স্রেফ ইহজীবন নয় জন্ম-জন্মান্তর শরীরিক-মানসিক সুখে থাকার ছায়া দেবে। এমনকি চিরসুখ, চিরশান্তি অবস্থা নির্বাণে পর্যন্ত পৌছে দেবে৷ আমি নিজেকে একজন খুব ভাগ্যবান মনে করি—সর্বজ্ঞ বুদ্ধের একজন মামুলি পুত্র হতে পেরে। তার পবিত্র সুশীতল ছায়া তলে আশ্রয় নিতে পেয়ে।।
বুদ্ধের ছায়া :
উপরে বর্ণিত পাঁচটি ছায়া থেকে এবং পৃথিবীতে যত ছায়া আছে তন্মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ছায়া হলাে মহাকারুণিক বুদ্ধের ছায়া। এই ছায়া খুবিই পবিত্র, সুশীতল, শান্ত, ঝামেলামুক্ত৷ এই ছায়া তলে আশ্রয় নিলে ক্লান্ত শরীর সতেজ হয়ে উঠে, অশান্ত মন শান্ত হয়ে যায়। এই ছায়া হারিয়ে যাওয়ার কোন ভয় নেই। এই ছায়া তলে ঠাই নিলে কোন একসময় অবিনশ্বর সুখ মিলে। বুদ্ধের সরেজ ছায়ায় এসে কত রাজা, মহারাজা, কত ধনী-মহাধনী, কত অভিজাত-অতিজাতের মানুষ অবিনশ্বর সুখের অধিকারী হয়েছেন ; কত দীন-দুঃখী চিরসুখী হয়েছেন৷ আরাে সমাজের কত ঘৃণিত, অবহেলিত, অপাঙক্তেয় নারী-পুরুষ বুদ্ধের আশ্রয় গ্রহণ করে আত্মমর্যাদায় সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে পূজার যােগ্য হয়েছেন—তা অবর্ণনীয় ও গণনাতীত৷ বুদ্ধের পবিত্র সুশীতল ছায়া সবার জন্য উন্মুক্ত৷ এই পবিত্র ও বৈষম্যহীন ছায়া তলে আসতে ধনী-গরীব কোন ভেদাভেদ নেই-যে কেউ আসতে পারেন৷ এই পবিত্র ছায়া তলে আসতে কোন অর্থকরি প্রয়ােজন হয় না। একদম বিনামূল্যে লাভ করা যায়। দরকার হয় স্রেফ ত্যাগের মানসিকতা, উচ্চ আকাঙ্খ, নির্মল চরিত্র, পঙ্কিলতাবিহীন। শিশু মনের মত সহজ-সরল একটা অন্তর, ক্ষমা-মৈত্রীর গুণ, ধৈর্য-সহ্যের শক্তি। সর্বোপুরি চারি আর্য সত্যকে অনুধাবন করার জ্ঞানের সক্ষমতা৷ তথাগত বুদ্ধ পুত্রদের কোন নিজস্ব কোন কোটি কোটি অর্থ-সম্পদ নেই, নিজস্ব কোন ঘর-বাড়ী নেই। নেই কোন চাকরি-বাকরি, স্ত্রী-পুত্র৷ তবু তাঁরা নির্মল মানসিক সুখে অবস্থান করে। কারণ, তাঁরা পৃথিবীর সর্বোত্তম স্নিগ্ধ বুদ্ধের ছায়া তলে থাকে। তাঁরা যে মানসিক সুখে থাকে পৃথিবীতে একজন প্রভাবশালী রাজা-মন্ত্রী কিংবা নামজাদা একজন কোটিপতিও সেই সুখ পায় না।
সকলের প্রজ্ঞা লাভের হেতু হোক।
সূত্র -সংগৃহিত