23/09/2024
প্রিয়তম নবীজীর (সা.) ভালবাসা
বিশ্ব জগতের একচ্ছত্র মালিক ও পালনকর্তা মহান আল্লাহ তায়ালার জন্য সকল প্রশংসা, যিনি মানব জাতির হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। শেষ নবী হিসাবে আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে প্রেরণ করে তার অনুকরণের মাধ্যমে তাকে ভালবাসার নির্দেশ দিয়েছেন।
দরূদ ও সালাম প্রেরণ করছি মানবতার মুক্তির দূত, রাহমাতুল্লিল আলামিনের প্রতি, যার আনুগত্য ও ভালবাসা আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা ও ভালবাসা লাভের মাধ্যম। শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক সকল সাহাবায়ে কেরামের প্রতি যারা ছিলেন রাসূলের (সা.) ভালবাসার ক্ষেত্রে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় এবং সকল তাবেয়িন ও তাবে তাবেয়িনসহ কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মুসলিম উম্মাহর প্রতি।
আরবি মাস সমূহের মধ্যে রবিউল আউয়াল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা এ মাসে সাইয়েদুল আম্বিয়ায়ে ওয়াল মুরসালিন খাতামুন নাবীয়্যিন এ ধরাপৃষ্ঠে আগমন করেন।
আবার এ মাসেই তিনি আল্লাহপ্রদত্ত রিসালাতের সকল দায়িত্ব পালন শেষে স্বীয় প্রভুর আহবানে সাড়া দিয়ে পরলোক গমন করেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জন্ম তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকগণের মাঝে অনেক মতভেদ রয়েছে।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুফাসসির ও মুফতি জনাব শফি সাহেব (রহমতুল্লাহি আলাইহি) সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া গ্রন্থে লিখেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ। অপরদিকে আর-রাহীকুল মাখতুমের লেখক আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী লিখেন, রাসুলের (সা.) জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের ৯ তারিখ। আবার কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ। তবে সকল ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে একমত যে, নবী করিম (সা.) রবিউল আউয়াল মাসেই জন্মগ্রহণ করেছেন। যদিও তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু এ মাসের ১২ তারিখ সোমবার রাসুল (সা.) ইন্তেকাল করেছেন এ ব্যাপারে কোন ঐতিহাসিকের মতভেদ নেই।
নিঃসন্দেহে মহানবী (সা.) কে ভালবাসা এবং তার প্রদর্শিত পথ অনুযায়ী জীবন-যাপন করা ঈমানের অংশ। এ প্রসঙ্গে ইমাম বুখারি (র.) বুখারি শরীফে স্বতস্ত্র একটি শিরোনাম এনেছেন। যার অর্থ ‘নবী (সা.) এর ভালবাসা ঈমানের অঙ্গ’। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আনাস (রাজিআল্লাহু তায়ালা আনহু) ও আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) বলেন, ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার নিকট নিজ নিজ পিতা-মাতা, সন্তান ও সকল মানুষ হতে প্রিয় না হই। (বুখারি)
আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহর জন্য কারো সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করল, আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করল, আল্লাহর জন্য কাউকে দান করল এবং আল্লাহর (সম্পদ) ব্যয় করা থেকে বিরত থাকল, নিশ্চয়ই সে স্বীয় ঈমানকে পরিপূর্ণ করল । (তিরমিজি ও আবু দাউদ)
হাদিসের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ভালবাসাকে অপরাপর ভালবাসার উর্ধ্বে স্থান দেয়া এবং শত্রুতা ও মিত্রতায় আল্লাহ ও তার রাসুলের হুকুমের অনুগত থাকা ঈমানের পূর্ণতা লাভের পূর্বশর্ত।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, (হে নবী)! আপনি বলুন, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা-মাতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই-বোন, তোমাদের বংশ, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের এমন ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ কর; আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসুল এবং তার রাস্তায় জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় না হয়, তাহলে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। (সুরা তওবা, আয়াত ২৪)
আয়াতের মর্ম হলো যারা দুনিয়াবি সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়ে আল্লাহ ও তার রাসুলের সম্পর্ককে উপেক্ষা করেছে তাদের করুণ পরিণতির দিন সমাগত। দুনিয়ার মধ্যেই সে আজাব আসতে পারে। তবে আখেরাতের আজাব অবশ্যই ভোগ করতে হবে।
উল্লেখিত আয়াতে সকল মুসলিমের প্রতি এ আদেশ দেয়া হয়েছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালবাসা এমন উন্নত স্তরে রাখা ওয়াজিব, যে স্তরে অন্য কারো ভালবাসা স্থান পায় না। তাই যার ভালবাসা এ স্তরে নেই সে শাস্তির যোগ্য।
তাই মুসলিমগণ আন্তরিকভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি পরিপূর্ণ সম্মান ও ভালবাসাকে ওয়াজিব মনে করে। নিচে এ বিষয়ে কতিপয় নির্দেশনা উল্লেখ করা হল।
১. রাসুল (সা.) এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর অত্যাবশ্যক করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা কোন ব্যাপারেই আল্লাহ ও তার রাসুলের সামনে অগ্রণী হয়ো না। (সুরা হুজুরাত : আয়াত ১) এ আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয়, রাসুল (সা.) এর অবর্তমানে তাঁর আনীত শরিয়ত ও আল্লাহর হুকুমের সামনে কারো কোন মত বা পথ গ্রহণযোগ্য হবে না।
২. আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের ওপর রাসুল (সা.) এর আনুগত্য ও ভালবাসাকে ফরয করে বলেন, (হে নবী!) আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার আনুগত্য কর। ফলে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ মাফ করে দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ৩১) যার আনুগত্য করা ওয়াজিব তার বিরোধিতা বা অবাধ্যতা করা হারাম। সমস্ত কাজে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আবশ্যক।
৩. আল্লাহ তায়ালা রাসুল (সা.) কে নেতা ও বিচারক রূপে পাঠিয়েছেন। এ মর্মে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব নাজিল করেছি, যাতে আপনি সে অনুসারে মানুষের মাঝে বিচার মিমাংসা করেন যা আল্লাহ আপনাকে জানিয়েছেন । (সুরা আন নিসা, আয়াত ১০৫)
৪. আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসুলের মহব্বতকে ফরজ করে দিয়েছেন। রাসুল (সা.) বলেন, সে সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ আমি তাঁর পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষ হতে অতি প্রিয় না হই। (বুখারি শরিফ) । যাকে ভালবাসা ওয়াজিব, তাকে সম্মান করাও ওয়াজিব।
৫. আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রাসূল (সা.) কে সর্বোত্তম সিরাত-সুরাত, সর্বগুণে গুণান্বিত, সৃষ্টির সেরা ও সর্বোৎকৃষ্ট মানব হিসাবে নির্বাচন করেছেন। এমন চরিত্র ও সৌন্দর্যের অধিকারীকে সম্মান প্রদর্শন করা অবশই জরুরি।
রাসুল (সা.) এর সিরাত আলোচনা করা যেমন পূণ্যের কাজ তেমনিভাবে তার সূরত বা দৈহিক গঠন নিয়ে আলোচনা করাও পুণ্যের কাজ। কিন্তু দৈহিক সূরত নিয়ে আলোচনার মাঝে আমাদের করণীয় কিছু নেই। শুধু আলোচনার দ্বারা সওয়াব পাওয়া যায়। কারণ শত চেষ্টা করেও আমাদের সূরতকে রাসূল (সা.) এর সূরতের ন্যায় করা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে তার সিরাত নিয়ে আলোচনার দ্বারা সওয়াব পাওয়ার পাশাপাশি অনুরূপ চরিত্র গঠনের আশা করা যায়। যা দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি। সত্যিকারার্থে রাসুল (সা.) এর ভালবাসার অর্থ হলো, তিনি যে সকল গুণে গুণান্বিত ছিলেন সেগুলোর চর্চা করা ও নিজের মাঝে সেগুলোর বাস্তবায়ন করা এবং যে সকল বিষয় তিনি পরিহার করেছেন ও পরিহার করতে বলেছেন তা পরিহার করা।
এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, রাসুল (সা.) এর আনীত দ্বীনকে তোমরা আকড়ে ধর, আর যা তিনি নিষেধ করেছেন তা পরিহার কর। (সুরা আল হাশর, আয়াত ৭) রাসুল (সা.) এর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা পরকালে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আশা রাখে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মাঝে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। (সুরা আল আহযাব, আয়াত ২১)
রাসুল (সা.) এর আদর্শ ও গুণাবলী সম্পর্কে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাজিআল্লাহু তায়ালা আনহা) বলেন, রাসুলের চরিত্র হল আল কোরআন। অর্থাৎ কোরআনে বর্ণিত সকল গুণাগুণ যেমন সততা, ন্যায় পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, আমানতদারি, কোমল স্বভাব, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, এতিম-অসহায় ও বিধবাদের সহায়তা করা, গৃহ পরিচারিকা, খাদেম, অধিনস্ত, স্ত্রী, পরিবার, পরিজনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া রাসুল (সা.) এর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যমান ছিল।
তাই আমাদের উচিত রবিউল আউয়াল মাসে রাসুলের (সা.) ভালবাসাকে সীমিত না রেখে বছরের প্রতিটি দিনে, প্রতি ক্ষণে, প্রতি মাসে এক কথায় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে সুন্নাতের অনুসরণের মাধ্যমে তাঁর রেখে যাওয়া জীবনাদর্শকে বাস্তবায়ন করা।
কোরআন ও হাদিসে প্রত্যেকটি বিষয় যেভাবে এসেছে এবং রাসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামগণ যেভাবে আমল করেছেন বা করতে বলেছেন সেভাবে করা বা মেনে নেয়ার নামই হল ইবাদত। এতে কোন ধরনের বাড়াবাড়ি করাকে শরিয়ত সমর্থন করে না। এমনিভাবে রাসুল (সা.) এর ভালবাসার ব্যাপারে রাসুল (সা.) যেভাবে ভালবাসতে বলেছেন বা সাহাবায়ে কেরামগণ যেভাবে ভালবাসা দেখিয়েছেন সেভাবে ভালবাসাই হল ইবাদত। এতে কোন ধরনের বাড়াবাড়ি করা শরিয়ত সমর্থন করে না। পাশাপাশি রাসুল (সা.) এ ব্যাপারে নিষেধও করেছেন।
তিনি বলেছেন, খ্রিস্টানরা যেমনভাবে ঈসা ইবনে মারয়ামের (আলাইহিমাস সালাম) ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা তেমনিভাবে আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর বান্দা, অতএব তোমরা বল আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। (বুখারি ও মুসলিম)
এক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করার অর্থ হল রাসুল (সা.) এর মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যাবলীর ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন ও সীমালঙ্ঘন করা। যেমন রাসুল (সা.) কে হাজির নাজির বলা, তিনি নূরের তৈরি, তিনি গায়েব জানেন, তার নামে কসম খাওয়া, তার নামে মান্নত করা, তার নিকট দোয়া ও আশ্রয় প্রার্থনা করা ইত্যাদি আল্লাহর গুণ সমূহে গুণান্বিত করা। এসবই রাসুল (সা.) এর সৌজন্য এ ধরনের কার্যকলাপ শরিয়তে গর্হিত। তাই এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকব।
সাহাবায়ে কেরামের (রাজিআল্লাহু তায়ালা আনহুম) নবী (সা.) এর প্রতি ভালবাসা ছিল নজিরবিহীন। যারা হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে রাসূলের (সা.) থুথু হাতে মুখে মেখেছিলেন এবং উহুদ প্রান্তরে তালহা (রা.) নিজেকে রাসুল (সা.) এর ঢাল হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। তাতে তার দেহে ৭০টি তীরের আঘাত লেগেছিল। এ ছাড়াও সাহাবায়ে কেরামের নবী প্রেমের অসংখ্য ঘটনা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। তারা কোন দিন এ ধরনের বাহ্যিক সাজ-সজ্জা, আড়ম্বরতা, মুখরোচক শ্লোগান ও লৌকিকতাপূর্ণ মাসিক বা বার্ষিক প্রথা হিসাবে কোন অনুষ্ঠান পালন করেন নি। বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা রাসূলের জীবনাদর্শ অনুসরণ করেছেন। ভালবাসার ক্ষেত্রে তাদের মত সুন্নাতের অনুকরণ ও আদর্শে আদর্শবান হওয়ায় ইবাদত ও সাওয়াবের কাজ।
এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা ঈমান আন যেমনি ঈমান এনেছেন মানুষগণ অর্থাৎ সাহাবাগণ। (সুরা আল বাকারা, আয়াত ১৩) সুতরাং তাদের ঈমান ও আমল অনুযায়ী আমাদের ঈমান ও আমল হওয়া উচিত। তাদের ঈমান ও আমলের প্রতি আল্লাহ তায়ালা খুশি হয়ে বলেন, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, তারাই আল্লাহর দলের অন্তুর্ভুক্ত। জেনে রেখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে। (সুরা মুজাদালাহ, আয়াত ২২)
মো : আসাদুজ্জামান