16/03/2024
বিভিন্ন ধর্মে উপবাসের গুরুত্ব
- সৈয়দ শফীক
-------------------------------
বিশ্বের নানা প্রান্তে নানা কারণে মানুষ সারাদিন বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খাবার গ্রহণে বিরত থাকে, রোজা রাখে বা উপবাস পালন করে। ধর্মীয় কিংবা আধ্যাত্মিক কারণ ছাড়াও শরীরের উপকার হবে, এমন ধারণাও রয়েছে অনেকের। কিছু সময়ের জন্য খাদ্য গ্রহণে বিরতি নেওয়া কি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো? এ প্রশ্নে অনেক বিশেষজ্ঞই ইতিবাচক উত্তর দিয়েছেন। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য খাদ্য গ্রহণে বিরতি নেওয়ার উপকারিতা রয়েছে। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, কিছু সময়ের জন্য খাবার গ্রহণে বিরত থাকার ফলে দেহের কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণ, হৃদরোগের সম্ভাবনা কমানো ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস পায়। এতে দীর্ঘ জীবনের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
উপবাস শব্দের বাংলায় অর্থ অনশন, উপোস। সামাজিক বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য খাদ্য গ্রহণ না করাকেই বলে উপবাস। বিবাহ, পূজার্চনা, রোজা এবং বিভিন্ন ব্রত উপলক্ষে উপবাস পালন করা হয়। উপবাস করা হল এমন ধর্মাচার, যা মানুষকে আধ্যাত্মিকতা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করে এবং মনে করিয়ে দেয় যে, বস্তগত জিনিসগুলো জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। উপবাস ঈশ্বরের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে। উপবাস করা হল এক বাধ্যবাধকতা, ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও কৃতজ্ঞতা দেখানোর এক প্রধান উপায়। একজন উপবাস করে কারণ সে সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসে।
সাধনক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় সংযম অত্যাবশ্যক কর্ম, আর এ জন্য উপবাস একটি প্রধান উপায়। উপবাস শব্দটির মধ্যে দুটি বিষয়ের দ্যোতনা আছে; একটি হলো খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা এবং অপরটি কায়মনোবাক্যে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য অনুভব করা। দেহ-মনকে সুস্থ ও নীরোগ রাখার জন্যও অনেকে নিয়মিত সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক উপবাস পালন করেন। তাঁদের ক্ষেত্রে দৈহিক ব্যাপারটিই প্রধান, মানসিক সংযম সেখানে গৌণ। অপরদিকে যাঁরা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে উপবাস পালন করেন তাঁরা দেহ-মন উভয় দিক থেকেই সংযত হযে থাকেন। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ এগুলি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও উপবাস বিশেষ ভূমিকা রাখে। উপবাস দ্বারা সংযমী সাধক মন, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দিয়ে আরাধ্য দেব-দেবীর সান্নিধ্য অনুভব করেন এবং এর মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করেন। তাই আত্মিক ভাবনায় ঋদ্ধ ব্যক্তিগণ দেহ ও মন উভয় সুস্থ রাখার জন্য সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে একাদশী তিথিতে অথবা অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপবাস পালন করেন। এছাড়া বিশেষ পূজা-অর্চনাদির সময়ও সনাতন ধর্মালম্বী ভক্তগণ উপবাস পালন করেন। যেমন সরস্বতী পূজা উপলক্ষে হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীরা উপবাস পালন করে। ব্যক্তিবিশেষের শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী উপবাসের প্রকৃতি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যদি কেউ পূর্ণ একটা তিথি (প্রায় চবিবশ ঘণ্টা) উপবাস থাকতে না পারেন তাহলে তিনি স্বাভাবিক আহারের পরিবর্তে কিঞ্চিৎ লঘুখাদ্য গ্রহণ করে থাকেন। আবার কেউ কেউ উপবাসের সময় পানীয় পর্যন্ত গ্রহণ করেন না। বহু সাধক-মহাপুরুষের জীবনে ক্রমাগত দুই, তিন, চার, পাঁচদিন ব্যাপী উপবাসের কাহিনীও জানা যায়। তবে একথা নিশ্চিত যে, উপবাস দেহ ও মনকে সুস্থ ও পবিত্র রাখে।
প্রায় সকল ধর্মেই উপবাস নিয়ে বলা হয়েছে ‘উপবাস” ঈশ্বরের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগ স্থাপন করাকে সাহায্য করে। হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, ইসলাম, জৈনধর্মসহ জগতের প্রধান প্রধান ধর্মের মধ্যে উপবাস এক সাধারণ প্রথা। অনেক লোক বিশ্বাস করে যে, নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য খাদ্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা একজনকে তার সৃষ্টিকর্তার নিকটবর্তী করে। নানান ধর্মের মানুষের নানান রকম পদ্ধতিতে উপবাস পালন করে, মাঝে মধ্যে উপোস করা শরীর ও মস্তিষ্কের জন্য বেশ উপকারী। বৌদ্ধ, হিন্দু, ইসলাম, জৈন ও ইহুদি ধর্মসহ জগতের অনেক ধর্মের মধ্যে উপবাস করা হল এক সাধারণ প্রথা।
হিন্দু ধর্মের উপবাস
হিন্দু ধর্মে উপবাস বা ব্রত বিভিন্ন উপায়ে অনুষ্ঠিত হয়, এবং এটি ধর্মীয় উন্নতি, সাধনা, ও দেবতার অমৃত্যু প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে করা হয়। হিন্দু ধর্মে উপবাসের বিভিন্ন ধরণ ও উপায়ের মধ্যে কিছু প্রধান উপবাস পদ্ধতি রয়েছে:
একাদশী ব্রতের উপবাস: এই ব্রতটি হিন্দু ক্যালেন্ডারের একাদশী তিথি বা তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনে হিন্দুদের বিশেষভাবে পুণ্য করতে বলা হয় এবং তাদের মধ্যে একাদশী ব্রতের উপবাস একটি প্রধান আচরণ। এই দিনে খাবারের মধ্যে দৈহিক অমৃত্যুর প্রয়োজনীয় জীবাণুগুলি থাকতে হয় না।
করবাচৌথ ব্রতের উপবাস: এই ব্রতটি ভারতীয় নারীরা অধিকাংশই শুক্রবারে অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত করে। এটি স্ত্রীরা তাদের স্বামীবর্গের দীর্ঘজীবন এবং সুখ-শান্তির জন্য প্রার্থনা করে এবং রাতে চাঁদের দেখা হওয়ার পর দীর্ঘকাল উপবাস করে। ভারতের অনেক অঞ্চলের বিবাহিত হিন্দু রমনীরা স্বামীর সুস্বাস্থ্য, আয় উন্নতি, দীর্ঘায়ু কামনা করে উপবাস পালন করে থাকে। একটি ঝালরের মাধ্যমে চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে তারা এই উপবাস ভংগ করে। শ্রাবণ মাসে অনেকে শ্রাবন উদযাপন করে। এই সময়ে অনেকেই সপ্তাহের একটি দিন তারা তাদের পছন্দের দেবতার জন্য উপবাস করে। আবার অনেকেই পুরো শ্রাবন মাস উপবাস পালন করেন।
নবরাত্রি ব্রতের উপবাস: নবরাত্রি হলো দেবী দুর্গার উপাস্য নৌবার পূজা, যা অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে বিশেষভাবে নারীদের মাঝে নারী শক্তি উৎকৃষ্ট করতে এবং দোষের নাশ করতে এক ধরণের আত্মপূনরুত্থান করা হয়। এই ব্রতের প্রতিটি দিনে একটি উপযুক্ত নারী দেবীর বিভিন্ন রূপ লাভের উদ্দেশ্যে নভরাত্রিতে হিন্দু সম্প্রদায় উপবাস পালন করে।
মহাশিবরাত্রি ব্রতের উপবাস : এটি ভগবান শিবের উপাস্য একটি বিশেষ ব্রত, যা ফাল্গুন মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনে শিবলিঙ্গ পূজা করা হয় এবং রাতে পূর্বে উঠে তৃষ্ণা করে শিবের পূজা করা হয়। মহাশিব রাত্রীতে অধিকাংশ হিন্দু উপবাস পালন করে এবং তারা একবিন্দু জল পর্যন্ত পান করে না।
কার্তিক মাসের একাদশী: এই ব্রতটি কার্তিক মাসের একাদশী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় এবং এটি বিশেষভাবে বিষ্ণু উপাস্য। এই দিনে খুব সুন্দর বা বৃক্ষের কিছু দান করা হয় এবং খাদ্য বিশেষভাবে শ্রীহরি উপাস্য খাওয়া হয়। অন্ধ্রপ্রদেশে কার্তিক মাসের শুরুর দিনে অনেক হিন্দু বিশেষ করে রমনীরা উপবাস পালন করে থাকে। এ মাসের সোমবার তারা শিবের জন্য, পূর্নচন্দ্রের দিন কার্তিকের জন্য উপবাস পালন করে থাকে।
হিন্দু ধর্মে উপবাস একটি আনুসংগিক অংশ। কিছু প্রধান হিন্দু উপবাসের পদ্ধতি বিভিন্ন রীতিতে অনুষ্ঠিত হতে পারে। ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং আঞ্চলিক রীতিনীতি অনুসারে হিন্দু ধর্মে বিভিন্ন ধরণের উপবাস প্রচলিত আছে। মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিন যেমন একাদশী, প্রদোষ অথবা পূর্ণিমাতে উপবাস পালন করেন অনেকে। সপ্তাহের কয়েকটি দিন নির্দিষ্ট দেবতার জন্য উপবাস পালন করার বিধান আছে অনেক অঞ্চলে। যেমন সোমবার শিবের জন্য, বৃহস্পতিবার বিষ্ণুর জন্য এবং শনিবার আয়াপ্পার জন্য উপবাস পালন করা হয়। মংগলবারে দক্ষিণ ভারত এবং উত্তর পশ্চিম ভারতে উপবাস পালন করা হয়। দক্ষিণের হিন্দু জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করে মঙ্গলবার শক্তির দেবী মারিয়াম্মানের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে। উপবাসকারীরা সূর্যোদয়ের আগে খাবার গ্রহন করে এবং সূর্যাস্তের পরে তারা উপবাস ভঙ্গ করে। তবে এই উপবাসকালীন সময়ে তারা পানীয় জল পান করে থাকে।
উত্তর ভারতে মঙ্গলবার দেবতা হনুমানের জন্য নির্দিষ্ট। উপবাসকারীরা এইদিনে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তকালীন সময় পর্যন্ত শুধুমাত্র দুধ এবং ফল খেয়ে থাকেন। উত্তর ভারতের হিন্দুগণ বৃহস্পতিবার উপবাস পালন করে থাকে। উপবাসকারী একটি গল্প বা শ্রুতি শ্রবনের মাধ্যমে উপবাস শুরু করে। বৃহস্পতিবারের উপবাসকারীরা বৃহস্পতি মহাদেবের পূজা করে। তারা হলুদ কাপড়; পরে এবং হলুদ রঙের খাবার খেতে পছন্দ করে। এদিন মহিলারা কলা গাছের পূজা করে এবং জল ঢালে। হলুদাভ বর্ণের ঘি দিয়ে খাবার প্রস্তুত করা হয়। বৃহস্পতিবার গুরুর জন্য উৎসর্গ করা হয়। যে সকল হিন্দুরা গুরুমন্ত্র গ্রহন করে তাদের অনেকেই বৃহস্পতিবার উপবাস পালন করে থাকে।
শ্রীবিদ্যায় উপবাস করতে নিষেধ করা হয়েছে। এই তান্ত্রিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে দেবী মানুষের মধ্যে বাস করেন। তাই কেউ যদি ক্ষুধার্ত থাকে তবে দেবীও ক্ষুধার্ত থাকে। শ্রীবিদ্যায় শুধু মাত্র পিতা-মাতার মৃত্যু বার্ষিকীতে উপবাসে কথা বলা হয়েছে। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে একাধিকবার উপবাসের কথা বলা হয়েছে। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘উচ্চজ্ঞানের উপবাস প্রথা পালন করো যার কথা সবাই জানে না’।
কনিফুসিয়াস ধর্মের উপবাস
কনফুসিয়াস ধর্মে একটি প্রধান উপবাস পদ্ধতি অনুষ্ঠান করা হয় না, কারণ কনফুসিয়ানিজম বোঝায় একটি বিশেষ ধর্মীয় উপবাসের প্রণালী নেই। কনফুসিয়াস ধর্ম, যা কনফুসিয়ানিজম হিসেবেও পরিচিত, একটি দার্শনিক এবং এতি একধরণের এতি একধরণের সমাজ-নীতি বা এতি একধরণের সংস্কৃতির উপর ভিত্তি রয়েছে।
কনফুসিয়ানিজমে বোঝানো হয় যে মূলত একজন ব্যক্তি কিভাবে আত্ম-উন্নতি এবং সামাজিক সম্পর্ক উন্নত করতে হয়, এবং এটি ধরে নেয় যে একজন ব্যক্তির চরিত্র, দারিদ্র্য, এবং নীতি কিভাবে তার দিকে এগিয়ে যায় তাই গুরুত্বপূর্ণ। এই ধর্মে আছে উপবাসের পদ্ধতি না, বরং আত্ম-শীলতা, ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি, এবং সামাজিক মূল্যাবলীর অধীনে ব্যক্তি কে উন্নত করার উপকরণ ও পথ প্রদান করা হয়।
এই ধর্মে উপবাসের জন্য প্রধান পদ্ধতি হলো নৈতিক ও আত্ম-শীলতার পথে চলা, এবং ধার্মিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যক্তি কে আত্ম-উন্নতি করার জন্য সহায়ক হতে উপযোগী হতে উদ্দীপ্ত করা হয়।
শিন্তো ধর্মের উপবাস
জাপানের প্রাচীনতম শিন্তো ধর্মে উপবাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অভ্যন্তরীণ অনুষ্ঠান। শিন্তোরা বিশ্বাস করে যে, উপবাস তাদের আত্মা এবং প্রকৃতির সাথে একরূপ থাকতে সাহায্য করতে পারে এবং ব্যক্তির বৃদ্ধি এবং শান্তির দিকে সাহায্য করতে পারে। শিন্তো উপবাস অনেক রকমের হতে পারে, কিছুটা কিছু হতে পারে পৌরাণিক ইতিহাস এবং পরম্পরাগত ব্রাহ্মণিক উপাস্যতা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
একটি প্রধান শিন্তো উপবাসের পদ্ধতি হলো "ওইতি" বা ধ্যান। ধ্যানের মাধ্যমে শিন্তো বাধ্য হয়ে যায় অপনার বৃদ্ধি ও সুস্থতা বৃদ্ধি করতে। এটি একটি প্রাচীন বৌদ্ধ প্রক্রিয়া, যা মৌন এবং ধ্যানের মাধ্যমে মানবকে তার আত্মা এবং প্রকৃতির সাথে একরূপ হতে সাহায্য করে। এটি সাধারণভাবে প্রচুর শিন্তো উপাসকের মাঝে অনুষ্ঠিত হয়।এর আলাদা একটি আচরণ হলো শিন্তো উপবাসের সময়ে কিছু প্রধান উপযোগী বা ব্যক্তিগত বিষয়ে বিচার করা হয়, এমনকি দান করা হতে পারে। এই উপযোগী এবং ধার্মিক কাজের মাধ্যমে উপবাসী তাদের সমাজ ও প্রাকৃতিক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাতে পারে।
শিন্তো উপবাস সময়ে আত্ম-নিরীক্ষণ এবং বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তি ও সামাজিক উন্নতির দিকে এক ধরনের আত্ম-শীলতা এনে দেয়।
ইহুদি ধর্মের উপবাস
ইহুদী ধর্মে উপবাস পদ্ধতি এবং অনুষ্ঠান ইহুদী লোকের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিনচর্যা। ইহুদী উপবাসের প্রধান উদ্দীপক হলো ধার্মিক ও ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি এবং উপাস্য দেবতা-দেবীদের প্রতি ভক্তি অর্পণ করা।
ইহুদি ধর্মে উপবাস মানে সকল ধরণের খাবার ও পানি গ্রহন থেকে বিরত থাকা। ঐতিহ্যগতভাবে ইহুদিরা বছরে ছয়দিন রোজা পালন করে থাকে। ইয়াম কিপ্পুর হচ্ছে ইহুদি বর্ষপঞ্জিকার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন সকল পূর্ণবয়স্ক নারী-পুরুষ উপবাস পালন করে থাকে। এই পবিত্র দিনে তারা উপসনার চেয়ে উপবাসকেই বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যদি কেউ উপবাস পালন করে বিছানায় শুয়ে থাকে তবুও সে পূর্ণ ধর্মীয় বিধান পালনের পূণ্য লাভ করবে। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপবাসের দিন তিশা বাব। এছাড়াও ইহুদী সমাজে কিছু উপবাস উপবাস পরিলক্ষিত হয়, যেমন-
ইহুদী নববর্ষ: এটি ইহুদী নববর্ষের উপবাস, যা সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনে ইহুদী লোকরা ধার্মিক কর্মসূচি অনুসরণ করে এবং আত্মনিরীক্ষণ করে যাতে আসছে নতুন বছরটি সফল হোক।
ইহুদী দিনের আবসর : ইহুদী লোকরা প্রতি সপ্তাহে শনিবার দিনটি উপবাসের রূপে পালন করে। এই দিনে উপবাসিনীরা নিজেদের বা পরিবারের সাথে আসবার জন্য সংস্কৃতির সাধারিত বিশেষ উপায়ে প্রস্তুতি করে এবং পরিবারের সদস্যরা এসে সান্ত্বনা, ভালোবাসা, এবং ভাগ্যবান অসময় পান করে।
ইহুদী এসার: ইহুদী এসার অথবা যোম কিপুর ইহুদীদের মধ্যে একটি অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দিন, যা রবিবার বা সোমবার বলে অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনে ইহুদী লোকরা নৈতিক অনুষ্ঠানে যান। তারা দোষ ক্ষমা প্রার্থনা করতে এবং দিনটি পুরো দিন উপবাস করে, খাদ্য এবং পানীয় অপরিহার্যতার সময়ে।
হানুক্কা: হানুক্কা ইহুদীদের একটি প্রসিদ্ধ উৎসব এবং ইহুদী উপবাস, যা হলো অষ্ট দিনের উৎসব। এই উৎসবে ইহুদী লোকরা একটি একাধিক দিন সমান বৃদ্ধি হতে পারে এবং প্রতি দিনে একটি অতিরিক্ত শক্তি।
বৌদ্ধ ধমের্র উপবাস
বৌদ্ধ ধর্মে উপবাস পদ্ধতি হলো বিশেষ ধার্মিক অনুষ্ঠান ও আত্মশীলনের একটি রূপ। বৌদ্ধ সাধুসমূহ এই উপবাসের মাধ্যমে আত্মশীলন, শিক্ষা, এবং সাধনা করে। উপবাসের মাধ্যমে তারা মানসিক, শারীরিক, এবং আধ্যাত্মিক পোষণ প্রাপ্ত করতে চেষ্টা করে। বৌদ্ধ ধর্মে কয়েক প্রকারের উপবাস প্রথাও প্রচলিত রয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু প্রধান উপবাস হলো বৌদ্ধ সাধুরা নির্ধারিত দিনে উপবাস অনুষ্ঠান করেন। এই উপবাসের মাধ্যমে তারা অত্যন্ত নিয়মিতভাবে প্রাণায়াম ও মেদিটেশন করে এবং আত্মা প্রবৃদ্ধি করার জন্য চেষ্টা করে।
বৌদ্ধ উপবাসের পদ্ধতিগুলি একসাথে বৌদ্ধদের আত্মা উন্নত করতে সাহায্য করে এবং তাদের মোক্ষের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী জীবন যাপন করতে সাহায্য করে।
বৌদ্ধধর্মে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিনয় নীতি অনুসরণ করে যাতে সাধারনত দুপুরের আহারের পরে সেদিন আর কোন খাবার গ্রহন করে না। যদিও এটাকে উপবাস বলা চলে না। তবুও শৃংখলিত আহার বিধি ধ্যান এবং সুস্বাস্থ অর্জনে সাহায্য করে। গৌতম বুদ্ধ প্রথম জীবনে অর্থ্যাৎ রাজপুত্র সিদ্ধার্থ দুজন শিক্ষকের তত্বাবধানে শিক্ষাগ্রহন করেন। এসময়ে তিনি খুবই কম খাদ্য গ্রহন করতেন। পরবর্তীতে তার উপদেশ মালায় তিনি কম খাদ্য গ্রহনের কথা উল্লেখ করেন। বৌদ্ধ ধর্মানুসারীদের সপ্তাহের একটি দিনে অষ্টবিধান অনুসরণ করতে বলা হয়েছে, যাতে দুপুর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত উপবাসের বিধান রয়েছে। বজ্রযান অনুসারীরা নুয়াং নে অনুসরণ করে যা তান্ত্রিক অনুশাসন চেনরেজিগের মত।
খ্রিস্টান ধর্মের উপবাস
খ্রিস্টান ধর্মে উপবাস বা ফাস্টিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ধার্মিক অভ্যন্তরীণ অনুষ্ঠান। খ্রিস্টান উপবাসের প্রয়োজনীয়তা এবং সহোজে বোঝার জন্য বিভিন্ন উপবাস পদ্ধতি রয়েছে। যেমন
লেন্ট: খ্রিস্টান ধর্মে, লেন্ট হলো একটি চুক্তিকাল যা ঈশ্বরের কাছে প্রতিরোধ এবং বিচারের জন্য উপবাস অনুষ্ঠান করা হয়। এটি প্রায়ই ক্রিসমাসের আগে শুরু হয় এবং এটি প্রতি বছর ৪০ দিন চলে, যা ঈশ্বর যিশুর আত্মসমর্পণ, প্রতিরোধ এবং প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুষ্ঠিত হয়। লেন্টে মূলত খাদ্যের উপবাস, দৈহিক পূণ্যকর্ম, প্রার্থনা, এবং শক্তি উৎসর্গের জন্য প্রতিশ্রদ্ধাভাবে চেষ্টা করা হয়।
আডভেন্ট: আডভেন্ট খ্রিসমাসের আগের চার সপ্তাহের অবধি চলতে থাকে এবং এটি খ্রিসমাস কার্যক্রমের প্রতিরোধে এবং ঈশ্বরের প্রতি অপেক্ষা করার জন্য মুখরিত হয়। এই সময়ে উপবাসের পদ্ধতি অনুষ্ঠিত হয় এবং ভগবান যিশুর দেখার অপেক্ষায় হয়।
পেন্টিকোস্ট : এই উপবাস বিশেষভাবে পেন্টিকোস্টের আগের ৫০ দিনের জন্য অনুষ্ঠিত হয়। এটি বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠান, উপাস্য হওয়া, এবং ধর্মীয় উন্নতির জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধতা প্রকাশ করার জন্য অবদান রাখে।
ক্রিসমাস ইভ: খ্রিসমাস ইভ সময়ে কোনও বিশেষ উপবাসের পদ্ধতি থাকে না, তবে কিছু খ্রিস্টান কমিউনিটি খ্রিসমাস ইভে উপবাস অনুষ্ঠান করে এবং শুধুমাত্র পানি বা ফলের রূপে খাদ্য পরিস্থিতি অনুভব করে।
খ্রিস্ট ধর্মের বাইবেলিকার বইয়ের মধ্যে ইসাইয়াহ (৫৮:৬-৭), জাকারিয়াহ (৭:৫-১০), বুক অফ দানিয়েলে উপবাসে কথা বলা হয়েছে। তবে এখানে উপবাসে খাদ্য পানীয় পরিহারের বদলে সৃষ্টিকর্তার আদেশ পূর্ণরূপে প্রতিপালন করতে গরীব এবং দুর্দশাগ্রস্থকে সাহায্যের কথা বলা হয়েছে। বুক অফ দানিয়েলে আংশিক উপবাসের কথা বলা হয়েছে। খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন শাখা বা চার্চ উপবাস পালন করে থাকে। তবে কিছু শাখা এটাকে পালন করে না। ক্যাথলিক চার্চ এবং ইস্টার্ণ অর্থোডক্স চল্লিশ দিনের আংশিক উপবাস পালন করে থাকে। ইথিওপিয়ান অর্থোডক্স চার্চ বছরে কয়েকবার সপ্তাহব্যাপী আংশিক উপবাস পালন করে। উক্ত সময়ে তারা মাংস এবং দুগ্ধ আহার থেকে বিরত থাকে। বাইবেলে (লেভিক্টাস ২৩:২৭,৩১) বলা হয়েছে, সবার উচিত সপ্তম মাসের নবম দিনের সন্ধ্যা থেকে দশম দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনরূপ খাদ্য গ্রহন না করা।
জৈন ধর্মের উপবাস
জৈন ধর্মে উপবাস পদ্ধতি মূলত আত্মশীলন, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ এবং আত্মপূর্ণতা অর্জনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠান করা হয়। জৈন ধার্মিক গ্রন্থগুলি, বিশেষভাবে জৈন আগম, উপবাসের একাধিক প্রকার ও নিয়ম উল্লেখ করে।
পারাণা : জৈন ধর্মের অন্যতম প্রধান উপবাস হলো পারাণা, যা বার্ষিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এটি আত্মশীলনের উদ্দেশ্যে একটি প্রক্রিয়া, একধরনের মৌন উপবাস, যা সপ্তাহের বা দশ দিনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে শ্রাবক এবং শ্রাবিকা মহোথ্সভা (বৃদ্ধি) অনুষ্ঠিত হয় এবং অতীত পাপের ক্ষমা জানানো হয়। এছাড়াও, অধিকাংশ শ্রাবক এবং শ্রাবিকা এই সময়ে মৌনধারণ করে এবং পরস্পরের সাথে সৎযাচ্ছার সম্পর্ক বজায় রাখতে চেষ্টা করে।
উত্তেনি: উত্তেনি হলো জৈন ধর্মের অভিনয় ও ক্ষমা উপবাসের একটি রূপ, যা পূর্বে কৃতকৃত্য যাত্রীদের স্মরণ করতে হয়। এই প্রক্রিয়াতে জৈন দান এবং শাস্তি পাওয়ার জন্য অতীত অপরাধের ক্ষমা জানায়।
অনেকান্তধারণা: এই ধারণা হলো সত্যের অন্যান্ত পথে পৌঁছতে অনেকগুলি দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। এটি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যা অপরাধের প্রতি ক্ষমা এবং উদারতা প্রকাশ করে। এই ধারণার অনুযায়ী, একটি বিষয় বা ঘটনার সত্য প্রতি সম্ভাব্য দৃষ্টিভঙ্গি আছে, এবং সত্য সম্পূর্ণভাবে জানার জন্য একই প্রক্রিয়াতে অনেকগুলি দৃষ্টি একত্রে মেলিতে হতে পারে। জৈন ধর্মে এই উপবাস পদ্ধতিগুলি পালন করে শ্রাবক ও শ্রাবিকা, এবং এটি তাদের জীবনে শান্তি, ধার্মিক অভিজ্ঞান এবং সাধারণভাবে আত্মবিকাশ এনে দেয়।
এছাড়াও জৈন ধর্মে বিভিন্ন ধরণের উপবাস প্রথা পচলিত আছে। যেমন- চৌবিহার উপবাস, যাতে পরবর্তী দিনের সূর্যোদয় পর্যন্ত কোন প্রকার খাবার বা পানি গ্রহন করা যায় না। ত্রিবিহার উপবাস- যেখানে কোন খাবার খাওয়া যায় না কিন্তু ফুটানো পানি পান করা যায়। জৈন ধর্মমতে যে কোন উপবাসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে অহিংসা অর্জন। সাধারনত পাজ্জ্যশনে উপবাস পালন করা হয়। কোন ব্যক্তি যদি পাজ্জ্যশনে আটদিন উপবাস পালন করে তবে তাকে বলা হল আত্থাই এবং দশদিন উপবাস করলে বলা হয় দশলক্ষন। আর মাসব্যাপী উপবাস পালন করলে বলা হয় মশখমন। জৈনদের মধ্যে উপবাস পালন না করে খুবই কম খাবার আহার করার রীতি অতি সাধারণ দৃশ্য। যে সকল ব্যক্তিরা মসুরের ডাল এবং স্বাদহীন খাবার শুধুমাত্র লবন ও মরিচ দিয়ে খেয়ে থাকেন তাদের বলা হয় আয়ামবলি। জৈনরা দিনে একবার মাত্র খাবার গ্রহন করে একাসসন নামে উপবাস পালন করে। দিনে দুই বার খাবার খেয়ে বিয়াসন উপবাস পালন করে।
শিখ ধর্মের উপবাস
শিখধর্মে উপবাস প্রথাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। গুরুগ্রন্থ সাহিবে বলা হয়েছে উপবাস কোন আত্মিক সুবিধা বয়ে আনে না। তাই শরীরকে কষ্ট দিয়ে কোন লাভ নেই। তবে শুধু মাত্র স্বাস্থ্যজনিত কারণে উপবাস করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
শিখ ধর্মে উপবাসএকটি গুরুমুখী জীবনধারা বা ইবাদতের একটি বিশেষ রূপ। ইহুদী ধর্মে এটি অখাড়া সমাজের মেধাবী সদস্যদের জন্য বৈষ্ণব মুক্তির পথে অনুমোদিত একটি সাধনা হিসেবে মনোনিবেশ করা হয়। এটি শিখ সমাজের প্রাথমিক ধার্মিক কাজ এবং গুরুমুখী জীবনের একটি উচ্চ স্তরের অবলম্বন হিসেবে গণ্য হয়। শিখ ধর্মে উপবাসের পদ্ধতি মৌনধারণ, সিম্রণ, আরদাস, বচন সাধুতা, কীরতন এবং ইহুদী গুরুমুখী জীবনের নৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মৌনধারণ : শিখদের উপবাসের প্রথম পদ্ধতি মৌনধারণ বা মৌনব্রত। এটি একটি নিয়মিত সময়ে ধার্মিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য ব্যক্তির মাসিক অবস্থান করে। এই সময়ে শিখদের মনোবল এবং অনুভূতি উন্নত হতে পারে, যার মাধ্যমে তারা আত্মা এক হতে পারে তা অনুভূত করে।
সিম্রণ: সিম্রণ হলো ঈশ্বরের নাম বা জাপ করার একটি উপায়। শিখদের সমাজে ব্যক্তি বিশেষভাবে এই মন্ত্র জপ করে। এটি একটি ধার্মিক অভ্যন্তরীণ উপাস্য, যা শিখদের মাসিক অবস্নেথা বা অন্যান্য সময়ে করা হয়। সিম্রণ করতে গিয়ে ব্যক্তি ঈশ্বরের নামের জপ করে এবং এটি করতে করতে একটি ধার্মিক চিত্র অবতীর্ণ হয়।
আরদাস: শিখ সমাজে ব্যক্তিরা প্রতি সকাল এবং সন্ধ্যায় একটি ধার্মিক কার্যক্রমে আরদাস অনুষ্ঠান করে। এটি একটি ধার্মিক প্রার্থনা ও অনুষ্ঠান, যা ঈশ্বরের দিকে মোড় নেয়।
ইসলাম ধর্মের উপবাস
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের চতুর্থ স্তম্ভ রোজা বা উপবাস। পবিত্র রমজান মাসে সারা জাহানের মুসলমানগণ রোজা পালন করে থাকেন। ইসলাম ধর্মে রামাদান মাসে ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত পূর্নবয়স্ক সুস্থ সবল নারী-পুরুষের জন্য বাধ্যতামুলক। রোজা পালন সময়ে কোন প্রকার খাদ্য গ্রহন এবং পান সম্পূর্নরূপে নিষিদ্ধ। ইসলাম ধর্মে উপবাস বা রোজা পালনের জন্য কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষনীয়-
নিয়ত: রোজা শুরু করার আগে একজন মুসলিমকে নিয়ত করতে হয়। তার মনে হতে হবে যে, এই রোজা ইলাহি প্রতি একমাত্র ইবাদতের জন্য অনুষ্ঠান করছে এবং তার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে নৈর্বোধ্য হয়ে থাকবে।
সাহরী : রোজা শুরু হওয়ার আগে এবং সেই দিনের জন্য শক্তি সাধারিত করার জন্য সুহূর (সহর) নামক খাদ্য একজন মুসলিমের জীবনযাপনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি সূর্যোদয়ের আগের সময়ে হতে হবে এবং এটি সারাদিনে থাকা আগ্রহী।
ইফতার : রোজা টুটে যাওয়ার সময়, সূর্যাস্তের পর, মুসলিমরা ইফতার করতে পারে। এই সময়ে প্রায়ই খেতে হবে এবং এটি খোদার দোআ (প্রার্থনা) দিয়ে শুরু হতে হবে।
আশুরা রোজা : আশুরা মাসে একাধিক রোজা অনুষ্ঠান করা হয়। মুহররম মাসে প্রথম ১০ দিনে রোজা রেখে দিন অধিক পুরানো পাপের ক্ষমা ও নিষ্কলঙ্কতা প্রাপ্তির মাধ্যমে আত্ম-পুনরুত্থান হয়।
কাফারা করার উপবাস: কিছু অসুযী অবস্থায় কাফারা পূর্ণ করার জন্য মুসলিম অবশ্যই কিছু দিন উপবাস অনুষ্ঠান করতে হবে।
এছাড়াও, ইসলামে মাহে মুহররম, শাবান মাসের বাকি দিন, এবং সোমবার এবং পঞ্চান্তিকা দিনে আইতিহাসিক ইবাদত রয়েছে যা অধিকাংশ মুসলিম সমাজের মধ্যে প্রচলিত।
আরাফার দিবসে (জুল হজ্ব মাসের ৯ তারিখ) আরাফায় অবস্থানরত হাজীরা এই দিনে রোজা পালন করবেন না। আশুরার দিনে( মুহাররম মাসের দশ তারিখ) রোজা পালন করা হয়। সুন্নি মুসলমানেরা এই দিনের আগের দিন ও পরের দিনও রোজা পালন করে। অন্যদিকে শিয়াহ অনুসারীরা শুধু মাত্র এদিনেই রোজা রাখেন। শাওয়াল মাসের ছয়দিন রোজা পালন করা হয় ( রমজানের পরবর্তী মাস) প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩,১৪ এবং পনেরো তারিখ প্রতি সপ্তাহের মংগল ও বৃহস্পতিবার নিষিদ্ধ দিন বাদে অন্যান্য সকল দিন ( দাউদ নবীর রোজা নামেও পরিচিত) রজব মাসের ২৭ তারিখ মিরাজ উপলক্ষ্যে শাবান মাসের ১৫ তারিখ শব ই বরাত উপলক্ষ্যেরোজা রাখার জন্য বছরের কয়েকটি দিন মুসলমানদের জন্য নিদিষ্ট করা হয়েছে। ইদ উল ফিতর (শাওয়াল মাসের এক তারিখ) তাশরিক (১১, ১২, ১৩ যিলহজ্ব), সুন্নী মুসলমানেরা অনুসরণ করেন। ইদ উল আযহা (শিয়া মতালম্বীদের কোন কোন শাখা এই দিনে রোজা রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করে)
বাহাই ধর্মের উপবাস
বাহাইদের উপবাস পদ্ধতি বাহাই ধর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আত্মবিকাশ এবং আধ্যাত্মিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে একে অপরকে সহানুভূতি ও সমর্পণ করতে সাহায্য করে। বাহাই উপবাসের সময়ে ব্যক্তি নিজেকে শারীরিক, মানসিক, এবং আধ্যাত্মিক উন্নত করতে চেষ্টা করে এবং অপরকে সেবা করতে উৎসাহিত হয়।
বাহাই উপবাসের মৌখিক নিয়মাবলী নেই, যা কিছু উপবাস পদ্ধতি রয়েছে তা ধর্মীয় গ্রন্থের লেখনী অনুসারে পরিচালিত:
“পবিত্র আক্দাস গ্রন্থ এই আদেশ দান করিতেছে! “তোমরা পুরুষ ও স্ত্রীলোক বয়োপ্রাপ্তির (ষোলো বৎসরে পদার্পণের প্রারম্ভ)-কাল হইতে আমরা তোমাদের জন্য উপবাস, ও উপাসনা বাধ্যতামূলক করিয়াছি। তোমাদের পরম প্রভু ও তোমাদের পূর্বপুরুষদের পরম প্রভু কর্তৃক ইহা আদেশ করা হইয়াছে।”
“হে মহিমান্বিত লেখনী! বলঃ হে পৃথিবীর নেতৃবৃন্দ। তোমাদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক উনিশদিনের উপবাস বাধ্যতামূলক করিয়াছি, এবং ইহা পরিসমাপ্তির পর, নও-রোজকে (নববর্ষের প্রথম দিনকে) তোমাদের জন্য একটি পর্বদিনরূপে নির্দিষ্ট করিয়াছি।’’
“ভ্রমণকারী, পীড়িত ব্যক্তি, গর্ভবতী নারী ও স্তন্যদানকারিণী নারীর উপবাস বাধ্যতামূলক নহে, এবং তাহারা উপবাস মাস পালন না করিলে কোনো দোষ নাই। ঈশ্বর নিজ অনুকম্পায় তাহাদিগোকে ক্ষমা করেন, নিশ্চয় তিনি অতি শক্তিশালী ও অতি দানশীল।’’
“এই উনিশদিন যাবৎ, প্রত্যহ সূর্যোদয় হইতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য ও পানীয় হইতে নিজেদের বিরত রাখো, এবং সাবধান হও, পাছে পবিত্র গ্রন্থে নির্ধারিত ও মহান অনুগ্রহ হইতে তোমাদের বাসনা তোমাদিগোকে বঞ্চিত করে।’’ -কিতাবে আকদাস।
বাহাই ধর্মের উপবাসে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনরূপ পানাহার এমনকি ধূমপান পর্যন্ত নিষিদ্ধ। ১৫ থেকে ৭০ বয়সী সকল বাহাইকে এই রোজা বা উপবাস পালন করতে হবে। অসুস্থ, গর্ভবতী, ঋতুবতী, পর্যটক, কঠোর পরিশ্রমকারীদের জন্য রোজার বিধান শিথিল করা হয়েছে। তবে যারা কঠোর পরিশ্রম করেন তাদেরকে নির্জনে স্বাভাবিকের তুলনায় কম আহার করতে বলা হয়েছে।
১৯ দিনের ফাস্টিং (ঘরহবঃববহ-উধু ঋধংঃ): এটি এক বা একাধিক ১৯ দিনের উপবাস হতে পারে, যা বাহাই সম্প্রদায়ে প্রচলিত। এই উপবাসের দিনে বাহাইগণ খাদ্য এবং পানি বদলে দেয় এবং আত্মবিকাশ এবং আধ্যাত্মিক প্রবৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করে।
আলোচনা এবং আত্ম-নিগর্হ : বাহাই সম্প্রদায়ের অনেক সদস্যরা আলোচনা এবং আত্ম-নিগর্হে মুখরিত করে থাকে। এটি তাদের আত্মবিকাশ এবং আধ্যাত্মিক প্রবৃদ্ধির একটি উপায় হিসেবে দেখা হয়। এই সময়ে বাহাইগণ আত্ম-পুনরুত্থান এবং আত্মবিকাশের প্রতি কমিটমেন্ট করতে পারে এবং আলোচনা এবং মেধাবৃদ্ধির জন্য উপবাস অনুষ্ঠান করতে পারে।
আত্ম-শিক্ষা : বাহাই উপবাসের সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ার এবং আত্ম-শিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যায়াম করতে পারে। এই পথে তারা আত্মবিকাশ এবং ধর্মীয় জ্ঞানে বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করে।
বাহাই উপবাসের এই পদ্ধতিগুলি একে অপরকে সহানুভূতি ও সমর্পণের সাথে জড়িত করে এবং এটি তাদের ধর্মীয় সম্প্রদায়ে আত্মবিকাশ ও সমৃদ্ধির দিকে প্রচুর মাধ্যম হিসেবে অবদান রাখে।