04/11/2024
শ্বশুর বাড়িতে পা রেখেই বুঝতে পারলাম, এই বাড়িতে সবকিছুই শাশুড়ী মায়ের ইশারায় চলে। নতুন বউ বরণ করার সময়ে, যারা ই আমাকে কিছু খাওয়াতে আসছেন, সবাই একনজর শাশুড়ী মায়ের দিকে তাকাচ্ছিলেন।
বিয়ের আগে উনাকে মাত্র একবার দেখেছি, যথেষ্ট রুচিশীল মহিলা, যেমন কথা বার্তা তেমন পোশাক আশাক।
সেদিন রাতে আমার স্বামী আমাকে খুব স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, দেখো এ বাসায় কখনো একটা কাজ করার চেষ্টাও করবেনা। মা যা বলবে, সেটাই মেনে নিবে। কোনও জিজ্ঞাসা করা যাবেনা। শুধু এটুকুই চাওয়া তোমার কাছে। সেদিন রাতেই আমার মনে হচ্ছিলো কত বড় নরকে পড়তে যাচ্ছি আমি!!!
সারাজীবন নাটক সিনেমাতে, কাছের ভাইবোনদের কাছে শুনতাম শাশুড়ি শাশুড়িই হয়!!!! ঝগড়াঝাটি ঝামেলা সারাক্ষণই লেগে থাকে। আমি ভীষন শান্তিপ্রিয় মানুষ, শ্বশুড়বাড়িতে প্রথম দিনেই এমন আভাস পাওয়ায় আমি বেশ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাম।
সমস্ত অনুষ্ঠানাদী শেষ হওয়ার পর, পুরো বাড়িতে তখন কেবল আমি, আমার স্বামী সৌর, আর আমার শাশুড়ী মা।
অফিসের ছুটিও ততদিনে শেষ হয়ে আসলো। শাশুড়ী মা তখনও গুরুগম্ভীর, কাজের বাইরে খুব একটা কথা বলেন না।
উনার কাছে বেশ ভয়ে ভয়েই বলতে গেলাম,
- মা আমার ছুটি শেষ হয়ে এসেছে, আমাকে কালকে থেকে অফিসে জয়েন করতে হবে।
তিনি সেরকম কোনও কথা না বলে বললেন,
- তোমার অফিসে কি লাঞ্চ দেয়? নাকি আগে বাসা থেকে নিয়ে যেতে?
- না মা, অফিসেই দেয়।
- ঠিক আছে সাবধানে যাও, পৌঁছে আমাকে জানিও, আর শোনো তোমার অফিসের ঠিকানা টা, বিছানার পাশে রাখা, আমার ডায়েরী তে লিখে দিয়ে যাও।
রাতে বাসায় ফিরে তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে ঢুকতেই মা বলে উঠলেন, "টেবিলে বসো তোমরা, খাবার দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়বে,তাহলে একটা লম্বা ঘুম হবে, না হয় অফিস গিয়ে তো ঝিমুবে। "
- মা আমি অফিস থেকে ফিরে রান্না করবো, আপনি রেস্ট করবেন। শুধু শুধু কষ্ট হবে আপনার।
- চাকরী করছো, পুরো মনোযোগ ওখানেই দাও। সব কিছু সামলে নিতে চাইলে কোনও টাই খুব ভালো হবেনা। তুমি মাঝেমধ্যে এটা ওটা করে খাওয়াতে চাইলে, ছুটির দিনে করিও। যতদিন বেঁচে আছি এদিক টা তোমার ভাবতে হবে না।
আমি যারপরনাই অবাক হলাম, শাশুড়ী মায়ের কথা শুনে। আমি ভাবলাম হয়তো নতুন তাই মা আমায় কিছু করতে দিচ্ছেন না!
কিন্তু ভাবনার ছেদ পড়লো, যখন বিয়ের একবছর পার হয়ে গেছে, এখনও রোজ অফিস থেকে ফিরলে মা খাবার রেডী করে টেবিলে সাজিয়ে রাখেন। উনাকে আমি বুঝতে পারিনা। ভীষণ শক্তপোক্ত মানুষ, খুব কম কথা বলেন, কিন্তু সবকিছু নিজ হাতে করেন! আমার বোঝার কোনও উপায় নেই আমি এ বাড়ির, বউ না মেয়ে!
বেশ কদিন হল অফিসে বেশ ঝামেলা চলছে, একদিন রাত ৯ টা বেজে গেলো, আমিও কাজের চাপে বাসায় ফোন করে জানাতে ভুলে গেছি যে বাসায় যেতে দেরী হবে। হঠাৎ রিসিপশন থেকে একটা ফোন আসলো,
-"ম্যাডাম নিচে ওয়েটিং রুমে আপনার জন্য একজন অপেক্ষা করছেন।"
আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না এই সময়ে আমার কাছে কে আসবে! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ওয়েটিং রুমে যেয়ে দেখি শাশুড়ী মা বসে আছেন! বেশ গম্ভীর মুখ।
-মা আপনি এখানে!
-তোমার কাজ শেষ নাকি আরেকটু লেট হবে?
- না মা, হয়ে এসেছে, আমি এই বের হবো।
- ঠিক আছে, ব্যাগ নিয়ে আসো, আমি অপেক্ষা করছি।
পুরোটা রাস্তা তিনি গুরুগম্ভীর ছিলেন, বাসায় ফিরতেই মা বললেন,
-কতগুলো ফোন দিয়েছি তোমাকে? ফোন দিয়ে তো জানাতে পারতে তোমার দেরী হবে!
-মা স্যরি দেখি নি।
-তোমার না দেখার কারণে যে, আমার কি পরিমান চিন্তা করতে হয়েছে সেটা তুমি বোঝ? এখন থেকে দেরী হলে আগে জানাবে আমায়।
-জ্বি মা।
-এরকম ওভারটাইমে অফিসে সন্ধ্যায় নাস্তা দেয় তো?
-জ্বি মা।
এরপর কখনো অফিসে রাত হলে, সবদিন ই বাসায় ফিরে দেখতাম মা আর সৌর আমার জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করতেন।
বিয়ের প্রায় দু'বছর হয়ে যাচ্ছে, এমন এক দিন আমরা তিনজন মিলে আমার ফুপু শাশুড়ীর বাসায় দাওয়াত খেতে গেলাম। গল্পের একফাঁকে ফুপু শাশুড়ী একটু খোঁচা মেরেই বললেন,
-বউ খালি বাইরে কাম করলে চলবে? বাচ্চা নিবে কবে?
আমি ইতস্তত করতে করতে কিছু একটা বলবো, তখনই শাশুড়ী মা বলে উঠলেন,
- দেখো রাহেলা, ওদের প্ল্যান অনুযায়ী যখন ইচ্ছে নিবে, আর সবচে বড় কথা উপরওয়ালা যখন চাইবে তখনই হবে। যেচে যেচে এতো গোপন কথা কাওকে জিগ্যেস করো না, ভালো দেখায় না। আমরা না হয় নিজের মানুষ অন্য কাউকে বললে আবার লজ্জায় পড়তে পারো।
মুহূর্তেই ফুপু শাশুড়ীর মুখ চুপসে গেলো, তৎক্ষনাৎ তিনি বলে উঠলেন,
- ভাবি বউরে এতো মাথায় তুইলো না, পরে যখন দেখবে না, মুখ ঝামটা দিবে তখন বুঝবা।
- আমার বাড়ির বউ কি, তোমাদের বাড়ির বৌয়ের মতো ঘরের কাজের লোক নাকি যে আমায় দেখে রাখবে? তোমরা তো আজীবন আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছো, পায়ে ঠেলে রেখেছো পুরো বাড়ির লোক মিলে। আমি না হয় আমার বৌ রে আদর দিয়ে মাথায় তুলেই রাখি। দেখবে কি না দেখবে সেই আশা তো আমি করি না।
বাড়ি ফিরে আমি ভাবছিলাম, এত শক্ত সমর্থ মানুষ, কি দারুণ ব্যক্তিত্ব তার সাথে আবার কেউ খারাপ ব্যবহার করতে পারে! তাকে আবার কেউ কমান্ড দিতে জানে!
ভীষণ কৌতুহল বোধ থেকে, বেশ সাহস সঞ্চয় করে, মায়ের সাথে গল্প করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম,
- মা আপনার সংসার জীবন কেমন ছিলো?
মা তখন বেশ দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
- শোনো মা, দুনিয়া টা শক্তের ভক্ত নরমের যম। আমি সবসময় চুপ থাকতাম, তাই সবাই পেয়ে বসতো। সরকারি চাকরী হয়েছিলো, শাশুড়ী মা আমায় চাকরী করতে দেন নি, পেটে তখন আমার সৌর। সে কি তুলকালাম কান্ড! তোমার শশুরও যাচ্ছে তাই ব্যবহার ই করতেন! ওদের এহেন ব্যবহারে আমার ঘেন্না চলে এসেছিলো। পরের জীবনটুকু দায়বদ্ধতা থেকে শুধু ওদের জন্য করেই গেছি, কোনও শ্রদ্ধা কিংবা কোন ভালোবাসার ছিটেফোঁটা ছিলো না। বলতে বলতেই তার দু'চোখ বেয়ে পানি পড়ছিলো।
আমি কেবল অবাক হয়ে দেখছিলাম, এত কঠোর মানুষ কিভাবে কাঁদছে!
মা তখনো বলছিলেন,
- শুধু মন থেকে চাইতাম আমার ছেলেটা যাতে মানুষ হয়, ছেলেটা ও বড় হলো, আমিও বল পেলাম। সবসময় চেয়েছি এ বাড়িতে সৌরে র বউ যাতে আমার মেয়ে হয়েই থাকে। নিজে যা পাইনি, আমার ছেলের বৌ যাতে সে বিভীষিকার মুখোমুখি না হয়।
শাশুড়ী তো সবাই হয় রে মা, কয় জন অন্যের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা মেয়েটার মা হয়ে উঠতে পারে বলো!
অবাক চোখে আর ভীষণ শ্রদ্ধাভরে আমি আমার শাশুড়ী মা কে দেখছিলাম! কি উন্নত একজন মানুষ।