17/09/2023
সন্তানের প্রতি পিতার উপদেশ
__________________________
জগৎবাসীর মাঝে মানুষের প্রতি সবচেয়ে বেশি মমতাময়ী এবং কল্যাণকামী হচ্ছে পিতা-মাতা। ক্বুরআন, হাদীস এবং সীরাত গ্রন্থে সন্তানের প্রতি পিতার দরদমাখা যে অসীয়ত বা উপদেশ পাওয়া যায়, নিম্নে এমনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাণী বর্ণনা করা হলো।
__________________________
(১) পিতা-মাতার উচিত সন্তান জন্মের পূর্ব থেকেই তাদের সন্তান যেন নেককার হয়, তার জন্য আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দুয়া করা।
যেমন ইব্রাহীম আ’লাইহিস সালাম দুয়া করেছিলেন,
رَبِّ هَبۡ لِي مِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ١٠٠
“হে আমার রব্ব! তুমি আমাকে একটি সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দান করো।” সুরা সাফফাতঃ ১০০।
যাকারিয়া আ’লাইহিস সালাম দুয়া করেছিলেন,
رَبِّ هَبۡ لِي مِن لَّدُنكَ ذُرِّيَّةٗطَيِّبَةًۖ إِنَّكَ سَمِيعُ ٱلدُّعَآءِ
“হে আমার রব্ব! আমাকে তোমার পক্ষ হতে একটি সুসন্তান দান করো, নিশ্চয় তুমি প্রার্থনা শ্রবণকারী।” সুরা আলে-ইমরানঃ ৩৮।
__________________________
(২) পিতা-মাতার সবচেয়ে বড় চিন্তা হবে, তাদের মৃত্যুর পর তাদের সন্তানেরা যেনো আল্লাহকে মাবূদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, আল্লাহর গোলামী করে, তাঁর প্রতি অনুগত থাকে, তাঁকে ছাড়া অন্য কোনো মাবূদের পূজা না করে। একারণে নবী রাসুলগণ তাঁদের সন্তানদেরকে নসীহত করতেন।
যেমন নূহ আ’লাইহিস সালামের মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে তিনি তাঁর দুই ছেলেকে ডেকে বললেন, আমি তো অক্ষম হয়ে পড়েছি। তাই আমি তোমাদেরকে অসিয়ত করে যাচ্ছি। আমি তোমাদেরকে দুইটি বিষয়ে আদেশ করছি এবং দুইটি বিষয় থেকে নিষেধ করছি। আমি তোমাদেরকে শিরক এবং অহংকার থেকে নিষেধ করছি। আর যে দুটি বিষয়ে আদেশ করছি তার একটি হলোঃ “লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ্”। কেননা সমস্ত আসমান ও যমীন এবং এর মাঝে যা কিছু আছে সব কিছু যদি এক পাল্লায় রাখা হয় আর অপর পাল্লায় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্” রাখা হয়, তাহলে কালেমার পাল্লাই ঝুলে যাবে (ভারী হবে)। আর যদি সমস্ত আসমান-যমীন (সাত আকাশ ও সাত যমীন) এবং এর মধ্যকার যা কিছু আছে, একটি হালকা বা গোলাকার করে তার উপর এই কালেমাকে রাখা হয়, তাহলে ওজনের কারণে তা ভেঙ্গে যাবে। আর আমি তোমাদেরকে আদেশ করছি ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহা’মাদিহি’ (পাঠ করার জন্য), কেননা এটা প্রত্যেক বস্তুর তাসবীহ, এর দ্বারাই প্রত্যেক বস্তুকে রিযিক্ব দেওয়া হয়।” মুসনাদে আহমাদঃ ৬৫৮৩, মুস্তাদরাক হাকিমঃ ১৫৪, হাদীসটি সহীহ।
__________________________
(৩) একজন পিতার উচিত সমস্ত গুনাহর মাঝে তাঁর সন্তানদেরকে বিশেষভাবে শিরক থেকে সতর্ক করা। যেমন লুক্বমান আ’লাইহিস সালাম তার ছোট্ট ছেলেকে অত্যন্ত আদরমাখা কন্ঠে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেনঃ
يَٰبُنَيَّ لَا تُشۡرِكۡ بِٱللَّهِۖ إِنَّ ٱلشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِيمٞ ١٣
“হে আমার প্রিয় বৎস্য! তুমি আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় জুলম।” সুরা লুক্বমানঃ ১৩।
__________________________
(৪) পিতা-মাতার উচিত তাদের সন্তানদেরকে তাক্বওয়ার ব্যাপারে অসীয়ত করা, পরকালের জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য উপদেশ দেওয়া।
যখন আল্লাহ তাআ’লা ক্কুরআনের এই আয়াত নাযিল করলেন,
(وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الأَقْرَبِينَ )
“(হে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি আপনার নিকটাত্মীদেরকে সতর্ক করে দিন।” সুরা শুআ’রাঃ ২১৪।
তখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়ালেন এবং ক্বুরাইশ গোত্রকে, আবদে মানাফ গোত্রকে, তাঁর চাচা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আ’নহুকে, তাঁর ফুফু সাফিয়া রাদিয়াল্লাহু আ’নহাকে নাম ধরে ডেকে ডেকে সতর্ক করেন। অতঃপর তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা ফাতিমাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,
“হে মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাহ! আমার ধন-সম্পদ থেকে তুমি যা ইচ্ছা চেয়ে নাও। (শেষ বিচারের দিন) আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে আমি তোমার কোন উপকার করতে পারবো না।” সহীহ বুখারীঃ ২৭৫৩।
__________________________
(৫) মানুষ যতই চেষ্টা করুক না কেনো, তার দ্বারা গুনাহ হবেই। এ কারণে বুদ্ধিমান এবং কল্যাণের অধিকারী তারাই, যারা গুনাহ হয়ে গেছে বুঝার পর বারবার তাওবা করে। সেইজন্য পিতা-মাতার উচিত সন্তানদেরকে তাওবা এবং ইস্তিগফার করার জন্য খুব বেশি নসীহত করা।
যেমন লুক্বমান আ’লাইহিস সালাম তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, “হে আমার বৎস! তুমি আস্তাগফিরুল্লাহ (হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা করো - এই দুয়া) অনেক বেশি পরিমাণে বলো। কেননা, নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে এমন কিছু সময় রয়েছে, যখন তিনি কোন ভিক্ষুককে ফিরিয়ে দেন না।” শুআ’বুল ঈমানঃ ১১৩, ইমাম বায়হাক্বী রহি’মাহুল্লাহ।
__________________________
(৬) পিতা-মতা যতই আশা এবং চেষ্টা করুক না কেনো, তারপরেও কিছু কিছু সন্তান পথভ্রষ্ট, দ্বীন বিমুখ থেকে যায়। এমন ক্ষেত্রে মুমিনদের উচিত হতাশ না হওয়া। আল্লাহ তাআ’লা ইতিপূর্বে অনেক বড় বড় কাফির, ইসলামের দুশমনদেরকেও হেদায়েত দিয়েছেন। সুতরাং সন্তানের নাফরমানির জন্য তাদের হেদায়েতের ব্যাপারে আল্লাহ রহমত হতে হতাশ হওয়া ঠিক না, কিংবা তাদেরকে বদ দুআ করা ঠিক না। কেননা সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দুআ এবং বদ দুআ; দুটোই কবুল হয়।
এ কারণে নূহ আ’লাইহিস সালাম তাঁর এক কাফির সন্তানের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তার হেদায়েতের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা গেছেন। অনুরূপভাবে, খারাপ সন্তান নিয়ে পরীক্ষায় নিপতিত মুমিনের উচিত তার সন্তানকে বারবার উপদেশ দেওয়া, দ্বীনের দিকে আহবান করা। তাদের হেদায়েতের জন্য দুআ কবুলের মুহূর্তগুলোতে বেশি বেশি দুআ করা।
মহাপ্লাবনের ঠিক পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত নূহ আ’লাইহিস সালাম ‘ইয়াম’ নামক তাঁর এক সন্তানকে কুফুরী থেকে তোওবা করে ঈমান আনার দাওয়াত দিয়েছিলেন,
وَهِيَ تَجۡرِي بِهِمۡ فِي مَوۡجٖ كَٱلۡجِبَالِ وَنَادَىٰ نُوحٌ ٱبۡنَهُۥ وَكَانَ فِي مَعۡزِلٖ يَٰبُنَيَّ ٱرۡكَب مَّعَنَا وَلَا تَكُن مَّعَ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٤٢
“পর্বত সদৃশ তরঙ্গমালার মধ্য দিয়ে তা তাদেরকে নিয়ে বয়ে চলল। তখন নূহ তার পুত্রকে, যে কিনা তাঁদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, তাকে ডাক দিয়ে বলল, “হে আমার পুত্র! আমাদের সঙ্গে আরোহণ কর, কাফিরদের সঙ্গে থেক না।” সুরা হুদঃ ৪২।
তাঁর সন্তান যখন দাওয়াত কবুল না করে হঠকারি প্রদর্শন করে তখন তিনি তাকে আল্লাহর রহমতের আশা এবং শাস্তির ভয় দেখান। কিন্তু সে ছিলো চরম হতভাগাদের একজন।
قَالَ سََٔاوِيٓ إِلَىٰ جَبَلٖ يَعۡصِمُنِي مِنَ ٱلۡمَآءِۚ قَالَ لَا عَاصِمَ ٱلۡيَوۡمَ مِنۡ أَمۡرِ ٱللَّهِ إِلَّا مَن رَّحِمَۚ وَحَالَ بَيۡنَهُمَا ٱلۡمَوۡجُ فَكَانَ مِنَ ٱلۡمُغۡرَقِينَ ٤٣
“সে (অর্থাৎ নূহের পুত্র) বলল, “আমি এক্ষুণি পাহাড়ে আশ্রয় নেব; যা আমাকে পানি থেকে রক্ষা করবে।” নূহ বলল, “আজ আল্লাহর হুকুম থেকে কোন কিছুই রক্ষা করতে পারবে না, অবশ্য আল্লাহ যার প্রতি দয়া করবেন সে রক্ষা পাবে।” অতঃপর ঢেউ তাদের দু’জনার মাঝে আড়াল করল আর সে ডুবে যাওয়া লোকেদের মধ্যে শামিল হয়ে গেল।” সুরা হুদঃ ৪৩।
__________________________
(৭) পিতা-মাতার উচিত তাঁদের সন্তান যেন হেদায়েতের উপরে টিকে থাকে, শিরক থেকে বেঁচে থাকে, নেক হায়াত পেয়ে সৌভাগ্যবান হয় তার জন্য আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দুআ করা।
যেমন আল্লাহর বন্ধু ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ দুআ করেছিলেন,
رَبِّ ٱجۡعَلۡ هَٰذَا ٱلۡبَلَدَ ءَامِنٗا وَٱجۡنُبۡنِي وَبَنِيَّ أَن نَّعۡبُدَ ٱلۡأَصۡنَامَ
“হে আমার রব্ব! আপনি এই (মক্কা) শহরকে নিরাপদ করে দিন এবং আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তি পূজা থেকে বাঁচিয়ে রাখুন।” সুরা ইব্রাহীমঃ ৩৫।
__________________________
(৮) মুমিনদের সফলতা এবং কল্যাণ নিহিত আছে ক্বুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করা, এর বিধি-বিধান অনুসরণ করা, এক কথায় ক্বুরআনকে আঁকড়ে ধরার মাঝে। একারণে পিতা-মাতার উচিত, ছোটবেলা থেকেই সন্তানদেরকে ক্বুরআনওয়ালা বানানোর জন্য চেষ্টা করা এবং ক্বুরআন তিলাওয়াত করার জন্য উপদেশ দেওয়া।
যেমন, আল-আব্বাস বিন আসবাগাহ রহি’মাহুল্লাহ বলেন, মুহাম্মদ বিন ক্বাসিম রহি’মাহুল্লাহ আমাকে বলেছেন, “আমি আমার পিতাকে বললাম, হে আমার পিতা! আমাকে অসীয়ত করুন।” আমার পিতা বললেন, “আমি তোমাকে আল্লাহর কিতাবের ব্যাপারে অসীয়ত করছি। ক্বুরআন থেকে তোমার সৌভাগ্য অর্জনের ব্যাপারে তুমি ভুল করো না এবং প্রতিদিন ক্বুরআন থেকে অন্তত এক পারা তিলাওয়াত করা তোমার নিজের জন্য অত্যাবশ্যক করে নাও।” তারিখ ইলমা’আ আল-আন্দালুসঃ ১/৩৯৮।
__________________________