সায়েন্স ফিকশন, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী।

  • Home
  • Bangladesh
  • Khulna
  • সায়েন্স ফিকশন, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী।

সায়েন্স ফিকশন, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। যারা সায়েন্স ফিকশন পছন্দ করেন তাদের জন্য আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াস

ত্রাতুলের জগৎ - মুহম্মদ জাফর ইকবাল দ্বিতীয় পর্ব _কিডন্যাপশহরতলিতে ছোট একটা রেস্টুরেন্টে আমি কিছু খেয়ে নিলাম–এখানে ভদ্র ...
17/02/2024

ত্রাতুলের জগৎ - মুহম্মদ জাফর ইকবাল

দ্বিতীয় পর্ব

_কিডন্যাপ

শহরতলিতে ছোট একটা রেস্টুরেন্টে আমি কিছু খেয়ে নিলাম–এখানে ভদ্র কিংবা সচ্ছল মানুষরা আসে না। যারা আসে তাদের সবাই সমাজের বাইরের মানুষ অনেকেই মাদকাসক্ত। একটা বড় অংশ আছে যারা ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্কে বড় ক্ষতি করে বসে আছে। অনেকেই চোখ ভালো করে খুলতে পারে না, হাত কিংবা পা নিয়ন্ত্রণের বাইরে কাঁপতে থাকে। কথা জড়িয়ে আসে। ভালো একটা চিকিৎসা কেন্দ্রে কিছু দক্ষ চিকিৎসক রোবট দিয়ে এদের অনেককেই সারিয়ে তোলা সম্ভব কিন্তু এই মানুষগুলোর সে ব্যাপারে উৎসাহ নেই। অনেকের ধারণা তা হলে জোর করে তাদেরকে সাইবর্গে পাল্টে দেওয়া হবে। কোনো মানুষ–তার যত সমস্যাই থাকুক কিছুতেই সাইবর্গ হতে চায় না।

রেস্টুরেন্টে নিরিবিলি খেয়ে আমি আমার শেষ সম্বলের কয়েকটি ইউনিট দিয়ে মূল্য পরিশোধ করে বের হয়ে এলাম। এই এলাকাটি সমাজবহির্ভূতদের এলাকা, চারদিকে আবছা অন্ধকার, আলোগুলো ভেঙে রাখা হয়েছে। আকাশের কাছাকাছি উত্তেজক পানীয়ের একটা বিজ্ঞাপন জ্বলছে এবং নিবছে, তার কিছু আলো এখানে ছড়িয়ে পড়েছে। দিনের বেলায় এই এলাকাটিকে অত্যন্ত নিরানন্দ এবং হতচ্ছাড়া দেখায় কিন্তু রাত্রিবেলায় আধো আলো এবং আধো অন্ধকারে এর মাঝে কেমন জানি এক ধরনের রহস্যের ছোঁয়া লেগেছে।

আমি রাস্তার পাশে উবু হয়ে বসে থাকা একজন মাদকাসক্ত মানুষকে পাশ কাটিয়ে কয়েক পা সামনে গিয়েছি, ঠিক তখন হঠাৎ করে একটি বাইভার্বাল নিঃশব্দে আমার পাশে নেমে এল। আমি কিছু বোঝার আগে তার গোলাকার দরজা খুলে যায় এবং এক জোড়া হাত আমাকে ধরে প্রায় হ্যাঁচকা টানে বাইভার্বালের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। প্রায় সাথে সাথে বাইভার্বালটি শূন্যে উঠে যেতে থাকে, আমি তুরণের প্রকৃতি দেখে বুঝতে পারি এটি খুব দ্রুত সরে যেতে শুরু করেছে।

আমি নিজের জীর্ণ পোশাকটিকে সমান করার চেষ্টা করতে করতে বললাম, এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমাকে ডাকলে আমি স্বেচ্ছায় তোমাদের কাছে যেতাম।

বাইভার্বালের কন্ট্রোল প্যানেলে একটি নিরানন্দ সাইবর্গ বসে আছে, ভেতরে দুজন মানুষ। ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায় দুজনের একজন পুরুষ অন্যজন মহিলা। এক সময় পুরুষ এবং মহিলার শারীরিক পার্থক্যটুকু খুব চড়া সুরে প্রকাশ করা হত–আজকাল খুব তীক্ষ্ণ চোখে পরীক্ষা না করলে সেটি ধরা যায় তার কারণ কী কে জানে। আজ থেকে এক শ বছর বা এক হাজার বছর পরে কীহলে পুরুষ এবং নারীর পার্থক্য কি ঘুচে যাবে, নাকি পুরুষ এবং নারী ছাড়াও অন্য ধরুন প্রজন্মের সৃষ্টি হবে?

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বাইভার্বালের জানালা দিয়ে নিচে তাকালাম, আলোকোজ্জ্বল একটা বড় শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের যে সহজ সৌজন্যতা থাকা উচিত এদের মাঝে তা নেই। আমার সাথে কেউ একটি কথাও বলে নি, কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবে কি কে জানে। তবুও আমি ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাবে?

মানুষ দুজন চুপ করে রইল, ভেবেছিলাম হয়তো উত্তরই দেবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী। ভেবে মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, সেটা তুমি নিজেই দেখবে।

আমার বিনা অনুমতিতে আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসা বেআইনি কাজ।

পুরুষ মানুষটি এবার কাঠকাঠ গলায় হেসে বলল, তোমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই। ইচ্ছে করলে তোমাকে আমি দরজা খুলে নিচে ফেলে দিতে পারি। কেউ কিছু জানবে না।

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি নিশ্চয়ই একটা এন্ড্রয়েড। কারণ একজন মানুষ কেউ জানবে না বলেই কখনোই আরেকজনকে খুন করে ফেলার কথা বলে না।

পুরুষ মানুষটি আমার কথা শুনে খুব ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল, আমার দিকে তার মাথাটা এগিয়ে এনে দাতে দাঁত ঘষে বলল, তুমি যদি একটা মানুষ হতে তা হলে এই কথা বলতাম না। তুমি হচ্ছ অকর্মণ্য, অপদার্থ, মাদকাসক্ত একজন ফালতু মানুষ। তুমি এই সমাজের কোনো কাজে আস না। তুমি দুপুরবেলায় নোংরা একটা ইঁদুরকে কোলে নিয়ে রাস্তায় পা ছাড়িয়ে বসে থাক।

আমি মুখে হাসি টেনে বললাম, সেটাই হয়তো সমাজের প্রতি আমার দায়িত্ব। অকর্মণ্য, অপদার্থ, মাদকাসক্ত, ফালতু হয়ে বেঁচে থাকা–যেন আমাকে দেখে সমাজের অন্যরা সতর্ক হতে পারে। এই সৃষ্টি জগতে তেলাপোকারও একটা ভূমিকা আছে, তুমি জান?

পুরুষ মানুষটি ক্রুদ্ধ গলায় কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু মহিলাটি তাকে নিবৃত্ত করল। বলল, আহ্! কেন খামকা ঝামেলা বাড়াচ্ছ?

নিরাপত্তা বাহিনীর দুজন আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

বাইভার্বালটি একটা ছোট শহরের ওপর একবার পাক খেয়ে নিচে নেমে এল। একটা হ্রদ পার হয়ে ছোট একটা পাহাড়ের পাদদেশে পুরোনো একটা অট্টালিকার পাশে এসে এটি স্থির হয়ে দাঁড়াল। দরজা খোলা মাত্রই আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে নামানোর আগেই আমি নিচে নেমে এলাম। আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে প্রতিরক্ষা বাহিনীর দুজন সদস্য আমার পিছু পিছু হটতে থাকে। বাইরের একটা বড় দরজায় কিছু গোপন কোড এবং রেটিনা স্ক্যান করিয়ে আমাদের ভেতরে ঢোকানো হল। একটা ছোট করিডর ধরে হেঁটে বড় একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সুইচ টিপে ভারী দরজা খোলা হল–ভেতরে নানা বয়সী কিছু মানুষ, চোখের দৃষ্টি দেখেই বোঝা যায় এদের সবাইকে ঠিক আমার মতো করে ধরে আনা হয়েছে। মানুষগুলো কৌতূহলী চোখে আমাদের দিকে তাকাল। আমি কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু তার দরকার হল না।অত্যন্ত রূঢ়ভাবে ধাক্কা দিয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষটি আমাকে ঘরের ভেতরে ঠেলে দিপ্রায় সাথে সাথেই ঘরঘর করে ভারী দরজাটি বন্ধ হয়ে যায়।

ভেতরের মানুষগুলো আমাকে এবং আমি ভেতরের মানুষগুলো যাচাই করে দেখতে শুরু করলাম। ঘরের ভেতর সব মিলিয়ে সাতজন মানুষ–দুজন মেয়ে এবং পাঁচজন পুরুষ। দুটি মেয়েরই চোখের দৃষ্টি অপ্রকৃতিস্থ, দেখে বোঝা যায় ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে মস্তিষ্কের সর্বনাশ করে বসে আছে। দুজন পুরুষকে মনে হল পেশাজীবী অপরাধী, চোখে–মুখে একটু বেপরোয়া ভাব এবং হাতের আঙুলগুলো অদৃশ্য একটি লেজার রাস্টার১২ ধরে রাখার ভঙ্গি করে নড়ছে। অন্য মানুষগুলোকে মনে হল জীবন সম্পর্কে উদাসীন, একজনের মুখে একটু মৃদু হাসি এবং তাকে দেখে মনে হল পুরো ব্যাপারটি দেখে সে ভারি মজা পাচ্ছে। ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে থাকা একটি মেয়ে ঘাড় বাকা করে একটা চোখ ঈষৎ খুলে বলল, তোমার কাছে কি বিভিচুরাস১৩ আছে?

বিডিচুরাসের মতো ভয়ংকর একটি মাদকদ্রব্য পকেটে নিয়ে কারো ঘোরার কথা নয়, কিন্তু মেয়েটি এই ধরনের সহজ যুক্তিতর্কের উপরে চলে গিয়েছে। ঈষৎ খুলে রাখা চোখটি বন্ধ করে অভিযোগ করার ভঙ্গি করে বলল, আমার স্টিমুলেটরটি নিয়ে গেছে।

পেশাজীবী অপরাধীদের একজন জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে টিটকারি দিয়ে বলল, বড় অন্যায় করেছে!

মেয়েটি তার কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে বিড়বিড় করে অনেকটা নিজের সাথে কথা বলতে থাকে। মুখে মৃদু হাসি লেগে থাকা মানুষটি তার মুখের মৃদু হাসিকে একটু বিস্তৃত করে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে কেন এনেছে?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, জানি না।

তুমি কি কোনো অপরাধ করেছ?

এভাবে ধরে নিয়ে আসার মতো কোনো অপরাধ করি নি।

মানুষটি সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, তার মানে ছোটখাটো কিছু একটা করেছ।

তা করেছি। ট্রাকিওশানটা বের করে ফেলেছি।

উপস্থিত যারা ছিল তাদের প্রায় সবাই আমার দিকে ঘুরে তাকাল। পেশাদার অপরাধীর মতো মানুষটি অদৃশ্য লেজার ব্লাস্টারের ট্রিগার ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তুমি ওস্তাদ মানুষ!

আমি তার কথায় কোনো উত্তর দিলাম না। মানুষটি তার ডান হাত দিয়ে গলায় পোচ দেবার ভঙ্গি করে বলল, কিন্তু ধরা পড়ে গেছ ওস্তাদ, এখন তুমি শেষ।

দ্বিতীয় পেশাদার অপরাধীটি বলল, তোমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটেকুটে নিয়ে নেবে।

কিংবা একটা বেকুব সাইবর্গ বানিয়ে ফেলবে।

কিংবা তোমাকে শীতল ঘরে নিয়ে রেখে দেবে। দ্বিতীয় পেশাদার অপরাধীটি দুলে দুলে হাসতে হাসতে বলল, হয়তো তোমাকে ভিনজগতের মহাকাশের প্রাণীর কাছে বিক্রি করে দেবে।

আমি এই অর্থহীন কথোপকথনে যোগ দিলাম না আমি নিশ্চিত বাইরে থেকে আমাদের প্রত্যেকটি কাজকর্ম, অঙ্গভঙ্গি খুব যত্ন করে লক্ষ করা হচ্ছে, ঠিক কী কারণ জানি না, আমার মনে হল এই দলটির মাঝে নিজেকে আলাদা করে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলায় বিপদের ঝুঁকি আছে। আমি নীরবে এক কোনায় গিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। মুখে মৃদু হাসি লেগে থাকা দার্শনিকের মতো মানুষষ্টি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মন খারাপ করার কিছু নেই, এরা বেশ ভালো যত্ন করে। এখানকার খাবার খুব ভালো।

ভেতরে কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। একটা নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাবার পর যখন হাল ছেড়ে দেওয়া হয় তখন হঠাৎ করে সময়ের আর কোনো গুরুত্ব থাকে না। আমাকে যখন ডেকে নেওয়া হল তখন আমি অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছি–ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি যে আমি একটা বিশাল অরণ্যে হারিয়ে গেছি, যেদিকেই যাই সেদিকেই একটা বিশাল বৃক্ষ আমার পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার পোশাক ধরে খুব রূঢ়ভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে আমাকে ঘুম থেকে তোলা হল, আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন মানুষ বলল, চলো।

কোথায় জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ হবে না বলে আমি কিছু জিজ্ঞেস করলাম না, নীরবে উঠে দাঁড়ালাম। আমি যখন ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম তখন অন্য মানুষগুলো এক ধরনের নিরুত্তাপ নিস্পৃহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমাকে একটি লম্বা করিডর ধরে হটিয়ে ছোট একটি কিউবিকেলে নেওয়া হল। সেখানে আমাকে নগ্ন হতে হল এবং আমি বুঝতে পারলাম এক ধরনের আঁজালো জীবাণুনাশক দিয়ে আমাকে পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। আমার সমস্ত শরীরকে স্ক্যান। করা হল, নানা ধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে আমার শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ঘুঁটিনাটি পরীক্ষা করা হল, জিনেটিকে কোডিং করে নেওয়া হল, মেটাবলিজমের হার নির্ধারণ করা হল এবং সবশেষে নিওপলিমারের একটি পোশাক পরিয়ে একটি বড় হলঘরে পৌঁছে দেওয়া। হল, সেখানে আমি প্রথমবার একজন সত্যিকারের মানুষ দেখতে পেলাম। মানুষটি একজন। কমবয়সী মেয়ে। তার সোনালি চুল এবং আকাশের মতো নীল চোখ। মেয়েটি সুন্দর করে হেসে বলল, আশা করছি তোমার কোনো অসুবিধে হয় নি।

আমি নিচু গলায় বললাম, হলেই সেটি নিয়ে কে মাথা ঘামাচ্ছে!

তোমাকে কী বলে ডাকব? তোমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–তোমার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।

আমি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, কিছু জান না বলেই তো আমাকে এনেছ। কী করবে করে ফেল–শুধু শুধু নামপরিচয় জেনে কী হবে?

মেয়েটির চোখে–মুখে এক ধরনের বিস্ময়ের ছায়া পড়ল, এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, আমার নাম জানা। আমি এখানকার চিকিৎসা কেন্দ্রের দায়িত্বে আছি।

আমার নাম ভ্রাতুল। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, এটা আমার সত্যিকারের নাম।

মেয়েটি সুন্দর করে হেসে বলল, সত্যিকারের নাম না হলেও আমি কখনো জানব না।

মেয়েটির কথাবার্তায় এক ধরনের সহৃদয়তার ছোঁয়া পেয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে তোমরা কেন এনেছ?

মেয়েটি একটু বিব্রত হয়ে বলল, আমি সত্যিই জানি না। মাঝে মাঝেই আমাকে কিছু মানুষকে পরীক্ষা করে তার শারীরিক অবস্থার একটা রিপোর্ট দিতে হয়। এর বেশি আমি কিছু জানি না। ক্রানা নামের মেয়েটি ইতস্তত করে থেমে গেল–মেয়েটি নিশ্চয়ই আরো কিছু জানে কিন্তু আমাকে বলতে চাইছে না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমার সম্পর্কে কী রিপোর্ট দিয়েছ?

তুমি নীরোগ স্বাস্থ্যবান হাট্টাকাট্টা একজন যুবক।

এবং—

এবং কী?

এবং মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করে একটি ট্রাইকিনিওয়াল বসানো সম্ভব।

মেয়েটি আমার কথা শুনে ভয়ানকভাবে চমকে উঠল, অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তু–তু–তুমি কীভাবে জান?

জানি না। অনুমান করছি। আমাকে যেভাবে জীবাণুমুক্ত করা হল তাতে মনে হচ্ছে। সম্ভবত শরীরে কোনো অস্ত্রোপচার করা হবে। মাথার পেছনে মনে হচ্ছে খানিকটা জায়গায় একটু বেশি করে চুল কেটেছে। এরকম জায়গায় ট্রাইকিনিওয়াল বসায়। তাই অনুমান করছি।

মেয়েটি কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, আমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–কাজেই আমাকে নিয়ে তোমরা যা। খুশি করতে পার। ভয়ংকর কোনো এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে আমার থেকে ভালো একজন মানুষ কোথায় পাবে? কারো কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই–একেবারে নিখুঁত একটি গিনিপিগ।

মেয়েটি নিচু গলায় বলল, শরীর থেকে ট্রাকিওশান সরিয়ে তুমি খুব ভুল করেছ ভ্রাতুল।

আমি মাথা নাড়লাম, তুমি ঠিকই বলেছ জানা। কিন্তু সেজন্যে আমার কোনো দুঃখ নেই–আমি জেনেশুনেই এই ভুলটা করেছি।

ক্রানা আমাকে যে কয়েকজন মানুষের কাছে পৌঁছে দিল তাদের চেহারা কঠোর এবং আনন্দহীন। অপারেশন থিয়েটারের মতো নানা ধরনের যন্ত্রপাতি বোঝাই একটা ঘরের মাঝামাঝি একটি স্বচ্ছ ধাতব টেবিলে শুইয়ে আমার দুটি হাত এবং পা স্ক্র্যাপ দিয়ে বেঁধে ফেলল। এখানে আপত্তি বা প্রশ্ন করার মতো কোনো সুযোগ বা পরিবেশ নেই। একটা চিকিৎসক বরাবট আমার মাথাকে গোলাকার একটা টিউবে আটকে দেওয়ার সময় আমি মরিয়া হলে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কী করছ?

আনন্দহীন চেহারার মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বলল, একটু পরেই জানতে পারবে।

আমি মানুষটির চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে বললাম তোমার নাম কী?।

আমার প্রশ্ন শুনে মানুষটি খুব অবাক হল। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, নাম? নাম দিয়ে তুমি কী করবে?

কৌতূহল।

কৌতূহল সংবরণ কর যুবক।

আমার নাম ত্রাতুল।

তোমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–কাজেই তোমার নাম ত্ৰাতুল না হয়ে কোলি ব্যাক্টেরিয়া হলেও কিছু আসে যায় না।

আমি নিচু গলায় বললাম, কিন্তু আমি একজন মানুষ।

মানুষ? হঠাৎ করে নিরানন্দ চেহারার মানুষটি আনন্দহীন গলায় হাসতে শুরু করল।

মানুষটির ভব্যতাবিবর্জিত পুরোপুরি হৃদয়হীন আচরণটিতে আমি হঠাৎ করে এক ধরনের আকর্ষণ খুঁজে পেতে শুরু করলাম। চিকিৎসক রোবটটি যখন আমার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করার জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করছিল আমি তখন ভেতরের মানুষগুলোকে তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে পরীক্ষা করতে থাকি। হৃদয়হীন নিরানন্দ মানুষটির চেহারায় কোথায় যেন সরীসৃপের সাথে একটু মিল রয়েছে, হয়তো তার শীতল ভাবলেশহীন মুখ হয়তো উঁচু কণ্ঠার হাড় বা ফ্যাকাসে এবং বিবর্ণ মুখাবয়ব।

দ্বিতীয় মানুষটির অগোছালো চেহারা এবং চেহারার মাঝে এক ধরনের বিরক্তির ভাব পাকাপাকিভাবে লেগে আছে। মানুষুটির চুল লালচে এবং মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তৃতীয় মানুষটি সম্ভবত মহিলা কিন্তু তাকে দেখে সেটি নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। চিকিৎসক রোবটটি যখন আমার মাথাটিকে বিশেষ গোলাকৃতি একটি হেলমেটের মতো যন্ত্রের মাঝে শক্ত করে আটকে ফেলার চেষ্টা করছিল তখন এই তিনজন মানুষ কয়েকটি ভিন্ন। ভিন্ন যন্ত্রের সামনে বসে কোনো একটি কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

একসময় সরীসৃপের মতো দেখতে নিরানন্দ চেহারার মানুষটি বলল, আমার সিস্টেম প্রস্তুত। পুরোটি চার্জ করা হয়েছে।

লালচে চুলের অগোছালো চেহারার মানুষটি এক ধরনের বিরক্তির ভাব নিয়ে বলল, আমিও প্রস্তুত। ডাটা সারিবদ্ধ করা হয়েছে।

মহিলা বলে যাকে সন্দেহ করছিলাম সে প্রথমবার মুখ খুলল, চিকিৎসক রোবটটিকে বলল, কাজ রু কর, ইলেনা। তার কণ্ঠস্বর শুনে আমি এবারে নিঃসন্দেহ হলাম, মানুষটি আসলেই মহিলা।

আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু বুঝতে পারলাম রোবটটি আমার মাথার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার মাথার পেছনে শীতল কিছু একটা স্পর্শ করল এবং হঠাৎ করে সেখানে প্রচণ্ড শক্তিতে কিছু আঘাত করল, আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। হঠাৎ করে মনে হল আমার সমস্ত চেতনা বুঝি লোপ পেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি চেতনা হারালাম না, মাথার পেছন দিয়ে কিছু একটা আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করানো শুরু করেছে। আমার দুটি হাত হঠাৎ করে আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। সমস্ত শরীরে আমি অপ্রতিরোধ্য এক ধরনের খিচুনি অনুভব করতে শুরু করলাম। আমার চোখের সামনে পরিচিত জগৎ হঠাৎ করে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। বিচিত্র কিছু নকশা, আশ্চর্য উজ্জ্বল কিছু রঙ চোখের সামনে খেলা করতে থাকে, সেগুলো নড়তে থাকে এবং মিলিয়ে যেতে থাকে, আমি উচ্চ কম্পনের কিছু শব্দ শুনতে থাকি এবং তার তীক্ষ্ণ ধ্বনি আমাকে অস্থির করে তোলে। হঠাৎ করে চারদিক নীরব হয়ে আসে, সেই ভয়ংকর নীরবতায় আমার সারা শরীর শিউরে ওঠে। আমি চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করি কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না, মনে হয় চারদিকে কুচকুচে কালো অন্ধকার। আমি নিজের ভেতরে এক ধরনের গভীর বিষণ্ণতা অনুভব করতে থাকি, এক গভীর বিচিত্র হতাশা সমস্ত পৃথিবী, জগৎসংসার সৃষ্টি জগতের সবকিছুর প্রতি এক অতিমান এক ধরনের তীব্র দুঃখবোধে আমার বুকের ভেতর হাহাকার করতে থাকে। হঠাৎ করে আমার মনে হতে থাকে কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি। তাতেও কিছু আসে যায় না। এই জগৎসংসার, এই পৃথিবী, এই সৃষ্টি জগৎ বেঁচে আছে ধ্বংস হয়ে গেছে তাতেও কিছু আসে যায় না। আমি আমার সমস্ত চেতনাকে অদৃশ্য কোনো একটি অস্তিত্বের কাছে সমর্পণ করে গভীর এক ধরনের শূন্যতায় নিমজ্জিত হয়ে গেলাম।

ত্রাতুলের জগৎ - মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রথম পর্ব ট্রাকিওশানহীন একজন যুবকদুপুরবেলা এই এলাকাটিতে মানুষ, সাইবর্গ, এন্ড্রয়েড আ...
17/02/2024

ত্রাতুলের জগৎ - মুহম্মদ জাফর ইকবাল

প্রথম পর্ব

ট্রাকিওশানহীন একজন যুবক

দুপুরবেলা এই এলাকাটিতে মানুষ, সাইবর্গ, এন্ড্রয়েড আর রোবটের একটা ছোটখাটো ভিড় জমে যায়। বেশিরভাগ মানুষের চেহারায় ব্যস্ততা আর উদ্বেগের ছাপ থাকে। কারো কারো চেহারায় থাকে ক্লান্তি, অবসাদ, এমনকি হতাশা। ক্বচিৎ এক-দুজনকে তারুণ্য বা ভালবাসার কারণে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে থাকতে দেখি, তাদের দেখতে আমার বড় ভালো। লাগে–আমি এক ধরনের লোভাতুর দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। সাইবর্গগুলোর চেহারায় সব সময় এক ধরনের বিভ্রান্তির ছাপ থাকে। তাদের মানুষ অংশটি প্রতিনিয়ত যন্ত্র অংশটির সাথে এক ধরনের অদৃশ্য সংঘাতের মাঝে আটকা পড়ে আছে, সেই সংঘাতের। ছাপটি তাদের চোখে–মুখে ফুটে থাকে। তাদের ভুরু হয় কুঞ্চিত, চোখে থাকে ক্রোধের ছায়া। তাদের পদক্ষেপ হয় দ্রুত এবং অবিন্যস্ত। আমার কাছে সবচেয়ে হাস্যকর মনে হয় এন্ড্রয়েডগুলোকে, তাদের চেহারা মানুষের মতো, সেই কথাটি মনে হয় তারা এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না। সব সময়ই তারা মুখে একটা মানবিক অনুভূতির চিহ্ন ফুটিয়ে রাখতে চায়–সেই অনুভূতিটি হয় চড়া সুরে বাধা। যখন ক্লান্তির ছাপ থাকার কথা তখন তাদের মুখে আসে গভীর অবসাদের চিহ্ন, যখন হালকা আনন্দ থাকার কথা তখন তাদের চোখে–মুখে আসে মাদকাসক্ত মানুষের বেপরোয়া উত্তেজনা, যখন বিরক্তির চিহ্ন থাকার কথা তখন তাদের মুখে থাকে দুর্দমনীয় ক্রোধের ছাপ! সেই তুলনায় রোবটগুলোকে দেখে অনেক। বেশি স্বস্তি অনুভব করি। তাদের চেহারা যান্ত্রিক এবং ভাবলেশহীন, তাদের কাজকর্ম বা ভাবভঙ্গিতে কোনো জটিলতা নেই, তাদের আচার-আচরণে কোথায় যেন একটি শিশু বা। পোষা কুকুরের সারল্য রয়েছে। আমি তাদের সাহচর্যকে পছন্দ করি না কিন্তু দূর থেকে দেখে এক ধরনের ছেলেমানুষি কৌতুক অনুভব করি।

আমার মনে হয় আমাকে দেখেও এই রোবট, এন্ড্রয়েড, সাইবর্গ বা মানুষগুলোর কপোট্রনে বা মনে বিচিত্র ভাবনার উদয় হয়। আমি সুউচ্চ সহস্রতল অট্টালিকার দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকি। এই রাস্তায় দুটো ইঁদুর, একটি কবুতর এবং কয়েকটি চড়ুই পাখির সাথে আমার ভাব হয়েছে। দুপুরে খাবার সময় আমি কিছু রুটির টুকরো ছড়িয়ে দিই এবং এই প্রাণীগুলো এক ধরনের আগ্রহ নিয়ে সেগুলো খায়। তাদের একেবারে সোজাসাপ্টা কাড়াকাড়ি করে খাওয়া দেখতে আমার এক ধরনের আনন্দ হয়। প্রাণীগুলো আজকাল আমাকে ভয় পায় না, আমার আস্তিনের নিচে নির্বিবাদে লুকিয়ে থাকে কিংবা আমার কাঁধে বসে কিচিরমিচির করে ডাকাডাকি করে। এই এলাকার রোবটগুলো ভাবলেশহীন মুখে আমাকে লক্ষ করে, কিন্তু তাদের সবুজ ফাটাসেলের চোখে আলোর তারতম্য দেখে আমি বুঝতে পারি তাদের কপোট্রনে খানিকটা হলেও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় এবং তারা নিজেদের ভেতরে কোনো একটা হিসাব মেলাতে পারে না। একজন অল্পবয়সী মানুষের সুউচ্চ অট্টালিকার দেওয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে থাকার কথা নয়, তার শরীরের ওপর দিয়ে পশুপাখির ছোটাছুটি করার কথা নয়। রোবটগুলো কখনোই আমাকে বিরক্ত করে নি কিন্তু সাইবর্গ এবং এন্ড্রয়েডগুলো মাঝে মাঝেই থমকে দাঁড়িয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেছে, কখনো কখনো অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য কিংবা ক্রোধ প্রকাশ করেছে। আমাকে দেখে মানুষেরা অবিশ্যি সব সময়ই সহজাত সৌজন্যের কারণে নিজেদের অনুভূতি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেটি কখনো গোপন থাকে নি। আমি বুঝতে পারি তারা আমার জন্যে এক ধরনের কণা এবং অনুকম্পা অনুভব করছে। প্রাচীনকালে মানুষ মানসিক রোগাক্রান্ত হয়ে জীবনবিমুখ হয়ে যেত–গত কয়েক শতাব্দীতে তার কোনো উদাহরণ নেই। এখন যারা সমাজের প্রচলিত নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাস্তার পাশে পা ছড়িয়ে বসে পাখির সাথে কিংবা ইঁদুরের সাথে বসবাস করে তারা পুরোপুরি নিজের ইচ্ছেতেই করে। এটি এক ধরনের বিদ্রোহ, যে বিদ্রোহের কারণ জানা নেই। মানুষ সেই বিদ্রোহকে ভয় পায়, সেই বিদ্রোহীর জন্যে করুণা অনুভব করে।

আমি মানুষের করুণামিশ্রিত অনুকম্পার দৃষ্টি দেখে কিছু মনে করি না। কারণ আমি জানি আমি আমার চারপাশের এই অসংখ্য মানুষ, সাইবর্গ, এন্ড্রয়েড বা রোবট থেকে অনেক ভালো জীবন পেতে পারতাম, কিন্তু সেই জীবনে আমার কোনো আকর্ষণ নেই। আমি দেখেছি সেই জীবন প্রকৃতপক্ষে অর্থহীন– প্রতিটি মানুষের জীবন এত সুনির্দিষ্ট, এত গতানুগতিক যে সেটি একটি সাজানো নাটকের মতো। আমি সেই সাজানো রঙ্গমঞ্চের অভিনেতা হতে চাই নি। তাই একদিন শহরের কমিউনিটি কেন্দ্রে গিয়ে অভ্যর্থনা ডেস্কের মেয়েটিকে বলেছিলাম, আমি আমার ট্রাকিওশানটি ফিরিয়ে দিতে চাই।

মেয়েটি আমার কথা বুঝতে পারল বলে মনে হল না, খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ট্রাকিওশান! ফিরিয়ে দেবে?

মেয়েটির মুখ দেখে আমি এক ধরনের কৌতুক অনুভব করলাম, মনে হল আমার কথা শুনে সে আকাশ থেকে পড়েছে। আমি মুখে হাসি টেনে এনে বললাম, তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি মনে করছ ট্রাকিওশান নয়, আমি বুঝি আমার মস্তিষ্ক ফিরিয়ে দিতে এসেছি।

মেয়েটি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, সেটা বরং আমি বুঝতে পারতাম। আজকাল জীবন এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে মাঝে মাঝে মনে হয় মস্তিষ্ক ছাড়াই দিন বেশ কেটে যাবে! কিন্তু ট্রাকিওশান–ট্রাকিওশান ছাড়া তুমি কেমন করে থাকবে?

আমার ধারণা খুব আনন্দে থাকব।।

মেয়েটি ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কি মাদকাসক্ত?

না। আমি এই মুহূর্তে মাদকাসক্ত নই। আমি পুরোপুরি সুস্থ মানুষ। আমার ট্রাকিওশানটি পরীক্ষা করলে তুমি দেখবে আমি মানুষটি খুব গবেট নই।

তা হলে কেন ট্রাকিওশান ফেরত দিতে চাইছ? তখন তোমাকে খুঁজে পাবার কোনো উপায় থাকবে না। তোমার যদি কোনো জরুরি প্রয়োজন হয় যদি কোনো বিপদ হয়

ঠিক সেজন্যেই ফেরত দিতে চাইছি। আমি মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বললাম, সব সময়ই কেউ না কেউ আমার ওপর নজর রাখছে, সেটা চিন্তা করলেই আমার রক্তচাপ বেড়ে যায়। আমি স্বাধীনভাবে থাকতে চাই।

মেয়েটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, স্বাধীনভাবে?

হ্যাঁ! প্রাচীনকালের মানুষের শরীরে ট্রাকিওশান ঢুকিয়ে দেওয়া হত না। তারা দিব্যি বেঁচে ছিল।

কিন্তু প্রাচীনকালের মানুষেরা নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলত। অদ্ভুত সব ভাইরাস আবিষ্কার করে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ মেরে ফেলেছিল। মানুষকে ক্লোন করতে গিয়ে

মেয়েটিকে আমি যতটুকু বুদ্ধিমতী ভেবেছিলাম সে তার থেকে বেশি বুদ্ধিমতী– ইতিহাসের অনেক খবর রাখে। তাই আমি যুক্তিতর্কের দিকে অগ্রসর না হয়ে বললাম, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু প্রাচীনকালের মানুষেরা সবাই সেরকম নির্বোধ ছিল না। তাদের মাঝেও অনেক ধাটি মানুষ ছিল। প্রথম আন্তঃনক্ষত্র অভিযানের ইতিহাসটুকু পড় নি? মানুষ সেখানে কী রকম বিপদের ঝুঁকি নিয়েছিল তুমি জান?

মেয়েটা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি বিপদের ঝুঁকি নিতে চাও?

ইচ্ছে করে নিতে চাই না। কিন্তু একটা ট্রাকিওশান আমাকে সব সময় চোখে চোখে রাখছে, একটা হাঁচি দিলেও দুটি বাইভার্বালে করে তিনটি চিকিৎসক রোবট পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমি সেরকম অবস্থা থেকে মুক্তি চাই।

মেয়েটা একটা ছোট যোগাযোগ মডিউল অন্যমনস্কভাবে হাত বদল করে বলল, এটা নিশ্চয়ই বেআইনি?

আমি মাথা নাড়লাম, না, বেআইনি না। যারা চার মাত্রার অপরাধী তাদের জন্যে বেআইনি। আমার রেকর্ড একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। ক্রিস্টালের মতো স্বচ্ছ।

মেয়েটা হাল ছাড়ল না, বলল, কিন্তু এটা শরীরের ভেতর থেকে বের করতে হলে নিশ্চয়ই চিকিৎসা কেন্দ্রে যেতে হবে। চিকিত্সক রোবট লাগবে

তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি মধুরভাবে হেসে বললাম, তোমার চোখের সামনে আমি আমার হাতের চামড়া কেটে ট্রাকিওশানটা বের করে দেব।

মেয়েটা এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল এবং আমি কিছু বলার আগেই সামনে রাখা একটা বোম স্পর্শ করে বলল, তুমি একটু দাঁড়াও, আমি দুজন প্রতিরক্ষা রোবটকে ডাকি।

আমি রোবটের সাহচর্য একেবারেই পছন্দ করি না। মানুষ–বড়জোর সাইবর্গকে আমি সহ্য করতে পারি কিন্তু ঠিক কী কারণ জানি না, আমি রোবটকে একেবারেই সহ্য করতে পারি না। আমি একটু ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম, তুমি শুধু শুধু রোবটকে ডেকে পাঠালে। শুধু খানিকটা যন্ত্রণা বাড়ালে।

যন্ত্রণা বাড়ালাম? মেয়েটি একটু উষ্ণ হয়ে বলল, তোমার যদি কিছু একটা হয়?

আমি চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেলাম দুটি কদাকার রোবট দ্রুত পায়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। কপালের পাশে কোম্পানির ছাপ এবং নম্বর, এগুলো চতুর্থ প্রজন্মের হাইব্রিড। কপোট্রনের নিউরাল নেটওয়ার্কে এদের তিন মাত্রার নিরাপত্তা বন্ধনী। রোবট দুটি নিঃশব্দে আমার দুপাশে এসে দাঁড়াল। আমি না তাকিয়েই বুঝতে পারি তাদের ফটোসেলের। চোখ তেইশ থেকে সাতচল্লিশ হার্টজে কাঁপতে শুরু করেছে। আমাকে রক্ষা করার জন্যে। এসেছে কিন্তু ব্যাপারটি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হয় নি আমাকে বিপদে ফেলে দেওয়া এদের জন্যে বিচিত্র কিছু নয়। ঝুঁকি নেওয়া আমার কাছে নিরাপদ মনে হল না। আমি মেয়েটির দিকে ঝুঁকে বললাম, গুগোলপ্লেক্স।

গুগোলপ্লেক্স? মেয়েটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি মাথা নাড়লাম, কিংবা স্কুয়ের সংখ্যা। সেটিও হতে পারে।

কী হতে পারে?

স্মৃতির বিভেদ। ট্রানসেন্ডেন্টাল সংখ্যার উদাহরণ হতে পারে। এক চার এক পাঁচ নয় দুই ছয় পাঁচ তিন পাঁচ…

আমি প্রথম ত্রিশটা সংখ্যা বলা মাত্রই রোবট দুটি চাপা স্বরে গর্জন করে উঠল। বলল, খবরদার। তুমি থামো।

আমি থামলাম না, দ্রুত পরের দশটি সংখ্যা উচ্চারণ করলাম এবং প্রায় সাথে সাথে ম্যাজিকের মতো কাজ হল। রোবট দুটি একেবারে মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল। আমি ঝুঁকি নিয়ে সহস্রতম অংশ থেকে আরো দশটি সংখ্যা উচ্চারণ করে রাখলাম। মেয়েটি বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?

বিশেষ কিছু না। আমি রোবট দুটোকে অচল করে রাখলাম।

মেয়েটি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বলল, অচল করে রাখলে? কীভাবে?

তুমি যদি এই লাইনের লোক না হও তা হলে বুঝবে না। সব কপোট্রনেরই কিছু না কিছু সমস্যা থাকে। টেস্ট করার জন্যে রোবট কোম্পানিরা কিছু ফাঁকফোকর রেখে দেয়। সেগুলো গোপন থাকে না–বের হয়ে যায়। সেটা জানতে হয়–হিসাব করে সেটা ব্যবহার করা যায়।

কিন্তু–কিন্তু–।

আমি মেয়েটাকে বাধা দিয়ে বললাম, এই রোবট দুটি বেশিক্ষণ অচল থাকবে না। এক্ষুনি আবার সিস্টেম লোড করে নেবে। কাজেই আমার বেশি সময় নেই। আমি পকেট থেকে ছোট এবং ধারালো একটা চাকু বের করে হাতের ভেতরের দিকে নরম চামড়াটা একটু চিরে ফেলতেই সেখানে এক বিন্দু রক্ত বের হয়ে এল। রক্তের ওপর ছোট ট্রাকিওশানটি ভাসছে, খুব ভালো করে না তাকালে সেটি দেখা যায় না। আমি চাকুর মাথায় সাবধানে সেটি তুলে নিয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিলাম। বললাম, এই যে আমার ট্রাকিওশান।

মেয়েটি কী করবে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ট্রাকিওশানটি খুব সাবধানে তার কোয়ার্টজের ডেস্কের ওপর রেখে বললাম, সাবধানে দেখে রেখো–হারিয়ে গেলে বিপদে পড়বে।

মেয়েটি ঠিক তখনো বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। আমার দু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোবট দুটির দিকে তাকিয়ে আমার দিকে ঘুরে তাকাল, বলল, তুমি যে কোনো রোবটকে অচল করে দিতে পার?

না। যে কোনো রোবটকে পারি না। নতুন সিস্টেম বের হলে একটু সময় লাগে।

কীভাবে কর?

চেষ্টাচরিত্র করে। কপোট্রনের গঠন জানা থাকলে পারা যায়। আমি মুখে হাসি টেনে বললাম, তুমি চাইলে তোমাকেও শিখিয়ে দিতে পারি! তৃতীয় প্রজন্মের যোগাযোগ রোবট খুব সোজা। একটা লাল কার্ড নেবে আরেকটা সবুজ। লাল কার্ডটা চোখের সামনে দুবার নাড়াবে তারপর সবুজ কার্ড একবার। তারপর বলবে দোহাই দোহাই এন্ড্রোমিডার দোহাই–নয়ের পর সাত চাই।

নয়ের পর সাত?

হ্যাঁ। দেখবে রোবট ফেঁসে গেছে। পুরো আড়াই মিনিট। আমি মুখে হালকা গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললাম, তবে সাবধান। আমি যতদূর জানি ব্যাপারটা হালকাভাবে বেআইনি। রোবটগুলোর মেমোরিতে থাকে না তাই ধরতে পারে না।

আমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোবটটার সবুজ ফাটাসেলের চোখে হালকা আলোর বিচ্ছুরণ দেখতে পেলাম, যার অর্থ সেগুলো তাদের সিস্টেম লোড করতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই সেগুলো জেগে উঠবে আমাকে তার আগেই চলে যেতে হবে। আমি ডেস্কের ওপর পাশে বসে থাকা মেয়েটির দিকে চোখ মটকে বললাম, বিদায়!

কিন্তু কিন্তু

মেয়েটি আরো কিছু একটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই আমি বড় হলঘর পার হয়ে বাইরে চলে এসেছি। আমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–আমার সাথে এই মেয়েটি আর কোনোদিন যোগাযোগ করতে পারবে না। শুধু এই মেয়েটি নয়, পৃথিবীর আর কেউই যোগাযোগ করতে পারবে না।


চড়ুই পাখিটি আমার কাঁধ থেকে নেমে আমার হাতের তালুতে আশ্রয় নিয়ে হাত থেকে খুঁটে খুঁটে কয়েকটি শস্যদানা খাচ্ছিল, ঠিক এরকম সময়ে আমার সামনে ক্রুদ্ধ চেহারার একটি সাইবর্গ দাঁড়িয়ে গেল। তার মাথার ডানপাশে মস্তিষ্কের ভেতর থেকে কিছু। টিউব বের হয়ে এসেছে। বাম চোখটি কৃত্রিম, সেখানে ঘোলা লাল রঙের একটা আলো। সাইবর্গের দাঁতগুলো ধাতব। সে এক ধরনের যান্ত্রিক গলায় বলল, তুমি কে? তুমি এখানে কী করছ?

আমি তার দিকে না তাকিয়ে বললাম, তুমি কে? তুমি এখানে কী করছ–আমি কি সেটা জানতে চেয়েছি?

সাইবর্গটি ধাতব গলায় বলল, না।

তা হলে তুমি কেন জানতে চাইছ?

এটি স্বাভাবিক নয়। পৃথিবীর সব মানুষকে তার দায়িত্ব পালন করতে হয়। তুমি তোমার দায়ি

আমি একটু কৌতূহল নিয়ে সাইবর্গটির দিকে তাকালাম, মস্তিষ্ক থেকে বের হওয়া টিউবগুলোতে কোম্পানির ছাপ দেওয়া রয়েছে। এটি সপ্তম প্রজন্মের ইন্টারফেস, এই সাইবর্গটির সিস্টেম অত্যন্ত ক্রটিপূর্ণ। আমি ইচ্ছে করলে চোখের পলকে এটিকে বিকল করে দিতে পারি। যন্ত্র অংশটি বিকল করে দেওয়া হলে তার মানব অংশটি কী করে আমার খুব জানার ইচ্ছে হল, কিন্তু আমি জোর করে আমার কৌতূহলকে নিবৃত্ত করলাম। শহরের মাঝামাঝি এলাকায় ভর দুপুরবেলা আমি একটা হট্টগোল শুরু করতে চাই না। কিন্তু সাইবর্গটি নাছোড়বান্দার মতো লেগে রইল, কণ্ঠস্বর এক ধাপ উঁচু করে বলল, তুমি এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি।

না দিই নি।

কেন?

কারণ প্রথমত আমার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়ত, আমি যদি উত্তর দিই তুমি সেটা বুঝবে না।

কেন বুঝব না?

কারণ তুমি একটা সাইবর্গ। সাইবর্গের বুদ্ধিমত্তার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। একটা বিশেষ ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে সাইবর্গ তৈরি করা হয়েছিল এবং আমার ধারণা সেই উদ্দেশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

সাইবর্গটি তার গলার স্বর আরো এক ধাপ উঁচু করে আরো উষ্ণ হয়ে বলল, তুমি কেন এই কথা বলছ?

কারণ তুমি সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে আমার সময় নষ্ট করছ। তোমার চেঁচামেচির কারণে আমার পোষা ইঁদুরটি লুকিয়ে গেছে। চড়ুই পাখিটি উড়ে ঐ বিল্ডিঙের কারনিসে বসে আছে। তুমি দূর হও।

সাইবর্গটি প্রায় মারমুখী হয়ে বলল, তুমি কেন আমার সাথে অপমানসূচক কথা বলছ? আমি তোমার সম্পর্কে মূল তথ্যকেন্দ্রে রিপোর্ট করে দেব।

আমার এবারে একটু ধৈর্যচ্যুতি হল–কাজেই আমি সাইবর্গটির চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ধু–ধু একটা প্রান্তর তার ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা পাথর গড়িয়ে যাচ্ছে।

সাইবর্গটির ভালো চোখটিতে হঠাৎ একটি আতঙ্ক ফুটে উঠল। কাঁপা গলায় বলল, কেন তুমি এ কথা বলছ?

পাথরটা ছয় টুকরো হয়ে গেছে। এখন ছয়টি ধু–ধু প্রান্তর। তার মাঝে ছয়টা পাথর গড়িয়ে যাচ্ছে।

সাইবর্গটা চিৎকার করে বলল, না, না–তুমি চুপ কর।

আকাশে তখন বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের রঙ নীল।

আমার কথা শেষ হবার আগেই সাইবর্গটি হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল এবং আমি তখন কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। যন্ত্রের অংশটি অচল হবার পর নিশ্চয়ই তার ভেতরের মানুষটি কাঁদছে। একটি সাইবর্গের ভেতরের মানুষটি কি সব সময়ই এরকম বিষণ্ণ এবং হতাশাগ্রস্ত? আমি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম তুমি কেন কাঁদছ?

আমাকে মুক্তি দাও। দোহাই তোমার

আমি তোমাকে কেমন করে মুক্তি দেব?

আমি কিছু একটা কথা বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। আমাকে ঘিরে ছোট একটা ভিড় জমে উঠেছে। বেশ কয়েকটি রোবট, সাইবর্গ এবং এন্ড্রয়েড দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে কিছু মানুষও রয়েছে।

কঠোর চেহারার একটি এন্ড্রয়েড বলল, এই মানুষটি মেটাকোড ব্যবহার করেছে।

আরো একটি এন্ড্রয়েড তাদের অভ্যাসমতো বাড়াবাড়ি বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, সত্যি?

হ্যাঁ। আমি নিজে শুনেছি।

নিরাপত্তা কেন্দ্রে খবর দিতে হবে।

কীভাবে খবর দেবে? তুমি দেখছ না এর শরীর থেকে কোনো সিগন্যাল আসছে না। এর শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই।

উপস্থিত সকল রোবট, সাইবর্গ, এন্ড্রয়েড এবং মানুষেরা বিস্ময়ের এক ধরনের শব্দ করল, আমি তখন বুঝতে পারলাম আমার এখান থেকে সরে পড়ার সময় হয়েছে। যদি। এভাবে বসে থাকি তা হলে কিছুক্ষণের মাঝেই আবার কিছু প্রতিরক্ষা রোবট নিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী চলে আসবে। আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং ঠিক তখন শুনতে পেলাম কাছাকাছি একটা বাইভার্বাল এসে দাঁড়িয়েছে এবং তার ভেতর থেকে দুজন প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষ নেমে এসেছে। একজন গলা উঁচু করে বলল, এখানে এত ভিড় কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?

অন্য কেউ কিছু বলার আগেই আমি বললাম, না বিশেষ কিছু হয় নি। একটা সাইবর্গের সিস্টেম ফেল করেছিল, সেটি আবার তার সিস্টেম লোড করে নিচ্ছে।

প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষটি দাঁতের নিচে দিয়ে অস্পষ্ট গলায় সাইবর্গ প্রজাতির উদ্দেশে একটা কুৎসিত গালি উচ্চারণ করে বলল, সেজন্যে এত ভিড় করার কী আছে? সবাই নিজের কাজে যাও।

রোবট, সাইবর্গ আর এন্ড্রয়েডগুলো কোনো কথা না বলে সাথে সাথে বাধ্য মানুষের মতো সরে যেতে শুরু করল। মানুষদের একজন নিচু গলায় বলল, সাইবর্গটার সিস্টেম এমনি এমনি ফেল করে নি। এই মানুষটি মেটাকোড ব্যবহার করে ফেল করিয়েছে।

প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষ দুজন শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে আমার দিকে তাকাল, হঠাৎ করে তাদের ভুরু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে এবং চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। একজন মানুষ অনাবশ্যক রকম কঠিন গলায় বলল, সত্যি?

আমি মাথা নাড়লাম। কাজটি হালকাভাবে বেআইনি, বাড়াবাড়ি কিছু হওয়ার কথা নয়। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষটি তবুও তার মুখে মোটামুটি একটা ভয়ংকর ভাব ফুটিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন মেটাকোড ব্যবহার করেছ?

আমি মুখে একটা নির্দোষ সারল্যের ভাব ফুটিয়ে বললাম, সাইবর্গটা আমাকে বড় বিরক্ত করছিল।

বিরক্ত করলেই তুমি মেটাকোড ব্যবহার করবে? কোথা থেকে তুমি এই মেটাকোড পেয়েছ?

আমি হাসার ভঙ্গি করে বললাম, পাবলিক টয়লেটে লেখা থাকে। নেটওয়ার্কের কথা তো ছেড়েই দিলাম।

প্রতিরক্ষা বাহিনীর লোকগুলো আরো কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই সাইবর্গটা নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, এই মানুষটার ট্রাকিওশান নেই।

প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষগুলো চমকে উঠে বলল, কী বললে?

বলেছি যে ট্রাকিওশান নেই।

মানুষ দুজন নিজেদের রনোগান বের করে আমার দিকে উঁচু করে কিছু একটা দেখে আবার শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, সত্যিই নেই।

আমি একটা নিশ্বাস ফেললাম, বড় ধরনের অপরাধীরা শরীর থেকে ট্রাকিওশান সরিয়ে ফেলে, আমি বড় ধরনের দূরে থাকুক, ছোট অপরাধীও নই। কিন্তু এখন সেটা প্রমাণ করা যাবে না। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষ দুটো এখন আমাকে ধরে নিয়ে যাবে, আমার জিনেটিক কোড দিয়ে আমার তথ্য বের করে তথ্যকেন্দ্র থেকে নিঃসন্দেহ হবে। যতক্ষণ আমার পরিচয় নিয়ে নিঃসন্দেহ না হচ্ছে ততক্ষণ আমার সাথে দুর্ব্যবহার করতে থাকবে। আমি একটি নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম–যেদিন নিজের ট্রাকিওশান ফিরিয়ে দিয়ে এসেছি সেদিন থেকে এই বাড়তি ঝামেলার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আছি।

প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষ দুজন কিন্তু হঠাৎ করে তাদের মুখের কঠোর ভাবটুকু ঝেড়ে ফেলে কেমন যেন সদয় চোখে তাকাল, তারপর সহজ গলায় বলল, ট্রাকিওশান খসিয়ে দিয়েছ?

আমি মাথা নাড়লাম। একজন চোখ মটকে বলল, ভালোই করেছ, এখন কোনো দায়দায়িত্ব নেই। ঝাড়া হাত–পা।

আমি মানুষটার চোখের দিকে তাকালাম, মনে হল সেখানে এক মুহূর্তের জন্যে একটা ধূর্ত দৃষ্টি উঁকি দিয়ে গেল। মানুষটি তখন উপস্থিত মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে জটলা না করে সবাই যে যার কাজে যাও। মানুষটা নিজের জীবনকে সহজ করার জন্যে ট্রাকিওশান পর্যন্ত খসিয়ে এসেছে অথচ তোমরা তাকে শুধু যন্ত্রণাই দিয়ে যাচ্ছ!

উপস্থিত মানুষগুলো এবং তার পিছু পিছু সাইবর্গটি সরে গেল, এখন এখানে আমি একা। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষগুলো কী করে দেখার জন্যে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম কিন্তু তারা কিছুই করল না। সহৃদয় ভঙ্গিতে একটু হেসে বলল, তোমার জীবন স্বাধীন হোক। শুভ হোক।

আমি জোর করে মুখে ভদ্রতার হাসি টেনে বললাম, ধন্যবাদ।

মানুষ দুজন বাইভার্বালে করে সরে যাবার পর আমি আবার হাঁটতে শুরু করি। পাতাল নগরীর কাছাকাছি একটি কৃত্রিম হ্রদ রয়েছে, তার তীরে একটা বিস্তৃত অংশে বনভূমি তৈরি করা হয়েছে। আমি সময় পেলে সেখানে গিয়ে হ্রদের বালুবেলায় ঘুরে বেড়াই–শহরের ঠিক মাঝখানে যেরকম উটকো বিপত্তির জন্ম হয় সেখানে সেরকম কিছু হওয়ার কথা নয়।

আমি অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে বড় বিল্ডিংটার অন্য পাশে চলে এসে পেছন দিকে তাকালাম। মাটি থেকে কয়েক মিটার উঁচুতে একটা বাইভার্বাল স্থির হয়ে আছে। আমি বড় রাস্তাটার অন্যপাশে এসে আবার পেছন দিকে তাকালাম, বাইভার্বালটি নিঃসন্দেহে আমাকে অনুসরণ করছে।

আমি একটা নিশ্বাস ফেললাম। শরীরের ভেতর রক্তস্রোতে ঢুকিয়ে দেওয়া একটা ট্রাকিওশান দিয়ে একজন মানুষকে বহু দূর থেকে চোখে চোখে রাখা যায়–সেটি নেই বলে একটি আস্ত বাইভার্বাল এবং কয়েকজন মানুষ মিলে আমাকে চোখে চোখে রাখছে।

কারণটা কী বুঝতে পারছিলাম না বলে আমি নিজের ভেতর এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করতে থাকি।

Address

4, Bosupara Main Road
Khulna

Telephone

+8801686614180

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when সায়েন্স ফিকশন, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to সায়েন্স ফিকশন, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী।:

Videos

Share

Category

Nearby media companies



You may also like