12/03/2022
১৩ মার্চ,
কটকা ট্রাজেডি
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস
স্থাপত্য ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের '০৩ ব্যাচ পযর্ন্ত সবাই ১৩ই মার্চ'২০০৪ এ কটকায় হারিয়ে যাওয়া এই মানুষগুলোকে কমবেশী চিনেছিলো তাই এই কষ্ট আর অনুপ্রেরণাগুলো ০৪'ব্যাচ থেকে পরবর্তী ব্যাচের সবার সাথে শেয়ার করার জন্য লিখে রাখলাম।
সাগরের গর্জনে নিজের চিৎকারের শব্দ নিজেই শুনতে পারছিনা। ডানপাশে তখনও কয়েকজন দল বেধে বল নিয়ে হাঁটুপানিতে খেলছে। যারা কোনমতে বেঁচে ফিরে এসেছে তারা বালুর উপর শুয়ে পড়ে হাপাচ্ছে আর বমি করছে। আমরা যারা সাগরপাড়ে হাটাহাটি করছিলাম তারা ছোটাছুটি করে সবাইকে একজায়গায় করছি।
কিছুক্ষনের মধ্যে সবাই ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। বামপাশে তখন এক অসহনীয় দৃশ্য। একটু দূরে সাগরের ঢেউয়ের উপর কালো কালো কয়েকটা মাথা দেখা যাচ্ছে আর তাদের উঁচু করা বাঁচতে চাওয়া হাতগুলো ভাটার টানে ভেসে যাচ্ছে আরো গভীরে। আমার আর সহ্য করার ক্ষমতা নেই। মুখ থুবড়ে পড়ে যাই বালুর উপর। গলা দিয়ে আর কোন শব্দ বের হয় না। চারপাশে সব ফাঁকা আর সাদা হয়ে যাচ্ছে। কতক্ষন এভাবে আছি জানিনা। শুধু মনে আছে সাদিক আমাকে টেনে একটু উঁচু জায়গায় রেখে আবারো পানির দিকে ছুটে গেল।
একটুপর উঠে দাড়ালাম। নিঝু আপুকে পানি থেকে টেনে আনলো কয়েকজন। অনেক পানি বের হলো আপুর মুখ দিয়ে। সবার মুখ ফ্যাকাশে, ভাবলেশহীন। কাউসার ভাইকে কারা যেন পানি থেকে ধরাধরি করে উঠিয়ে আনলো। রূপা আপুকেও নিয়ে আসা হয়েছে। রূপা আপু ততক্ষনে আর নেই, ওখানেই জেনে গেলাম। কাউসার ভাইয়েরও কোন সাড়াশব্দ নেই।
সাগরে ভাসতে থাকা মাথাগুলো আর দেখাও যাচ্ছেনা। গাছের ডাল আর লুঙ্গি দিয়ে স্ট্রেচার বানিয়ে কাউসার ভাই আর রূপা আপুকে নিয়ে সবাই ফিরতে শুরু করলাম লঞ্চঘাটের দিকে। অসহ্য সময়, চুপচাপ কিন্তু ফুপিয়েঁ ফুপিয়েঁ সবাই কাঁদছে, তখনও কেউ সঠিক জানিনা পেছনে কতজনকে হারিয়ে এসেছি। একটু আগেও কটকার যে বুনো পথ দিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে করতে এসেছিলাম, সেই পথেই আবার ফিরে যাচ্ছি নি:শব্দে।
অনন্তকাল পার করে লঞ্চে ফিরলাম। শুরু হল কষ্টের আরেক অধ্যায়।একজন একজন করে নাম ধরে খোঁজা হয়, খুজেঁ না পেলে বুঝে যাই সে নেই। তাকে হারিয়ে এসেছি সাগরে। কেউ কাউকে স্বান্তনা দিতে পারেনা কিন্তু সবাই সবার কাছে স্বান্তনা খোজেঁ। খুলনার দিকে লঞ্চ চলা শুরু করে। নীচ তলায় রূপা আপু আর কাউসার ভাই চাদরে মুখ ঢেকে নিথর। আমরা সবাই চুপচাপ বসে, শুয়ে বা রেলিঙে হেলান দিয়ে ফেলা আসা সময়টাকে একটা দু:স্বপ্ন বানাতে শূন্যতা চোখে নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। যারা ঢেউ থেকে বেঁচে এবং বাচিয়েঁ ফিরে এসেছে তারা ডুকরে উঠছে মাঝে মাঝে।
লঞ্চের শব্দ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন শব্দ নেই যেন।
কষ্টের এই স্মৃতি ঝাপসা হয়না। অপু ভাই, নিপুন ভাই, শুভ ভাই, কুশল ভাই, বাকী ভাই, তোহা ভাই, কাউসার ভাই, রাসেল ভাই, রূপা আপু, শাকিল ভাই, সামিউল ভাই- এই ১১ জনের হাসিমাখা মুখ এখনও সারাক্ষন সাথে থাকে। ২০০৪ সাল থেকে এই অবয়বগুলো বুকের ভেতর নিয়ে ঘুরে বেড়াই।
সময়ের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ হলে উদীচি হামলার পরপরই অসাধারণ একটা কবিতা লিখে ফেলতে পারতেন নিপুন ভাই। আর হুমায়ুন আজাদ আহত হওয়ার সাথে সাথে খুবি ক্যান্টিনে লাল রং মাখানো একটা সাদা ফতুয়া নিয়ে অপু ভাই সবাইকে জড় করে 'সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে' শিরোনামে একটা তাৎক্ষনিক জমায়েত তৈরী করে ফেলতে পারতেন তা আমরা হা হয়ে দেখতাম। যে কোন দু:সময়ে এখনও অপু ভাই আর নিপুন ভাইয়ের হাসি আমাকে সাহস যোগায়।
আমড়া, পেয়ারা মাখানো খেলে বা আর্কিটেক্চারের নতুন কোন বইয়ের মলাট খুললেই কেন যেন রূপা আপুর হাসিমাখা মুখটা সবার আগে ভেসে ওঠে।
কোন critical section বা detail drawing স্কেঁচ করতে গেলে কাউসার ভাইয়ের হাতটা এখনও কাধে পাই, বলে, 'দুর! চিন্তা করোনা তো, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।'
খুব মাথা ব্যাথা হলে বাকী ভাইয়ের যাদুর হাতটা এখনও কপালে বুঝতে পারি।
তোহা ভাই, the god must be crazy- মুভিটা দেখলেই আপনি পাশে এসে বসে থাকেন আর হা হা করে হাসতে থাকেন। জেমসের গান আর জেমসের গলায় ভালো লাগেনা ভাই, আপনি গেয়ে দেন না প্লিজ।
কুশল ভাই, কোন তত্বীয় দর্শনের কোন আগামাথা যখন বুঝিনা তখন আপনার হাসিমাখা ঝাড়িটা খুব কাজে দেয়, আমি আবার চেষ্টা করি প্রথম থেকে।
শুভ ভাই আপনার দুষ্টুমি মাখা সিরিয়াসনেসের গুনটা হাজারবার ফলো করেও রপ্ত করতে পারিনি, শেষে এসে ঠিকই হেসে ফেলি ।
রাসেল ভাই, হলে আমার একটা রূম পরেই আপনি ছিলেন, কুষ্টিয়া যাওয়ার প্ল্যানটা এখনও ঠিক আছে, যদিও লালন মেলা প্রতি বছরই আসে আর যায়।
সামিউল ভাই আর শাকিল ভাই, আপনারা দুজন বুয়েট থেকে এসেছিলেন আমাদের গেস্ট হয়ে কিন্তু ট্যুরে কখনই মনে হয়নি যে আপনারা আমাদের গেস্ট। পরে জেনেছি বুয়েটে আপনারাও ছিলেন আড্ডা মাতানোর ওস্তাদ।
[আমি আগেই বলেছি যে অনেকদিন চেষ্টা করেও এই লেখাটা লিখতে পারিনি বা চাই নি। কিন্তু ইদানিং কষ্টের তীব্রতার পাশাপাশি এই মানুষগুলোর হাসিমাখা মুখ, এদের ব্যক্তিত্ব, এদের বৈশিষ্ট বিভিন্নভাবে খুব প্রেরণা যোগায়। তখন এদের জন্য গর্ব আর নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয় কেননা তিন বছরেরও বেশী এদেরকে অভিভাবক হিসেবে পেয়েছিলাম।]
লিখেছেনঃ মুনির হোসেন সজল ভাই।