02/08/2020
সমাজ বিকাশের ধারাবাহিকতায় দেখা যায় একটা সমাজ ব্যবস্থা যখন প্রগতির পথে চূড়ান্ত অন্তরায়, সমাজ বিকাশের গতিকে ব্যাহত করে, তখন সমাজ প্রগতির স্বার্থে একদল মানুষ বিবেকের আহবানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি, যশ, অর্থ, প্রতিষ্ঠা কে উপেক্ষা করে সমাজের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির উচ্চ আদর্শকে নিজেদের চরিত্রের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন। একসময় তারা থাকেন না কিন্তু তাদের জীবনের সংগ্রাম পরবর্তীকালে প্রজন্মের কাছে আলোকবর্তিকার মতো কাজ করে, সামাজিক দায়িত্ব পালনে তাদের উদ্বুদ্ধ করে। তেমনই এক মহান মানবতাবাদী মানুষ ছিলেন বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ভারতবর্ষের আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ। মধ্যযুগের অন্ধতা কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করে রামমোহন বিদ্যাসাগরের সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে নবজাগরণের সূচনা হয় বিজ্ঞানের জগতে তার সার্থক সৃষ্টি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। সমস্ত রকম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে মূল্যবোধভিত্তিক বিজ্ঞানচর্চার যে অনন্য নজির তিনি স্থাপন করেছিলেন, চরিত্রের সেই অনির্বাণ শিখা আজকের এই মেরুদন্ডহীন বিবেকবর্জিত সমাজের কাছে অনুপ্রেরণার এক উৎস। মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে তার অবদান কেবলমাত্র বিজ্ঞান গবেষণা বা আবিষ্কারের জন্য নয়, তিনি স্মরণীয় তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য, মানব জাতির কল্যাণে নিরলস প্রচেষ্টার জন্য।
এক বিত্তশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ছেলেবেলা থেকেই দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের সাথে প্রফুল্লচন্দ্রের মেলামেশা খামতি ছিলনা। গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলো চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পথ্য না পেলে তাদের জন্য দুঃখে তাঁর মন কেঁদে উঠত। মায়ের অজান্তে চুপিচুপি সাগু, বার্লি, মিছরি তাদের দিয়ে আসতেন। একদিন মা ভুবন মোহিনী দেবী টের পেয়ে ছেলেকে বললেন এসব সাগু বালি দিয়ে তুই কি করিস? ভয়ে ভয়ে মায়ের কাছে প্রফুল্ল চন্দ্র সব কথা খুলে বলতেই মা গভীর স্নেহে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর শিক্ষকজীবনে বহু জটিল বিষয়ের তাৎপর্য ছাত্রদের সামনে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরতেন। রসায়নের বিভিন্ন তত্ত্ব গল্পচ্ছলে ছাত্রদের মনে গেঁথে দিতেন। বিদ্যাচর্চার যে এক মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে, তা যে কোনও ব্যবসায়িক স্বার্থে নয়, তা বোঝাতে তিনি ছাত্রদের সামাজিক দায়বদ্ধতা, যুক্তিভিত্তিক চিন্তা, কঠিন পরিশ্রমের মানসিকতা ও কর্তব্যনিষ্ঠ মূল্যবোধের শিক্ষাও দিতেন।
রসায়নের ক্লাস। ছাত্রদের সামনে এক টুকরো হাড় হাতে নিয়ে বুনসেন বার্নারে পুড়িয়ে মুখে পুরে দিয়ে নির্বিকারে চিবোতে লাগলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ছাত্রদের শেখালেন, এটা বিশুদ্ধ ক্যালসিয়াম ফসফেট। এছাড়া আর কিছুই নয়। ছাত্রদের বোঝাতেন যে পোড়ানো হাড়ের কোন জাত-ধর্ম নেই। এভাবেই শুধু রসায়ন শিক্ষাই নয়, ছাত্রদের মনে ধর্মান্ধতার মূল উপড়ে ফেলার মন্ত্রটিও প্রবেশ করিয়ে দিতেন তিনি।
প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজ এর ক্লাসের পরে ল্যাবরেটরীতে ঘন্টার পর ঘন্টা গবেষণার কাজে মগ্ন থাকতেন। দিনের পর দিন একটা ছোট্ট ঘরে বসবাস করে অক্লান্ত প্রচেষ্টায় অর্থ সংগ্রহ করে, আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে উন্নত মানের বিজ্ঞান গবেষণাগার তৈরি করে বিজ্ঞান কলেজে মৌলিক শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
সেসময় খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল এর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং এ বিষয়ে গবেষণা করে ঘি ও তেলে ভেজাল নির্ণয়ের জন্য নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
তিনি যুগান্তকারী আবিষ্কার মারকিউরাস নাইট্রাইটের উদ্ভাবক। তা ছাড়াও তিনি বহু বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন, যাকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো নাইট্রাইট ও হাইপোনাইট্রাইট যৌগ ও তাদের ভৌত রাসায়নিক ধর্ম সংক্রান্ত। দ্বিতীয় হল সালফার যুক্ত জৈব যৌগ সংক্রান্ত এবং তৃতীয় হল ডাবল সল্ট হেমোমরর্ফিজম এবং ফ্লুওরিনেশন সংক্রান্ত। নাইট্রাইট সম্পর্কে তার বিস্তৃত জ্ঞান ও অবদানের জন্য তাকে মাস্টার অফ নাইট্রাইট বলা হত। ভৌত রসায়নবিদ্যার ক্ষেত্রেও নিজস্ব প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছিলেন তিনি।
প্রেসিডেন্সি ও বিজ্ঞান কলেজে থাকাকালীন সমগ্র জীবনে বিভিন্ন বিষয়ে তার 150টি গবেষণাপত্র নেচার, রয়েল সোসাইটির জার্নাল সহ নানান বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি বলতেন "যাহার ভিতর গবেষণা কাজের কোন অনুপ্রেরণা জাগে নাই কেবলমাত্র বৃত্তির লোভেই তাহার পক্ষে গবেষণা কার্যক্রম হওয়া উচিত নহে" (আত্মচরিত)। আর এ কাজটি তথাকথিত ভালো গ্রন্থকীট ছাত্র দিয়ে দিয়ে হবে না, কারণ তিনি মনে করতেন "ভালো ছেলে পুতুলের মত যারা তাদের চোখ আছে কিন্তু তারা দেখতে পায় না কান আছে কিন্তু শুনতে পায় না তাদের ব্যক্তিত্ব নেই স্বাতন্ত্র্যতা নেই নিজের জন্য তারা ভাবতে পারে না। তারা সকলের কথা মত চলে। বাঙালি দপ্ করে জ্বলে ওঠে খপ্ করে নিভে যায়। ভালো ছেলে সাজায় তাদের একমাত্র লক্ষণ"। এরই ফসল হিসেবে তাঁর প্রত্যক্ষ সাহচর্যে রসায়ন বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ দাস, নীলরতন ধর, রসিকলাল দত্ত , জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জী বিমানবিহারী দে প্রমুখ এবং তার উৎসাহ ও প্রেরণায় পদার্থ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মেঘনাথ সাহা সত্যেন্দ্রনাথ বোস এর মতো বিজ্ঞানীদের আবির্ভাব হয়েছিল।
তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল "The History of Hindu Chemistry" রচনা। সে সময় এদেশে একটি ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল যে বিজ্ঞানের আজকের যা আবিষ্কার তার সবকিছুই প্রাচীনকালে ভারতে ছিল। এ যে কতটা ভান্ত তা তিনি জানতেন। আবার প্রাচীন ভারতে একটা সময় প্রকৃতি বিজ্ঞানের চর্চা ও হয়েছিল । তাই প্রাচীন ভারতের সত্যিকারের ইতিহাস বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তুলে ধরাটা ছিল সে যুগের প্রয়োজন। আর এই মহান কাজের দায়িত্বভার প্রফুল্ল চন্দ্র নিজে গ্রহণ করেন। যদিও এটি খুব সহজ কাজ ছিল না। কারণ এ সংক্রান্ত কোন তথ্যাবলি পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল। দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন তিনি। নেপাল, তিব্বত ও লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস থেকেও বেশকিছু পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন। আচার্য্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ও পন্ডিত নবকান্ত, কবি ভূষণের সহায়তায় পোকায় কাটা, নষ্ট হয়ে যাওয়া পুঁথি থেকে পাঠোদ্ধার করলেন অপরিসীম ধৈর্য ও কঠিন অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ ১৫ বছর কঠিন সাধনার ফসল হিসেবে ১৯০২ এবং ১৯০৯ সালে ২টি খন্ডে বই প্রকাশ করেন।
এই বইটিতে প্রফুল্লচন্দ্র প্রাচীন ভারতের জ্ঞান চর্চার অসামান্য অগ্রগতির ইতিহাস বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিচার বিশ্লেষণ করে বহু তথ্য ও প্রমাণের মধ্য দিয়ে যেমন তুলে ধরেছেন, আবার প্রাচীনকালের সম্পর্কে রচিত কাল্পনিক গৌরবের ভ্রান্ত ধারণার অসাড়তাকেও বলিষ্ঠ ভাবে প্রকাশ করেছেন।
প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা নির্ভর বিজ্ঞানের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটলেও পরবর্তীতে মধ্যযুগীয় অবস্থায় তার বিলুপ্তি ঘটে। তার কারন হিসেবে 'প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানের অবনতি' শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন "এই সমস্ত জাতিভেদ প্রথা প্রচলন হয় অনমনীয় রূপে। মনুসংহিতা এবং পরের দিকে লেখা পুরান গুলিতে ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়কে মহিমান্বিত করার প্রবণতা দেখা গেল। সুশ্রুত বলেছিলেন- তাঁর ছাত্র দের শব ব্যবচ্ছেদ করে শল্যচিকিৎসা শিখতে হবে। কিন্তু মনুর তাতে বিশেষ আপত্তি। মনুর মতে মৃতদেহ স্পর্শ করলে ব্রাহ্মণের জাত যাবে। তাই আমরা লক্ষ্য করি ভাগবত এর পর থেকেই সপ্তাহ কাটাছেঁড়া করে শিক্ষাদান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার ফলে শরীর তত্ত্ব ও শল্যচিকিৎসা চর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং বাস্তবে এইগুলি হিন্দুদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশন এর মত কষ্টসাধ্য কাজ উঁচু জাতের পক্ষে বেমানান বলে পরিগণিত হল এবং বহুদিনের চর্চায় গড়ে ওঠা 'কলা'গুলি সমাজের চিন্তাশীল শ্রেণীর চিন্তাজগতের বাইরে চলে গেল।" আজ একশত বছর পেরিয়ে আসলেও আবার আমরা দেখি ভারতের চিন্তা জগতকে আবার সেই অন্ধকার জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির ছিল, বিমান ছিল, ইন্টারনেট ছিল, জ্যোতিষ শাস্ত্র হল বিজ্ঞান এরকম অগণিত অবৈজ্ঞানিক চিন্তা উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করে ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে। আজ তার এই গ্রন্থ চর্চা ভীষণভাবে প্রয়োজন।
বিজ্ঞানের সমর্পিত প্রাণ হয়েও প্রফুল্লচন্দ্র কিন্তু কখনোই গবেষণাগারের চৌহদ্দির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। বিপ্লবীদের সাহায্য করে গেছেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিবাদ প্রতিরোধে নানান সভা-সমিতির প্রথম সারিতে উপস্থিত থেকেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন। নবজাগরণের চিন্তা থেকে তিনি নারী শিক্ষা প্রসারে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি বলতেন 'দেশে স্ত্রী শিক্ষার অভাবে সমাজদেহের আধখানা তো অসাড় ও গতিহীন হয়ে পড়ে আছে।'
'মাতৃজাতির হীনতা ও অজ্ঞানতা দূর করিবার সামর্থ্য আমাদের নাই। কোন মুখে আমরা স্বরাজ লাভের যোগ্য বলি।' (পশ্চিমবঙ্গ, প্রফুল্ল রায় বিশেষ সংখ্যা) । জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হলে সেখানে স্ত্রীশিক্ষার স্থান না থাকায় তীব্র ভাষায় সমালোচনা করে বলেছেন 'ভারতবর্ষে যদি depressed class কাউকে বলতে হয় তবে মহিলাগণই depressed. আমরা চিরকাল তাঁদের বাহিরে রেখেছি, জ্ঞানের আলো হতে চিরকাল বঞ্চিত করে রেখেছি।' (পশ্চিমবঙ্গ প্রফুল্ল রায় বিশেষ সংখ্যা)। তিনি বিধবা বিবাহ আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। বিধবাদের জন্য মাসিক বরাতের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। বিভিন্ন ট্রাস্টি গঠন হয়েছিল। পণপ্রথা, বাল্যবিবাহ, পর্দা প্রথা সম্পর্কিত সমাজপতিদের ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
১৯২১ সালে খুলনায় পরপর দুবছরের অনাবাদে দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ আকার ধারন করে এবং সরকার এর প্রতিরোধে কোন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তিনি নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নেন ও 'খুলনা রিলিফ কমিটি' গঠন করে বেশ কয়েক মাস ধরে স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ত্রাণকার্য চালিয়ে যান। পরের বছর অবিরাম বৃষ্টিতে উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা হয়। 'বেঙ্গল রিলিফ কমিটি' গঠন করে তিনি ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর মহৎ চরিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সুভাষচন্দ্র, মেঘনাদ সাহা সহ কলেজের অধ্যাপক ও ছাত্র সকলেই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ত্রাণকার্যে সহায়তা করেন। 1931 সালে আবার উত্তরবঙ্গে বন্যা হলে বয়সের ভার উপেক্ষা করে তিনি আবারও এগিয়ে আসেন। নিজের সুখসুবিধার কথা না ভেবে, ভগ্নস্বাস্থ নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন দরিদ্রের সেবায়, অসহায়ের সাহায্যে, পীড়িতের পাশে দাঁড়াতে। সে সময়ে সমাজের অবক্ষয় লক্ষ্য করে তিনি বলেছিলেন "ধণতন্ত্রের উন্মত্ততা কতদূর চরমে উঠিয়াছে তাহার নিদর্শন - দেশে প্রচুর কাঁচামাল থাকিতেও মানুষ দুর্দশা ভোগ করিতেছে, না খাইয়া মরিতেছে। গম গুদামে পচিতেছে। চিনি নষ্ট করিয়া ফেলা হইতেছে। কিন্তু এই অতি প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ খাইতে পারিতেছে না, তাহার জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যক জিনিস মিলিতেছে না"।এ কথা আজও কি ভীষণ পরিমাণে প্রাসঙ্গিক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আজকের এই মহামারী পরিস্থিতিতে যখন নিম্ন, হতদরিদ্রদের অন্ন নেই, বাসস্থান নেই, জীবিকা নেই, স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধের কোনো নিশ্চয়তা নেই, এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের মতো এক মহান চরিত্র আমাদের কি শিক্ষা দেয়, তা আমাদের অবশ্যই পুনঃবিবেচনা করা উচিত।
পরাধীন ভারতবর্ষে যখন ব্রিটিশ দ্রব্যসামগ্রীতে বাজার ছেয়ে যায়, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাবে বহু দেশীয় দ্রব্য উৎপন্ন হলেও জীবনদায়ী ওষুধের জন্য ভারতবাসীকে ব্রিটিশদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো। প্রফুল্লচন্দ্র এবিষয়ে এগিয়ে এলেন স্বদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তিনি ঔষধ সংক্রান্ত রাসায়নিক দ্রব্য প্রস্তুত করার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের গবেষণাগারে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ওষুধ প্রস্তুত করে তিনি নিজেই দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়িয়ে ওষুধ বিক্রি করতেন। এক্ষেত্রে গরীব দুঃখীদের সাহায্যার্থে লোকসানের স্বীকার হয়েও তিনি ওষুধ দিয়েছেন। পরবর্তীকালে বহু দরদী মানুষের সাহায্যে 1901 সালে 'বেঙ্গল কেমিক্যাল লিমিটেড' গড়ে তোলেন। পরে এটি ভারতের সর্ববৃহৎ ওষুধ প্রস্তুতকারী শিল্প হিসেবে সুনাম অর্জন করে। এই শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে প্রফুল্ল চন্দ্র নিজে কোনপ্রকার বেতন না নিয়ে সমগ্র টাকা ব্যয় করতেন কর্মচারীদের সুখ-সুবিধার জন্য, তাদের পরিবারকে সাহায্যের জন্য। দুঃখের বিষয়, পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধনতান্ত্রিক গোষ্ঠী এই প্রতিষ্ঠানটিকে সর্বোচ্চ মুনাফা লক্ষ্যে পরিচালিত করতে চাইলে তিনি অত্যন্ত ঘৃনার সাথে পদত্যাগ করেন। অত্যান্ত বেদনার হলেও সত্য, বলতে দ্বিধা নেই যে, আজ সারা বিশ্ব যখন করোনার জর্জরিত, বারবার সারা বিশ্ব তাকিয়ে থেকেছে এই বেঙ্গল কেমিক্যাল এর দিকেই।
প্রফুল্লচন্দ্র সারাজীবন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন মানুষের স্বার্থে। মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা তাঁর জীবনের সমস্ত কর্মপ্রণালী পরিচালিত করেছে। একদিনের জন্যও তিনি ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে নিমজ্জিত হয়ে কোনোপ্রকার সুযোগ সুবিধা নেননি। তাঁর এই দুর্লভ মহান মানবতাবাদী চরিত্র আজও আমাদের কাছে শিক্ষনীয়। এর বিপরীতে আজ আমরা দেখতে পাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিয়ে ধনকুবেরদের সর্বোচ্চ মুনাফা লাভের প্রতিযোগিতা। বঞ্চিতদের আরো বঞ্চিত করার মধ্যে বিজয়ের উল্লাস। প্রফুল্লচন্দ্রের জীবনসংগ্রাম আমাদের শিক্ষা দেয় সমাজের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার, অন্ধকার তমসাচ্ছন্ন গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যুক্তিবাদের প্রসার ঘটানোর, বুদ্ধিবৃত্তির সাথে হৃদয়বৃত্তির সংমিশ্রণ ঘটানোর। এই ঐতিহাসিক অবদানকে সঠিকভাবে অনুধাবন করার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে তাঁর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধাজ্ঞাপণ করতে পারবো।
সূত্র:
'আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়: বিজ্ঞানের ইতিহাসে মানবিক মূল্যবোধে ভাস্বর এক অবিশ্বরণীয় চরিত্র'-- ব্রেকথ্রু প্রকাশনা।