কাজী নজরুল ইসলামের খুব বিখ্যাত একটি উক্তি। কী প্রেক্ষিতে তিনি এটি বলেছিলেন তা আমার জানা নেই। জানার উপায়ও নেই। ছোটবেলা কবিতার ভাবার্থ পড়তে গিয়ে এমন মানে পেতাম যে সন্দেহ হতো কবি আদৌ তার কবিতা দিয়ে এতোকিছু বুঝিয়েছেন তো! এটাও তেমন কিছু কিনা কে জানে!
.
তবে সুশীল মহলে ও কিছু তথাকথিত আধুনিক মুসলিমদের মধ্যে কথাটা খুব জনপ্রিয়। প্রায় ১৪০০ বছর পরেও যারা সবকিছুতে কুর’আন-হাদিস খোঁজে তাদের একটা খোঁচা দেয়া যায়। বলা যায়, ‘ইউরোপিয়ানদের দেখে কিছু শেখো। ওরা ঠিকই ধর্মীয় সংস্কৃতিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। আর তোমরা মোল্লারা! এখনো মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা নিয়ে পড়ে আছো! ছ্যাহ!”
.
হ্যাঁ! এটা সত্যি ওরা বস্তুগত জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। মানব সভ্যতার যান্ত্রিক উৎকর্ষতায় ওদের অনেক অবদান। সে হিসেবে ওরা সফল। কিন্তু আমরা যে সফলতাকে একটু অন্য লেন্সে দেখি। মার্কিন সাংবাদিক জন গুন্থার তার ‘Inside Europe’ গ্রন্থে বলেছিলেন-
“ইংরেজ জাতি সপ্তাহে ছয়দিন পূজা করে ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের আর সপ্তম দিন হাজিরা দেয় গীর্জায়।”
.
আমরা তো এই ধ্যান-ধারণা কে লালন করি না। বিশ্বাস করি না, ধর্ম আর রাষ্ট্রকে আলাদা করা যেতে পারে। যা সিজারের তা সিজারকে আর যা স্রষ্টার তা স্রষ্টাকে দেয়া যেতে পারে। যে মানুষ তার মেধা দিয়ে জটিল জটিল ল্যাপ্লাস-ফুরিয়ার করতে পারে, কিন্তু তার রবকে চিনতে পারে না, তাঁর উদ্দেশ্যে মাথা ঠেকাতে পারে না, আমাদের কাছে তার জ্ঞানের কোন মূল্য নেই। আমরা বলি-
“আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ- সব কিছু সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্য।” [সূরা আন’আম, আয়াতঃ ১৬২]
.
তবে কি ওরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাবে আর আমরা বসে থাকব? বস্তুগত বিদ্যা বলে জ্ঞান চর্চা থেকে দূরে থাকব? না, মোটেও না। তবে এ জ্ঞান-অন্বেষণই আমাদের সফলতা এনে দিবে না, এ বিশ্বাসটা আমাদের রাখতে হবে। আজ যদি মুসলিম উম্মাহ থেকে একশোটা বিল গেইটস বের হয়, দশটা আইন্সটাইন বের হয় তবে কি আমাদের অবস্থা রাতারাতি বদলে যাবে? না, একটুও বদলাবে না। আমরা পদে পদে মার খেতেই থাকব। অপমানিত হতে থাকব। কারণ, আমাদের সম্মান শুধু এক জায়গাতেই রয়েছে। সে সম্মান খুঁজতে ইতিহাসের একটু পিছনে ফিরতে হবে।
.
উমার (রা) জেরুজালেমের পথে যাচ্ছেন। গায়ে ছিন্ন জামা। চেহারা ধূলি-মলিন। সিরিয়াতে প্রবেশের পর উম্মাতের আমিন আবু উবাইদা (রা) এর সাথে তার দেখা হলো। আবু উবাইদা (রা) নিজেও ছিলেন দুনিয়া-বিমুখ। গভর্নর হওয়া সত্ত্বেও তার ঘরে কোন ফার্নিচার ছিল না। কিন্তু উমার (রা) কে এ অবস্থায় দেখে তিনি কিছুটা লজ্জিত হলেন। ভাবলেন, কতো মানুষ আজ উনাকে দেখবে। তারা যদি দেখে আমাদের আমিরুল মুমিনীন এর এই অবস্থা! তাই কিছুটা বিব্রত হয়ে তিনি উমার (রা)-কে বললেন, “হে আমিরুল মুমিনীন! এখন তো আপনি লোকদের নেতাদের সাথে দেখা করবেন (আর আপনার এ কী অবস্থা!)”
উমার (রা) তখন তার বিখ্যাত উক্তিটি করলেন, “আমরা ছিলাম অপমানিত জাতি। তারপর আল্লাহ তায়ালা আমদেরকে ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করলেন। যদি আমরা ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুতে সম্মান খুঁজি, তবে অবশ্যই তিনি আমাদের অপমানিত করবেন।” (মুসতাদরাক, হাদিস নং-২০৭)
.
ইতিহাসের একটি শিক্ষা আছে। আর তা হচ্ছে, ইতিহাসের শিক্ষা থেকে কেউই শিক্ষা নেয় না। উমার (রা) এর এই ছোট্ট কথার মধ্যে আমাদের অধঃপতনের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। আমরা আজ আমাদের ইসলাম থেকে দূরে সরে গেছি, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ থেকে বিমুখ হয়ে আছি। বেছে নিয়েছি এক আরামদায়ক জীবনকে। বেছে নিয়েছি এমন এক ইসলামকে, সে ইসলামে কোন কষ্ট নেই, সংগ্রাম নেই। সে ইসলামে খুব সহজেই স্ত্রী-সন্তান আর উপার্জিত অর্থ নিয়ে আরামের জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। তাই আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে লাঞ্ছিত করছেন। অপমানিত করছেন।
.
এক সময় মুসলিমরা ইলম চর্চায় এখনকার সময়ের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে ছিল। গলিতে গলিতে পাওয়া যেতো একজন হাফেজাকে। অনেক সাধারণ মানুষেরই হাদিসের কিতাব, ফিকহের কিতাব নখদর্পণে থাকতো। সে সময়ে এই উম্মাহ থেকে বের হয়েছিলেন জাবির ইবনে হাইয়ান এর মতো বিজ্ঞানী। যাকে আধুনিক অপটিকস এর জনক বলা হয়। বলা হয়ে থাকে, আর্কিমিডিস থেকে নিউটনের মধ্যকার প্রায় দুই হাজার সময়ের ব্যবধানে তার সমতুল্য কোন বিজ্ঞানী জন্ম নেয়নি। সে সময়ে জন্ম নিয়েছিলেন ইবনুন নাফিস (রহ) এর মতো বিজ্ঞানী যিনি আজ থেকে ৮০০ বছর আগে রক্ত সঞ্চালন নিয়ে বিস্ময়কর তথ্য দিতে পেরেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা সে সময়ে মুসলিমদের বিজ্ঞানের জ্ঞান দান করেছিলেন। কারণ, সে সময়ে তারা ইসলাম থেকে আমাদের মতো দূরে সরে যাননি। তাদের রবকে ভুলে যাননি। সেকুলারিজম এর পূজা করেননি। তাই তিনি মুসলিম উম্মাহকে যেমন একজন ইবনুন নাফিস (রহ) কে দান করেছিলেন, তেমনি একজন ইবনে তাইমিয়াকেও (রহ) দান করেছিলেন।
.
তারপর আমরা যেমন ইলম থেকে দূরে সরে গিয়েছি, আল্লাহ তায়ালা আমদেরকে বিজ্ঞান থেকেও দূরে সরিয়ে নিয়েছেন। আবুল হাসান আলী নাদভী (রহ) তার ‘মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কি ক্ষতি হলো?”- বইতে এসব বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সে ইতিহাস কষ্টের। কান্নার। স্পেনের প্রাসাদ থেকে আল্লাহ তায়ালা আমাদের লাঞ্ছিত করে বের করেছেন। আজকের ইউরোপ দেখে কে বলবে আমাদের বাগদাদ যখন রাতের বেলায় আলোকিত হয়ে থাকতো, তখন লন্ডন কেবল একটি গ্রাম ছিল?
.
তবে আমরা যদি আমাদের ইসলামকে ঠিক করি, আল্লাহ তায়ালা এমনিতেই আমাদের বাকি সব কিছু ঠিক করে দিবেন। আমাদের জন্য জান্নাতকে সহজ করে দিবেন। আমাদের জন্য ওটাই চূড়ান্ত সফলতা। রাসূল (সা) বলেন-
“যে ব্যক্তি ইলম অর্জনের জন্য একটি পথ খুঁজবে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য এমন এক পথ বের করে দিবেন যা তাঁকে জান্নাতে নিয়ে যাবে।” (তিরমিযী, হাদিস নং- ২৯৪৫)
.
তাই যেসব তথাকথিত মুসলিম আজ কুর’আন হাদিসকে জানা বাড়াবাড়ি মনে করে, ইসলামকে যারা কেবল জুমু’আ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে, আমরা যেন তাদের কথায় কান না দেই। তাদের টিটকারিতে বিচলিত না হই। কারণ, তারা নিজেরাও ইসলামকে ফেলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যেয়ে জান্নাতে চলে যাবে, এমনটা কখনোই সম্ভব না। উস্তাদ আলী হাম্মুদা (হাফি) কিছুদিন আগে চমৎকার একটি ঘটনা শেয়ার করেছেন-
.
এক শায়খ বুখারির উপর দারস দিচ্ছিলেন। এক ব্যক্তি সে দারসে প্রবেশ করলো। তারপর শায়খের ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল-
“হায়রে! ইউরোপের লোকজন চাঁদে চলে যাচ্ছে। আর তোমরা এখনো বসে বসে বুখারি পড়তেছো! দিন বদলে গেলো, কিন্তু তোমরা কূয়ার মধ্যেই রয়ে গেলা।”
এমন টিটকারি শুনেও শায়খ রেগে গেলেন না। শান্ত স্বরে জবাব দিলেন-
“ওরা চাঁদে গেলে অবাক হবার কী আছে? তারা আল্লাহ তায়ালার একটি সৃষ্টি, আর তারা আরেক সৃষ্টির কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। আমরা হচ্ছি অন্য সৃষ্টি আর আমরা আমাদের স্রষ্টার কাছে পৌঁছাতে চাই।
.
কিন্তু একটা কথা কি জানো? এখানকার মধ্যে তুমি হচ্ছো সবচেয়ে বড়ো দূর্ভাগা।
তুমি না চাঁদে যেতে পারলে, আর না আমাদের সাথে বসে বুখারী শিখতে পারলে।”
Biplov khan.