গোমতী তীরবর্তী এলাকার হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত দেবিদ্বারের ইতিহাস প্রাচীনকালের। ভৌগোলিক, রাজনৈতিক আর প্রাকৃতিক সম্পদসহ নানা কারণে কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলা খুবই গুরম্নত্বপূর্ণ। ১৯১৫ সালে সৃষ্টি হয় দেবিদ্বার থানা এবং পরবর্তী ১৯৮০ সালে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়। বর্তমান দেবিদ্বার উপজেলাসহ কুমিল্লা অঞ্চল (ত্রিপুরা) ছিল এক সময় হিন্দুদের রাষ্ট্র। যে কারণে এখানে যারা বসবাস করত তারা প্রায় সবাই ছিল হ
িন্দু সম্প্রদায়ের। হিন্দুরা বিভিন্ন দেব-দেবীদের উপাসনালয়গুলোতে ছিল বর্ণালী কারুকার্য খচিত দোয়ার বা দ্বার। পরবর্তীতে এই দেবীর দোয়ার বা দ্বার থেকে জনপদটির নামকরণ করা হয় দেবিদ্বার।
দেবিদ্বার উপজেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভীষণ প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে, অজ্ঞ এবং নিরক্ষর জনগণের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে বদান্য জমিদার, রতনপুর, নবীনগর, জেলা- ত্রিপুরা (বর্তমান ব্রাহ্মনবাড়িয়া) বিখ্যাত কাজী পরিবারের সুযোগ্য সমত্মান শ্রদ্ধেয় নবাব স্যার কাজী গোলাম মহিউদ্দিন ফরুকী ১৯১৭ সালে এ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৮ সালের আগে এটি ছিল স্ট্যান্ডার্ড সিক্স পর্যন্ত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল।
দিপ্তীমান ব্যক্তিত্ব ও উজ্জ্বল নৈতিকতার জন্য তৎকালীন ভারতীয় ব্রিটিশ সরকার কাজী গোলাম মহিউদ্দিন ফারুকী ওরফে শোভা মিয়াকে ‘স্যার’ উপাধী দান করেন এবং তাকে ১৯২৯ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত বাংলার স্থানীয় সরকারের কৃষি, শিল্প, সমাজকল্যাণ ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করেন।
তাঁর শ্রদ্ধেয় বাবার পবিত্র স্মৃতিকে চিরস্থায়ী করার লক্ষক্ষ্য এই শ্রদ্ধাভাজন যোগ্য জমিদার স্কুলের নামকরন করেন তার বাবা কাজী রেয়াজ উদ্দিন আহমেদ এর নামে এবং খুজে বের করেন প্রতিশ্রম্নতিশীল প্রধান শিক্ষক বাবু বসন্ত কুমার দাসকে। বাবু বসন্ত কুমার (বি.এ,বি.টি) ছিলেন গভীর জ্ঞান ও নিখুত আদর্শের। সর্বশক্তিমান আল্লাহর দয়ায় ও স্থানীয় লোকদের পরম উৎসাহ ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে সর্বোপরি স্যার কে জি এম ফারুকীর অতিশয় দানশীলতায় প্রতিষ্ঠানটি বিরূপ পরিস্থিতি ও বাধার সাথে সংগ্রাম করে উত্তরোত্তর সাফল্য লাভ করে। বিনামূল্যে কিছু জমি দান ছাড়াও ফারুকী এস্টেট থেকে অনুদান ছিল অসামান্য। সূচনালগ্নের অল্প সময়ের মধ্যে এটি একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত এবং সর্বদিকে শিক্ষার মহান দিপ্তী ছড়াতে থাকে। প্রধান শিক্ষকের জ্ঞানের গভীরতা ও গতিশীল ব্যবস্থাপনা দ্রম্নত তাকে এলাকার জন্য একজন অদ্বিতীয় শিক্ষার ধারক হিসেবে পরিগণিত করে এবং এতে থানা সংলগ্ন এলাকার মেধাবী শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হয়।
১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এ বিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে কিছু উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিল M/S গঙ্গাচরণ বীর, নরেন্দ্র চন্দ্র কর্মকার এবং ফতেহাবাদ গ্রামের আবদুল আজিজ ভূঁইয়া, গুনাইঘরের মোঃ হায়দার আলী এভাবে বছর বছর বিদ্যালয়ৈ এরকম উজ্জ্বল ফলাফল চলতে থাকে এরই সাথে বিদ্যালয়ের অপরিণত পরিস্থিতি দূরীভূত হয়। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সন্তুষ্ট হয়ে বিদ্যালয়টির প্রভিশনাল স্বীকৃতি প্রদান করে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৬ সালে স্থায়ী ভাবে এ বিদ্যালয়টির স্বীকৃতি দান করে। পরবর্তীদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ো কেমিষ্ট্রি বিভাগের আমরন চেয়ারম্যান ডক্টর আবদুল জাববার, প্রফেসর এমেরিটাস ডাঃ কফিল উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোর ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহামদ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা ও ত্রাণ পুনর্বাসন মন্ত্রী ও আইজিপি আবদুল খালেক (জিরুইন), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডঃ আবুল বায়েস, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর গোলাম মাওলা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মঞ্জুরুল আলম খান, সিলেট বিভাগীয় কমিশনার জনাব জিয়া উদ্দিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম, ইস্পাহানী স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপাল লেঃ কর্ণেল জনাব মোসলেহ উদ্দিন প্রমুখ।
ছাত্রদের ভর্তিপ্রবাহের দরুন বিদ্যালয়ের আবাসন কল্পে কাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই ১৯২৮ সালে বিদ্যালয়ের উত্তর পাশের দু’তলা ভবনের নীচতলার কাজ শুরু করা হয়। এটি শুধু প্রবেশিকা এবং পরবর্তীতে মেট্রিক ও মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষাতে উজ্জল ফলাফলই নয়, পরম দক্ষতা ও শৃংখলার জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। শীঘ্রই এটি অন্যতম সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত স্বনামধন্য ইংলিশ উচ্চ বিদ্যালয় স্বীকৃতি পায়। সবচেয়ে বড় সাফল্য অর্জিত হয় যখন ১৯৩৮ সালে ১০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে সকলেই ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হয় এবং ১৯৮৭ সালে ৯ জন বালকা বালিক বিভিন্ন কেটাগরিতে জুনিয়ার Talent-Scheme Scholarship লাভ করে। তাছাড়া বেশ সংখ্যক শিক্ষার্থীর্ কোলকাতা, ঢাকা ও কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রথম বিশ মেধা তালিকায় স্থান লাভ করে। শিক্ষার পাশাপাশি সহপাঠক্রম ও শৃংখলায় আকৃষ্ট হয়ে সরকার সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে বিদ্যালয়টিকে উন্নয়নের জন্য নির্বাচন করে। তখন দু’টি ভবন, একটি এসেম্বলি হল, একটি ব্যায়ামগার, ল্যাট্রিন ও রান্নাঘরসহ দুটি ছাত্রাবাস নির্মাণ করে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক এবং সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের গতিশীল অবয়ব লক্ষ্য করা যায়। অনেক প্রাক্তন ছাত্র কেবল বিভিন্ন প্রাশাসনিক উচ্চ পদকেই অলংকৃত করেনি বরং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশামূলক ডিগ্রীও অর্জন করে। বাবু বসন্ত কুমার দাস বিদ্যালয়টির সূচনালগ্ন থেকে কৃতিত্ব ও সাফল্যের সাথে ১৯৬০ সালের মার্চে অবসর যাওয়া পর্যন্ত সেবা দিয়ে এসেছিলেন। ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত। তার মূল্যবান সেবার স্বীকৃতি স্বরূপ স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি তাহাকে রেক্টর হিসাবে নিয়োগ দেন এবং তারই সঠিক নির্দেশনায় ১৯৬০ সালে ২০ এপ্রিল এ.কে.এম ফজলুল হোসাইনকে শিক্ষানবিশ প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়।
অবসর জীবনের নিঃসঙ্গতা বাবু বসন্ত কুমার দাসকে তাড়া করে এবং ১৯৬২ সালে ৬ই নভেম্বর তিনি অসংখ্য ভক্ত প্রাণ ছেড়ে এদেশ ত্যাগ করে ভারতে তার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার সুশীল কুমার