14/11/2022
তিন লাখ রোহিঙ্গাকে গছাতে চায় সৌদি সংস্করণ
সৌদি আরবে বসবাসরত মিয়ানমারের তিন লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিতে বলেছে আরব বিশে^র তেলপ্রধান দেশটি। সৌদি স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী নাসের বিন আবদুল আজিজ আল দাউদ ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠকে এ বার্তা দেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর আগেও সৌদি আরব ৫৪ হাজার রোহিঙ্গার কথা বলেছে। কিন্তু এবার বলছে তিন লাখ। সৌদিতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে সুরাহা করতে হবে। কেননা রিয়াদের সঙ্গে ঢাকার জাতীয় স্বার্থ জড়িত আছে।
একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আজ যে তিন লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশি পাসপোর্ট চাইছে তার পেছনে রয়েছে কমবেশি ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সালের সালের ঘটনা। ওই সময়ে মিয়ানমারের সরকার ও জান্তা বাহিনীর নির্যাতন থেকে জীবন বাঁচাতে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমার ছেড়েছিল। ওই সময় ইসলামিক দেশগুলোর জোট ওআইসি অনেক প্রভাবশালী ছিল। ওআইসির মধ্যস্থতায় তখন ওই পাঁচ লাখ রোহিঙ্গাকে সৌদি আরব স্বেচ্ছায় আশ্রয় দেয়। সৌদি আরবের অনুরোধে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে আড়াই লাখ পাকিস্তানের পাসপোর্ট এবং বাকি আড়াই লাখ বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবে আশ্রয় পায়। ওই সময়ে পাকিস্তান যে আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে পাসপোর্ট দেয়, সেই পাসপোর্টে তাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেই উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের আমলারা রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেওয়ার সময় এসব কিছুই উল্লেখ করেনি। শুরুতে বাংলাদেশ থেকে সৌদিতে যাওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পাসপোর্ট দিতে যে ভুল করেছিল, চার দশক পরে এসে এখন সেই ভুলের দায় বহন করতে হচ্ছে। ওই সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন জিয়াউর রহমান। এদিকে সৌদি আরবে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের অবৈধ ও অনৈতিক বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপের জন্য বিরক্ত দেশটি। এজন্য গত ২০১০ সালের পর থেকেই সৌদি চাইছে এসব রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে। এই নিয়ে মাঝে সৌদি বাংলাদেশকে একাধিকবার চাপে রাখে এবং ঢাকা-রিয়াদ একাধিকবার বৈঠকও হয়েছে, কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।
সর্বশেষ সৌদি স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী নাসের বিন আবদুল আজিজ আল দাউদ রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠকে সৌদিতে বসবাসরত তিন লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিতে বলেছেন। এর আগে ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে চাপে রাখে সৌদি আরব। তখন দেশটি দাবি করেছিল, যে ৫৪ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবে গেছেন তারা বাংলাদেশি। তাই তাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিতে হবে। রিয়াদের পক্ষ থেকে ঢাকার কাছে ওই সময়ে এ ৫৪ হাজার রোহিঙ্গার তথ্য-উপাত্তও দেওয়া হয়। তখনও এই বিষয়ে যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয় এবং ওই কমিটির বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু এরপরই করোনা অতিমারি শুরু হওয়ায় বিষয়টি আর বেশিদূর এগোয়নি।
এ বিষয়ে ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে ৮০-৯০ সালের দিকে ওই সময়ের সৌদি বাদশা স্বপ্রণোদিত হয়ে অনেক রোহিঙ্গাকেই তার দেশে নিয়ে যান। অনেকে সরাসরি চলে যান, অনেকে হয়তো বাংলাদেশ হয়েও গেছেন। আমরা এ ঘটনার বিস্তারিত জানি না। সৌদি বলছে, ওখানে ৫৪ হাজার রোহিঙ্গা আছেন এবং তাদের অনেকের আবার পরিবারও হয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েরা জীবনে বাংলাদেশে আসেনি, তারা আরবিতে কথা বলে, বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানে না। সৌদি সরকার প্রথম বলেছিল ৪৬২ জন রোহিঙ্গা জেলে আছেন, তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। আমরা সৌদিকে বলেছি, তারা বাংলাদেশি হলে অবশ্যই আমরা ফিরিয়ে আনব; কিন্তু তার আগে আমরা যাচাইবাছাই করব। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তারা কোনো একটা প্রমাণ দিতে পারলে, আমরা অবশ্যই তাদের ফিরিয়ে আনব। আমাদের মিশন সৌদি গিয়ে বিষয়টি যাচাইবাছাই করেছে। দেখা গেছে, অধিকাংশেরই বাংলাদেশি হিসেবে কোনো প্রমাণপত্র নেই। তারপর সৌদি আরও বলল, ৫৪ হাজারের মতো রোহিঙ্গা তাদের দেশে আছে। এদের কোনো পাসপোর্ট নেই। সৌদি তাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার জন্য আমাদের বলল। আমরা বললাম, আগে যাদের পাসপোর্ট দিয়েছিলাম তাদের যদি আবার পাসপোর্ট লাগে তাহলে দেব; কিন্তু নতুন কাউকে পাসপোর্ট দেওয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া এ রোহিঙ্গারা যদি আমাদের লোকই না হয় তাহলে কেন পাসপোর্ট দেব। এই বিষয়ে আমরা পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে একটা উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছি, তারা যাচাইবাছাই করে দেখবে।’
একই বিষয়ে ২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের উপস্থিতিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ইসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলান বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা ঢাকা হয়ে রিয়াদ অথবা দাম্মাম হয়ে সৌদি আরবে পৌঁছেছে। কাজেই তারা বাংলাদেশি। এদের পাসপোর্টের মেয়াদ না থাকায় বা পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ায় তাদের তালিকা বাংলাদেশকে দিয়েছে সৌদি আরব। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়ায় সৌদি আরব এদের বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করছে।’ ওই অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশি নাগরিক যদি ওইখানে (সৌদি আরব) রোহিঙ্গা হিসেবে গিয়ে থাকে অবশ্যই তাদের পাসপোর্ট না থাকলে আমরা পাসপোর্ট দেব। তারা যদি বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে না যায় আর রোহিঙ্গাই হয়ে থাকে তবে সেসব ক্ষেত্রে বিচার-বিশ্লেষণ করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’
রোববার সৌদি স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী নাসের বিন আবদুল আজিজ আল দাউদ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেই ২০২১ সালের ১৭ নভেম্বরের কথাই বলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সৌদি আরবে রোহিঙ্গারা তিন প্রজন্ম ধরে অবস্থান করছেন। পাকিস্তান আমল থেকে তারা সেখানে আছেন। বাংলাদেশ থেকে যেসব রোহিঙ্গা নিজেদের ম্যাকানিজমে বিশেষ বিবেচনায় গিয়েছিলেন তাদের বিষয়ে কী করা যায় সেটা তারা খতিয়ে দেখবেন। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি আরও জোরদার করতে সৌদি আরবের সহযোগিতা চেয়েছি আমরা। একটা জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ হচ্ছে। এ কমিটিতে সৌদি আরবের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা থাকবেন। যখন যে সমস্যা সামনে আসবে সেটা তারাই সমাধান করবেন। তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করে দেওয়ার জন্যই কমিটি করে দেওয়া হচ্ছে। কমিটি যেটা মনে করবে এটা নবায়ন করে দিতে হবে। বাংলাদেশি পাসপোর্ট সম্পর্কে নিশ্চিত হলে সঙ্গে সঙ্গে তারা নবায়ন করে দেবে। কীভাবে যাচাইবাছাই হবে তারাই ঠিক করবেন। আমরা আমাদের পাসপোর্টধারীদের প্রাধান্য দেব। এর বাইরে কাউকে প্রাধান্য দেব না।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সৌদি স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী নাসের বিন আবদুল আজিজ আল দাউদ রোববার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে একটি অভিজাত হোটেলে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে বাংলাদেশে সাময়িক আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সৌদির সহযোগিতা চেয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
মিয়ানমারে নিযুক্ত সাবেক সামরিক অ্যাটাশে এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল হক সময়ের আলোকে বলেন, ‘সৌদি এখন যে তিন লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিতে বলছে, এ রোহিঙ্গারা ৭৬ থেকে ৭৯ সালের দিকে বাংলাদেশ থেকে সৌদি যায়। ওই সময় আড়াই লাখ করে মোট পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি যায়। কিন্তু পাকিস্তান তাদের তখন পাসপোর্ট দিলেও তারা যে মিয়ানমারের নাগরিক তা পাসপোর্টে উল্লেখ করে দেয়, যা বাংলাদেশ করেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সৌদি আরব বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজার। সেখানে কমবেশি ২৮ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত এবং দেশের রেমিট্যান্সের অন্যতম উৎস সৌদি আরব। রিয়াদের সঙ্গে ঢাকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই রোহিঙ্গা ইস্যুটা সৌদির সঙ্গে সতর্কভাবে সমাধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আগ বাড়িয়ে কাজ করে প্রমাণ করতে হবে যে, সৌদিতে বসবাসরত তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশি নয়, তারা মিয়ানমারের নাগরিক। তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হোক।’