28/10/2023
হযরত ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) কি তাবেয়ী ছিলেন না? মতানৈক্য ও সমাধান
উত্তরঃ মুতাকাদ্দিমীনদের মধ্যে প্রায় সকলেই একমত ছিলেন যে, ইমামে আ'যম (রহ.) একজন তাবেয়ী ছিলেন। মুতায়াখখিরীন উলামায়ে কেরামের মধ্যে অবশ্যই ৩টি মত হয়ে যায়।
1 একটি জামাতের মতে ইমামে আ'যম (রহ.) তাবেয়ী ছিলেন না। তবে এ জামাত অতিব সংখ্যালঘু একটি জামাত। এদের মধ্যেও ইমাম দারা কুতনী থেকে দু'টি মত রয়েছে। ইমামে আ'যম (রহ.)-এর সাথে হযরত আনাস (রা.)-এর সাক্ষাৎ হওয়া প্রমাণিত নয়। আরেকটি মত ছিল, হ্যাঁ সাক্ষাৎ হওয়া প্রমাণিত, তবে শ্রবণ প্রমাণিত নয়। শেষের মতটি ইমাম জালালুদ্দীন আস-সুয়ূতি (রহ.) তার 'তাব'য়ীদুস সহীফাহ' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এভাবে যে, ((قال حمزة السهمي: سمعت الدارقطني يقول: "لم يلق أبو حنيفة أحدا من الصحابة إلا إنه رأى أنسا بعينه ولم يسمع منه)) অর্থাৎ “হামযাহ আস-সাহমী বলেন, আমি ইমাম দারা কুতনী (রহ.) থেকে শুনেছি তিনি বলেন, ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) সাহাবীদের মধ্যে আনাস ইবনে মালেক ছাড়া আর কারো সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেননি, তবে তিনি আনাস (রা.)-কে স্বচক্ষে দেখেছেন, কিন্তু তিনি তাঁর কাছ থেকে শ্রবণ করেননি।”
2 দ্বিতীয় জামাতের মতে, ইমামে আ'যমের সাথে শুধুমাত্র হযরত আনাস (রহ.)-এর সাক্ষাৎ হওয়াই প্রমাণিত, কিন্তু শ্রবণ প্রমাণিত নয়। ইমাম হাফিয যাহাবী হাম্বলী, ইবনে হাজার আসকালানী শাফেয়ী আল-আশ'আরী, খতীবে বাগদাদী আশ শাফেয়ী, ইমাম ইবনু সা'আদ, ইমাম ওয়ালি আল ইরাক, ইবনু যওযী, আবূ মা'শার হামযাহ আস সাহামী, আল ইয়াফিয়ী, আল জাজরী সহ ইমামগণের বড় একটি জামাত এ মতের পক্ষে (আল মওসূআতুল হাদীসিয়্যাহ ২:৮৯-৯০)। এমনকি ইমাম হাফিয যাহাবী 'তাজরীদু আসমায়িস সাহাবাহ' (تجريد اسماء الصحابة) গ্রন্থে এবং ইমাম ইবনুল আছীর (إبن الأثير) 'উসদুল গাবাহ'-أسد الغابة (৫/৫০৫) গ্রন্থে মুতাকাদ্দিমীনগণের মধ্য হতে ইমামু জারহি ওয়াত তা'দীল ইয়াহইয়া ইবনে মা'ঈন আল হানাফী (১৫৮-২৩৩ হিজরী)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ((أثبت سماع ابى حنيفة من عائشة بنت عجرد يحيى ابن معين)) অর্থাৎ ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মা'ঈন হযরত আয়েশা বিনতে উজরাদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে আবূ হানীফা (রহ.)-এর শ্রবণ প্রমাণিত বলে সাব্যস্ত করেছেন।” (তাব'য়ীদুস সহীফাহ পৃ-৬২ পাদ টীকা দ্রষ্টব্য)।
ইমাম যাহাবী আরেক জায়গায় লিখেছেন, ((و كان من التابعين لهم ان شاء الله باحسان فانه صح انه رأى انس بن مالك اذ قدمها أنس رضى الله عنه)) অর্থাৎ “তিনি (ইমামে আযম) সাহাবায়ে কেরামের সাক্ষাৎ লাভের কারণে তাবেয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত। এ কথা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত, হযরত আনাস বিন মালেক যখন কূফায় আগমন করলেন তখন ইমাম আবূ হানীফা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন।” (মানাকীবে ইমাম আবী হানীফা ৯-১০, ইমাম যাহাবী)।
তারপর ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) লিখেছেন, ((أدرك أبو حنيفة جماعةً من الصحابة؛ لأنه ولد بالكوفة سنة ثمانين من الهجرة، وبها يومئذٍ: عبد الله بن أبي أوفى، فإنه مات بعد ذلك بالاتفاق. وبالبصرة يومئذ أنس بن مالك، ومات سنة تسعين أو بعدها. وقد أورد ابن سعد بسند لا بأس به: أن أبا حنيفة رأى أنسا، وكان غير هذين من الصحابة بعِدَّةٍ من البلاد أحياء)) অর্থাৎ আবূ হানীফা (রহ.) সাহাবীদের একটি জামাতের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। কারণ তিনি জন্মগ্রহণ করেন কূফায় ৮০ হিজরীতে আর সেখানেই ছিলেন (সাহাবী) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা (রা.)। তিনি সর্বসম্মতিক্রমে মারা গিয়েছিলেন ৮০ হিজরীর (অনেক) পরেই (অর্থাৎ ৮৭ হিজরীতে)। আর সে সময় বসরায় ছিলেন হযরত আনাস বিন মালেক (রা.)। তিনি ইন্তেকাল করেন ৯০ হিজরীর পরে। ইবনু সা'আদ এটি এমন সনদে বর্ণনা করেছেন যাতে কোনো সমস্যা নেই। মোটকথা হল, আবূ হানীফা হযরত আনাসকে দেখেছিলেন। এ দু'জন ছাড়া অধিক সংখ্যক সাহাবী সেই শহরে জীবিত ছিলেন।” (আল মওসূআতুল হাদীসিয়্যাহ ২:৯০)।
ইমাম হাফিয মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ সালেহী আশ-শাফেয়ী (মৃত: ৯৪২হিজরী) বলেন, ((اعلام رحمك الله تعالى أن الامام أبا حنيفة رضى الله عنه تعالى عنه من التابعين و صح كما قال الحافظ الناقد ابو عبد الله الذهبى أنه رأى أنس بن مالك رضى الله عنه و هو صغير)) অর্থাৎ “আল্লাহ তাঁর উপর রহম করুন। এ কথা জেনে নাও যে, ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) তাবেয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত, যেমনটি হাফিয যাহাবী বলেছেন; এ কথা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত যে, ইমাম সাহেব শৈশবকালে হযরত আনাস বিন মালেক (রা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন।” (উকূদুল জুমান লিস-সালেহী পৃষ্ঠা নং ৭০)।
ইমাম আবূ ইসহাক ইবরাহীম ইবনে আলী আস-সিরাজি (মৃত. ৪৭৬) طبقات الفقهاء নামীয় কিতাবে লিখেছেন, ((أبا حنيفة في فقهاء التابعين بالكوفة، فقال: كان في أيامه أربعة من الصحابة: أنس بن مالك وعبد الله بن أبي أوفى الأنصاري وأبو الطفيل عامر ين واثلة وسهل بن سعد الساعدي، وجماعة من التابعين كالشعبي والنخعي وعلي بن الحسين وغيرهم، وقد مضى تاريخ وفاتهم، ولم يأخذ أبو حنيفة عن أحد منهم)) অর্থাৎ “আবূ হানীফা (রহ.) ছিলেন একজন কূফার ফকীহ তাবেয়ীগণের অন্যতম। তাঁর সময় চারজন সাহাবী ছিলেন। আনাস বিন মালেক, আব্দুল্লাহ বিন আবী আওফা আল আনসারী, আবূ তোফায়েল আমের বিন ওয়াসেলাহ, সাহাল বিন সা'আদ আস-সা'দী এবং তাবেয়ীদের বিরাট জামাত ছিল। তন্মধ্যে শু'বাহ, নাখ'ঈ, আলী বিন হুসাইন প্রমুখ। সাহাবীদের তিরোধানের তারিখ অতীত হয়ে যায় কিন্তু আবূ হানীফা (রহ.) তাদের থেকে কোনো কিছু নেননি।”
3 তৃতীয় জামাতের মতে, ইমামে আ'যমের সাথে একাধিক সাহাবীর সাক্ষাৎ হওয়াই প্রমাণিত, এমনকি কয়েকজন সাহাবীর কাছ থেকে তাঁর রেওয়ায়েতও প্রমাণিত। আল্লামা আ'ঈনী, তুরফুসতী, সুয়ূতী এবং হাইসামী সহ অসংখ্যা ইমাম এ মতের পক্ষে। শারেহে বুখারী ইমাম বদরুদ্দীন আ'ঈনী আল-হানাফী প্রমাণ করেছেন যে, ইমামে আ'যম যাদের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন তিনি তাদের কাছ থেকে শ্রবণও করেছেন (তাব'য়ীদুস সহীফাহ পৃ-৬২ পাদ টীকা দ্রষ্টব্য)। শাফেয়ী মাযহাবের বিখ্যাত অনেক ইমামও এ মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং স্বতন্ত্র "মানাকিব" রচনা করে এ মতটি প্রতিষ্ঠাও করে গেছেন। তাদের মধ্যে ইমাম ইবনে হাজার মাক্কী আল হাইছামী (মৃত. ৯০৯ হিজরী), ইমাম আবুল ফালাহ মুহাম্মদ ইবনুল ই'মাদ আল হাম্বলী (মৃত. ১০৮৯ হিজরী), শায়খুল কুররা ইমাম মুক্বরি আশ শাফেয়ী (মৃত. ৪৭৮ হিজরী) এবং ইমাম জালালুদ্দীন আস-সুয়ূতী (মৃত. ৯১১ হিজরী) অন্যতম। ইমাম হাইছামী (রহ.) তো আল্লামা আ'ঈনীর মতকে দৃঢ়ভাবে সমর্থনও করেছেন (আল খায়রাতুল হিসান পৃ-২১-২৩)।
ইমাম আবূ যাকারিয়া ইবনে ইয়াহইয়া ইবনে ইবরাহীম ইবনে আহমদ আল আযদী (মৃত. ৫৫০ হিজরী)-এর রচিত منازل الأئمة الأربعة للأزدي কিতাবে লিখা আছে, ((قال أبو حنيفة: حججت مع أبي سنة ست وتسعين، ولي ست عشرة سنة، وإذا أنا بشيخ قد اجتمع الناس عليه، فقلت لأبي: من هذا الرجل؟ فقال: هذا رجل قد صحب محمدا صلى الله عليه وسلم يقال له عبد الله بن الحارث)) অর্থাৎ “আবূ হানীফা (রহ.) বলেন, আমি আমার পিতার সাথে ৯৬ হিজরীবর্ষে হজ্জ করেছি, তখন আমি ষোল বছরের তরুণ। ইত্যবসরে আমি একজন প্রবীণ (শায়খ) ব্যক্তিকে কাছে পেলাম। লোকজনও তাঁর নিকট এসে জমায়েত হল। তখন আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, এ লোকটি কে? তিনি বললেন, এ লোকটি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একজন সাহাবী, নাম আব্দুল্লাহ ইবনে হারেস।”
তিনি আরও লিখেছেন, ((فابو حنيفة أدرك الصحابة رضى الله عنهم فهو من التابعين)) অর্থাৎ “ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) সাহাবীদের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। কাজেই তিনিও তাবেয়ীদের অন্তর্ভুক্ত।” (ঐ পৃষ্ঠা নং ৩৫)।
শামসুল আয়েম্মাহ আল কিরদারী-الكردرى (রহ.) (৫৬৯-৬৪২ হিজরী) 'মানাকিবু আবী হানীফা' (পৃ-২৫) গ্রন্থে চমৎকার বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ((فالحاصل ان جماعة من المحدثين انكروا ملاقاته مع الصحابة رضى الله عنهم، و اصحابه أثبتوه بالاسانيد الصحاح الحسان، و هم اعرف باحواله منهم، و المثبت أولى من النافى)) অর্থাৎ সারমর্ম কথা হচ্ছে, মুহাদ্দিসগণের একটি জামাত সাহাবায়ে কেরামের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হওয়াকে অস্বীকার করেছেন। অথচ ইমামে আ'যম (রহ.) এর সাথীগণ সহীহ এবং হাসান পর্যায়ের সনদ সমূহ দ্বারা তাঁর সাক্ষাৎ হওয়াকে সাব্যস্ত করেছেন। পরন্তু তাঁর ব্যাপারে তাঁর সাথীগণই এদের চেয়ে বেশি জানতেন। ফলে সাক্ষাৎ লাভ হওয়া মতটিই সাক্ষাৎ না হওয়া মতের চেয়ে বেশি প্রাধান্যযোগ্য ও প্রমাণিত। (তাব'য়ীদুস সহীফাহ পৃ-৬২ পাদ টীকা দ্রষ্টব্য)।
উল্লেখ্য, ইমাম যাহাবী (রহ.) আল্লামা কিরদারী (রহ.) সম্পর্কে লিখেছেন ((العلامة فقيه المشرق شمس الأئمة أبو الوحدة محمد بن عبد الستار بن محمد العمادي الكردري الحنفي البراتقيني)) অর্থাৎ একজন আল্লামা, ফকীহুল মাশরিক্ব ও শামসুল আয়েম্মাহ, আবুল ওয়াহদাহ মুহাম্মদ ইবনু আব্দিস সাত্তার ইবনু মুহাম্মদ আল ইমাদি আল কিরদারী আল হানাফী আল বুরাতাক্বীনী। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ২৩:১১৩)।
এবার ইমাম সুয়ূতী (রহ.) সংকলিত 'তাবয়ীদুস সহীফাহ' কিতাব থেকে আলোচ্য অংশটির অনুবাদ নিচে তুলে ধরছি,
“ইমাম মুক্বরী আশ শাফেয়ী স্বীয় 'আল জুঝ' গ্রন্থে সাহাবায়ে কেরাম থেকে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর বর্ণিত রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন যে, আবূ হানীফা বলেছেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাতজন (৭) সাহাবীর সাক্ষাৎ লাভ করেছি। তারা হচ্ছেন,
১. আনাস বিন মালেক, ২. আব্দুল্লাহ বিন জুঝ আয যোবাইদী, ৩. জাবির ইবনু আব্দিল্লাহ, ৪. মা'ক্বাল ইবনু ইয়াসার, ৫. ওয়াসিলাহ ইবনু আস'কা ৬ আয়েশা বিনতে উজরাদ (এবং ৭. আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আ'ওফা) প্রমুখ।”
সংক্ষেপে।
প্রামাণ্য স্ক্যানকপি দ্রষ্টব্য
লিখক মুহাম্মদ নূরুন্নবী এম.এ
অ্যাডমিন ফিকহ মিডিয়া
#ইমামে
#আযম
#তাবেয়ী