27/05/2024
মানব কল্যাণে পঞ্চশীলের গুরুত্ব
ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু
মহান শিক্ষক ভগবান বুদ্ধ হলেন পৃথিবীর জন্য এক আশীর্বাদ তুল্য। বুদ্ধগণের আবির্ভাব হয় বহুজনের হিত ও সুখের জন্য। তিনি সমগ্র জগতের মহান মার্গদাতা। এজন্য মানব সমাজ তাঁর প্রতি সবসময় অবনত মস্তক। লোকেরা সর্বত্র বৈশাখী পূর্ণিমাকে উপলক্ষ করে তাঁর জয়ন্তী মহাসমারোহে উদযাপন করে থাকে। সমগ্র পৃথিবীর লোকদেরকে তাদের দুঃখ দূর করতে এবং প্রত্যেকের হিত-সুখের প্রসার করতে তিনি পঞ্চশীল মার্গে চলার বার্তা প্রদান করেছেন। তিনি বলেছিলেন-‘বহুজন হিতায় এবং বহুজন সুখায়’ এ লক্ষ্যে পাঁচটি নৈতিক সদাচার নীতি পালন করা অতীব আবশ্যক। নৈতিক সদাচার বিহীন জীবন ও পশুর জীবনের মধ্যে তেমন পার্থক্য থাকেনা। মানুষের মধ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা, মানবতা, সদাচার, নৈতিকতা, সদ্ভাব, সম্প্রীতি, প্রেম-মৈত্রী ইত্যাদি স্থাপনে পঞ্চশীলের গুরুত্ব রয়েছে অপরিসীম। তাহলে আসুন, আমরা দেখব যে, পঞ্চশীল কি?
সমগ্র পৃথিবীতে মানব সমাজের বিকাশ এবং নৈতিক উত্থানের জন্য বৌদ্ধ ধম্মের বা বুদ্ধ শিক্ষার পঞ্চশীল অনুশীলন অতীব তাৎপর্যপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়। তথাগত গৌতম বুদ্ধ প্রত্যেক মানুষের জন্য পঞ্চশীলের অনুশীলন করা আবশ্যক বলে বর্ণনা করেছেন। সদাচার এবং সংযম অমান্যকারীদেরকে সমাজে চরিত্রহীন বলে গণ্য করা হয়। সদাচার-সচ্চরিত্রের অনুসরণ করা মনুষ্য জীবনের জন্য উচ্চ আদর্শ মান্য করা হয়েছে।
বৌদ্ধ ধম্মে কোনো বর্ণ, জাতি এবং গোত্রে জন্ম নিলে তাতে কোনো ব্যক্তি বড় বা ছোট অথবা উঁচু বা নীচু হয়না। বরং বুদ্ধ নির্দেশিত পঞ্চশীল লাগাতার প্রতিপালন করলেই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ ও আদর্শ মনুষ্য হয়ে থাকে এবং পঞ্চশীল প্রতিপালন না করলে বা তার বিপরীত আচরণ করলেই কোনো ব্যক্তি ছোট বা নিম্ন শ্রেণীর বলে দেখা হয়। ইহাকে কর্মবাদ বলা হয়। বুদ্ধের শিক্ষায় কর্মবাদকে অধিকতর মহত্ব প্রদান করা হয়েছে। তাই গৃহত্যাগী ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের জন্য আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুসরণ করা অতীব আবশ্যক। কিন্তু পরিবার এবং সমাজে বসবাসকারী সাধারণ গৃহস্থ লোকদের জন্য পঞ্চশীল মার্গের অনুশীলন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মান্য করা হয়।
ভগবান বুদ্ধ বারাণসীর নিকটে সারনাথের মৃগবনে ৫২৮ খৃষ্টপূর্বে আষাঢ়ী পূর্ণিমা দিনে ধম্মচক্র প্রবর্তন করতে গিয়ে পাঁচজন পরিব্রাজকদেরকে বলেছিলেন, যে কোনো ব্যক্তি ভাল চরিত্র সম্পন্ন হতে ইচ্ছা করলে, জীবনের বিকাশ ও শান্তি লাভ করতে চাইলে, তার জন্য জীবনের কোনো মানদণ্ড অনুসরণ করা অতীব আবশ্যক। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জীবনের কোনো মানদণ্ড থাকা অবশ্যই উচিত। যাতে করে সে জীবনের ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখের পরিমাপ করতে সক্ষম হয়। তথাগত বুদ্ধ বলেছেন যে, তাঁর নির্দেশিত পাঁচ প্রকারের যে নীতি বা শীল রয়েছে, তা হল ভাল সদাচরণ, যা হল মনুষ্য জীবনের জন্য ভাল-মন্দ পরিমাপ করার এক অনন্য মানদণ্ড। পঞ্চশীল হল নিম্ন প্রকার-
১) ‘পাণাতিপাতা বেরমণী’ অর্থাৎ কোনো প্রাণীকে হত্যা না করা বা ব্যক্তি দ্বারা কোন স্বার্থ, উদ্দেশ্য বা ইচ্ছার দ্বারা মনুষ্য বা অন্য কোনো প্রাণীকে হত্যা করা হল অনেক মন্দ বা অসৎ কর্ম। হিংসা-বিদ্বেষ, জায়গা-সম্পত্তি, ব্যভিচার এবং অন্যান্য শত্রুতার কারণেও লোকেরা একে অপর ব্যক্তি বা প্রাণীকে হত্যা করে থাকে। এজন্য বৌদ্ধ ধম্মে মনুষ্যকে হত্যা হতে বাঁচতে পঞ্চশীলের এ প্রথম শীলের অনুশীলন অতীব তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। ইহা হল মানুষের প্রথম নৈতিক সদাচার। হত্যা হতে বিরতির জন্য মনুষ্যকে সকল জীবের প্রতি অপরিমেয় প্রেম, মৈত্রী, দয়া, করুণা ও ভালবাসা ভাবনা এবং ব্যবহার থাকা উচিত। যদি কোনো ব্যক্তি জীব-হত্যা হতে বিরত থাকার সঙ্কল্প গ্রহণ করে কায়-বাক্য-মনে ঈর্ষা-দ্বেষ ত্যাগ করেছে এবং সে অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যবহার ত্যাগ করে দিয়েছে, তাহলে তার অহিংসা ধম্মের অর্থাৎ শীলের প্রতিপালন হয়ে থাকে।
২) ‘অদিন্নদানা বেরমণী’ অর্থাৎ অদত্ত বস্তু গ্রহণ বা চুরি না করা। বুদ্ধের শিক্ষায় চুরি হল এক বড় অপরাধ। এজন্য তথাগত বুদ্ধ বলেছেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তির সততার সাথে জীবন-যাপন করা উচিত। কখনও কারো বস্তু বা সামগ্রী চুরি করতে নেই। কখনও কারো সম্মতি ব্যতিরেকে কোনো বস্তু গ্রহণ করা সমীচীন যেমন নয়, তেমনি নেওয়ার প্রচেষ্টা করাও উচিত নয়। পঞ্চশীলের দ্বিতীয় এ শীল বা সদাচারটিও প্রত্যেকের নিষ্ঠার সাথে পালন করা উচিত। যদি কারো কোনো বস্তুর আবশ্যক হলে, তখন তা মালিকের কাছ হতে চেয়ে নেওয়াই বাঞ্ছনীয় এবং মালিকের সম্মতিতেই নিতে হবে। যদি সে বস্তু ফেরত দেওয়ার শর্তে নেওয়া হয়, তাহলে যথাসময়ে তা ফেরত দেওয়াও কর্তব্য। অন্য ব্যক্তির সম্পত্তি লোভ করে আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই চুরি, হত্যা, লুঠ এবং অন্যান্য হিংসাত্মক ঘটনা সমূহ ঘটে থাকে এবং তাতে সমাজে নানা অশান্তি সৃষ্টি হয়।
৩) ‘কামেসু মিচ্ছাচারা বেরমণী’ অর্থাৎ বুদ্ধের শিক্ষায় পুরুষ বা স্ত্রী দ্বারা পর পুরুষ বা পর নারীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাকেই মুখ্যতঃ ব্যভিচার বলা হয়। অর্থাৎ তৃতীয় শীল ভঙ্গের আরোপ এসে যায়। যে সকল মেয়ে অবিবাহিত এবং সে যদি নিকট সম্বন্ধিত কারো সংরক্ষণে জীবন-যাপন করে, তার সাথে যৌন সহবাস করা হলে এবং যে নারীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তার সাথে অন্যপুরুষ যদি কামভোগ করে থাকে, তাহলে তাতে ব্যভিচার হয়ে যায়। এরকম আচরণ করলে মনুষ্যের ধন, শরীর এবং সম্মান হানি হয়ে থাকে। এরকম অপরাধ যুক্ত আচরণ দ্বারা সমাজে ব্যক্তি ব্যক্তির মধ্যে ঈর্ষা, দ্বেষ, লড়াই-ঝগড়া, এবং হিংসাত্মক ঘটনা সমূহ বৃদ্ধি পায়। ইহা সমাজের সবচেয়ে বড় অনাচার সমূহের মধ্যে অন্যতম। এজন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে এরূপ অপরাধ কর্ম হতে দূরে থাকা প্রয়োজন।
৪) ‘মুসাবাদা বেরমণী’ অর্থাৎ মিথ্যা কথন হতে বিরত থাকা। ইহা হল বাক্য সম্বন্ধিত শীল বা সদাচার। প্রত্যেক লোকের উচিত সত্য ভাষণ করা এবং সকলকে মিথ্যা বলা হতে সবসময় বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। মিথ্যা বলা হল অনেক বড় অপরাধ। পরিবার হোক বা সমাজ-সভা হোক অথবা পঞ্চায়েত হোক বা রাজ্য পরিষদ হোক বা বিচারালয় হোক, সর্বত্র ব্যক্তিকে পক্ষপাত বিহীন কোনো ঈর্ষা, দ্বেষ, ভয় এবং স্বজন প্রীতি বশতঃ নিজের বা অন্য কারো জন্য লাভ-ক্ষতি চিন্তা না করে সর্বদা সত্য ভাষণ করা উচিত। এরকম স্থানে মিথ্যা বললে অন্য কোনো ব্যক্তির শাস্তি, হানি এবং পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হয়। বৃথা কথা বললে, কটু কথা বললে এবং ভেদমূলক বাক্য বললেও অসত্য বাক্য হয়ে থাকে। এগুলির কারণেও সমাজে অশান্তি প্রসারিত হয়। এজ বুদ্ধের শিক্ষায় সত্য এবং প্রিয় বলা অনেক বড় সদাচার মান্য করা হয়। এরকম সত্য বলা হলে সমাজের মধ্যে এবং লোকদের মধ্যে পরস্পরের মধ্যে প্রেম, ভ্রাতৃত্ব এবং শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন হয়ে থাকে।
৫) ‘সুরা-মেরেয্য-মজ্জ-পমাদট্ঠান বেরমণী’ অর্থাৎ মদ্যাদি নেশা জাতীয় পদার্থের সেবন না করা। সুরা, মদ ইত্যাদি নেশা জাতীয় বস্তু ত্যাগ করাও হল এক বড় সদাচার বা শীল। বুদ্ধের শিক্ষায় ইহারও অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে। নেশাপান করলে মানুষের মন এবং চিন্তাশক্তি যুক্তিসঙ্গত, বিবেক প্রসূত এবং জ্ঞান পূর্বক থাকেনা। ব্যক্তির বুদ্ধি-বিবেক এবং ব্যবহার অসামান্যরূপে গড়বড় হয়ে যায়। নেশাপান করলে চুরি, লুঠপাট, মিথ্যা, হত্যা, এবং ব্যভিচার ইত্যাদি করার প্রবৃত্তি উৎপন্ন হয়ে থাকে। যার কারণে পরিবার এবং সমাজকে ভারী ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় এবং ব্যক্তিকে শারীরিকভাবে, আর্থিকভাবে এবং সম্মানের হানির স্বীকার হতে হয়। নেশা জাতীয় ব্যবসা হতেও অন্য লোকদের এবং সমাজের ভারী ক্ষতি হয়ে থাকে। এজন্য বুদ্ধের শিক্ষায় নেশাদ্রব্যকে গ্রহণ করা, সেবন করা এবং সেগুলির ব্যবসা করাকে এক বড় অপরাধ গণ্য করা হয় এবং এগুলি হতে বিরত থাকাকে এক অনেক বড় সদাচার বিবেচিত হয়।
এরূপ উপযুক্ত মানদণ্ডের আধারে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের জীবনে অনুধাবন করতে পারে যে, সে সত্য এবং ন্যায়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, না পতন বা অপরাধের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এরূপ উপরিউক্ত মানদণ্ডের ভিত্তিতে আমরা নিজের সমাজ এবং রাষ্ট্রের মূল্যাঙ্কন করতে পারি যে, তার নাগরিকদের নৈতিক উত্থান এবং বিকাশের স্তর কতটুকু। উপরিউক্ত ধম্ম এবং নৈতিক সদাচার পালন না করলে ব্যক্তি এবং সমাজের পতন হয়ে থাকে। সদাচার হতে পতন হওয়া বহুসংখ্যক নাগরিকদের কারণেই সমাজ এবং রাষ্ট্রের পতন হয়ে থাকে।
পৃথিবীর অনেক বিদ্বান সমাজ বিজ্ঞানীরা এ সম্পর্কে পুস্তকাদি প্রণয়ন করে বিস্তৃতভাবে লিখেছেন যে, পৃথিবীতে প্রত্যেক স্থানে দু’ প্রকারের মন্দ এবং পতিত লোক হয়ে থাকে। যাদের জীবনে অবশ্যই কোন না কোন মানদণ্ড দেখা যায়। প্রথম প্রকারের লোক নিজের পতন বা পতন হওয়ার অবস্থা হতে সবসময় উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু কিভাবে উপরে উঠতে হবে সে রাস্তা জানতে পারেনা।
দ্বিতীয় প্রকারের পতিত বা মন্দ ব্যক্তি হল যাদের জীবনে কোন প্রকার মানদণ্ড থাকেনা। তারা পতিত বা পতন হতে থাকলেও জানেনা যে তাদের পতন হয়েছে বা পতন হতে যাচ্ছে। এজন্য এরকম লোক উপরে উঠার কোনো প্রয়াসই করতে পারেনা। এরকম লোক নিজের স্তর হতে নীচে নেমে পড়লেও বিশেষ কিছু তাদের উপলব্দি হয়না, যা তাদের জীবনে কোনো স্তরই নয়।
তথাগত বুদ্ধ বলেছেন যে, প্রত্যেক মনুষ্যের নিজেকে জিজ্ঞাসা করা উচিত যে, পঞ্চশীল পালন করলে ব্যক্তির কি কল্যাণ হয়, না অকল্যাণ? সমাজের জন্যও এ শীল কল্যাণকারী, না অকল্যাণকারী? যে সকল লোক এ সদাচার সমূহ পালন করেনা, তাদের চার প্রকারের হানি হয়ে থাকে। যেমন-
১) তাদের ধন-সম্পত্তির অনেক ক্ষতি হয়ে থাকে।
২) তাদের সম্পর্কে বহু অকীর্তি, অযশ ও অসম্মান প্রসারিত হয় এবং অন্যদের দৃষ্টিতে তাদেরকে হীন-নীচ দেখা হয়।
৩) তারা যে কোনো সভা, পরিষদ বা সমূহে বড়ই অশান্ত মন, সঙ্কোচ এবং ভয়ভীত হয়ে পেছনে উপস্থিত হয় এবং
৪) মৃত্যুর সময় তারা শান্তিতে মরতে পারেনা এবং মৃত্যুর পরেও তারা দুঃখ ভোগ করে থাকে।
এভাবে স্পষ্ট হচ্ছে যে, মনুষ্য এবং মনুষ্য সমাজের জন্য পঞ্চশীলের সীমাহীন গুরুত্ব রয়েছে। পঞ্চশীল হল সকল লোকের জন্য খুবই হিতকারী ও লাভদায়ক। এরূপ সদাচার পালন করলে কোনো বর্ণ, জাতি, বিশ্বাস বা আস্থায় ভেদ-বিভেদ থাকেনা এবং আত্মা-পরমাত্মা, ঈশ্বর-পরমেশ্বর, স্বর্গ-নরক, তন্ত্র-মন্ত্র, পূজা-অর্চনা ইত্যাদি নানা প্রকার কাল্পনিক কর্মকাণ্ড মানারও আবশ্যকতা হয়না। ইহা হল মনুষ্যের বিকাশের জন্য একেবারেই যথার্থ এবং ভাল কর্মের ভিত্তিতে কর্মবাদ, যার প্রভাবে ভাল, সদ্গুণ এবং লাভান্বিত হওয়ার অনুভব করা যায় ও তা স্বচক্ষে দৃশ্যমান হয়। এজন্য বৌদ্ধ পরম্পরায় পঞ্চশীলকে ধম্মের সংজ্ঞা প্রদান করে বলা হয়েছে-‘পঞ্চসীলং ধম্মং সাধুকং সুরক্খিতং কত্বা অপ্পমাদেন সম্পাদেথ।’ অর্থাৎ পঞ্চশীল ধম্মকে অপ্রমাদের সাথে উত্তমরূপে সম্পাদন করো।