06/10/2023
ফিরে দেখা!!
চীন-রাশিয়া-ভারতীয় স্বার্থের কূটিলতা ও বাংলাদেশের মানবিকতা।
১৯৭১ সালে সারা দুনিয়ার বেশিরভাগ দেশ ও জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু গণচীন বলে কথিত চীন বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে ছিল না, ছিল পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পক্ষে। সে বিষয় নিয়ে এদেশে তখনকার চীনাপন্থী কমিউনিস্ট গ্রুপগুলোর মধ্যে অনেক বিভ্রান্তি ও তর্ক-বিতর্ক চলে। এর মূলে ছিল আবদুল হকের ইপিসিপি(এমএল)।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা গত প্রায় ৩০-৪০ বছরের। এ সমস্যা বাংলাদেশের ওপর এসে পড়েছে। ৩-৪ দশক আগে ৪ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। এখন অনেকে অনেক বাকা-তেড়া কথা বলছেন বটে। তবে, প্রশ্ন তোলা যায়, এর মাঝে যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে কী পদক্ষেপ নিয়েছে ?
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বিরুপ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া, যথা জঙ্গী-্ইয়াবা’র কথা কমবেশি আমরা জানি। অতি সম্প্রতি আরও ৪.৫ থেকে ৫ লাখ রোহিঙ্গা ঢুকে পড়লো। এখনো আসছে রোহিঙ্গারা ! আগে পরে মিলে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থী্। রোহিঙ্গারা মানুষ, এটাই তাদের মূল পরিচয়। মানুষের পরিচয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে মানবতার তাগিদে। বাংলাদেশ তাঁর সীমিত সামর্থ্য ও সাধ্য নিয়ে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে ও সহায়তার হাত বাড়িয়ে ধরেছে।
পাশাপাশি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের জোট সরকার মানবিক দিকটি প্রাধান্য দিয়ে দেশে-বিদেশে সব রকম সাধ্য মত কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। তার কিছু ইতিবাচক ফলাফলও দেখা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যাটি দীর্ঘমেয়াদি থাকবে, পুরোপুরি নিরসন করতে সময় লাগবে।
এখন প্রসঙ্গক্রমে চীন-রাশিয়া-ভারতের কথা আসছে। কারণ এ ৩টি দেশ রোহিঙ্গা বিষয়ে তাদের নিজ নিজ দেশের ব্যাণিজ্যিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির স্বার্থ বিবেচনা করছে। প্রতিটা দেশ তার স্বার্থই আগে ভাববে, তারপর অন্যের কথা বিবেচনা করবে। বাংলাদেশও সেভাবেই চেষ্টা করে। এটাই কূটনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
চীন-রাশিয়ার পরিচিতি আগে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ছিল, ভূমিকাও ছিল। এখন তাদের সে পরিচয় ও ভূমিকা আর আগের মত নেই। ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়া ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা করে।
কিন্তু সমাজতান্ত্রিক চীন পাকিস্তানের সামরিক শাসনের কবল থেকে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে। এই ঘটনাটি বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে কলন্ক বিশেষ। চীন স্বাধীন সার্বভৌম মুক্ত বাংলাদেশকে ১৯৭৫ সালের শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি দেয় না। ৭৫’এর ১৫ই আগস্ট পাকিস্তানীপন্থী সৈনিকরা ষড়যন্ত্র করে খন্দকার মোশতাকের সহযোগিতায় অভ্যুত্থান ঘটায়। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বাংলাদেশ নীতিগতভাবে পাকিস্তানী পথে পিছনের দিকে যাত্রা শুরু করে তখন।
‘জয় বাংলা’ ছিল মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান, এই ‘জয় বাংলা’ বলে স্বাধীনতার পর সাধারণ মানুষ সালাম বিনিময়, কুশল বিনিময় করতো। খুনি ফারুখ-রশীদ ও মোশতাক চক্র ‘জয় বাংলা’র বদলে পাকিস্তানী জবানে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ চালু করে। এরপর পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয়, তারপর দেয় চীন। জেনারেল জিয়া ও বিএনপি’র হাত দিয়ে, পরে জেনারেল এরশাদ ও জাতীয় পার্টির শাসনামলে বাংলাদেশে ধীরে ধীরে পাকিস্তানপন্থা, পশ্চাৎপদতা, ধর্মান্ধতা পাকাপোক্ত হতে থাকে। দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও জামায়াতী মতাদর্শ শক্ত ভিত পায়।
যাহোক, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী জান্তাকে সমর্থনের দায়ে সমাজতান্ত্রিক চীনের যে ‘পাপ’, তা কি কোনোভাবে মোচন করা যাবে ? চীনের মহান নেতা মাও সে তুং’এর শত শত লাল বইয়ের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়ে কি সে ‘পাপ’ মোচন হবে ?
সোভিয়েত রাশিয়া বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ। প্রায় ৭০ বছর সেখানে সমাজতন্ত্র অাদর্শ টিকে ছিল। পরে এক সময় রাশিয়ায় রাজনীতিগত আদর্শ পরিবর্তন হলেও তাকে হয়তো কিছু বুঝা যায়। কিন্তু আগে-পরে চীনের রাজনীতি, পররাষ্ট্র নীতি বেশ জটিল ; কূটিল তার মনস্বত্ত্ব। চীনের কূটনীতি বুঝা বেশ দুষ্কর ! এমত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সীমিত লোকবল নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে সম্প্রতি যে কূটনীতিক তৎপরতা চালিয়েছে, এবং তার যে সাফল্য দেখা যাচ্ছে, তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।
এটা সত্যি যে, চীনকে এখনো মিয়ানমারকে ছেড়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পুরোপুরি বাংলাদেশের পক্ষে নিয়ে আনা যায়নি---। সব বিষয়ে সবাইকে পাশে পাওয়াও যায় না। তাতে মহাভারত অসুদ্ধ হয়ে যাবে না। আবার, চীনকে সাথে পেতেই হবে, এমনও দিব্যি দেওয়া যাবে না।
কারণ,বিশ্ব বিবেক ও বিশ্ব জনমত রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। ৭১ সালেও চীনকে সাথে পাওয়া যায়নি, তো কী হয়েছে ? বাংলাদেশ স্বাধীন হয় নি ? পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকসহ দাতারা পিছিয়ে গেল। তো কী হয়েছে ? পদ্মা সেতু তৈরী হচ্ছে না ? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি আমেরিকায় জাতিসংঘ অধিবেশনে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে কিছু আশা করেন না। তাঁর এমন মন্তব্যে অনেকে ভিমড়ি খেয়েছেন হয়তো। বঙ্গবন্ধুরও অনেক ্ঐতিহাসিক বক্তব্য ও সিদ্ধান্তে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, অবাক (!) হয়েছেন। কিন্তু সেগুলোই বাংলাদেশের ইতিহাসের মৌলিক ও বিশেষ উপাদান। আমাদের দেশে রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনীতি ক্ষেত্রে এ সবই নতুন অনুষঙ্গ, নিত্য-নতুন অভিজ্ঞতা ও নতুন শিক্ষা।
মোট কথা, বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ করে রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনীতির প্রসঙ্গে আমাদের সমাজে কিছু কিছু
পুরনো ধারণা প্রচলিত রয়েছে। এগুলো গৎবাধা, সীমাবদ্ধ এবং এক চোখা। এসব কারণে আমাদের মনজগতে সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ হয় না, গতিশীলতার স্ফুরণ ঘটে না। বিভিন্ন বিষয়কে একটু খোলা চোখে দেখার চেষ্টা করা দরকার। যাকে সমালোচনা করা হচ্ছে, নিজেকে সেই অবস্থানে দাঁড় করিয়ে, কল্পনায় সেই দায়িত্ব কাধে নিয়ে একবার ভেবে দেখতে হবে আমি বা আমরা ঐ স্থানে থাকলে কী করতাম বা করতে পারতাম।
প্রসঙ্গত, সব বড় বড় উন্নত দেশ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা দিয়ে থাকে, এর পিছনে তাদেরও স্বার্থ জড়িত। সময়ের নিরিখে অন্য অনেক দেশ বাংলাদেশের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। বুঝে সুজে চীনও পরে বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে, এখন পদ্মা সেতুতে সহযোগিতা করছে।
অমেরিকার নতুন প্রশাসন দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধু পাকিস্তানের আইএস ঘেষা তালেবানী নীতিতে বিরক্ত হয়ে ভিন্ন পথ নেওয়ার কথা বলতে শুরু করেছে। কিন্তু চীনের এক চোখা দৃষ্টিভঙ্গী এখনো পাকিস্তান প্রীতিতে অন্ধ। কাজেই, চীনের জটিল ও কুটিল প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতিক তৎপরতা ও সাফল্যকে অবমূল্যায়ন করা ঠিক হবে বলে মনে হয় না। বলা বাহুল্য, পাকিস্তানসহ ওআইসি, আরব লীগ রোহিঙ্গা ইস্যুতে অপেক্ষাকৃত কম সরব ও কৌশলী। এক্ষত্রে এখনো তাদের কথিত ‘মুসলিম উম্মাহ’ চেতনা পুরোপুরি জাগ্রত হয় নি !
----বাবলু রহমান, সাংবাদিক। অক্টোবর ৩, ২০১৭।
[email protected]