01/11/2024
বাংলার কন্ঠ সম্পাদকীয় ও পাঠকের অভিমত
নভেম্বর ২০২৪ সংখ্যা
যেতে হবে বহুদূর
অক্টোবরের প্রথম ১৯ দিনে ১৫৩ কোটি ২৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)-এর পরিমাণ প্রায় ১৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্য বলছে, অক্টোবরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি ডলারের বেশি বা ৯৬৮ কোটি টাকার বেশি রেমিট্যান্স আসছে। এর মধ্যে ৬১ শতাংশের বেশি এসেছে মাত্র পাঁচটি দেশ থেকে। এই পাঁচ দেশের মধ্যে এককভাবে রেমিট্যান্স পাঠানোর শীর্ষে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব। তবে একক মাস হিসেবে শুধু সেপ্টেম্বরে আমিরাতকে টপকে শীর্ষ উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরব থেকে তিন মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৮৫ কোটি ৮৮ লাখ ডলার, মালয়েশিয়া থেকে ৬১ কোটি ৯৬ লাখ ডলার, যুক্তরাজ্য থেকে ৫৬ কোটি ৫৬ লাখ ডলার, ইতালি থেকে ৪২ কোটি ৫৭ লাখ ডলার, কুয়েত থেকে ৩৫ কোটি ৯১ লাখ ডলার, ওমান থেকে ৩২ কোটি ৭৫ লাখ ডলার, কাতার থেকে ২৬ কোটি ৫১ লাখ ডলার ও সিঙ্গাপুর থেকে ১৯ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতকে পেছনে ফেলে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী আয় প্রেরণকারী শীর্ষ দেশ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ মাসে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৩৮ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল প্রবাসীদের কল্যাণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে তাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রবাসী কর্মীদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রবাসীরা যখন বিদেশে থাকেন তখন তারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রত্যেকেই বাংলাদেশের এক একটি পতাকা হয়ে কাজ করেন। প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। তাদের যথাযথ মূল্যায়ন, প্রবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের কল্যাণমূলক সুরক্ষা নিশ্চিত করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। গত ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে বৈধভাবে যাওয়া সব বাংলাদেশি কর্মীর মালয়েশিয়া যাওয়ার পর বিদেশী শ্রমিক ক্ষতিপূরণ স্কিমের (এফডব্লিউসিএস) আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশি কর্মীরা মালয়েশিয়ার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সোশ্যাল সিকিউরিটি অরগানাইজেশন থেকে আবশ্যিকভাবে নিবন্ধিত হয়ে মেডিকেল বেনিফিট, টেম্পোরারি ডিজেবলমেন্ট বেনিফিট, পার্মানেন্ট ডিজেবলমেন্ট বেনিফিট, ডিপেন্ডেন্ট ডিজেবলমেন্ট বেনিফিট, ফার্নাল বেনিফিট, কনস্ট্যান্ট অ্যাটেনডেন্স অ্যালাউন্স, রেবেলিটেশন ফেসিলিটি ইত্যাদি সুবিধা পাবেন।
গত ৪ অক্টোবর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দাতুক সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর মালয়েশিয়া থেকেও প্রবাসীদের জন্য সুখবর পাওয়া গেছে। অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড (ইপিএফ) বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা করেছে মালয়েশিয়া সরকার। প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের বরাতে সরকারি সংবাদ সংস্থা বারনামা জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মান অনুসারে জাতীয়তার ভিত্তিতে বৈষম্য ছাড়াই সব কর্মীকে ন্যায্য অধিকার প্রদানে মালয়েশিয়া সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গত ১৮ অক্টোবর দেশটির সংসদ দেওয়ান রাকয়াতে ২০২৫ সালের বাজেট পেশ করার সময় এই প্রস্তাব ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন আনোয়ার ইব্রাহিম। এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড (ইপিএফ) এর আওতায় রিটায়ারমেন্ট সেভিংস আই-সারাণ ম্যাচিং প্রণোদনা ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে, যা বার্ষিক সীমা হিসেবে সর্বোচ্চ ৫০০ রিঙ্গিত থেকে সারাজীবনে সর্বোচ্চ ৫০০০ রিঙ্গিত পর্যন্ত থাকবে।
দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অর্থনৈতিকভাবে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ সার্বিয়া বিদেশি কর্মী খুঁজছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফ্যাক্টরি ও নির্মাণশিল্পে কর্মীনির্ভর খাতে সংকট কাটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে সার্বিয়া। পাশাপাশি ২০২৭ সালে ইউরো এক্সপো আয়োজনের জন্য তাদের ৫ লাখ নির্মাণশ্রমিক প্রয়োজন। এ কর্মীর চাহিদা বৈধ পথে পূরণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালে অন্তত ৫০ হাজার অভিবাসী বৈধভাবে সার্বিয়ায় কাজের ভিসা পেয়েছেন। পরিবহন খাতে সংকট কাটাতে শ্রীলঙ্কা থেকে বাস ড্রাইভার নেওয়া হয়েছে, ভারত থেকে নেওয়া হয়েছে রেস্টুরেন্টের শেফ। নেপাল থেকেও কর্মী নেওয়া হয়েছে। অভিবাসন বিশ্লেষকেরা বলছেন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইমেজ কাজে লাগানোর দারুণ সুযোগ আছে। ড. ইউনূসকে সামনে রেখে শ্রমবাজার নিয়ে আলোচনা হলে পূর্ব ইউরোপের শ্রমবাজার ভারত ও নেপালের হাতে চলে যাওয়া ঠেকানো সম্ভব। এর মাধ্যমে তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের বড় বিকল্প শ্রমবাজার। প্রায় একই পরিস্থিতি দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের আরেক দেশ নর্থ মেসিডোনিয়ায়। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আইটি, মেডিকেল, কৃষি ও নির্মাণ খাতে শ্রমিক নেওয়ার জন্য চলতি বছরেই প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আগ্রহের কথাও জানায় নর্থ মেসিডোনিয়া। তৎকালীন সরকারের কাছে সমঝোতা স্মারকের জন্য নমুনাও চেয়েছিল দেশটি। কিন্তু পরে আর সে বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। অন্যদিকে, মাত্র সাড়ে তিন বছরে ৩৫ হাজারের বেশি শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছিলেন পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়ায়। সহজে ভিসা প্রাপ্তি এবং কাজের সুযোগ থাকায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের পছন্দের গন্তব্য হয়ে ওঠে দেশটি। ঢাকায় প্রতিনিধি পাঠিয়ে অস্থায়ী ভিসা সেন্টার স্থাপন করে ভিসা দেওয়ার মতো পদক্ষেপও নিয়েছিল রোমানিয়া। তবে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তৎকালীন দুর্নীতিপরায়ণ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে বন্ধ হয়ে যায় ভিসা সেন্টারটি। ভারতে গিয়ে ভিসা সংগ্রহের সংকটেও আটকে যায় অনেক আবেদন। অনেক ভিসাও পরে বাতিল হয়ে যায়। শ্রমবাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার্বিয়া, নর্থ মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রোর মতো পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণের দারুণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতদিন খুব স্বল্প পরিমাণে জনশক্তি পাঠানো সম্ভব হলেও এখন এখানকার কৃষি, গার্মেন্ট, ফ্যাক্টরি, হোটেলগুলোয় হাজারে হাজারে কর্মী পাঠানো সম্ভব হবে। তবে পূর্ব ইউরোপের শ্রমবাজারের সুযোগের জন্য প্রয়োজন রয়েছে বেশ কিছু উদ্যোগের। কারণ পূর্ব ইউরোপের এসব দেশ থেকে বাংলাদেশিদের পালিয়ে ইউরোপের অন্য দেশে প্রবেশের প্রবণতা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে রোমানিয়ার সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতার কারণে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বাংলাদেশিদের মধ্যে এ পর্যন্ত ১১৩ জন দেশে ফিরেছেন। সাধারণ ক্ষমা পেয়ে দেশে ফিরলেও তারা জিসিসিভুক্ত (উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিল) দেশ-সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান ও বাহরাইনে পরবর্তী সময়ে চাকরি বা আবাসনের জন্য স্থায়ীভাবে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকবেন। আরও ৫৪ জনের মামলা আদালতে উঠেছে; দ্রুত দেশে ফেরার প্রত্যাশা করছেন। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের তৎপরতা না থাকলে আরও দেরির শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়ছে। এক মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে ২৪ কোটি ২ লাখ ১০ হাজার ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবায়ন পদ্ধতি অনুসারে, বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ এক হাজার ৯৮০ কোটি ৭৮ লাখ ২০ হাজার ডলার (বিপিএম৬)। এক মাস আগে ২৫ সেপ্টেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৯৫৬ কোটি ৭৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার (বিপিএম৬)। তবে নিট ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ ১৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আগের সরকারের আমলে রিজার্ভ প্রতি মাসে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন (১৩০ কোটি) ডলার করে কমে আসছিল, তবে এখন তা একটি ইতিবাচক প্রবণতায় ফিরছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাথমিক লক্ষ্য নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে ঋণমুক্ত হওয়া।
বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তির মধ্যে তৈরি পোশাক খাত অন্যতম। জিডিপিতে অবদান ও কর্মসংস্থান তৈরিতে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখছে রপ্তানিমুখী এ খাত। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩: কি ইনসাইটস অ্যান্ড ট্রেন্ডস’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, একক দেশ হিসেবে ২০২২-এর মতো ২০২৩ সালেও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চেয়ে ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার কম তৈরি পোশাক রপ্তানি করে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। আর শীর্ষে বরাবরের মতোই রয়েছে চীন। কিন্তু জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের এই শিল্পে উল্লেখযোগ্য ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পরও পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের চাকরি ও ভালো বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। এ ধরনের বিক্ষোভ কখনও কখনও সহিংসতায় রূপ নেয়। তবে চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করে বর্তমানে এই শিল্পটি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে গভীর অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে রয়েছে। অবাধে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং খাতে লাগামহীন দুর্নীতি, ব্যাপক মূল্যস্ফীতি ও একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের অর্থনীতিকে এক রকম খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এ মুহূর্তে যদি তৈরি পোশাক খাতের মতো রপ্তানিমুখী একটি খাতকে নৈরাজ্যের মুখে ঠেলে দিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাতীয় অর্থনীতি। কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে দেশের বেকারত্বের বোঝা আরও বাড়বে; বৃদ্ধি পাবে অসন্তোষ। যদিও প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে, তবুও সজাগ থাকতে হবে সবাইকে।
বাজেট সহায়তা বাবদ বিভিন্ন উৎস থেকে বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। বড় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে কয়েক দফায় বড় অঙ্কের বাজেট সহায়তা পেতে যাচ্ছে সরকার। জাপান, চীন ও কোরিয়ার মতো দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী দেশের কাছ থেকেও সহায়তা পাওয়া যাবে। চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৬০০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তার অনুমোদন হতে পারে। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৭২ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বাজেট সহায়তার মধ্যে আইএমএফ অনুমোদন দিতে পারে ৩০০ কোটি ডলার। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের ১৫০ কোটি ডলার ও এডিবির ১৩৫ কোটি ডলার দেওয়ার কথা রয়েছে। আইএমএফের ৩০০ কোটি ডলার চলমান সংস্কার কার্যক্রমে বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যয় করা হবে। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণের আগ পর্যন্ত বিদেশি উৎস থেকে যত বেশি নমনীয় ঋণ নেওয়া সম্ভব, সেই কৌশল রয়েছে সরকারের। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বর্তমানের মতো নমনীয় সুদে ঋণ পাওয়া যাবে না। বাজেট সহায়তাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে। রিজার্ভ সংকট কমবে। টাকা-ডলার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আসবে। যে উদ্দেশ্যে এ অর্থ ব্যবহার করা হবে, তার একটা সুফল আসবে অর্থনীতিতে। তবে যথাযথ এবং মানসম্পন্ন ব্যবহারে সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ বাজেট সহায়তার অর্থও সুদাসলে পরিশোধ করতে হবে।
ব্যক্তিগত অভিমত
ইতিহাস বিচার, বিভাজন ও সত্য নিয়ে সংশয়
আটটি জাতীয় দিবস উদযাপন বা পালন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক আদেশে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। আটটি দিবসের মধ্যে তিনটি- ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ও ৪ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস দেশের ইতিহাসে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বাকি পাঁচটি দিনের মধ্যে চার দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর স্ত্রী ও দুই পুত্রের জন্মদিন এবং অবশিষ্ট দিনটি স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্মদিন জাতীয়ভাবে উদযাপনের যে রীতি চলে আসছিল, সেটি অবশ্যই আওয়ামী লীগের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উৎসারিত। স্মার্ট বাংলাদেশ দিবসও নিছক রাজনৈতিক বোলচালের বিষয়। কিন্তু বাকি তিনটি দিন? দিবসগুলো বাতিলের কারণ জানিয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন- ‘ফ্যাসিস্ট সরকার এসব দিবস চাপিয়ে দিয়েছিল। জাতীয় দিবস হলো এমন দিবস, যেটি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সবাই ধারণ করবে। আওয়ামী লীগ ইতিহাসকে নষ্ট করে ফেলেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকেও আওয়ামী লীগই নষ্ট করেছে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে সরকার, যে নতুন বাংলাদেশ- সেখানে আমরা এই ফ্যাসিস্ট প্রবণতা রাখতে পারি না’।
মুক্তিযুদ্ধের দরজায় পৌঁছতে দীর্ঘ পথ পেরুতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। পঞ্চাশের দশক থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। সাতচল্লিশে পাকিস্তানের জন্ম থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত মোট ২৪ বছরের অর্ধেক ১২ বছরই কারান্তরীণ ছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে তাঁর উত্থাপিত ছয় দফা কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগোষ্ঠীকে একসূত্রে গাঁথে। ঊনসত্তরে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের মূলেও ছিল এই ছয় দফা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর এ দেশের মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে নিজেদের অবিসংবাদিত নেতা মেনে নেয়। সত্তরের নির্বাচন ছিল মুক্তির পক্ষে মানুষের সম্মিলিত রায়, আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতির মুক্তির দূত। এরই ধারাবাহিকতায় আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ।
রেসকোর্স ময়দানের উত্তাল জনসমুদ্রে কোনো স্ক্রিপ্ট ছাড়া বঙ্গবন্ধু উদাত্ত কণ্ঠে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে যে ঘোষণা, যে মহাকাব্যিক ভাষা ও অতুল ভঙ্গিমায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার তুল্য উদাহরণ বিশ্বে বিরল। ২০১৭ সালে ইউনেস্কো এই বক্তৃতাকে বিশ্ব হেরিটেজের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বক্তৃতা এ দেশের স্বাধীনতার অনিবার্য ঘোষণা। দিনটিকে আওয়ামী লীগের দলীয় সম্পত্তি হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার কী করে বিবেচনা করছে! কেন করছে?
এটা ঠিক, খোদ আওয়ামী লীগই বঙ্গবন্ধুকে নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে রাজনীতি করেছে। কিন্তু এতে বঙ্গবন্ধুর দোষ কোথায়? আওয়ামী লীগের একনায়কতান্ত্রিক আচরণে বঙ্গবন্ধুর অবদান কেন অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাবে?
বলা হচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মনে করে না। কারণ, তাদের ভাষায়, এই ভূখ-ের লড়াইয়ের ইতিহাসে কেবল একজন না, বহু মানুষের অবদান রয়েছে। আরও ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ রয়েছেন; শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, যোগেন ম-ল, মওলানা ভাসানী।
এ দেশের জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার দীর্ঘ আন্দোলনে ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ হিসেবে উল্লিখিত ব্যক্তিদের ভূমিকা নিশ্চয়ই রয়েছে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নায়ক অবশ্যই বঙ্গবন্ধু। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, জেনারেল ওসমানীসহ আরও অনেক নেতা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন; কিন্তু তারা বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে, তাঁর নামেই সব করেছেন।
সত্য যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারও নাম উচ্চারণ করতে চায়নি। এটা আওয়ামী লীগের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। এর দায় বঙ্গবন্ধুর ওপর না চাপিয়ে বরং উপেক্ষিত সবাইকে যথাযথভাবে সম্মান জানানো জরুরি।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে সাড়ে তিন বছর শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। সদ্য স্বাধীন দেশটিতে সুশাসন ও গণতন্ত্রের অভাব নিশ্চিতভাবেই ছিল। এরই পরিণতিতে অস্থির অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধুর একদলীয় বাকশাল গঠনের উদ্যোগ দেশে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের সূচনা করে। এসবই রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবের ব্যর্থতার দিক; তবে তাতে করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও ভূমিকা ম্লান হয়ে যায় না। একইভাবে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার অপশাসন, অতিকথন ও কর্তৃত্ববাদে মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান ধূলিসাৎ হয় না।
২.
টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনে আওয়ামী লীগ বিভাজনের রাজনীতি জিইয়ে রেখেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির নামে এক অক্ষয় ভেদরেখা জারি রেখে প্রকারান্তরে গোষ্ঠী চর্চাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। দখল, দুর্নীতি আর দুঃশাসনে তারা জনগণের ভোটের মুখোমুখি হতে ভয় পেয়ে একদিকে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করবার চেষ্টা করে; অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনকে ‘হাস্যকর’ করে তোলে। অন্ধ গোষ্ঠীচর্চার চূড়ান্ত পরিণতি, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দম্ভভরা সরকারের পতন। ছাত্র-জনতার অসামান্য যে অভ্যুত্থান, তা বিভাজনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে জাতীয় ঐকমত্য তৈরির সুবর্ণ সুযোগের সামনে জাতিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইতিহাসে যার যা প্রাপ্য, তা নির্মোহ ও দলীয় দৃষ্টিকোণের বাইরে থেকে বিচার করতে না পারলে বিভাজন আরও বাড়বে।
৩.
৫ আগস্টকে অনেকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলছেন। আওয়ামী দুঃশাসন থেকে মুক্ত হওয়ার ঘটনাকে স্বাধীনতা হিসেবে আখ্যা দিতে হবে কেন? এটা ঠিক, বাংলাদেশের ইতিহাস একাত্তরে শুরু হয়নি। সাতচল্লিশ, একাত্তর, নব্বই, চব্বিশ- সবই সত্য। তবে সবচেয়ে বড় সত্য, স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম একাত্তরে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশ। ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মাহুতি, দুই লাখ নির্যাতিত নারীর জীবন আর কোটি কোটি মানুষের আর্তনাদ-হাহাকার-প্রতিরোধে রক্তাক্ত একাত্তর।
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কারণ-পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য, পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ, নিপীড়ন। পাকিস্তানিদের শোষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে, মুক্তিযুদ্ধ হয়ে ওঠে অনিবার্য। স্বাধীন দেশে নব্বইতে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন বা চব্বিশে শেখ হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান এ দেশের রাজনীতির নীতিহীনতার ফল। অবশ্য চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান রুখতে গিয়ে নিজ দেশের মানুষের বুকে যেভাবে গুলি ছুঁড়েছে শেখ হাসিনা সরকারের পুলিশ ও ক্যাডার বাহিনী, এর দ্বিতীয় উদাহরণ এ দেশের ইতিহাসে আর নাই। এই সত্যও ইতিহাসের অন্তর্গত এবং নিশ্চিতভাবে তা যথাযথ বিচারের অপেক্ষায়।
রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের শাসনামলে নিজেদের পছন্দমতো দেশের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে। আওয়ামী লীগের আগে বিএনপি আমলেও একই ঘটনা আমরা দেখি। দেশের ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্য সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে ‘ভিত্তি’ ও অবাধ-সুষ্ঠু গণতন্ত্র জাতির ‘গন্তব্য’ হিসেবে কাজ করবে- এই ঐকমত্য তৈরি করতে পারলে ধ্রুব ইতিহাস নিয়ে আর প্রশ্ন উঠবে না। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত কারণ ও গৌরব সম্পর্কে দায়িত্বশীলরা যথার্থ দ্বিধাহীন হলেই ইতিহাসের সত্য নিয়ে সংশয় থাকে না, গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তাও প্রশ্নাতীত হয়ে ওঠে।
মাহবুব আজীজ, উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
নতুন বাংলাদেশের ধারণাটি স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন
আশি ও নব্বই দশকেও বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন উঠতে দেখিনি। ’৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, সামরিক শাসনের সূচনালগ্ন এবং ৯০-এ স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এ ধরনের প্রশ্ন মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো না; যদিও ততদিনে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নির্বাচিত ও অনির্বাচিত সরকার এবং রাজনৈতিক পক্ষের আন্দোলনের অংশীদার হয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছিল।
ধর্মের ভিত্তিতে উপমহাদেশ ভাগ হলেও ধর্মীয় বিদ্বেষের খুব বেশি ঘটনা এখানে ঘটেনি। একসময় এ দেশ যে পাকিস্তানের অংশ ছিল, সেখানে ইসলামী মৌলবাদ আর পার্শ্ববর্তী ভারতে হিন্দু মৌলবাদীদের উত্থানের মাঝেও বাংলাদেশের পরিচয় ছিল উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এ চরিত্র আর থাকবে না বলে মনে হচ্ছে। এমনকি এ পরিবর্তনের জন্য কোনো কোনো মহল থেকে বল প্রয়োগও করা হচ্ছে। বাঙালি ও বাংলাদেশের মৌলিক চরিত্রের এই পরিবর্তন কাম্য নয়। এটি ঠেকাতে বৈশ্বিক রাজনীতির আগ্রাসন রোখার পাশাপাশি হুমকি-ধমকির শক্তি নিশ্চিহ্ন করতে হবে। সেই সঙ্গে পরমতসহিষ্ণুতা এবং মুক্ত আলোচনার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এ দায়িত্ব নিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকেই। তাদের বুঝতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষতার মানে ধর্মহীনতা নয়, এই সত্যের অপলাপ যারা করে তারা রাষ্ট্রচিন্তাকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের ওপর স্থান দেবে না।
আইনজীবী শাহ্দীন মালিককে সরিয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজকে কমিশনের প্রধান করায় এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এ প্রশ্নের অবশ্যই মেরিট আছে। সংবিধান সংস্কারের কাজটি সহজ হবে না বলেই মনে হয়। তদুপরি এটি সময়সাপেক্ষ। কোনো অনির্বাচিত সরকার কীভাবে দ্রুততম সময়ে এ কাজ করবে সে ধারণা স্পষ্ট নয়। যতই ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে একটি সরকার তার যাত্রা শুরু করুক, দীর্ঘদিন একটি অনির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকার ঝুঁকি সম্পর্কে এ দেশের জনগণ ওয়াকিবহাল। সুতরাং সংবিধান পুনর্লিখনের নামে অহেতুক সময় নষ্ট না করে নির্বাচনী সংস্কার, রাষ্ট্রক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষাকল্পে সংশোধন, বিতর্কিত আইন ও অনুশাসন পরিবর্তন, পরিমার্জন করা যেতে পারে। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো আর তার পরিবর্তনের ভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উত্তম।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনো বিতর্ক নয়। জুলাই ’২৪ গণআন্দোলনের বিজয়কে আমরা নতুন স্বাধীনতা বলে অভিহিত করেছি। বিজয়ের অত্যুৎসাহে এটি করা হয়তো অপরাধ নয়, কিন্তু একটি বিশেষ দল কথাটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যবহার করছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলুণ্ঠিত এবং সুকৌশলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। একজন স্বৈরশাসকের অপশাসন এবং ভুলের দায় মুক্তিযুদ্ধ, যার মাধ্যমে এ দেশ গঠিত হয়েছে, নিতে পারে না। উপরন্তু, ’২৪-এর বিজয় কোনো বিপ্লব নয়, দেশের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ নয়, ছিল স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণমানুষের প্রতিবাদ। সুতরাং এ বিজয়কে নতুন স্বাধীনতা বলে ’৭১-এর বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে অন্তত গণমানুষের কোনো বিশেষ লাভ আছে বলে মনে করি না।
উদ্বেগের বিষয় হলো, অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু ইস্যুতে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ আনুকূল্য বা দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। তার একটি উদাহরণ হলো পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন কমিটি ভেঙে দেওয়া। এ ধরনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের সক্ষমতার ওপর অনাস্থা তৈরির জন্য যথেষ্ট। একই সঙ্গে তা অনিষ্টকারীর ইচ্ছা ও স্পৃহা বেগবান করার সহায়ক। কমিটিতে স্থান পাওয়া ব্যক্তিদের জন্যও তা সামাজিক ও পেশাগতভাবে অপমানিত হওয়ার শামিল।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব নয়, এটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। সরকারের উচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মিবাহিনী, জনসমর্থন ও নেটওয়ার্ককে ইতিবাচক উপায়ে ব্যবহার করা। নিজের মৌলিক কাজ আর সত্তাকে বিসর্জন না দিয়ে অপশক্তির অপতৎপরতা রুখতে সহায়ক শক্তি হিসেবে পাশে রাখা। প্রতিটি সংকট নেতৃত্বের জন্ম দেয় কিন্তু সমন্বয়কদের জড়িয়ে আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বিতর্ক অনভিপ্রেত ও অপ্রয়োজনীয় ছিল। তা ছাড়া সমন্বয়কদের একটি অংশের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ ও এই অংশটি যেভাবে গণআন্দোলনের ক্রেডিট নিজেদের দিকে নেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, তাও দৃষ্টিকটু।
‘কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’-এ নীতি থেকে বের হয়ে এসে বাংলাদেশের বিগত সরকারের ভারতের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়াটা দেশের স্বার্থ বিঘিœত করার জন্য যথেষ্ট ছিল এবং সেটি প্রমাণিত। কিন্তু নতুনভাবে অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রতি অতিসখ্য নতুন সংকটের জন্ম দিতে পারে। রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের মধ্যকার বক্তিগত সম্পর্ক রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠলে সংকট ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। সুতরাং রাষ্ট্রের স্বার্থ কোনোভাবেই ক্ষুণœ করার উপায় নেই। ইতিহাস সাক্ষী, পশ্চিমা বন্ধুদের সব পরামর্শ সব দেশের জন্য সব সময় সঠিকভাবে কাজ করেনি; বরং সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। সেই দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
জাতিসংঘের সফল কূটনীতির পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ সবার মাঝে আস্থা তৈরির জন্য সচেষ্ট হওয়া। তবে আইনশৃঙ্খলার হতাশাজনক পরিস্থিতি, তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা, পাহাড়ে সহিংসতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর ধর্মীয় ও জাতিগত বিষয়ে ছড়ানো বার্তা যথেষ্ট উদ্বেগের। এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিতে পারলে এগুলো বড় ধরনের সংকট জন্ম দিতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ-সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে আশু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কোন পথে চলবে এবং তার মৌলিক বিষয়গুলো কী হবে সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে তার টিউন সেট করা।
ড. মো. মাহবুবুল আলম, অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
fans