04/02/2025
এগারো বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে, তার মা-বাবাকে ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে। বিষয়টা হয়তো অনেকের কাছে হাসির খোরাক দিলেও, এটা কিন্তু ভাববার বিষয়। এটা ঠিক না ভুল, এই বিচার করার বয়স তার হয়নি! সে কেবল বুঝে, মা-বাবা যা নিষেধ করেন তা সবই ভুল! এই যে বাচ্চা মেয়েটা বেরিয়ে পড়ল, এটা তার ভুল নয়, এটা সময়ের প্রভাব। অনেকেই আপনারা আপনাদের ছোটোবেলার কথা বলছেন, তার চেয়ে আপনারা অনেক ভালো ছিলেন ইশারাতে বোঝাতে চাচ্ছেন। ওই বয়সে আপনারা খেলতেন, দলবেঁধে স্কুলে যেতেন,পুতুলের বিয়ে দিতেন। কিন্তু আপনি বিচার করুন, তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ আর আপনার পরিবেশ কি এক? আপনি গ্রামে থেকেছেন, একান্নবর্তী পরিবার পেয়েছেন, গ্রামের বিভিন্ন আত্মীয় পেয়েছেন, এক জগড় পরিচিত খেলার সঙ্গী পেয়েছেন। তাদের সাথে সারা দিন কাটালেও মা-বাবা চিন্তা করতেন না কারণ সবাই সবার কোনো না কোনোভাবে পরিচিত। আপনার অবসর কাটানোর জন্য বিভিন্ন উপায় পেয়েছেন। কিন্তু বাচ্চাটা? সে তো এসব কিছুই পায়নি, পাওয়া বলতে মুঠোফোনে পুরো পৃথিবী পেয়েছে, যেখানে সব দেখা যায় কিন্তু স্নেহের স্পর্শ পাওয়া যায় না। জীবিকার জন্য মা-বাবাকে শহরে একটা খুপড়ি বাসা নিতে হয়েছে, আশেপাশে যাদের পেয়েছে তারা সবাই ফেইক মানুষজন, যারা কালে-ভদ্রে প্রশংসাটা করলেও সেটা ফেইক। বাচ্চা মেয়েটার মা-বাবার বাইরে আর কোনো ভালো বন্ধু পায়নি। তাই বারবার সে ভার্চুয়াল জগৎকেই বেছে নিয়েছে। মা-বাবা বাচ্চার হাতে মোবাইল দিয়ে তারা মুক্তি নিয়েছে! এখানে সে হয়তো ভাবছে, আমার নিজের একটা জগৎ আছে যা মা-বাবার নিষেধ থাকবে না। প্রথমেই বলেছি, এটা সময়ের প্রভাব। এই প্রভাব থেকে আপনার, আমার বাচ্চারাও মুক্ত নয়। কারণ তাদের বেড়ে ওঠার গল্পটা কিন্তু একই!
এমন না যে, এ দেশীয় কালচারে এ বয়সে কারো বিয়ে হয়নি! অনেক হয়েছে, এই তো দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই এই বয়সে অনেকের সন্তানও হয়েছে। আমাদের মা,চাচি,দাদি,নানি এ বয়সের কাছাকাছি তাদেরও বিয়ে হয়। আমাদের উনিশ শতক বা বিশ শতকের অনেক লেখকের বউ ও মেয়েদের বিয়ে অল্প বয়সেই হয়েছিল এ কথা প্রায় সবারই জানা। বাঙালিরা প্রথম জানল ইংরেজরা আসার পর থেকে, মেয়েদের বিয়ের বয়স বেশি হলেও সমস্যা নেই। উনিশ শতকে বাংলায় সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্য ছিল শেক্স পিয়রের 'রোমিও-জুলিয়েট' অনুবাদ গ্রন্থটি। তখনকার সময়ে কোনো বাঙালি মানুষ যদি 'রোমিও-জুলিয়েট' না পড়ত তাহলে তাকে শিক্ষিত বাঙালি হিসেবে কেউ ধরতো না, বলা যায় সে সময় ট্রেন্ডিং বই ওটা। ওই বইয়ে নায়িকা জুলিয়েট এর বয়স ছিল সতেরো। বাঙালি এটা পড়ার পরেই বিভিন্ন কথা সাহিত্যিক তাদের গল্পে নায়িকাদের বয়স বাড়াতে শুরু করল!
যা বলতে চাই,
বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে, ডিপ্রেশনে, সুইসাইড করে। বিশ্বে, বছরে গড়ে দশ লক্ষাধিক। যা মহামারি, যুদ্ধ, অ্যাক্সিডেন্ট থেকেও বেশি। এর কারণ কী! এর কারণ, আমরা দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছি। বয়স বিশ হওয়ার পরেই আমাদের সব আগ্রহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সব কৌতূহল পূরণ হয়ে গেছে, কিছুই বাকি নেই, জানার, বোঝার। আঠারো হওয়ার আগেই পাঁচাখানা সম্পর্ক হয়ে গেছে। তারপর সব বোর লাগে, বিরক্ত লাগে, ওভার থিংকিং হয়! একটা জিনিস ভাবুন, আগের সময়ে এগারো বছরে বিয়ে হয়ে সংসার করতো এমনকি বাচ্চা পালনও করত। কিন্তু এখন পঁচিশ বছরে বিয়ে হওয়ার পরও অনেকের সংসার হচ্ছে না। কারণ কী! কারণ সময়ের প্রভাব।
কারণ খোঁজার চেষ্টা করি,
দেখুন, গত পনেরো বছরে যে পরিবর্তন এসেছে, সেটা একটা বিরাট পরিবর্তন। যা পাঁচশো বছরেও হয়নি। মুঠোর মধ্যে সারা পৃথিবী থাকার ফলে আমরা এখন সবচেয়ে বেশি তথ্যের আঘাত পাচ্ছি। এখনকার মা-বাবারা এখনও আয়ত্ত করতে পারেনি, এই বিপুল তথ্য পাওয়া বাচ্চাগুলোকে কীভাবে পরিচালনা করতে হবে! এখনকার মা-বাবারা তাদের বাচ্চাদের বয়সে এত তথ্যের ভান্ডার পায়নি। পেপার, পত্রিকা পড়ে যা জানত তা খুবই অল্প। কিন্তু এখন একটা বাচ্চা চ্যাট জিপিটি দিয়ে মুহূর্তে সব জেনে যাচ্ছে। এত বিপুল পরিমাণ তথ্য পাওয়া বাচ্চাদের মা-বাবারাও হিমশিম খাচ্ছে সামলাতে কারণ, তারাও এই বিপুল তথ্য দ্বারা আক্রান্ত। উভয়ের মধ্যে বাচ্চারাই বেশি, কারণ ভালো-মন্দ বিচার করার মতো বয়স তাদের হয়নি, তারা বিবেক বা মূল্যবোধ দিয়ে নয় বরং ফ্যান্টাসি দিয়েই সব বিচার করে। আর সর্বনাশটা ঘটে এখানেই!
আজকে যে বাচ্চাকে নিয়ে আমরা ট্রল বা সাইবার বুলিং করছি, মনে রাখবেন, আপনার বাচ্চাও কিন্তু হুমকিতে। তাই কারোর খারাপ সময়ে নির্লজ্জের মতো মজা না নিয়ে, আপনি আপনার পরিবারের শিশুটির ওপর মনোযোগ দিন। কারণ আপনার শিশুও ওইভাবে বেড়ে উঠছে। যে বাবার শিশুটি ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে, সেই বাবার জায়গায় নিজেকে বসান। মোবাইলের স্ক্রিনে বাচ্চাকে ছেড়ে না দিয়ে, নিজেও স্ক্রিনের মুখ গুঁজে না দিয়ে বাচ্চাক সময় দিন। তা না হলে, ভালোবাসা পাওয়ার জন্য,আগ্রহ পাওয়ার জন্য, মনোযোগ পাওয়ার জন্য, মোস্তাক সাহেবের মতো একজন বেশি বয়সী মানুষকে, তিশার মতো বাচ্চা একটা মেয়ে বেছে নিতে দ্বিধা করবে না। সবার মঙ্গল হোক, শুভ বোধ উদয় হোক!
copied