16/11/2025
গত কিছুদিন ধরে সরকারের কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তি—বিশেষত অর্থ উপদেষ্টা—বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে বারবার বলছেন যে দেশের ফরেইন এক্সচেঞ্জ বেড়েছে, রিজার্ভ বেড়েছে, রপ্তানি বেড়েছে।
কিন্তু বাস্তব অর্থনৈতিক সূচকগুলো একে ভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে। নিচে গত ১৬ মাসে দেশের অর্থনীতির মূল সংকটগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
নিজস্ব প্রতিবেদক
১. মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রানীতি
১.১ অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি
• ২০২৫ সালের প্রথম ১০ মাসে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি: ৯.৭৩%
সূত্র: বিবিএস
১.২ মুদ্রা ছাপানোর ফলে মূল্যস্ফীতি
• টাকশাল থেকে অতিরিক্ত ১.০৮ হাজার কোটি টাকা ছাপানো
• ফল: অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতি ৮.২৯%
সূত্র: বিবিএস
২. বাণিজ্য ও উৎপাদন খাতের অবস্থা
২.১ আমদানি কমে যাওয়া
• গত বছরের তুলনায় আমদানি কমেছে ১৭ বিলিয়ন ডলার
• প্রবৃদ্ধি: –৫.৫৮%
২.২ রপ্তানিতে কৃত্রিম বৃদ্ধি
• ২০২৪ সালের সন্ত্রাসী পরিস্থিতিতে আটকে থাকা পূর্বের অর্ডার ২০২৫ সালে শিপমেন্ট হওয়ায় রপ্তানি বাড়তি দেখাচ্ছে
• বাস্তবে জুলাই–অক্টোবর সময় নতুন অর্ডার কমেছে ৫%
• ২০২৫–২৬ অর্থবছরে রপ্তানি কমার আশঙ্কা
২.৩ শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়া
• মোট ৩৫৩টি শিল্প কারখানা বন্ধ
• ফলে: উৎপাদন হ্রাস + বেকারত্ব বৃদ্ধি + রাজস্ব হ্রাস
৩. সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক
৩.১ জিডিপি হ্রাস
• বর্তমান GDP প্রবৃদ্ধি: ৪.৯%
• গত ১৬ বছরে সর্বনিম্ন, এমনকি কোভিডের চেয়েও কম
৩.২ বাজেট ঘাটতি
• ২০২৫–২৬ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি: ২.২৬ লাখ কোটি টাকা
• বড় উন্নয়ন প্রকল্প না থাকা সত্ত্বেও ঘাটতি বৃদ্ধি
৩.৩ রাজস্ব ঘাটতি
• রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি: ১.০৫ লাখ কোটি টাকা
৪. ব্যাংকিং খাত ও আর্থিক স্থিতিশীলতা
৪.১ খেলাপি ঋণের রেকর্ড বৃদ্ধি
• ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণ: ২.১১ লাখ কোটি টাকা
• এক বছরে বৃদ্ধি: ৪.৫৫ লাখ কোটি টাকা
• মোট খেলাপি তিনগুণ বৃদ্ধি—অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ
৪.২ ব্যাংকিং বিশৃঙ্খলা
• দুর্বৃত্তায়ন ও রাজনৈতিক মালিকানার প্রভাব
• বাংলাদেশ ব্যাংকের জামাতি মালিকানার কয়েকটি ব্যাংককে ২০,০০০ কোটি টাকা শর্তহীন ঋণ প্রদান—ব্যাংকিং স্থিতিশীলতার জন্য বড় উদ্বেগ
৫. বৈদেশিক মুদ্রা ও রিজার্ভ পরিস্থিতি
৫.১ ডলার বাজারের স্থিতিশীলতার প্রকৃত কারণ
ডলার স্থিতিশীল হওয়ার কারণ ডলার প্রবাহ বৃদ্ধি নয়।
বরং—
• আমদানি কমে যাওয়া (১৭ বিলিয়ন ডলার)
• শ্রমিক রপ্তানি কমে যাওয়ায় রেমিট্যান্স চাহিদা কম
• শিল্প উৎপাদন কমে কাঁচামালের চাহিদা কম
চাহিদা কমলে দাম কমে – এটি মৌলিক অর্থনীতির নিয়ম।
৫.২ রিজার্ভ “বাড়তি দেখানোর” ব্যাখ্যা
আমদানি কমে যাওয়ায়—
• ডলারের ব্যবহার কমেছে
• তাই রিজার্ভে ডলার থেকে গেছে
• এটি প্রকৃত শক্তির নির্দেশক নয়; বরং অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হওয়ার চিহ্ন
৬. বৈদেশিক মুদ্রা পাচার
৬.১ বৈধ ও অবৈধ উপায়ে পাচার বৃদ্ধি
• ট্রেড-বেসড মানি লন্ডারিং: ৮.২৭ বিলিয়ন ডলার
• হুন্ডি-বেসড পাচার: ৭.৮ বিলিয়ন ডলার
• অর্থনীতিতে ডলার সংকটের বাস্তব কারণগুলোর অন্যতম
৭. কর্মসংস্থান সংকট
৭.১ দেশীয় শ্রমবাজার
• মাত্র ২০২৫ সালেই চাকরি হারিয়েছে: ১.১ মিলিয়ন শ্রমিক
৭.২ বিদেশে কর্মসংস্থান
• ভিসা সীমাবদ্ধতা + বৈশ্বিক চাহিদা কম
• প্রবাসে ফিরে এসেছে: ৪.৩৩ লাখ শ্রমিক
• শ্রমিক রপ্তানি কমে: ২৭%
এর ফলে রেমিট্যান্স কমবে, আর্থিক চাপ বাড়বে।
৮. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
৮.১ IMF ও উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ স্থগিত
• সমর্থনের অভাব সরকারের নীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আস্থাহীনতার ইঙ্গিত
৯. সরকারি আর্থিক পরিচালনা
• সরকারি কর্মচারীদের নতুন পে-স্কেল ঘোষণা করে পরে স্থগিত
• সরকারের হাতে ৩ মাসের বেশি ব্যয় চালানোর অর্থ নেই
• আদানি বিদ্যুৎ আমদানি বিল পরিশোধে অক্ষমতা
এসবই আর্থিক চাপ ও নগদ সঙ্কটের নির্দেশক।
১০. সার্বিক মূল্যায়ন
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে—
• উৎপাদন কমছে
• আয় কমছে
• কর্মসংস্থান কমছে
• ব্যাংকিং ব্যবস্থা দুর্বল হচ্ছে
• রাজস্ব ও বাজেট ঘাটতি বাড়ছে
এ অবস্থায় কেবল রিজার্ভ বা ডলার স্থিতিশীলতা দেখিয়ে পরিস্থিতি “স্বাভাবিক” দাবি করা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
সাধারণ মানুষের কাছে ইতিবাচক বার্তা দিতে গিয়ে অর্থ উপদেষ্টা যদি প্রকৃত সমস্যাগুলো আড়াল করেন—
তাহলে ভবিষ্যতে এই ভুল তথ্যচিত্র আরও বড় সঙ্কট তৈরি করতে পারে।