25/04/2022
🤔 বিদেশে গাড়ির স্টিয়ারিং বাঁ দিকে থাকে কেন❓
পুরো বিশ্বের মাত্র ৩৫ শতাংশ দেশে হাতের বাম দিয়ে গাড়ি চালানোর নিয়ম। বামে গাড়ি চালানো দেখাই যায় মূলত ইংল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর কয়েকটি দেশে। তবে ইংল্যান্ড ছাড়া ইউরোপের অন্যান্য দেশসহ আমেরিকা এবং আফ্রিকা মহাদেশের অধিকাংশ দেশেই দেখা যায় রাস্তার ডান দিক দিয়ে গাড়ি চালাতে।
প্রাচীনকালে প্রায় সবখানেই হাতের ‘বামে চলা’ নিয়ম চালু ছিল। মাত্র ক’দিন হলো মানুষ হাতের ‘ডানে চলা’ নিয়মের সাথে অভ্যস্ত হয়েছে।
🐎 ইতিহাসবিদরা বলেন, রাস্তার বামে দিয়ে চলাচলের রীতিটা আসলে এর প্রচলন প্রথম শুরু করে রোমানরা। মধ্যযুগের সড়কগুলো ছিল অনিরাপদ। তাই তখন চালকরা গাড়ির বাম দিকে বসতো, যাতে প্রয়োজনের সময় ডান হাতের সাহায্যে অস্ত্রের ব্যবহার করতে পারে। তা ছাড়া তখন অশ্মারোহীরাও তাদের বাম হাতে রাখত ঘোড়ার লাগাম, যাতে ডান হাতের সাহায্যে পথে দেখা হওয়া পরিচিতজনদের সঙ্গে সহজেই করমর্দন করতে পারে। এভাবেই চালকের বাম দিকে অবস্থান এবং বাম হাতের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ জনগণেনর মধ্যে। আর বাম ঘেষে চলার ফলে যদি কখনো রাস্তায় যেতে যেতে কোনো বন্ধু বা পরিচিত কারো সাথে দেখাও হয়ে যায় সেক্ষেত্রে তার সাথে ডান হাত দিয়ে করমর্দন করাও সহজ ছিল। তাছাড়াও একজন ডানহাতির জন্য ঘোড়ার বাম দিক দিয়ে আরোহণ এবং নিচে নামাও সহজ। দেহের ডানদিকে তলোয়ারের খাপ থাকলে সেটা শুধু ঝামেলাপূর্ণই হতো। পাশাপাশি রাস্তার ডান পাশের তুলনায় বামেই ঘোড়ায় চড়া বা নামাটা নিরাপদ ছিল। তাই কেউ বাম দিক দিয়ে ঘোড়ায় আরোহণ করলে তার ক্ষেত্রে বাম দিকে দিয়েই ঘোড়া চালানোটা যুক্তিযুক্ত ছিল।
🎯এই ‘বামে চলা’ রীতিটা এতটাই প্রচলিত ছিল যে ১৩০০ সালে অষ্টম পোপ বোনিফেস এক বিধি জারী করেছিলেন যে, রোমে আগমনকারী সকল তীর্থযাত্রীকে হাতের বাম দিক দিয়েই আসতে হবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে প্রায় ১৭০০ সাল পর্যন্ত এই নিয়ম চালু ছিল।
🇺🇸 সর্বপ্রথম ডানে চলার যে উৎস পাওয়া যায় তা হলো আমেরিকায় ১৮ শতাব্দীতে। আমেরিকায় তখন বড় বড় মালবাহী ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ছিল। যেহেতু গাড়িগুলোর আকার বিরাট ছিল এবং তারাই রাস্তাগুলোয় দাপট দেখিয়ে বেড়াতো সেহেতু অন্যান্য সকলকেই গাড়িগুলোর চলার নিয়ম অনুযায়ী নিজেদের মানিয়ে নেয়া লাগতো। এই গাড়িগুলোর যে বৈশিষ্ট্য ছিল তা হলো এখানে ৫-৭টার মতো ঘোড়া যুক্ত থাকতো। চালকের বসার জন্য নির্দিষ্ট কোন আসনও থাকতো না। যার ফলে একজন ডানহাতি চালক সবার বামে যে ঘোড়া থাকতো তার উপর বসতো এবং ডান হাতে একটা চাবুক নিয়ে একসাথে সবগুলো ঘোড়াকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো।
এই বামে বসার ফলে তারা সামনে আগমনকারী যেকোনো যানবাহনের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে পারতো যাতে তাদের গাড়িগুলো সামনে দিয়ে আসা কোনো কিছুর সাথে লেগে না যায়। রাস্তার ডান দিক দিয়ে চলার ফলে, বাম দিক দিয়ে খুব সহজেই দূরের যানবাহন সম্পর্কে অবস্থা বিবেচনা করে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলা যেত। এমনকি ১৭৯২ সালে আমেরিকার পেনসিলভানিয়ায় ডান দিক দিয়ে চলার জন্য আইনও জারী হয়। এরপর থেকে এ নিয়ম আমেরিকার সর্বত্র এবং কানাডায় ছড়িয়ে পরে।
🚘 ফোর্ড তার এই মডেল দিয়ে বাম দিকে স্টিয়ারিং হুইল বসানোর নিয়ম পাকাপোক্ত করেন। এটার পেছনে তার প্রধান যে উদ্দেশ্য ছিল তা হলো যাত্রীরা, বিশেষ করে মহিলারা যাতে সামনের এবং পেছনের সিট থেকে নেমে রাস্তার পাশের কার্ব বা উঁচু বাধাই করা স্থানে নামতে পারেন; এবং যাতে রাস্তার কাঁদা বা নোংরা তাদের পোষাকে যেন না লাগে! ফোর্ডের এই ‘মডেল-টি’ হলো বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত গাড়ি। শুধুমাত্র ১৯০৮ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্তই ১৫ মিলিয়ন ইউনিট বিক্রয় হয়েছিল। তাই এটা সহজেই অনুমেয় যে, আমেরিকা মহাদেশের অধিকাংশ স্থানেই এই গাড়ির সুবাদে ‘ডানে চলা’ রীতিটি প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
🇫🇷 তাহলে এই রীতিটা পুরো ইউরোপে কিভাবে ছড়িয়ে পরলো? ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে ফ্রান্সের অবদান অনেক বেশি। তবে ফ্রান্সে কেন তাদের চিরাচরিত ‘বামে চলা’ রীতির পরিবর্তে ‘ডানে চলা’ রীতি চালু হয়েছিল তা পরিষ্কার নয়।
🏴 এদিক দিয়ে ইংল্যান্ড আবার পুরোই বিপরীত ছিল। আমেরিকানদের ডান দিক দিয়ে চলার পেছনে এই যে বড় বড় মালবাহী গাড়িগুলোর অবদান রয়েছে সেগুলো কিন্তু তেমন সুবিধাই করতে পারেনি ইংল্যান্ডে, কারণ লন্ডনের রাস্তাগুলো ছিল সরু, এবং এ ধরনের গাড়ি চলার জন্য ছিল অনুপযুক্ত। তার সাথে ইংল্যান্ড কখনোই নেপোলিয়ন বা জার্মানির অধীনে ছিল না। তাই তারা তাদের শত বছরের পুরনো ‘বামে চলা’ নিয়মটাই মেনে আসছিলো। ১৭৫৬ সালে এটাকেই আইন হিসেবে জারি করে ব্রিটেন। তারপর যত ব্রিটিশ সম্রাজ্য বিস্তার করতে শুরু করে পুরো বিশ্বে তত এই ‘বামে চলা’ রীতিরও প্রসার হতে থাকে। তবে জার্মানির প্রসার এবং ‘ডানে চলা’ রীতির জনপ্রিয়তার কারণে ব্রিটেনের অধীনে থাকা অনেক দেশেই আর এই রীতির প্রচলন নেই। তবে এখনো এশিয়া মহাদেশের কিছু দেশে রাস্তার বাম দিক দিয়ে চলার রীতি এখনো চালু রয়েছে, যার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, জাপান ও বাংলাদেশ অন্যতম।