16/07/2023
| নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারবেন না |
বেশ ক’বছর থেকে বহুবিবাহ নিয়ে অনলাইনে বেশ ফ্যান্টাসি ছড়িয়েছে কিছু লোক, যাদের অধিকাংশই নাকি আবার অবিবাহিত। ফ্যান্টাসি এত দূর গড়িয়েছে যে, কনে দেখার সময় মাসনা সুলাসার প্রতি সম্মতি-সংক্রান্ত প্রশ্নকে পাত্রীর দীনদারীর গভীরতা পরিমাপের অব্যার্থ স্কেল হিসেবে সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
যেকোনো প্রান্তিকতা আরেকটি প্রান্তিকতার জন্ম দেয়। তো এই মাসনা সুলাসা প্রসঙ্গে ছেলেদের প্রান্তিকতা এবার কিছু মেয়েদেরকেও অন্য রকম আরেক প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তারা মেয়েদেরকে বিয়ের সময় ছেলেদেরকে ভবিষ্যতে মাসনা সুলাসা না করার শর্ত আরোপে উসকানি দিচ্ছেন।
এই লেখায় বহুবিবাহ নিয়ে কোনো সামগ্রিক আলোচনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বিশেষ ব্যতিক্রম কোনো কেইস স্টাডিও এটি নয়। আমরা এখানে শুধু দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই।
১. বিয়ের আলোচনায় কনেকে বহুবিবাহ নিয়ে প্রশ্ন করা
২. বিয়ের আলোচনায় বরকে বহুবিবাহ না করার শর্ত দেওয়া
আমরা বলতে চাচ্ছি সাধারণভাবে এ দুটোই অকালপক্ক ছেলেমেয়েদের কাজ এবং এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। প্রথমে আমরা ছেলেদের বিষয়টিতে বলি, আচ্ছা আমরা যদি সাহাবীদের জীবন দেখি, তবে দেখতে পাই সেখানে খুব কম সাহাবিই পাওয়া যাবে—কিংবা যাবেই না, যার একাধিক স্ত্রী ছিল না; কিন্তু এমন কোনো উদাহরণ আমাদের জানা নেই যেখানে কোনো সাহাবি বিয়ের সময় কনেকে এই প্রশ্ন করেছেন! যদি সর্বোচ্চ মাত্রার বহুবিবাহ চর্চার সমাজে এই প্রশ্ন করার প্রয়োজন না হয় তবে আপনাদের কেন এর প্রয়োজন পড়ল?
জানি উত্তর আপনাদের জিহবার আগায় এসে আছে: সেই সমাজে এটা প্রচলন ছিল, সেখানে ইসলামি আইন ছিল, সমাজব্যবস্থা ভালো ছিল। তাহলে বলি, বহুবিবাহ নিয়ে খুব বেশি ফ্যান্টাসিতে ভোগার আগে আপনারাও সেই সমাজের পুরুষদের অনুসরণে সত্যিকারে পুরুষ হন; সেই সমাজ কায়েম করুন, ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করুন, আপনাদের সমাজেও তখন এটা নরমালাইজড হয়ে যাবে। চারজন করে স্ত্রী রাখবেন, কেউ বাঁধা দেবে না; বরং সরকার হয়তো বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দেবে। একটা অনৈসলামিক শাসন ও সমাজব্যবস্থার মধ্যে থেকে যখন এমন একটা প্র্যাক্টিস করতে যাবেন তখন পশ্চিমা সেক্যুলারিজম দ্বারা প্রভাবিত নারি-পুরুষদের দ্বারা কিছুটা বাধার ও সমালোচনার সম্মুখীন হওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। এটাকে অতটা আমলে নেওয়ার কিছু নেই--যদি আপনি সত্যিই সুপুরুষ হয়ে থাকেন।
বহুবিবাহ মানে যতখুশি বিবাহ করে কিংবা বিবাহ না করেই যত খুশি নারী সম্ভোগ তো দুনিয়াতে সব জায়গাতেই আছে এখন। কিছুদিন আগে ইন্ডিয়াতে আপনারা ৪৮ বিয়ে করার খবর দেখেছেন। এটা নিয়ে কিন্তু কারও কোনো আপত্তি নেই। একই সঙ্গে বর্তমান সমাজেও আপনি যদি একাধিক নারীর সাথে বিবাহ-বহির্ভূত লিভ-টুগেদার করেন তাতেও কিন্তু সমাজ রাষ্ট্রের আইনি কোনো আপত্তি নেই। এটা তো আপনাদের আলোচ্যবিষয় নয়; আপনারা তো সেটা করবেন না। আপনাদের আলোচ্যবিষয় হলো ইসলামের বহুবিবাহ, যার সীমা একত্রে সর্বোচ্চ চার। এটা যদি নির্বিঘ্নে করতে চান তাহলে পুরুষ হন, সেই সমাজ কায়েম করুন; কেউ আপনাদের চারটা পর্যন্ত বিয়েতে বাঁধা দিতে পারবে না; বরং হয়তো উৎসাহ দিবে। তখন পশ্চিমারা আপনাদের নারীদের মগজধোলাই করে এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর দিকে নিয়ে যেতে পারবে না।
আর দয়া করে কনে দেখার সময় এই প্রশ্ন দিয়ে ঈমানের গভীরতা মাপা বন্ধ করুন। এর দ্বারা অকারণ বিয়েকে কঠিন করে ফেলা হয়। বিয়েকে কঠিন করা ইসলামি সামাজিক মুল্যবোধের পরিপন্থি।
জীবন-জগত সম্পর্কে সম্পুর্ণ অনভিজ্ঞ একটি মেয়েকে; হিন্দুস্তানি সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা, পশ্চিমা তথ্য সন্ত্রাসের শিকার একটি মেয়েকে; বন্ধুর একটু দাওয়াত, দুইটা নাস্তিকতা সম্পর্কিত সস্তা বই পড়ে নড়বড়ে ঈমান নিয়ে কোনোমতে দীনের ওপর চলতে চেষ্টা করা মেয়েটিকে এই প্রশ্ন করে বিব্রত করবেন না, বিপদে ফেলবেন না, নিজেও বিপদে পড়বেন না। এটা সাধারণভাবে আমরা আমাদের সালাফদের জীবনে দেখতে পাই না।
বিয়ের আলোচনায় মেয়েদের পক্ষ থেকে ছেলেদের প্রতি মাসনা সুলাসা না করার শর্ত আরোপ প্রসঙ্গে বলি।
আপনারা অনেক গলিঘুপচি ঘেটে দু-একটি ঘটনা এনে দলিল সাব্যস্ত করে নিজেদের বিরাট অধিকার কায়েম করে ফেলেছেন ভাবছেন! এটা তো নিশ্চিত এই শর্তের মাধ্যমে বিয়েকে আরও কঠিন করে ফেলা হবে। বিয়েকে কঠিন করার আলটিমেট সাফারার কারা এটা জানেন? যদি না জানেন তাহলে দয়া করে একটু স্টাডি করবেন। আপনারা গলিঘুপচি থেকে দু-একটি উদাহরণ এনে যে উসকানি মেয়েদেরকে দিচ্ছেন, অন্যদিকে ছেলেরা যে ফ্যান্টাসিতে আছে—এই দুয়ের পরিণতিতে এই উঠতি ইসলামি সমাজটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে একবারও কি ভেবে দেখেছেন? অন্য সবকিছু ঠিক থাকার পরেও কেবল এই একটা প্রশ্ন উত্থাপনের কারণে শতশত বিয়ে আলোচনাতেই ভেঙে যেতে পারে! অথচ সেই ছেলের হয়তো মাসনা সুলাসার কোনো চিন্তাই ছিল না! হয়তো জীবনে সে করতও না!
এবার আসুন এই শর্ত যদি আপনি দেনও তাতে ফলাফল কী দাঁড়াবে, সেটা একটু জেনে নিন। এর ফলাফল হলো কেবল ডিভোর্স রেইট বাড়ানো, বাকি কিছুই না। আপনি শর্ত দেওয়া মানেই এই নয় যে বর মাসনা সুলাসা করতেই পারবে না। আপনি এই শর্ত দেওয়ার পরও বরের মাসনা সুলাসার অধিকার বহালই থাকে। কেবল মেয়ের পক্ষে বিবাহ তার নিজের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে চলে আসার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণভাবে খোলা তালাক নিতে গেলে স্বামীর যে সম্মতির প্রয়োজন শুধু সেটুকুই রহিত হয়।
অর্থাৎ, ধরুন আপনি বিয়ের সময় শর্ত দিলেন যে বর মাসনা সুলাসা করতে পারবে না; কিন্তু কবছর পর যদি বর মাসনা করেই ফেলে তখন বাস্তবে কী হবে? বরের মাসনা ইনভ্যালিড হয়ে যাবে? কিছুতেই না। বিয়ের শর্ত ভঙ্গের কারণে আপনি কেবল আপনার নিজের বিয়ে ইনভ্যালিড করে বাপের বাড়িতে ফেরত আসার অধিকার পাবেন। বরের মাসনার তাতে কিছুই হবে না; আইনি কোনো বিপত্তিই তার ঘটবে না।
বরং মাসনার প্রতি যদি বরের প্রচণ্ড আগ্রহ তৈরি হয়, আর ওয়াহিদা যদি প্রবল বাধ সাধেন তখন অনেক ক্ষেত্রেই এমন হতে পারে যে বরই মনে মনে চাইবে, ওয়াহিদা তার অধিকার প্রয়োগ করে নিজে থেকে বিদেয় হোক। তালাক দিয়ে নিজের ঘাড়ে দায় চাপানোর দরকার নেই।
আর এক রূঢ় বাস্তবতা হলো এই অধিকার প্রয়োগ করে যখন বাবার বাড়িতে ফেরত যাবেন; নানারকম সামাজিক ও পারিবারিক নিগ্রহের শিকার হবেন তখন হয়তো এই আপনিই মাসনা সুলাসার পক্ষে প্ররাচনায় নামবেন, অন্যান্য অনেক দেশের নারীদের মতো। এই শর্ত আরোপ হয়তো কেবল এই ম্যাচিউরিটি অর্জনটাই আপনাদের জন্য সহজ করে দেবে। বস্তুত এ ছাড়া অন্য কোনো ফায়দা এই শর্ত আরোপের মধ্যে নেই।
তাই উভয়পক্ষকে বলি, বিয়ের আলোচনায় মাসনা সুলাসার প্রসঙ্গ এনে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবেন না। নিজেদের পায়ে যদি নিজেরা কুড়াল মারেন তো কেউ তা ঠ্যাকাতে পারবেও না, ঠ্যাকাতে আসবেও না। অনেক তো হলো, ছেলেমেয়ে থেকে একটু নারী-পুরুষ হওয়ার চেষ্টা তো এবার একটু করা উচিত।
ধন্যবাদ।
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান