02/05/2022
যাকাতুল ফিৎর
"""""""""""""""""""""""
📙বইঃ ছিয়াম ও ক্বিয়াম |
✍🏼___হুকুম : এটি ২য় হিজরী সনে ঈদুল ফিৎরের দু’দিন পূর্বে ফরয করা হয়। (মির‘আত ৬/১৮৬)। যা ঈদুল ফিৎরের ছালাতে বের হওয়ার আগেই মাথা প্রতি এক ছা‘ বা মধ্যম হাতের চার অঞ্জলী হিসাবে দেশের প্রধান খাদ্যশস্য হ’তে প্রদান করতে হয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,
فَرَضَ رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِّنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِّنْ شَعِيرٍ (صَاعًا مِّنْ طَعَامٍ) عَلَى الْعَبْدِ وَالْحُرِّ، وَالذَّكَرِ وَالأُنْثَى، وَالصَّغِيرِ وَالْكَبِيرِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ، وَأَمَرَ بِهَا أَنْ تُؤَدَّى قَبْلَ خُرُوجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلاَةِ- وَفِي رِوَايَةِ لِّأَبِي سَعِيْدِ الْخُدْرِيِّ: صَاعًا مِّنْ طَعَامٍ، مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ-
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতের ক্রীতদাস ও স্বাধীন, পুরুষ ও নারী, ছোট ও বড় সকলের উপর মাথা পিছু এক ছা‘ খেজুর, যব ইত্যাদি ফিৎরার যাকাত হিসাবে ফরয করেছেন এবং তা ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই আমাদেরকে আদায় করার নির্দেশ দান করেছেন’। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, ‘এক ছা‘ খাদ্যশস্য’।[1] আগে দিলে সেটি কবুল ছাদাক্বা হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু পরে দিলে সাধারণ ছাদাক্বায় পরিণত হবে। যেমন,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ فَرَضَ رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- زَكَاةَ الْفِطْرِ طُهْرَةً لِّلصَّائِمِ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ وَطُعْمَةً لِّلْمَسَاكِينِ مَنْ أَدَّاهَا قَبْلَ الصَّلاَةِ فَهِىَ زَكَاةٌ مَّقْبُولَةٌ، وَمَنْ أَدَّاهَا بَعْدَ الصَّلاَةِ فَهِىَ صَدَقَةٌ مِّنَ الصَّدَقَاتِ، رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ-
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাকাতুল ফিৎর ফরয করেছেন ছায়েমকে অনর্থক কথা ও বাজে কাজ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং অভাবগ্রস্তদের খাদ্যের জন্য। যে ব্যক্তি এটি ঈদের ছালাতের পূর্বে আদায় করবে, সেটি কবুল ছাদাক্বা হিসাবে গৃহীত হবে। আর যে ব্যক্তি এটি ছালাতের পরে আদায় করবে, সেটি সাধারণ ছাদাক্বা হিসাবে গৃহীত হবে’।[2]
যার পরিবারে একদিনের খাদ্য মওজূদ আছে এবং মাথা পিছু এক ছা‘ করে খাদ্য প্রদানের ক্ষমতা আছে, এরূপ ছোট-বড়, ধনী-গরীব সকল মুসলিম নর-নারীর উপরে যাকাতুল ফিৎর ফরয (ফাৎহুল বারী ৩/৪৩২; মির‘আত ৬/১৮৭)। এর জন্য ‘ছাহেবে নিছাব’ অর্থাৎ সাংসারিক প্রয়োজন সমূহ বাদে ২০০ দিরহাম তথা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য কিংবা সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণের মালিক হওয়া শর্ত নয়। এটি ফরয ছাদাক্বা। যা আদায় না করলে তার উপর ঋণ হিসাবে থেকে যাবে, যা শেষ বয়সে হ’লেও তাকে আদায় করতে হবে।[3]
কোন কোন বিদ্বান এটিকে ‘মনদূব’ বলেছেন। যা প্রথমে ওয়াজিব ছিল, পরে রহিত হয়। তাদের দলীল হ’ল- ক্বায়েস বিন সা‘দ বিন ওবাদাহ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ যেখানে বলা হয়েছে যে,أَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- بِصَدَقَةِ الْفِطْرِ قَبْلَ أَنْ تُنْزَلَ الزَّكَاةُ فَلَمَّا نَزَلَتِ الزَّكَاةُ لَمْ يَأْمُرْنَا وَلَمْ يَنْهَنَا وَنَحْنُ نَفْعَلُهُ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে ছাদাক্বাতুল ফিৎর আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন যাকাত ফরয হওয়ার আয়াত (বাক্বারাহ ৪৩) নাযিলের পূর্বে। অতঃপর উক্ত আয়াত নাযিলের পর তিনি আর আমাদের আদেশও করেননি, নিষেধও করেননি’।[4]
এ বিষয়ে হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, উক্ত হাদীছের সনদে একজন অজ্ঞাত পরিচয় রাবী আছেন। এক্ষণে এটিকে ‘ছহীহ’ ধরে নিলেও এর দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় না যে, একটি ফরয আরেকটি ফরযকে বাতিল করবে।[5] খাত্ত্বাবী বলেন, কায়েস বিন সা‘দ-এর হাদীছ ছাদাক্বাতুল ফিৎরের উজূবকে দূর করেনা। কেননা এর অর্থ এটা নয় যে, একটি ইবাদত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আরেকটি ইবাদতের অপরিহার্যতা দূরীভূত হবে’। তাছাড়া সকল প্রকার যাকাতের মূল উৎস হ’ল, সম্পদ। পক্ষান্তরে ছাদাক্বাতুল ফিৎরের মূল উৎস হ’ল ব্যক্তি’। ইমাম বায়হাক্বীও একই কথা বলেন। ছাহেবে মির‘আত বলেন, বিদ্বানগণ যাকাতুল ফিৎর ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন (মির‘আত ৬/১৮৭)।[6]
কোন কোন বিদ্বান ছাদাক্বাতুল ফিৎর কেবল ছায়েমদের উপর ওয়াজিব বলেছেন। কেননা ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাকাতুল ফিৎর ফরয করেছেন ছায়েমকে অনর্থক কথা ও বাজে কাজ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং অভাবগ্রস্তদের খাদ্যের জন্য’।[7] এর জবাবে ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, ‘পবিত্র করা’র কথা এসেছে অধিকাংশের হিসাবে। এর অর্থ এটা নয় যে, যারা গোনাহ করেনি তাদের উপর এটা ওয়াজিব নয়। অথবা যে ব্যক্তি সূর্যাস্তের সামান্য পূর্বে ইসলাম কবুল করেছে তার উপর ফিৎরা ওয়াজিব নয়।[8]
‘ছোটদের উপর’ ফিৎরা ফরয বলে তার পিতা বা অভিভাবককে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ তার ফিৎরা তার অভিভাবক দিবে। দ্বিতীয়তঃ প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফিৎরা ফরয। আর শিশুরাও মুসলিম সন্তান হিসাবে মুসলমান। সেকারণ তাদের উপর ফিৎরা ফরয। যে ব্যক্তি ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে ইসলাম কবুল করে, তাকেও ফিৎরা দিতে হয়। তৃতীয়তঃ এটি জানের ছাদাক্বা, মালের ছাদাক্বা নয়। অতএব এখানে ‘নিছাব’ শর্ত নয় যেমনটি হানাফী মাযহাবে বলা হয়েছে। ইবনু বাযীযাহ বলেন, ঈদের আগের দিন যদি কোন সন্তান জন্ম নেয়, তার জন্য ফিৎরা দিতে হয়। আবার যদি কেউ মারা যায়, তার জন্য ফিৎরা দিতে হয় না’। ইবনু কুতায়বা বলেন,الْمُرَادُ بِصَدَقَةِ الْفِطْرِ صَدَقَةُ النُّفُوْسِ ‘ছাদাক্বাতুল ফিৎর’ অর্থ জানের ছাদাক্বা’। আর ফিৎর এসেছে ফিৎরাত হ’তে (ফাৎহুল বারী ৩/৩৬৭)। যার অর্থ ধর্ম বা সৃষ্টিগত স্বভাব। যার উপরে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে (রূম ৩০/৩০)। সেদিকে সম্বন্ধ করেই ছাদাক্বাতুল ফিৎর বলা হয়েছে তাযকিয়ায়ে নাফ্স বা আত্মশুদ্ধিতা অর্জনের জন্য।[9]
‘ক্রীতদাস বা গোলামদের উপর ফিৎরা’ বলতে তাদের মনিবদের বুঝানো হয়েছে। যদি গোলামের নিজস্ব কোন আয় না থাকে’।[10] অতএব ধনী ও গরীব প্রত্যেকেই ফিৎরা দিবে। গরীবরা যা ফিৎরা দিবে, ধনীদের কাছ থেকে তার অনেক গুণ বেশী ফেরত পাবে।[11] কেননা ধনীদের জন্য ফিৎরা গ্রহণ বৈধ নয়।
ফিৎরা কখন জমা করবে :
ফিৎরা জমা করা সুন্নাত। যাতে সুশৃংখলভাবে বণ্টন করা সহজ হয়। ছাহাবায়ে কেরাম ঈদুল ফিৎরের এক, দুই বা তিন দিন পূর্বে জমাকারীর নিকট ফিৎরা জমা দিতেন’।[12]
কি কি খাদ্যবস্ত্ত :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় মদীনায় খাদ্য হিসাবে যেসব বস্ত্ত প্রচলিত ছিল, সবই এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে। একইভাবে বিশ্বের যে দেশে যেটি প্রধান খাদ্যবস্ত্ত, সেটা দিয়েই যাকাতুল ফিৎর আদায় করবে। যেমন আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন,كُنَّا نُخْرِجُ زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِّنْ طَعَامٍ، أَوْ صَاعًا مِّنْ شَعِيرٍ، أَوْ صَاعًا مِّنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِّنْ أَقِطٍ، أَوْ صَاعًا مِّنْ زَبِيبٍ- ‘আমরা এক ছা‘ খাদ্যশস্য অর্থাৎ এক ছা‘ যব বা এক ছা‘ খেজুর, এক ছা‘ পনির বা এক ছা‘ কিশমিশ থেকে যাকাতুল ফিৎর বের করতাম’।[13] আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)-এর বর্ণনায় খোসাবিহীন যবের (السُّلْتُ) এবং আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় ‘আটা ও ছাতু’-র কথা এসেছে।[14] এক্ষণে গম দিয়ে আদায় করলেও তা এক ছা‘ করেই দিতে হবে। যেমনটি অন্য খাদ্য শস্যের বেলায় নির্ধারণ করা হয়েছে (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩৮৫)। এটি ঐ সময় মদীনায় চালু ছিল না। যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,
لَمْ تَكُنِ الصَّدَقَةُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- إِلاَّ التَّمْرُ وَالزَّبِيبُ وَالشَّعِيرُ وَلَمْ تَكُنِ الْحِنْطَةُ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে ছাদাক্বাতুল ফিৎর আদায় করা হ’ত না খেজুর, কিশমিশ ও যব ব্যতীত। আর তখন গম ছিল না’ (ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/২৪০৬)। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, যব, খেজুর, পনির ও কিশমিশ’ (বুখারী হা/১৫০৬)। ইবনুল মুনযির (রহঃ) বলেন,لاَ نَعْلَمُ فِي الْقَمْحِ خَبَرًا ثَابِتًا عَنِ النَّبِيِّ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- يُعْتَمَدُ عَلَيْهِ وَلَمْ يَكُنِ الْبُرُّ بِالْمَدِينَةِ ذَلِكَ الْوَقْتَ إِلاَّ الشَّيْءَ الْيَسِيرَ مِنْهُ- ‘আমরা গমের ব্যাপারে কোন নিশ্চিত খবর রাসূল (ছাঃ) থেকে জানতে পারিনি। যার উপরে নির্ভর করা যায়। আর সে সময় মদীনাতে গম পাওয়া যেত না, খুবই অল্প পরিমাণ ব্যতীত’। পরে ছাহাবীগণের যামানায় যখন এর আমদানী বৃদ্ধি পায়, তখন অনেকে এক ছা‘ যবের বদলে অর্ধ ছা‘ গম দেন’ (ফাৎহুল বারী হা/১৫০৮-এর আলোচনা, ৩/৪৩৭)।
মু‘আবিয়া (রাঃ) খলীফা হওয়ার পর সিরিয়া থেকে মদীনায় প্রথম গম আমদানী হয়। এটি ছিল উচ্চ মূল্যের। ফলে আমীর মু‘আবিয়া (৪১-৬০ হি.) এটি অর্ধ ছা‘ দিতে বলেন। কিন্তু ছাহাবীগণ তা মানেননি। যেমন হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন,
كُنَّا نُخْرِجُ إِذْ كَانَ فِينَا رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- زَكَاةَ الْفِطْرِ عَنْ كُلِّ صَغِيرٍ وَّكَبِيرٍ حُرٍّ أَوْ مَمْلُوكٍ صَاعًا مِّنْ طَعَامٍ أَوْ صَاعًا مِّنْ أَقِطٍ أَوْ صَاعًا مِّنْ شَعِيرٍ أَوْ صَاعًا مِّنْ تَمْرٍ أَوْ صَاعًا مِّنْ زَبِيبٍ فَلَمْ نَزَلْ نُخْرِجُهُ حَتَّى قَدِمَ عَلَيْنَا مُعَاوِيَةُ بْنُ أَبِى سُفْيَانَ حَاجًّا أَوْ مُعْتَمِرًا فَكَلَّمَ النَّاسَ عَلَى الْمِنْبَرِ فَكَانَ فِيمَا كَلَّمَ بِهِ النَّاسَ أَنْ قَالَ إِنِّى أُرَى أَنَّ مُدَّيْنِ مِنْ سَمْرَاءِ الشَّامِ تَعْدِلُ صَاعًا مِّنْ تَمْرٍ فَأَخَذَ النَّاسُ بِذَلِكَ. قَالَ أَبُو سَعِيدٍ فَأَمَّا أَنَا فَلاَ أَزَالُ أُخْرِجُهُ كَمَا كُنْتُ أُخْرِجُهُ أَبَدًا مَّا عِشْتُ-
‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় প্রত্যেক ছোট-বড়, স্বাধীন ও গোলাম এক ছা‘ করে খাদ্যবস্ত্ত অর্থাৎ এক ছা‘ পনির বা এক ছা‘ যব বা এক ছা‘ খেজুর বা এক ছা‘ কিশমিশ যাকাতুল ফিৎর‘ হিসাবে আদায় করতাম। আমরা এভাবেই (যাকাতুল ফিৎর) বের করতাম। এমন সময় মু‘আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান (খলীফা হওয়ার পর) হজ্জ বা ওমরাহ উপলক্ষ্যে মদীনায় এলেন। (তাঁর সঙ্গে সিরিয়ার গমও এল)। তিনি মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে বললেন, আমি মনে করি সিরিয়ার দুই মুদ (অর্ধ ছা‘) গম (মূল্যের দিক দিয়ে) মদীনার এক ছা‘ খেজুরের সমান। অতঃপর লোকেরা সেটা গ্রহণ করল। তখন আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বললেন, আমি যতদিন দুনিয়ায় বেঁচে থাকব ততদিন সেটাই আদায় করব, যেটা আমি (রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায়) আদায় করতাম’।[15] অন্য বর্ণনায় এসেছে,فَأَنْكَرَ ذَلِكَ أَبُو سَعِيدٍ وَقَالَ لاَ أُخْرِجُ إِلاَّ مَا كُنْتُ أُخْرِجُ فِي عَهْدِ رَسُولِ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- وَفِى رِوَايَةٍ : لاَ أُخْرِجُ أَبَدًا إِلاَّ صَاعًا- ‘তখন আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) এটি প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, আমি কখনই বের করব না সেটা ব্যতীত, যা আমি বের করতাম রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায়’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আমি কখনই বের করব না, এক ছা‘ ব্যতীত’।[16]
তিনি অর্ধ ছা‘ গমের ফিৎরা বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন,لاَ، تِلْكَ قِيمَةُ مُعَاوِيَةَ، لاَ أَقْبَلُهَا وَلاَ أَعْمَلُ بِهَا- ‘না। ওটা মু‘আবিয়ার মূল্য নির্ধারণ। আমি ওটা মানিনা এবং ওটাতে আমলও করিনা’।[17] হাকেম ও ইবনু খুযায়মাতে এক ছা‘ গমের (صَاعًا مِّنْ حِنْطَةٍ) কথা এসেছে। যে বিষয়ে ইবনু খুযায়মা বলেন,ذِكْرُ الْحِنْطَةِ فِي خَبَرِ أَبِي سَعِيدٍ غَيْرُ مَحْفُوظٍ، وَلاَ أَدْرِي مِمَّنِ الْوَهْمُ- ‘আবু সাঈদের বর্ণনায় গমের উল্লেখ হওয়াটা ‘নিরাপদ নয়’ (অর্থাৎ এটি ভুলক্রমে হয়েছে)। জানিনা এটি কার ধারণা মতে হ’ল? শায়খ আলবানীও অনুরূপ বলেন’।[18] এক্ষণে যারা সে সময় অর্ধ ছা‘ গমের ফিৎরা দিয়েছিলেন, তারা উচ্চ মূল্যের বিবেচনায় সেটি দিয়েছিলেন তাদের ইজতিহাদ অনুযায়ী।
অতএব গমের ফিৎরার উপর ছাহাবীগণের ইজমা হয়েছে কথাটি ঠিক নয়। কেননা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (মৃ. ৭৩ হি.), আবু সাঈদ খুদরী (মৃ. ৭৪ হি.) প্রমুখের ন্যায় জ্যেষ্ঠ ছাহাবীগণ সর্বদা এক ছা‘ খাদ্য শস্যে ছাদাক্বাতুল ফিৎর আদায় করেছেন। এক্ষণে যদি কেউ গম দিতে চান, তাহ’লে এক ছা‘ করেই দিতে হবে। যেমন ঐ সময় প্রচলিত খাদ্য শস্য সমূহের মূল্যে কম-বেশী থাকা সত্ত্বেও পরিমাণে একই ছিল (ফাৎহুল বারী ৩/৪৩৭)।
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, মু‘আবিয়ার কথা অনুযায়ী অর্ধ ছা‘ গমের ফিৎরা দানের মধ্যে ত্রুটি রয়েছে (فِيهِ نَظَرٌ)। কেননা এটি একজন ছাহাবীর বক্তব্য। যার বিরোধিতা করেছেন আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) ও অন্যান্য ছাহাবীগণ। যারা মু‘আবিয়ার চাইতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দীর্ঘ সাহচর্য লাভ করেছেন এবং তাঁর অবস্থা সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত ছিলেন। তাছাড়া মু‘আবিয়া স্পষ্টভাবেই বলেছেন যে, এটি তার ‘রায়’ মাত্র। তিনি এটি রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ হিসাবে বলেননি। আবু সাঈদ খুদরীর হাদীছে ইত্তেবায়ে সুন্নাতের দৃঢ়তা রয়েছে এবং হাদীছ পাওয়ার পরে ইজতিহাদ পরিত্যাগ করার প্রমাণ রয়েছে। পক্ষান্তরে মু‘আবিয়ার রায় ও লোকদের তা মেনে নেওয়ার মধ্যে ইজতিহাদ জায়েয হওয়ার দলীল রয়েছে। যা প্রশংসিত। কিন্তু দলীল মওজুদ থাকার পর উক্ত ইজতিহাদ অগ্রহণযোগ্য।[19]
পরিমাণ :
ফিৎরার পরিমাণ এক ছা‘। আর তা হবে মাদানী ছা‘। যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,اَلْوَزْنُ وَزْنُ أَهْلِ مَكَّةَ وَالْمِكْيَالُ مِكْيَالُ أَهْلِ الْمَدِينَةِ- ‘ওযন হ’ল মক্কাবাসীদের ওযন এবং মাপ হ’ল মদীনাবাসীদের মাপ’।[20]
যারা মদীনার ছা‘-এর বিপরীতে ইরাকী ছা‘ গ্রহণ করেন ও তার অনুপাতে অর্ধ ছা‘ গমের ফিৎরা দেন, তারা বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করুন। কেননা হিজাযী ছা‘ ৫১/৩ রতল (যা আড়াই কেজি চাউলের সমান)। পক্ষান্তরে ইরাকী ছা‘ তার প্রায় দ্বিগুণ ৮ রতল (মির‘আত ৬/১৮৮)। যা প্রায় সাড়ে ৩ কেজি চাউলের সমান।
ফিৎরা জমা ও বণ্টন :
ফিৎরা ঈদের এক, দুই বা তিন দিন পূর্বে বায়তুল মালে জমা করা সুন্নাত। তার পূর্বে নয়। ইবনু ওমর (রাঃ) অনুরূপভাবে জমা করতেন। তিনি বলেন, ঈদুল ফিৎরের দু’তিন দিন পূর্বে খলীফার পক্ষ হ’তে ফিৎরা জমাকারীগণ ফিৎরা সংগ্রহের জন্য বসতেন ও লোকেরা তাঁর কাছে গিয়ে ফিৎরা জমা করত। ঈদের পরে হকদারগণের মধ্যে বণ্টন করা হ’ত।[21]
যাকাত-ওশর-ফিৎরা-কুরবানী ইত্যাদি ফরয ও নফল ছাদাক্বা ইসলামী রাষ্ট্রের আমীর কিংবা কোন বিশ্বস্ত ইসলামী সংস্থা-র নিকটে জমা করা, অতঃপর তার মাধ্যমে বণ্টন করাই হ’ল বায়তুল মাল বণ্টনের সুন্নাতী তরীকা। ছাহাবায়ে কেরামের যুগে এ ব্যবস্থাই চালু ছিল। তাঁরা কখনোই নিজেদের যাকাত নিজেরা হাতে করে বণ্টন করতেন না। বরং যাকাত জমাকারীর নিকটে গিয়ে জমা দিয়ে আসতেন। এখনও সঊদী আরব, কুয়েত প্রভৃতি আরব দেশে এ রেওয়াজ চালু আছে। এর ফলে যাকাত দাতা রিয়া ও শ্রুতি থেকে বেঁচে যান এবং ‘ডান হাতের দান বাম হাত টের পায় না’ এরূপ দাতাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর ছায়া প্রাপ্ত মুমিনের অন্তর্ভুক্ত হ’তে পারেন।[22]
[1]. বুখারী হা/১৫০৩, ১৫০৬; মুসলিম হা/৯৮৬, ৯৮৫; মিশকাত হা/১৮১৫-১৬।
[2]. আবুদাঊদ হা/১৬০৯, সনদ হাসান; মিশকাত হা/১৮১৮ ‘ছাদাক্বাতুল ফিৎর’ অনুচ্ছেদ।
[3]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩৮৫-৮৬ পৃ. ‘যাকাতুল ফিৎর’ অনুচ্ছেদ; মির‘আত ৬/১৮৭ পৃ. ‘ছাদাক্বাতুল ফিৎর’ অনুচ্ছেদ।
[4]. নাসাঈ হা/২৫০৬-০৭; ইবনু মাজাহ হা/১৮২৮; আহমাদ হা/১৫৫১৫, ২৩৮৯৪।
[5]. ফাৎহুল বারী হা/১৫০৩-এর পূর্বে ‘ছাদাক্বাতুল ফিৎর ফরয’ অনুচ্ছেদ-৭০, ৩/৪৩০-৩১ পৃ.।
[6]. খাত্ত্বাবী, মা‘আলিমুস সুনান (হালব, মিসর : আল-মাত্ববা‘আতুল ইলমিইয়াহ, ১ম সংস্করণ ১৩৫১ হি./১৯৩২ খৃ.) ২/৪৭; মির‘আত ৬/১৮৭ পৃ.।
[7]. আবুদাঊদ হা/১৬০৯; মিশকাত হা/১৮১৮ ‘যাকাত’ অধ্যায় ‘ছাদাক্বাতুল ফিৎর’ অনুচ্ছেদ।
[8]. ফাৎহুল বারী হা/১৫০৩-এর আলোচনা ৪৩২ পৃ.; মির‘আত হা/১৮৩৩-এর আলোচনা ৬/১৯২ পৃ.।
[9]. মির‘আত, ‘ছাদাক্বাতুল ফিৎর’ অনুচ্ছেদ-এর আলোচনা ৬/১৮৫ পৃ.।
[10]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩৮৫; মির‘আত ৬/১৯০; ফাৎহুল বারী ৩/৪৩২ পৃ.।
[11]. ছহীহ আত-তারগীব হা/১০৮৬; মির‘আত ৬/১৯০ পৃ.।
[12]. বুখারী হা/১৫১১; ফাৎহুল বারী (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ ১৩৭৯ হি.) ৩/৪৪০-৪১ পৃ.; ঐ, কায়রো : দারুর রাইয়ান লিত-তুরাছ, ২য় সংস্করণ ১৪০৭ হি./১৯৮৭ খৃ. ৩/৪৩৯ পৃ.; ।
[13]. বুখারী হা/১৫০৬; মুসলিম হা/৯৮৫; মিশকাত হা/১৮১৬।
[14]. (وَمَنْ أَدَّى دَقِيقًا قُبِلَ مِنْهُ، وَمَنْ أَدَّى سَوِيقًا قُبِلَ مِنْهُ) ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/২৪১৬, ২৪১৫।
[15]. মুসলিম হা/৯৮৫; বুখারী হা/১৫০৮।
[16]. ফাৎহুল বারী হা/১৫০৮-এর আলোচনা, ৩/৪৩৮; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৩০৭, সনদ হাসান; আবুদাঊদ হা/১৬১৮, সনদ যঈফ।
[17]. হাকেম হা/১৪৯৫; ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/২৪১৯; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৩০৬।
[18]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/২৪১৯; তাহকীক, ড. মুহাম্মাদ মুছত্বফা আল-আ‘যমী।
[19]. (لَكِنَّهُ مَعَ وُجُودِ النَّصِّ فَاسِدُ الإعتبار) ফাৎহুল বারী হা/১৫০৮-এর আলোচনা, ৩/৪৩৮।
[20]. আবুদাঊদ হা/৩৩৪০; নাসাঈ হা/২৫২০; ছহীহাহ হা/১৬৫।
[21]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/১৫১১-এর আলোচনা ৩/৪৪০-৪১ পৃ.; মির‘আত ১/২০৭ পৃ.।
[22]. বুখারী হা/১৪২৩; মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১।