14/08/2024
মানবতার জয় হোক, ড. ইউনূসের পরিষদের জয় হোক
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম
মঙ্গলবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৪
বৈষম্যবিরোধী ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের মহা সাফল্যে আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। বিশ্বখ্যাত শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করছি। সেই সঙ্গে দেশের মানুষের মুক্তির জন্য যারা অকাতরে জীবন দিয়েছে, বিশেষ করে রংপুরের আবু সাঈদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। জীবনে হাজারবার উচ্চারণ করেছি, সকাল বেলার আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা।
আমার স্ত্রী যখন পাশে বসে তখনই কথাটি মনে করে। ইদানীং নেত্রী শেখ হাসিনার নিদারুণ পতনের পর কথাটি আরও বেশি আলোচনা করছে। শেখ হাসিনার প্রতি মায়া-মমতা-ভালোবাসা আমার পরিবারের সবারই আছে। কিন্তু তার একরোখা মনোভাব অন্যকে গুরুত্ব না দেওয়া বড় বেশি তাচ্ছিল্য করা দেশটি কারও বাবার এ মনোভাব কখনো সমর্থন করতে পারতাম না।
যে জন্য অনেক নির্যাতিত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছি। তারপরও বঙ্গবন্ধুর কন্যা, সে সম্মান না দিয়ে পারি না। দেশে একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে যেমন অজানারা সফলতা এনেছিল, এবারের বিজয়ও ঠিক তেমনি।
আমার বহুদিনের একটা ধারণা ছিল এভাবে দেশ চলতে পারে না, দেশ কখনো এভাবে চলে না। এই জীবনে খুব একটা কম দেখিনি। ’৭০-এ প্রথম ভোট দিয়েছি, তারপর ’৭৩, ’৯১, ’৯৬। এরপর আর কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে মনে হয় না। আমার কোনো গুণ আছে কি না বলতে পারি না।
তবে একটা বদ্ধমূল দোষ যে আছে সেটা বুঝি। আমি কারও ভালোমন্দ অস্বীকার করতে পারি না। আমরা ঢাকা বিজয় করে নিয়াজির সঙ্গে হাত মেলাইনি। কিন্তু সেদিন বঙ্গভবনে জামায়াত নেতা ডা. শফিকুর রহমানের এগিয়ে দেওয়া হাত ফিরিয়ে দেইনি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অনেকদূর থেকে উঠে এসে হাত মিলিয়েছেন। আমি তারও চাইতে বিনয়ের সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে হাত মিলাবার চেষ্টা করেছি। ব্যক্তিজীবনে কাউকে শত্রু মনে করি না। অনেককেই ভালোবাসি, সম্মান করি। সেখানে ড. কামাল হোসেন অন্যতম প্রধান। ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে তাঁর দল যখন গঠিত হয়, সেখানে ড. ইউনূস একটা অসাধারণ ধারণাপত্র পাঠ করেছিলেন। অন্যদিকে বাংলার মা, মানুষের মা মানবতার প্রতীক বেগম সুফিয়া কামাল প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি জাতীয় সম্প্রীতির জন্য এক অসাধারণ বক্তব্য দিয়েছিলেন। প্রতিটি মা যেমন তাঁর সন্তানের জন্য ভাবে, চিন্তা করে ঠিক তেমনি একপর্যায়ে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর দুটি কন্যা তাঁদের আপনারা দেখবেন। তাঁদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। সামনের সারিতে বসে আমি নিবিষ্টমনে তার কথাগুলো শুনেছিলাম। আগাগোড়াই স্বাধীনচেতা ছিলাম। তাই আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদের এক নম্বর সদস্য হয়েও ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের জন্মদিনে উপস্থিত হতে দ্বিধা করিনি।
গণফোরামের সম্মেলনের কয়েকদিন আগে ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ আমার অনুরোধে টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলেন। আমি যখন তাঁকে টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম তখন তিনি বলেছিলেন, ‘ভাই, কারে যেতে অসুবিধা, পায়ে কষ্ট। জিপ হলে ভালো হয়। ’ কথাটা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে বললে তিনি বলেছিলেন, ‘কাদের ভাই কোনো চিন্তা করবেন না। স্যারকে আমি আমার গাড়িতে নিয়ে যাব। ’ সেভাবেই গিয়েছিলেন। তখন বিএনপির সরকার। কিন্তু ফরিদপুর সার্কিট হাউস এবং টুুঙ্গিপাড়ার সবকটি সরকারি বিশ্রামাগার ব্যবহারে কোনো অসুবিধা হয়নি। মনে হয় তার কদিন পর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে গণফোরামের জন্ম। পরদিন গিয়েছিলাম হাই কোর্টে ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদের চেম্বারে। অসম্ভব যত্ন করেছিলেন। সেদিন তিনি যেমনটা করেছিলেন সাধারণত হুজুর মওলানা ভাসানীর কাছে গেলে তিনিও অমন করতেন। কী খাওয়ালে খুশি হব, কী করলে ভালো লাগবে, আমাকে নিয়ে তাঁর ছটফটানি দেখে ভীষণ অভিভূত হয়েছিলাম। একপর্যায়ে বলেছিলাম, স্যার গতকাল গণফোরামের জন্মতিথিতে আপনাকে তো দেখলাম না। আমাকে অবাক করে বলেছিলেন, ‘সিদ্দিকী সাহেব, আপনি লম্বা মানুষ। অনেক কিছুই বুঝবেন না। অতটা পথ তাই আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ’ অবাক হয়ে বলেছিলাম, কী বলেন স্যার! হাই কোর্ট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট ১০০ গজও না। সেটা দূর হলো আর আমার সঙ্গে আরিচা-ফরিদপুর ঘুরে প্রায় ২০০ কিলোমিটার টুঙ্গিপাড়া গেলেন সেটা দূর মনে হলো না? একটা অট্টহাসি দিয়ে ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ বলেছিলেন, ‘কাদের ভাই, ওটাই তো কথা। আপনার আন্তরিকতা আপনার চেষ্টা আমাকে টুঙ্গিপাড়া নিয়ে গেছে, কোনো দূর মনে হয়নি। হাই কোর্ট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট অনেক দূর মনে হয়েছে। এটাই হলো প্রচেষ্টা, এটাই হলো আন্তরিকতা। ’ বড় ভালো মানুষ ছিলেন ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ। অমন প্রাণখোলা বঙ্গবন্ধু প্রেমিক খুব বেশি হয় না। তিনি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, নির্বাচনি প্রচারণা চলছিল। হঠাৎই তাঁর ফোন পাই, ‘কাদের সাহেব, এই মাত্র আপনাকে দলীয় প্রতীক হিসেবে গামছা দিয়ে দিলাম। আনন্দে বুক ভরে গিয়েছিল। আমি তখন ঘাটাইলের ধলাপাড়া থেকে সাগরদিঘি যাচ্ছিলাম। তাঁর ছেলে সৈয়দ রেফাত আহমেদ প্রধান বিচারপতি হলেন। এ আমার জন্য যে কত বড় গর্বের, বলে কয়ে বোঝানো যাবে না। কতবার স্যারের কাছে গেছি, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা হয়েছে। কত ব্যাপারে সাহায্য করেছেন।
যখন গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে খুব গোলমাল তখন এক দিন ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, আপনি একটু ইউনূসের ওখানে যান, সাহস পাবে। আমরা গিয়েছিলাম দলবদ্ধ এবং পারিবারিকভাবে। তিনি সত্যিই সাহস পেয়েছিলেন এবং সে কথা অকপটে প্রচার মাধ্যমে বলেছিলেন। যে কদিন হাই কোর্টে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে শুনানি হয়েছিল সে কদিনই সেখানে ছিলাম। আমি একটু মুখচোরা স্বভাবের মানুষ, আগবাড়িয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলতে পারি না। হাই কোর্টে পেছনের বেঞ্চে বসতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু ব্যারিস্টাররা এত সম্মান দেখিয়েছেন, পেছন থেকে টেনেটুনে সামনে নিয়ে বসাতেন। এরপর অনেক বছর যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই ছুটে গেছি। কোনো ভূত-ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করিনি। গত কিছু দিন যখন তাঁকে কোর্টে কোর্টে দারুণভাবে নাজেহাল করা হচ্ছিল তখন বারবার মনে হচ্ছিল কারও ওপর এমন অন্যায়-অত্যাচার, অপমান আল্লাহ সহ্য করবেন না। যেদিন তাঁকে মেট্রোপলিটন কোর্টে লোহার গারদে নেওয়া হয় সেদিন আমার মনে হয়েছিল এই বুঝি আকাশ ভেঙে পড়ল। মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং রংপুরের আশিকুর রহমানকে রাজাকার বলায় আমাকেও ওই লোহার গারদে নেওয়া হয়েছিল। আমি না হয় কেউ না, রাস্তার মানুষ। কিন্তু ড. ইউনূসের মতো একজন মানুষকে গারদে ঢুকানো হলে আল্লাহর তরফ থেকে তার বিচার তো হবেই হবে। ব্যাপারটা তাই হয়েছে। এসব নিয়ে আমি অনেক সময় ভেবেছি এবং দু-একবার নেত্রীকে বলার চেষ্টাও করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় একেবারে বিপরীত মেরুর মানুষ জয়প্রকাশ নারায়ণকে ভারতের মহান নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বিশেষ দূত হিসেবে সারা পৃথিবী ঘুরিয়ে ছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের ৮০-৯০ ভাগ মানুষের এবং সরকারের সমর্থন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আমরা পেয়েছিলাম। অধ্যাপক ইউনূসের মতো অমন একজন মেধাবী বিশ্ববিখ্যাত মানুষকে শেখ হাসিনা এভাবে নাজেহাল না করে তাঁকে দেশের কাজে লাগাতে পারলে আমরা আরও অনেক এগিয়ে যেতে এবং সারা পৃথিবীর একটা নামকরা দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে স্থান পেতাম। শেখ হাসিনার লোকেরা অনেক বড় বড় কথা বলতেন এবং আরও বলবেন। কিন্তু তারপরও আমি বলব, তাঁর সময়ে যে অবাধ দুর্নীতি হয়েছে সেটা পৃথিবীর সমস্ত ইতিহাসকে ছাড়িয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের ওপর ঋণের টাকায় যেসব বড় বড় প্রজেক্ট করা হয়েছে সেসব প্রজেক্টে ১০০ টাকার কাজ হাজার টাকায় করে সবাইকে চুরি করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। সেটা পদ্মা সেতুই হোক, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, হানিফ ফ্লাইওভার কোনো কিছুতে চুরির পরিমাণ কম হয়নি। কারণ আমার যতটুকু সাধারণ জ্ঞান তাতে বুঝি আমাদের দেশে বিদেশি সাহায্যপুষ্ট সবকটি প্রজেক্টে চার থেকে ছয় গুণ বেশি অর্থে প্রাক্কলন করা হয়েছে। ভাঙ্গা-আরিচা রাস্তায় কিছু জায়গা আমেরিকা-নিউইয়র্কের সড়ক নির্মাণের চাইতে প্রাক্কলিত অর্থ বেশি। তাই একসময় না একসময় এসবের জবাব কাউকে না কাউকে দিতেই হবে। আল্লাহর ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক ইউনূসের হাতে বাংলাদেশের ভাগ্য উন্নয়নের দায়িত্ব পড়েছে। আকুরটাকুর পাড়া আমাদের বাড়ির পাশে গ্রামীণ ব্যাংকের গোড়াপত্তন করেছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। যে গ্রামীণ ব্যাংক আজ বাংলাদেশের সম্পদ। যার মাধ্যমে অধ্যাপক ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। যেটা আমাদের জন্য, দেশ ও দেশবাসীর জন্য এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সাদা চোখে যা দেখছি তাতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ যথেষ্টই গুণমানসম্পন্ন। এখন পর্যন্ত দুজন সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে নেওয়া হয়েছে। সেদিন শপথের সময় বঙ্গভবনে পাশে বসে মুহূর্তকাল কথা বলে তাদের আমার ভালো লেগেছে। অনেকেই বৈষম্যবিরোধী ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকে এর ওর ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে বলার চেষ্টা করছেন বা করবেন। কেন যেন আমার মোটেই তেমন মনে হয় না। লম্বাচড়া মানুষ, সাধারণত সরল সোজা হয়। আমিও সেই জাতের। তেমন ঘোরপ্যাঁচ কূটকৌশল করি না, বুঝিও না। ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনের পর ছাত্র-যুবকদের এত সততা কখনো লক্ষ্য করিনি। একসময় আমারও মনে হয়েছে ছাত্র-যুবকরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চীন আফিমের নেশায় বুঁদ হয়েছিল। আমাদের ভবিষ্যৎও মোবাইল স্ক্রিনে আটকা পড়েছে। কিন্তু সেসব একেবারে ভুল প্রমাণ করে আমাদের সন্তানরা অসাধ্য সাধন করেছে। আজ সাত দিন জাতির গৌরব, জাতির ঠিকানা ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাতায়াত করছি। যে ধ্বংস বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে করা হয়েছে সেটা শুধু একমাত্র চেঙ্গিস খান, হালাকু খানের মিসরীয় সভ্যতা ধ্বংস বা গুঁড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করা চলে। বঙ্গবন্ধু বাংলার ঠিকানা, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি জ্বালালিয়ে-পুড়িয়ে যেভাবে দলিল দস্তাবেজ ছারখার করে ফেলা হয়েছে তাতে ভাবিকালে আমরা আমাদের শৌর্য-বীর্যের পরিচয় দিতে পারব না। আমি একজন পা থেকে মাথা পর্যন্ত মুসলমান। আমার দ্বারা অন্য ধর্মের কারও এক বিন্দু অসুবিধা হোক বা ক্ষতি হোক তা আমি চাই না, আমার ধর্ম সেটা অনুমোদন করে না। আমি ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জির তালকাটরা রোডের বাড়িতে নামাজ আদায় করেছি, প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির বাড়িতে নামাজ পড়েছি, প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শেখর, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিজু পট্টনায়েকের বাড়িতে পড়েছি। তাদের কোনো অসুবিধা হয়েছে কি না বলতে পারব না। কিন্তু আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জি আমার ঘরে আমার বিছানায় শুয়েছেন, মনে হয় তাতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি। শোবার আগে এবং ঘুম থেকে উঠে আহ্নিক করেছেন। তাঁর মতো করে পূজা-অর্চনা করেছেন, তাতে আমার ইমানের ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, সেখানে সৃষ্ট জাদুঘর পুড়ে ছারখার করে যে ক্ষতি করা হয়েছে হাজার বছরে সে ক্ষতি আর পূরণ হবে না। ধানমন্ডি যাওয়া-আসার পথে ছোট্ট ছোট্ট যুবক-যুবতীরা যেভাবে রাস্তা সামাল দিচ্ছে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। আমার গাড়িও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আটকে, কাগজপত্র দেখেছে, ভিতরে অবৈধ কোনো জিনিসপত্র আছে কি না দেখবার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। আমি অনেকক্ষণ বসে থেকে তাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছি। তারা সব পরীক্ষায় পাস করেছে। কিন্তু বুঝতে পারছি না সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর অফিস ওভাবে ধ্বংস করা হলো কেন? গণভবনে না হয় শেখ হাসিনা থাকতেন, সেটা ভাঙা...
১০ তারিখ গিয়েছিলাম হুজুর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মাজার জিয়ারতে সন্তোষে। অসাধারণ সাড়া পেয়েছি। মাজার প্রাঙ্গণ লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার পথে ছাত্র-যুবকদের রাস্তা সামলানো দেখে গিয়েছিলাম, বিকালে ফেরার পথে আরও দেখলাম। টাঙ্গাইলে যাওয়ার আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি আমায় খুব পছন্দ করেন। বলেছিলেন, এলাকায় গেলে সবাইকে একটু সাহস দেবেন। আপনার ভরসায় কাজ হবে। পারলে পুলিশের সঙ্গে কথা বলবেন। তাই পুলিশ লাইনে গিয়েছিলাম। সেও এক ইতিহাস। টাঙ্গাইল পুলিশ লাইনে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সার্কিট হাউস দখলের অভিযানে এক প্লাটুন পুলিশ নিতে গিয়েছিলাম। তখন সেখানে আমাদের নেতাদের মধ্যে টাঙ্গাইল সংগ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান খান এমপি ছিলেন, পরিষদের আহ্বায়ক লতিফ সিদ্দিকী এমপি ছিলেন, ছিলেন ডিসি-এসপিরা, আরও অনেকেই। ১০ তারিখ এসপি, এএসপিসহ অনেক পুলিশ সদস্য ছিলেন। আমি তাদের আশ্বস্ত করেছি, আপনারা কোনো দল-মত-গোষ্ঠীর কথায় চলবেন না। আপনারা আইনের নির্দেশে চলবেন। আপনাদের ১১ দফা দাবি বিশেষ করে বেতন বাড়ানো এবং ৮ ঘণ্টা ডিউটিতে আমাদের সমর্থন থাকবে। আন্দোলনে জয়ী ছাত্রদের সমর্থন পাবেন, আমাদেরও পাবেন। গিয়েছিলাম টাঙ্গাইল কালীবাড়ি হিন্দু সম্প্রদায়কে ভরসা দিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইল কালীবাড়ি হানাদার রাজাকাররা দখল করে ক্যাম্প বানিয়েছিল। ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ টাঙ্গাইল স্বাধীন করে সন্ধ্যাতেই সেখানে গিয়েছিলাম। আবার গিয়েছিলাম ১৪ ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজি এবং এক দল ভারতীয় সৈন্য নিয়ে। তারা গঙ্গা থেকে জল এনেছিলেন। সেই গঙ্গা জল ছিটিয়ে টাঙ্গাইল কালীবাড়িকে তারা পূত-পবিত্র করেছিলেন। তাদের আশ্বাস দিয়েছি, কোনো রকম ধ্বংসাত্মক কাজ হলে আমরা সেটা সহজভাবে নেব না। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন স্বস্তিতে থাকুন। তারপর গিয়েছিলাম হুজুর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মাজার জিয়ারতে। যে কোনো কাজেই আমি হুজুরের মাজারে যাই, তারপর টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর কবরে। এবারও নিয়ত করেছি, আগামী ১৫ তারিখ ধানমন্ডি পিতার বাড়িতে বাদ আসর মিলাদ পড়ে ১৬ আগস্ট শুক্রবার টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবরের পাশে জুমার নামাজ আদায় করব। ঢাকা ফেরার পথে টাঙ্গাইলের ডিসি মো. কায়ছারুল ইসলামকে ভরসা দিতে গিয়েছিলাম। সাধারণত টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা ফিরতে দুই ঘণ্টা-সোয়া দুই ঘণ্টা লাগে। কিন্তু ১০ তারিখ সাড়ে চার ঘণ্টা লেগেছে। বেশি সময় লাগার মূল কারণ রাস্তায় ট্রাফিক নেই। ছাত্র বন্ধুরা ছোট্ট মেয়েরা ওই রাতেও ট্রাফিকের কাজ করছে। সে এক অসাধারণ দেখার মতো ব্যাপার। কেউ এক চুল এদিক-ওদিক হচ্ছে না। কেউ ট্র্যাক বদল করছে না। বাচ্চারা যেদিকে বলছে সবাই সেদিকেই চলছে। এক অভাবনীয় ব্যাপার দেখলাম ইপিজেডের কাছাকাছি থেকে রায়হান শেখ নামে দ্বাদশ শ্রেণির আমিন মডেল টাউন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক ছোট্ট ছেলে এগিয়ে এসে সালাম করে হাত মেলায়। তারপর সে কী তার তীব্র গতি। সে একটা মোটরসাইকেলে আমাদের এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কখনো গাড়িতে কখনো পায়ে হাওয়ার বেগে এগিয়ে চলছে। ¯ন্ডেœহ মমতায় বাচ্চাটির প্রতি এবং সব আন্দোলনকারীর প্রতি বুক ভরে গিয়েছিল। আমরা যদি এই সততার দেশ মমতার দেশ মানবতার দেশ ধরে রাখতে পারি। ঘুষ-দুর্নীতি দাঙ্গা-হাঙ্গামার হাত থেকে রক্ষা পেলে যে আশায় রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলাম তা হয়তো বাস্তবায়িত হবে।
ভাবতেই পারি নাই কেন এমন হয়, হঠাৎ ১১ তারিখ ১১টা বাজার ৫ মিনিট আগে বঙ্গভবন থেকে ফোন, প্রধান বিচারপতির শপথ অনুষ্ঠান। মহামান্য রাষ্ট্রপতি চান আপনি আসুন। ’ ক’টায় শপথ? ১২টায়। তখন ১০টা ৫৫ মিনিট। তাড়াহুড়া করে তৈরি হয়ে ১১টা ৫ মিনিটে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। প্রথমে খামারবাড়ী রাস্তা সে যে কী প্রচন্ড যানজট। এক জায়গায়ই ২৫-৩০ মিনিট কেটে যায়। সেখান থেকে ঘুরে আবার সায়েন্স ল্যাবরেটরি হয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যখন পৌঁছি তখন ১২টা বেজে গেছে। তাই বঙ্গভবনের দিকে আর না গিয়ে কেবিন ব্লকে গিয়েছিলাম। ৬১৭ নম্বরে আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বীরপ্রতীক বহুদিন ধরে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তাকে দেখে সাড়ে ১২টায় মোহাম্মদপুরের বাড়ির দিকে রওনা হই। পরে হঠাৎই শুনলাম তখনো শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। শপথ অনুষ্ঠান হয়েছে ১২টা ৫০-৫৫ মিনিটের দিকে। তাই সময়ের হেরফেরে দুই অতিরিক্ত উপদেষ্টা এবং প্রধান বিচারপতির দুর্লভ শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারিনি। কিন্তু তবু আশা করি, অমন কৃতী পিতার কৃতী সন্তান দেশে সুশাসনের একটি চমৎকার বাতাবরণ সৃষ্টিতে সফলকাম হবেন। আমি তাকে আমার, আমার দল, আমার পরিবার ও দেশবাসীর পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভকামনা ও অভিনন্দন জানাই। তিনি সফলকাম হোন। যে আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, দুই-আড়াই লাখ মা-বোনের সম্মান-সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্থবহ হোক -এই প্রত্যাশাই করি। বহু বছর আগে বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীকে পন্ডিত জওহরলাল নেহরু লিখেছিলেন, কারও কাছে ক্ষমতা যখন আসে মেঘের গর্জনে দিগি¦দিক কাঁপিয়ে সিংহের বিক্রমে আসে। আবার ক্ষমতা যখন চলে যায়, যার কাছ থেকে চলে যায় এত সন্তর্পণে যায় যে সে কিছুই বুঝতে পারে না। সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে কথাটি চলে কি না বারবার বুকের মধ্যে আলোড়ন তুলছে।
লেখক : রাজনীতিক