23/03/2024
ভূত নাকি অন্য কিছু ?😱
-----------------------------
রাত ঠিক একটা চল্লিশ মিনিটে কুকুরগুলো ডেকে ওঠে। এত রাতে কুকুরের ডাক শুনলে, এমনিতেই ভয় লাগার কথা। তারপরে কুকুরগুলো কেমন যেন অদ্ভুত সুরে ডাকে। প্রথম যেদিন আমি শুনি, সেদিন ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সবগুলো কুকুর একসাথে ডেকে থেমে যায়। এরপর ঠিক আধা ঘণ্টা পরে আবার একবার সবাই একসাথে ডেকে ওঠে। তারপর আরো আধা ঘন্টা পরে শেষবারের মত ডেকে, থেমে যায় কুকুরগুলো। অবাক করা ব্যাপার হলো, আমার স্বামী আবির যেদিন বাড়িতে থাকে, সেদিন কুকুরগুলো ডাকে না। কিন্তু যেদিন ওর নাইট ডিউটি থাকে, ঠিক সেদিনই কুকুরগুলো একই সময়ে একই নিয়মে ডাকে।
আমি আবিরকে ব্যাপারটা বলেছি। কিন্তু আবির হেসেই উড়িয়ে দেয়। বলে, " তুমি সারাজীবন যৌথ পরিবারে মানুষ হয়েছো। একা থাকতে তাই তোমার ভয় করে। কোন সমস্যা নেই, কিছুদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। " আমি আবিরকে বোঝাতে পারি না, যৌথ পরিবারে মানুষ হলেও আমি যথেষ্ট সাহসী মেয়ে। ভূতের ভয় আমিও পাই না। কিন্তু অবশ্যই এই বাসাটায় কোন সমস্যা আছে। যা আমি অনুভব করতে পারছি, কিন্তু বুঝতে পারছি না, বা বোঝাতে পারছি না।
আমি মৌ। আমাদের বাড়ি যশোর। বিয়ের পরে আবিরের চাকরির সুবাদে সিলেটে এসেছি। আবির টিভি সাংবাদিক। প্রথমে দুই বন্ধু মিলে একটা বাসা ভাড়া করে থাকতো। আমাকে বিয়ে করার পরে এই বাসা ভাড়া নিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, বাসাটা আমার পছন্দেই নেওয়া হয়েছে। এই এলাকাটা একটু নির্জন। খুব বেশি বাড়ি ঘর নেই এদিকে। চারিদিকের সুন্দর দৃশ্য তাই খুব সহজেই দেখা যায় দোতালার বেলকনি থেকে। প্রায় দু বিঘা জমির উপরে বাংলো টাইপের বাসা। বাসার সামনে ফুলবাগান। বাসাটার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ভালো। সি সি ক্যামেরা লাগানো আছে। একজন কেয়ারটেকার আছে। সেই ই দারোয়ান এবং মালির কাজও করে। বাড়িওয়ালা চাচা খুবই অমায়িক। বয়স আনুমানিক পঞ্চান্ন / ষাট হবে। বিয়ে শাদি করেননি। একতলাতে একাই থাকেন। দোতালাটা ভাড়া দিতে চান। বলা যায় পানির দরে বাসা ভাড়া দিচ্ছেন। চাচা বললেন, " বুঝলে মা, বাসা ভাড়া দেওয়ার আমার কোন প্রয়োজন পড়ে না। আমার সম্পত্তি, ব্যাংক ব্যালান্স যা আছে, তা চাইলে আরো পাঁচ, সাত জেনারেশন বসে খেতে পারে। কিন্তু সময় থাকতে বিয়ে শাদি করিনি। তখন ইচ্ছাও করেনি। কিন্তু এখন একটু একাকিত্বে ভুগি। তাই ভাড়া দিয়ে মাঝে মাঝে ভাড়াটেদের সাথে গল্প গুজব করি। সময় কেটে যায়। " এমন একটা বাসার স্বপ্ন ছিল আমার। সামর্থ্যের ভিতরে এত সহজেই সেটা পেয়ে যেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম আমি।
আবিরেরর যেদিন নাইট ডিউটি থাকে, সেদিন ভয়ে আমি ঘুমাতে পারি না। কুকুরগুলোর ডাকে গা ছমছম করে। আজকাল আর আবিরকে বলি না সেটা। খামোখাই হাসাহাসি করবে। সাহস করে মাঝে মাঝে বেলকনিতে আসি। খেয়াল করে দেখি, বাড়ির ডান পাশে সীমানা প্রাচীরের সাথে লাগানো চাচাদের পারিবারিক কবরস্থান থেকে কুকুরের ডাকগুলো আসে। কবরস্থানটাও উচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ফুলগাছ সহ নানা ধরনের গাছপালা আছে কবরস্থানটায়। বেশ সুন্দর কবরস্থানটা। এ বাড়ির সীমানা প্রাচীরের সাথে একটা গেট লাগানো আছে। সেই গেট দিয়েই যাওয়া যায় কবরস্থানটায়। দুই একদিন কুকুরগুলোর ছায়া দেখতে পাই আমি। একদিন বিকালে একাই গিয়েছিলাম কবরস্থানটায়। কিন্তু কুকুরগুলোকে দেখতে পাইনি। রাতেরবেলা কোথা থেকে আসে কে জানে।
সপ্তাহখানেক আগে এক রাতে দেখতে পেলাম, কবরস্থানে একটা মেয়ে ঘোরাঘুরি করছে। বাসার সিকিউরিটি লাইটগুলোর আলো কবরস্থানে পড়ে। সেই আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম মেয়েটাকে। আমি বুঝতে পারছিলাম, এটা আমার কল্পনা। নিজেকে সেটাই বোঝাচ্ছিলাম। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো, মেয়েটাও ঘুরে আমাকে দেখছে। আমি দ্রুত বেলকনি থেকে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। জীবনে এত ভয় কোন দিন পাইনি। ভয়ে মনে হলো, জ্বর চলে এসেছে।
পরের দিন আবির বাসায় ফিরলে ওকে বললাম ঘটনাটা। ও হাসলো না। বেশ সহানুভূতির সাথে বললো, " আসলে এত বড় বাড়িতে একা থাকো, তার উপরে বাসার সাথে লাগানো কবরস্থান, এই সবকিছুই তোমার মনের উপরে ভীষণ প্রভাব ফেলেছে। আমি একটু সময় বের করতে পারলেই তোমাকে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে যাবো। "
আমি রাতে আর বেলকনিতে যাচ্ছি না। গতকাল আবির একটা অবাক করা কথা বললো। নিজে থেকেই বললো,
- মৌ, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, এই বাসাটা ছেড়ে নতুন একটা বাসা ভাড়া নিবো।
- হঠাৎ ?
- না, মাঝে মাঝেই তোমাকে একা থাকতে হয়। তুমি ভয় পাও, বোঝাই যায়। আর তাছাড়া, একটা ঘটনা শুনে নিজের মনেও একটু দ্বিধা তৈরি হয়েছে।
- কি ঘটনা ?
- গতকাল টি রুমে বসে চা খাওয়ার ফাঁকে শোভনকে তোমার সমস্যার কথা বলছিলাম। জিজ্ঞাসা করছিলাম, ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট এখানে কে আছেন। আমার চাকরিটাও তো বেশিদিনের নয়। আমিও সিলেটে নতুন ই বলা যায়। তাই সাইকিয়াট্রিস্ট ভালো কে আছেন, আমি জানি না।
শোভন ডাক্তারের ঠিকানা দিয়েছে। কিন্তু ঐ সময় পাশে বসে আমাদের কথা শুনছিলেন সুমন ভাই। আমাদের বাসার ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর যা বললেন, তা শুনে আমার মনটা একটু খারাপ হয়েছে।
- সুমন ভাইয়া কি বলেছেন ?
- সুমন ভাই বলেছেন, এই বাড়িটাকে নাকি অনেকে ভূতের বাড়ি বলে থাকে। তাই এই বাড়িটা বহুকাল ভাড়া হয়নি। খালি পড়ে ছিল। আমাদের নাকি এই বাসাটা ভাড়া নেওয়া ঠিক হয়নি। পাঁচ বছর আগে এই বাসা থেকে একটা মেয়ে হারিয়ে যায়। তার স্বামী অফিসের প্রয়োজনে খুলনা গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে মেয়েটা নেই। অনেক খোঁজ খবর করেও তাকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রহস্যের সমাধান হয়েছে অন্যভাবে। মেয়েটার স্বামী নাকি মাঝে একদিন এসেছিল রাত একটার দিকে। সি সি ক্যামেরাতে দেখা গেছে একটা লোক ভূতের মুখোশ পরে রাত একটার দিকে এই বাসার তালা খুলছে। লোকটার মুখ দেখা যায়নি, কিন্তু পোশাক যেটা পরে ছিল, সেটা তার স্বামীর পোশাক ছিল। কিভাবে যেন সি সি ক্যামেরাটা নষ্ট হয়েছিল। ঠিক করার পরে এটুকুই শুধু দেখা গেছে। এরপর আর কোন রেকর্ড নেই। স্বামীকে পরে আটক করা হয়েছিল। কিন্তু যথেষ্ট প্রমানের অভাবে ব্যাপারটা আজও বিচারাধীন। তারপর থেকেই নাকি কোন কোন গভীর রাতে মেয়েটাকে দেখা যায় এই বাড়িটার আশেপাশে।
- আবির, তুমি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছো। প্লিজ , এই ব্যাপারটা নিয়ে মজা করবে না।
আবির কিছু বললো না। শুধু চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোট কামড়ালো।
আজ আবার আবিরের নাইট। সন্ধ্যা থেকেই খুব ভয় করছে। দারোয়ান চাচাও আজ দুইদিন হলো ছুটিতে। ঠিক হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব আমরা বাসা শিফট করবো। আমি একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম আসছে না। আজ হঠাৎ রাত বারোটাতেই কুকুরগুলো ডাকতে শুরু করলো। আমি খুবই অবাক হলাম। কুকুরগুলো প্রতিদিন একই সময়ে ডাকে। আজ আগে আগে কেন ডাকছে ? নিজেকে বোঝালাম, সবই আমার কল্পনা। আমার ভূতের ভয় দেখে আবিরও আমার সাথে মজা করেছে। আমি নিজের কাছে প্রমাণ করতে চাইলাম, আমি ভীতু নই। কাঁচের দরজাটা ঠেলে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালাম। কুকুরগুলো কিছুতেই থামছে না। আমি দৃঢ়ভাবে কবরস্থানটার দিকে তাকিয়ে আছি। আজ আমি কিছুতেই ভয় পাবো না। হঠাৎ করেই ঘাড়ের পিছনে কারো নিশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ পেলাম। পিছন ফিরেই জমে গেলাম আমি। সেই মেয়েটা ! আমাকেও লোকে সুন্দরী বলে কিন্তু এর রূপের কাছে আমার চেহারা কিছুই নয়। কিন্তু আমি তখন অনর্গল নিজেকে বলছি, " এটা আমার কল্পনা, এটা আমার কল্পনা। " আমি নড়তে পারছিলাম না। দুইটা পায়ের ওজন মনে হয়, কয়েক মন হয়ে গেছে। বহু কষ্টে ঘরে ঢুকে কাচের দরজার লক লাগিয়ে দিলাম। মেয়েটা তখনও বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। কি যেন বলার চেষ্টা করছে, আমি শুনতে পারছি না। কাঁচের দরজায় নক করছে। আমি প্রানপনে চোখ বন্ধ করে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, ' এটা সত্যি নয়, সব আমার কল্পনা। ' কিছুক্ষণ পরেই কুকুরগুলোর ডাক থেমে গেল। আমি চোখ খুলে দেখি, মেয়েটা নেই। বুঝতে পারলাম, সবই আমার কল্পনা।
পানি খাওয়ার জন্য ডাইনিং স্পেসে আসলাম। এখন অনেকটাই স্বাভাবিক লাগছে। পানি খেয়ে বেডরুমে ঢুকতে যাবো। এমন সময় মেইন দরজায় শব্দ হলো। আমি পা টিপে টিপে দরজার কাছে গেলাম। লুকিং গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে দেখি, আবির! কিন্তু মুখে ভূতের মুখোশ পরেছে। এই দরজাটায় কোন সিটকিনি নেই। দুইটা লক আছে। এর চাবি শুধু আমার আর আবিরের কাছে আছে। আবির একটা লক খুলেছে আর একটা খোলার চেষ্টা করছে। আমার মাথায় কি হলো জানি না। দরজার সাথেই যে বড় সু রেকটা আছে সেটা ঠেলে দরজার সাথে লাগিয়ে দিলাম। আবির এবার দরজা নক করছে। বললাম, " আবির তুমি আমার সাথে মজা করছো কেন? তুমি ভালো করেই জানো আমি ভয় পাই। " আবির কোন কথা না বলে দরজা নক করতে থাকলো। আমি লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখলাম, এখনও মুখোশটা পরে আছে।
হঠাৎ ই আবিরের হাতের দিকে নজর গেলো। আরে এই হাতে তো একটা উল্কি আঁকা দেখতে পাচ্ছি। আবিরের হাতে তো এমন উল্কি ছিল না। কিন্তু এই উল্কিটা আমি আরো কোথাও দেখেছি। মনে পড়েছে ; একটু আগে যখন মেয়েটা কাঁচের দরজা নক করছিল, তখন মেয়েটার হাতে এটা দেখেছি। কিন্তু মন বলছে, আরো কারো হাতে আমি এটা দেখেছি। মেয়েটা সম্ভবত আমাকে এটাই দেখানোর চেষ্টা করছিল। এ আবির নয়। অন্য কেউ। হঠাৎ ই মাথায় খেলে গেল, বাড়িওয়ালা চাচার হাতে এমন উল্কি আছে। নিশ্চিতভাবে ওনার কাছেও চাবির আরও একটা কপি আছে। ততক্ষণে উনি দরজা ঠেলা আরম্ভ করেছেন। চোখের সামনে নিজের মৃত্যু দেখতে পাচ্ছি। বুঝতে পারছি, মেয়েটাও এমনই বিপদে পড়েছিল।
দরজাটা খুলে যাচ্ছে। আমি জ্ঞান হারাতে শুরু করেছি। হঠাৎ করেই আমার পাশে মেয়েটাকে দেখতে পেলাম। জ্ঞান হারানোর আগে শুধু মনে হলো, মেয়েটা আজ আমাকে মরতে দেবে না।
( সমাপ্ত )
©️
লেখাঃ সুমনা তানু