26/12/2017
মনোযোগ দিয়ে কথা শোনার অভ্যাস সুস্থ ও জনপ্রিয় মানুষের বৈশিষ্ট্য
শুক্রবার, ৯ জানুয়ারি ২০১৫
সফল ও জনপ্রিয় ব্যক্তিরা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনার দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। এটি একটি সাধনা, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং গভীর ধৈর্যের বিষয়। কারো কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা মানে হলো- তাকে দাম দেয়া, মর্যাদা দেয়া, সম্মান দেখানো। ঠিক তেমনই অন্যের কথা না শোনা মানে তাকে গুরুত্ব না দেয়া, মর্যাদা ও সম্মান না দেখানো, বা মূর্খ মনে করা।
মানুষ সব চাইতে বেশি খুশি হয় যখন সে তার মনের কথা অন্যের কাছে খুলে বলতে পারে এবং মানুষ তার প্রতি খুশি হয় যে তার কথা শোনে। সম্পর্ক দৃঢ় হয়, মধুর হয়, দীর্ঘস্থায়ী হয় কথা বলার ওপরে নয়, কথা শোনার ওপরে। কথা শোনার অভ্যাস জনপ্রিয়তার একটি ভিত্তি। সেই বড় নেগোসিয়েটর বা সমঝোতাকারী, বড় ক‚টনীতিক এবং বড় নেতা যে কথা বলার চাইতে শোনার ওপরে গুরুত্ব দেয়। সঠিক এবং ভালো সিদ্ধান্ত তিনিই দিতে পারেন যিনি ওই বিষয় সম্পর্কে সব দিকগুলো গভীরভাবে শুনেছেন এবং বুঝেছেন। শুধু শ্রবণ করলেই হবে না লিসিনিং করতে হবে। অর্থাৎ হিয়ারিং, লিসিনিং, আনডারস্ট্যানডিং, কান দিয়ে শ্রবণ করা, মন দিয়ে শোনা এবং বোঝা। পৃথিবীর অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান হয়েছে শুধুমাত্র পরস্পরকে শ্রদ্ধা, সম্মান এবং গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে এবং এর মূলসূত্র হলো অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা।
আপনি কি একটি বিষয় খেয়াল করেছেন? তা হলো আমরা কথা সুন্দরভাবে বলার জন্য, সঠিক উচ্চারণের জন্য, ভালো বক্তা হওয়ার জন্য, সেরা উপস্থাপক হওয়ার জন্য কতই না প্রশিক্ষণ, কতই না শিক্ষা গ্রহণ করছি। কিন্তু কথা শোনার কৌশল, কথা শোনার পদ্ধতি, কথা মনোযোগ দিয়ে শুনার ইচ্ছা তৈরি করার উপায় কি? এর ওপর আমরা কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিয়েছি কি? কথা গুছিয়ে বলার জন্য, অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য, কথার মাধ্যমে অন্যের কাছে আকর্ষণীয় হওয়ার জন্য, নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য আমরা প্রশিক্ষণে অর্থ ব্যয় করছি। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন হলো কথা শোনা এবং তা রপ্ত করার সহজ উপায় সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা। কথা বলার কৌশল শিখছি কিন্তু কথা শোনার কৌশল শিখছি না। অথচ বিষয়টি ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আপনি তত ভালো বলতে পারবেন যত ভালো শুনতে শিখবেন। কোনো সমস্যার ৫০ ভাগ সমাধান রয়েছে সমস্যাটি চিহ্নিতকরণের ওপর। সমস্যা খুঁজে বের করা এবং সমাধানের গভীর থেকে গভীরে যাওয়া সম্ভব যত গভীরভাবে কথা শোনার অভ্যাস করা যায়। পৃথিবীতে তারাই সফল এবং জনপ্রিয় যারা মানুষকে যত বেশি বুঝেছিলেন। গভীরভাবে কথা শোনার মধ্যেই তা অর্জন করেছিলেন।
কথা শুনতে হবে জ্ঞান অর্জনের জন্য, উপলব্ধি করার জন্য, সমাধানের জন্য, বক্তাকে মর্যাদা দেয়ার জন্য। আমরা অধিকাংশরা অন্যের কথা শুনি মানার জন্য নয় তাকে আটকানোর জন্য, তার কথাটি গুরুত্বহীন সেটা প্রমাণের জন্য। কারো কথা শুনতে থাকি আর ভাবতে থাকি এর উত্তর কি দিব। কিভাবে নিজের কথাটা ঠিক প্রমাণ করব ইত্যাদি। ফলে নিজের দর্শন বা বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মাথায় পরিকল্পনা করতে থাকি। ফলে অন্যকে কথা বলতে দিতে চাই না, শুনতেও চাই না এবং অন্যের কথার মধ্যে বাধা সৃষ্টি করে নিজের কথা বলার চেষ্টা করি। অন্যের বক্তব্য শেষ করতে না দিয়ে নিজের বক্তব্যকে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করি।এটি এক প্রকার অস্থিরতা এবং মানসিক অসুস্থতা। এই অধৈর্য এবং ইগোস্টিক এটিচিউড কোনোভাবেই সমস্যার সমাধানের জন্য যথার্থ নয়। এতে আলোচনা হয় না, হয় তর্ক। জ্ঞানীরা কখনই তর্ক করেন না, উত্তেজিত হন না। এতে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় না। সম্পর্ক সুন্দর থাকে না। কথা শুনতে হবে শোনার ভান করার জন্য নয়, তার কথাকে না মানার জন্য নয়, শুনতে হবে গুরুত্ব বোঝার জন্য এবং যুক্তিসঙ্গত হলে তা মেনে নেয়ার মানসিকতা থাকা। একজন ভালো শ্রোতা, গুড লিসিনর হওয়ার জন্য প্রয়োজন কথা শোনার চর্চা করা। কথা শোনার ইচ্ছা জাগ্রত করা। বক্তার প্রতিটি শব্দ প্রতিটি বাক্য হিয়ারিং এবং লিসিনিং করা এবং সম্পূর্ণ কথা শোনার পর নিজের বক্তব্য গুছিয়ে নিয়ে পিনপয়েন্ট লক্ষ্য বস্তুতে উপস্থাপন করা।
আপনার হয়তো বক্তার কথার পিঠে অনেক উত্তরই মনে এসে যাবে। বলতে ইচ্ছে করবে কিন্তু আপনি মনে মনে নিজেকে বলবেন ‘থামো’। আপনার কষ্ট হবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। তবুও মনকে বলুন ঈড়হঃৎড়ষ,
কোনো ব্যক্তি যখন কথা বলেন তখন তিনি তার বিশ্বাস ও তার লজিক দিয়েই কথা বলেন। কারণ মানুষ যাই বলুক সত্য বা অসত্য তার পেছনে কারণ থাকে যুক্তি থাকে। যুক্তি বা কারণ ছাড়া কেউ কোনো কাজ করে না, বলে না। সুতরাং তাকে স্বমতে বা আপনার দর্শনে নিয়ে আসা কঠিন কাজ। তর্কে তার সমাধান নেই। যখন কেউ যুক্তি এবং প্রমাণ মানবে না তখন বুদ্ধিমানের কাজ হলো কথা না বাড়ানো। কারণ সে তার লালিত দর্শন বা বিশ্বাসের ভিত্তি থেকে সরে আসবে না।
চুপ থাকার অনেক অর্থ আছে, জ্ঞান তত্ত্ব আছে। চুপ থাকলে অনেক অর্থ বোঝা যায়। কিন্তু বলে ফেললে শুধু ওইটাই বোঝা যায়। মনোযোগ দিয়ে কথা শোনার অভ্যাস মানসিক সুস্থতার ইঙ্গিত বহন করে। মনোযোগ দিয়ে কারো কথা শুনছেন মানে তাকে গুরুত্ব ও সম্মান দিচ্ছেন। চোখ, কান, মন সব ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে অন্যের বক্তব্যকে উপলব্ধি তিনিই করতে পারেন যিনি উচ্চমাত্রার সচেতনতা বোধ, বিচার বিবেচনা বোধ নিজের ভেতর সৃষ্টি করতে পেরেছেন এবং তা আদর্শ পর্যায়ে রাখতে সক্ষম। বর্তমান বিশ্বের জনপ্রিয় বক্তা ও মটিভেটর যুক্তরাষ্ট্রের জল অস্টিন বলেন, ‘আমি কোনো একটি ঘটনা (চুটকি) শতবারের বেশি শুনেছি এবং প্রতিবারেই শুনার সময় এমন একটি ভাব দেখিয়েছি যেন ঘটনাটি এই প্রথম শুনলাম।’ কারো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে যদি কোটি টাকার আনন্দ ও শান্তি দেয়া যায় তবে এই শান্তি আপনি বিনা পয়সায় দেবেন না কেন! অন্যকে শান্তি দিলে নিজেও শান্তি পাওয়া যায়। সুস্থ, নিরোগ ও আনন্দময় জীবনের জন্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
বন্দুকের গুলি যদি কারো শরীরে বা হৃদয়ে আঘাত করে সেই গুলি সার্জারি করে বের করা যায়। এন্টিবায়োটিক দিয়ে ঘা শুকানো যায়, পেনকিলার দিয়ে কষ্ট দূর করা যায়, কিন্তু কথার গুলি যদি কারো মনে বা হৃদয়ে আঘাত করে তবে তা কোনো সার্জারি করে বা এন্টিবায়েটিক দিয়ে বা পেনকিলার দিয়ে ব্যথা দূর করা যায় না। কথার গুলির ব্যথা সারাজীবনই থাকে। বন্দুকের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় কিন্তু কথার গুলি হৃদয়ে লাগবেই। আর তাই সফল ও জনপ্রিয় মানুষ বুঝেশুনে কথা বলেন। যখন তারা কোনো কথা বলেন, তখন সেটি কথা না হয়ে, হয়ে যায় বাণীর মত।
মনোযোগ দিয়ে কথা শোনা শ্রেষ্ঠ মানুষের একটি বড় গুণ। এই গুণটিকে বিকাশ ঘটিয়ে আমরা সুস্থ, সফল এবং জনপ্রিয় মানুষে পরিণত হতে পারি