অন্য-পুরুষের গল্প

অন্য-পুরুষের গল্প সমাজের সেইসব মানুষগুলির জন্য, যারা অন্যসব মানুষের মতই, তবে তথাকথিত কিছু মানুষ তাদের অন্য চোখে দেখে..!
(3)

||প্রেম এবং কাকতাড়ুয়া||  (দ্য ভিনটেজ টেইল)   ২য় মৌসুম/১ম পর্ব-- আব্দুল্লাহ নূর রবি_____________________১. জোনাকির গান বু...
07/11/2024

||প্রেম এবং কাকতাড়ুয়া||
(দ্য ভিনটেজ টেইল)
২য় মৌসুম/১ম পর্ব
-- আব্দুল্লাহ নূর রবি
_____________________

১. জোনাকির গান বুঝি থামলো,
চাঁদ নিজে লুকালো আড়ালে।
শিশিরে স্নান করে ভোর হয়,
তুমি এসে দুটি হাত বাড়ালে।
আগুনের দিন, শেষ হবে একদিন।
ঝর্ণার সাথে গান হবে একদিন।
এ পৃথিবী ছেড়ে চলো যাই,
স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে সীমাহীন।....

লালুদের গ্রামে সত্যিই যেন আগুনের দিন শেষ হয়ে এবার নতুন করে ঝর্ণার গান শুরু হয়ে গেছে। গ্রামটার পরিবেশে বিশেষ কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি যদিও, এখনও তার আঁচল ঘেঁষে বয়ে চলে ইছামতি নদী, এখনও সন্ধ্যায় সে শিতানে হরিতালয় পর্বতখানা বিছিয়ে নিয়ে ঘুমাতে যায়, তবে কি এক বিচিত্র কারণে যেন নব্য নব্য লাগে আজকের এই গ্রামখানাকে। এরই মাঝে সময় চলে গেছে অনেকটা। অনেকটা বলতে বেশ অনেকটাই, লালুর কাছে এই দুইটি মাস যেন পৃথিবীর দীর্ঘতম দিবস বলেই মনে হয়েছে। কেননা, সে আচমকা প্রেমে পড়তে শুরু করেছিলো তখন। কি জানি কার প্রেমে, সে তখনও শনাক্ত করতে পারেনি তার অধিক তর হৃদকম্পনের উৎস। কেন জানি তার হঠাৎ হঠাৎ -ই শ্বাসের গতি তীব্র হয়ে যেতো কারো প্রাক্কালের আগমনে। তবুও সে কেন জানি আনমনে নিজের এই অনুভূতি স্বীকারে সচেষ্ট ছিলো না। কিন্তু অনুভূতি কি আর পাটের দড়ি দিয়ে বেধে রাখা যায়? উপচে পড়া গরম দুধের মতো তার অনুভূতিও তাই ক্রমেই ফুলে ফেঁপে ওঠতে লাগলো। যখনই সকাল কিংবা সন্ধ্যায় অথবা মধ্যাহ্নে সাইকেলের চাকার ঘূর্ণনের সরাৎ সরাৎ শব্দ হতো, ঝনঝন করে বেজে উঠতো সাইকেলের সাইরেন, ওমনি তার পা দুটো হৃদয়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছুটে চলতো পালানের দিকে। জলপাইয়ের মতো চোখগুলো তার অবাক হয়ে চেয়ে থাকতো কাছা দিয়ে লুঙ্গি পড়া গলুর বাদামি লালচে বর্ণের সুগঠিত শরীরের পানে। কনকনে গলায় ঝংকার তুলে গলু যখন বলতো,

-- কিরে, ভোদাই !! দাড়াইয়াই থাকবি, নাকি যাবি আমার লগে?? তোর চুতমারানি বাপে আর কালগুক্কই বোইনে দেখলে তো আবার আঁশ বটি নিয়া দৌড়ানি দিবো নে। আয় হাদারাম, পিছে আইসা বয়। আজকে যামু আঁখ চুরি করতে, ওগো কাওরে কই নাই। তুই আর আমিই, মজা হয়বানে....

লালু তখনও হাবার মতো চেয়ে থাকে গলুর মুখপানে, যতক্ষণ না তার হাতের তাল এসে পড়ে তার পদ্ম কোমল পিষ্ঠে। গলুর মুখঝামটা খেয়ে লালু তখন গিয়ে বসে পড়ে গলুর ঝনঝনাঝন লোহার গাড়ির পিছনে। তখনও যেন তার আপত্তি থাকে গলুর কোমড়ে হাত খানা দিয়ে অক্টেপাশের মতো পেচিয়ে ধরতে, যতক্ষণ না গলু পুনরায় গাল দিয়ে বলে, কিরে!! আমি কি তোর ভাসুর লাগি যে দূরে সইরা বসবি। হালার পো, হাত দে, দুই হাত দিয়া পেঁচাইয়া ধর আমারে। যে আচুদা রাস্তা ঘাট, ধইরা না বসলে পইড়া যাবি। আর আমার কাছের কিয়ের লজ্জা তোর। জানোস না আমি তোর কি লাগি?? বলতো, আমি কি লাগি তোর?? বল, শুনি!!..

গলু অধীর আগ্রহে পিছনপানে মুখ ফিরিয়ে থাকে লালুর জবাবের প্রতীক্ষায়। লালুর মনে তখন রসিকতা করার সাধ জাগে। মুখ ভেঙ্চি কেটে সে বলে, তুই আমার কি লাগোস শুনবি?? তুই হয়লি, আমার জা....

--- জা...???

--- তুই হয়লি আমার জা, জা, জাফর ভাইয়ের বন্ধু লাগিস...।।

গলু লালুর মুখ চেপে ধরে বলে, কি কয়লি তুই। কুত্তার বাচ্চা, আবার ক....

লালু তখন স্বর নরম করে বলে, তুই আমার জামাই লাগোস। হয়ছে, এবার খুশি চল!!

-- না,, শুনতেই তো পায়লাম না। আরও জোরে ক, কি কয়লি??

লালু তখন চিৎকার গলুর কানের গোড়ে গিয়ে বলে, তুই আমার পাঠা লাগোস, পাঠার ঘরের পাঠা, আর আমি তোর পাঠী!! হয়ছে?? চল, এইবার, আব্বায় চইলা আইবো....

গলু মুচকি হেসে সাইকেলের প্যাডেলে পা চাপিয়ে ঘোড়ার শক্তিতে ঘূর্ণন দিয়ে এগিয়ে চলে আকা বাঁকা কাঁচামাটির পথ ঘাট পেরিয়ে কি জানি কোন অচিনপুরের দেশে। আমরা আমাদের চেনশোনা প্রায় গল্পেই দেখি নায়িকার সান্নিধ্যে নায়ক ভালো হয়ে ওঠার চিরাচরিত গল্প, তবে আমাদের এ গল্পে ওল্টো কাহিনী ঘটেছে। লালু আগে ভালো ছিলো, তবে গলুর খপ্পরে পড়ে আজ লালুও বখে গেছে বেশ অনেকটাই। সেও এখন রীতিমতো দৈনিক গলুর সাথে দিগবিদিক চরে বেড়ায়, এর ওর গাছ থেকে ক্ষেত থেকে এটা ওটা চুরি করে খায়, বিড়ি খায়, নেশা করে, পড়ালেখায় ঠিক মতো মনোযোগ দেয় না। আর এই নিয়ে খুব বেশিই চিন্তিত এ গায়ের নব্যাগত ইঞ্জিয়ার মিস্টার শোবেল।

আপাতত সে কয়েকদিনের জন্য তার তাবুতে গিয়ে থাকে, রাতদিন কাজ করে বেড়ায়, তবে যখনই সে অবকাশ পায় ওমনি ছুটে আসে লালুর সাথে দেখা করতে। তবে তার দেখা পাওয়া যেন ডুমুরের ফুল
দেখা পাওয়ার মতোই দূর্লভ হয়ে উঠেছে ইদানিং। মর্মাহত হয়ে তখন মিস্টার শোবেল লালুর বাবা মাস্টার সাহেবের সাথে এই ব্যাপারে আলোচনা সভার আয়োজন করে। খানিকটা ভগ্নপ্রায়, খানিকটা আশাহত, কিছুটা বিমর্ষ এবং ক্রোধিত গলায় সে তখন মাস্টারসাহেবকে বলে, স্যার। লালুর বিষয়টা আমার মোটেও সুবিধার ঠেকছে না। চেয়ারম্যানের ভাই গোলাপ শাহ যে কোন ধরনের ছেলে সেটা এই হোল গায়ের সবাই জানে, আর সেই ছেলেটির সাথেই লালু সারাটাদিন টইটই করে এধারছে ওধার ঘুরে বেড়ায়। আমি শুনেছি, সে নাকি নেশাপানিও ধরেছে। রাতে ঘুমুতে গিয়ে আমি ওর গায়ে থেকে বিড়ির গন্ধও পেয়েছি বহুবার। ও পড়ালেখায় আর আগের মতো মন দেয় না, আমার সাথে ঠিকমতন কথাও বলে না একটি। স্যার, এবার আপনিই বলুন ওর আচার ব্যবহার কি আপনার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়? আর ওই গোলাপের সাথে ওকে ঘুরতে দেওয়াটা কি উচিত?

মাস্টারসাহেবের চুল অনেকটাই পাকিয়ে গেছে। মাথা ভরা সেই সাদা চুলের ঝাঁকিরাশি নিয়ে সে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কিছুক্ষণ গভীর চিন্তার পরে জবাব দেয়, আমি আর কি বলুম বাবা?? তোমরাই দেহো, তোমরাই কও। ওই জাওড়া পোলাডায় পুরাই খাইয়া দিছে আমার বেডারে। আমার কথাও ওই আর হুনতে চায় না। এহন ওর সব দায় দায়িত্ব আমি তোমার ওপর আর ললিতার ওপর ছাইড়া দিলাম। তোমরা যেডা ভালো মনে করো সেডাই করো। দরকার হয়লে ধইরা জিগা গাছের ডালা দিয়া ওর গায়ের চামড়া তুইলা দিবা, তাও দেহো যদি পোলাডারে আবার ঠিকঠাক করতে পারো।

মাস্টারসাহেবের কথায় শোবেল কিছুটা আশ্বাস পায়। তবে ললিতা বিরূপ মুখভঙ্গি করে বলে, হেয় ক্যান আমার ভাইরে মারবো? হের কি অধিকার আছে? ওই আমার ভাই, আমার রক্ত। দরকার হয়লে ওরে পিটায়া বিছায়া ফেলবাম। তয় হেয় জানি আমার লালুর গায়ে হাত না তুলে।

শোবেল ক্লান্ত মুখে বলে, আচ্ছা আচ্ছা। আপনি ভয় পাবেন না, অস্থির হবেন না। আমি আপনার ভাইকে কিছুই বলবো না। তবে আপনি তো তাকে কিছু বলতেই পারেন। শাসন করতেই পারেন। তার উপর তো আপনার পূর্ণ অধিকার আছে। একটু ভালো করে চিন্তা করে তারপর দেখুন, কি করে তাকে আবার সেই নিরীহ লালু বানানো যায়।

ললিতা খানিকটা গর্জিত কন্ঠে জবাব দেয়, ওইডা নিয়া আপনেরে এত চিন্তা করুন লাগতো না। আমার ভাই আমি বুইঝা লইবাম। আর হো, আরও একটা কথা। আপনের তো এখন থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হইয়াই গেছে। আপনের আর তো আমাগো বাড়ি না আসলেও চলে। হুদাই এতদূর কষ্ট কইরা হাইটা আইসা উড়াপাখির মতো পরের সংসারে নাক গলায়বার কি দরকার আছে???

মিস্টার শোবেল হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে ললিতার মুখপানে, আর মনে মনে ভাবে, ও আমার ওপর এত রেগে আছে কেন? আমি ওর কি করলাম আবার??
________________

২. এদিকে কুটু মিয়া লঞ্চের ডিকিতে বসে বসে হাজার হাজার নতুন নতুন খাবারের পদ আবিষ্কার করে ফেলেছে। সেই খুশিতে চেয়ারম্যান সাহেবও গদগদ হয়ে কুটুকে " বিজ্ঞানী কুটুশচন্দ্র বসু" উপাধি দিয়েও ফেলেছেন। এই গতকালই তো কুটু মিয়া কোত্থেকে চিংড়ির মতো কষা করে কাঁকড়ার মালাইকারি রেঁধে নিয়ে আসলো। তাতে স্বাদ বাড়ানোর জন্য দিলো এক ছিপি কেওড়ার জল, গোলাপ জল, চন্দনের গুঁড়া, মিঠা আতর, লেবুর রস, ভিনেগার, আঙুরের রস, আর এক চামচ দিলো চেয়ারম্যানের বোতল থেকে চুরি করা সাদা জল। টমেটো কুচি কুচি করে কেটে সিদ্ধ করে পেস্ট বানিয়ে সেটা দিতেও ভুল করলো না। সবশেষে দিলো জিরের ফাঁকি। তখন তার গন্ধে পুরো স্টিমার মাখোমাখো হয়ে উঠলো। চেয়ারম্যান সাহেবেরও আগে ছুটে এলো স্টিমারের অন্যান্য কর্মচারীগণ। সবাই অতি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো আজকের বিশেষ পদ কি? তখন কুটু মিয়া তাদের সম্মুখে তুলে ধরলো তার নতুন আবিষ্কৃত আরও একটি পদ জলকচু ফুলের বড়া। কোনো এক ফাঁকে নদীতে নাইতে নেমে সে কচুরিপানা হতে তুলে এনেছিলো ময়ূরপেখমের নকশাখচিত বেশ কিছু ফুল। তারপর এনে তাতে লবণ দিয়ে ভালোকরে খেঁচে নিয়ে তারপর তাতে দিলো এক বাটি বেসনের ফাকি, কয়েক চামচ মশলার গুড়া, কয়েক চিমটি নুন, গোল মরিচ কালোজিরা আর তারপর সেগুলোকে ডুবু ডুবু গরম তেলে ভেজে উঠিয়ে খবরের কাগজের উপর জুরাতে দিয়েছিলো।

সবাই আশা করেছিলো মাংস জাতীয় কিছু একটা রাধা হয়েছে। তবে জলকচুর বড়া দেখে একেকজন নাক ছিটকাতে লাগলো। তারপর মুহুর্তেই স্থান খালি করে চলে গেলো। তবে চেয়ারম্যান সাহেব যখন তাদের এই রকম অসভ্যতার কথা শুনেছেন ওমনি সবাইকে ডেকে নিয়ে লাইন করে বসিয়ে জলকচুর বড়া দিয়ে ভাত খেতে দিয়েছেন। যদিও প্রথমে সবাই অনিচ্ছাতেই খেতে বসেছিলো, তবে একটা বড়া মুখে নিতেই সবার মুখ উজ্জল হয়ে উঠলো। তারপর যেন প্রতিযোগিতা করে করে তারা বড়া খেয়ে শেষ করতে লাগলো। কটু তখন চিন্তায় পড়লো, চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য পরে কিছু থাকে কি না কে জানে। তাই সে কাঁকড়া মালাইকারির পাশেই কয়েকটা বড়াও তুলে রাখলো। আর সেই কারি হতে কিছুটা ঝুল এনে একেক করে সবার পাতে ছুইয়ে দিয়ে বললো, লও খাও সবাই। আইজ ভালো মন্দ রান্দনের কিছু ছিলো না। তাই বড়া করছি। আর চেয়ারম্যান সাহেবের জন্যে একটু কাঁকড়ার কারী রাধছিলাম। ওইদিন নাইতে গিয়া দুইটা কাঁকড়াও ধরছিলাম দানবের মতো। খাইয়া দেহো কেমন ট্যাস।

নতুন রেসিপির নাম শুনে সবাই আরও একবার বিমর্ষ মুখে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে শেষে পাতে হাত দিয়ে সংকোচপূর্ণ ভাবে খাবার মুখে নিলো। ঠিক তেমনই মুখে যেন তাদের আরও একবার স্বাদের বিস্ফোরণ ঘটলো। ওমনি তারা চেয়ারম্যান সাহেবকে ডেকে বললেন,

সাহেব। এই কুটু মিয়ারে আপনি আমাগো পক্ষ হয়তে কিছু একটা উপহার দিয়া দ্যান, বেতন পায়লে আমরা শোধ কইরা দিমু। তাজমহল বানায়বার পর শাহজাহান যেমন কারিগরদের হাত কেটে দিইচিলো, আইজ আমাগো মনে হয়তাছে কুটু মিয়ার হাতও আমরা কাইটা সাথে কইরা লইয়া যাই। ওই মানুষ না সাহেব, সাক্ষাৎ ওই হিন্দু গো দেবী অন্নপূর্ণা। কি যে স্বাদের রান্দা আজকে রাঁধছে। ওরে আপনি কিছু দ্যান...

চেয়ারম্যান সাহেবের মুখটা রঙিন হয়ে ওঠলো। তিনি কটুর দিকে চেয়ে তার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলেন। তারপর নিজের হাতের একটা লাল রত্নের আংটি খুলে কুটুর আঙুলে পড়িয়ে দিয়ে আলতো আদর দিয়ে বললেন, এমন সুন্দর সুন্দর হাতগুলা তোমরা কাইটা দিতে চাও!! এমন হাত কাটুন লাগে না, সোনা দিয়া বান্ধাইয়া দেওন লাগে। বুঝলা মিয়ারা? এহন যাও তোমরা, তোমাগো বেতন হয়তে আর কিছু দিওন লাগবো না। এহন আমার খায়বার টাইম। কুটু আহো, আমার খায়বার নিয়া আহো।।

চেয়ারম্যান সাহেবের কামড়ায় খাবার নিয়ে পরিবেশন করার পর কুটু শুধু তার হাতখানা দেখতে লাগলো। এমন দামী একটা আংটি তার হাতে ঠিক মানায়তাছে না। কেমন বাদুড়ের গলায় মুক্তার মালার মতো মনে হচ্ছে। এই নিয়ে বরং কিছু কথা বলা দরকার বলে তার মনে হলো।

সাহেব!! এই আংটিডা আপনে ফিরায়া নেন। আপনের হাতেই এইডা ভালো মানায়তো। আমার হাতে মনে হয়তাছে উলুবনে মুক্তার মতো। আমি এমনিতেই খুশি।
আইচ্ছা আপনের আর কিছু লাগতো? কাঁকড়ার মালাই কারীডা কেমন হয়ছে??

চেয়ারম্যান সাহেব একটু তম্বি খেলেন৷ ঢুক গিলে বললেন, এটা কাঁকড়ার মালাইকারি??

কুটু মাথা নাড়লো। আরও বললো, হো। আর এইডা কচু ফুলের বড়া। খাইয়া দেহেন ভালোই লাগে।

চেয়ারম্যান সাহেব খকখক করে হেসে হেসে বললেন, ওরে খোদা। তোমার মাথায় এত বুদ্ধি। নতুন নতুন আবিষ্কার করো দেহি তুমি রোজরোজ। আইজ হয়তে তেমার নাম হইলো গিয়া কুটুসচন্দ্র বসু। জগদীশ চন্দ্র বসুর ছোট ভাই তুমি। হা হা হা.....

_______________

৩. চারিদিকে সমতলে ছেয়ে আছে শ্যামল মসৃণ গোচারণভূমি। জৈব পুষ্টিতে সমৃদ্ধ অঞ্চল বলেই এত সবুজ আর সবুজ চারিধারে। তার উপর যখন হরিতালয় থেকে ঢেউ বয়ে আসে তখন যেন একে সবুজের সমুদ্দুর বলে মনে হয়। আর এই সবুজ সমুদ্রেই এসে ডুব লাগালো লালু আর গোলাপ শাহ। ঝনঝনা সাইকেলটার মৃতদেহটাকে এক পাশে ফেলে দিয়ে সবুজ ঘাসের গা এলিয়ে শুয়ে আছে লালু। তার পাশেই দুটা বিশাল বিশাল মিষ্টি রসালো আখের লাঠি। গোলাপ শাহ একটা ছোট খন্ড ছিলে চিপড়ে চিপড়ে রস বের করে লালুর গালে ঢালছে। আর একটু পরপরই আনমনে কি জানি কি ভেবে মাছরাঙা পাখির মতো ঠোঁকর দিচ্ছে লালুর ঠোঁটে। লালু কি বলবে এই পাগলটাকে বুঝতে পারছে না কিছু। তবে তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। তাদের থেকে একটু দূরেই ক্ষেতের মাঝে একটা বাঁশের মাথায় কুমড়া দিয়ে তার গায়ে শার্ট পড়িয়ে কে যেন একটা কাকতাড়ুয়া দাড় করিয়ে গেছে। চোখমুখোও আকা হয়েছে আবার তাতে। লালু গোলাপ শাহকে হঠাৎ বলে ওঠলো, আপনে মাইনষের সামনে এসব করতাছেন, লইজ্জা করে না আপনের??

গোলাপ শাহ অবাক হয়ে বললো, মানুষ। আবার মানুষ পায়লি কই?

লালু তখন ওই কাকতাড়ুয়া দেখিয়ে বললো, ওই তো ওই কুমড়ামানবটা।

গোলাপ তখন রাগী মুখে ওঠে দাড়িয়ে হনহন করে এগিয়ে গেলো ওটার দিকে। তারপর গিয়ে পাগলের মতো ওই মূর্তির সামনে বকবক করতে লাগলো, কিরে?? হেনে দাড়ায় দাড়ায় কি দেখছোস তুই? ওরে চিনোস কেরা? ওর নাম লালু, আমার একমাত্র বউ। আর আমার বউরে আমি চুমা দেই না, উপ্তা কইরা চু** তাতে তোর কি সমস্যারে মাঙের নাতি? যাহ, সর এহান থেকা। তোর জন্য আমার বউ লজ্জা পায়তাছে। চোখ সরা, উল্টো দিকে ঘোর।

গোলাপ শাহ কাকতাড়ুয়ার মাথায় বিশাল দুটো কলাপাতা দিয়ে ঢেকে দিয়ে আবারও লালুর কাছে এলো। বললো, এইবার দেখ। ওর চোখ আটকায় দিছি। এইবার তো বউ আর কেউ নাই, কুপি লিবায়া এহন চইলা আয় তোর সোয়ামীর কাছে।

বলেই গোলাপ শাহ ঝাঁপিয়ে পড়লো লালুর গায়ের উপর। হাতে হাত আটকে, ঠোঁটে ঠোঁট আটকে, চোখে চোখ আটকে যখন সে ঘাসখেতে প্রেমের খেলা খেলছিলো, তখন চারিপাশে তরতর করে ঝড়ও হাওয়া ভীষণ বেগে ছুটাছুটি করছিলো। সবুজের সমুদ্দুরে যেন সবুজ সুনামি শুরু হয়েছিলো তাতে। আর তাতে নড়ে নড়ে উঠচিলো এক পায়ে দাড়িয়ে থাকা কাকতাড়ুয়াটা ও। হঠাৎ করেই একটা ঝাপটা হাওয়ায় তার মাথায় দেওয়া কলাপাতার মুখোস খুলে গেলো। আর তার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে অর্ধ-উলঙ্গ দুজন যুবকের উন্মত্ততায়। আর তাই দেখে যেন তার চোখে মুখে একটা হাসির আভা আরও বিস্তারিতভাবে ফুটে ওঠলো।

______(চলবে)___

(গল্পটির পরবর্তী পর্ব পেতে কমপক্ষে ২৫টি শেয়ার, ৫০ টি মন্তব্য প্রযোজ্য🤭)

গল্প|| প্রণয়ী|| ৪র্থ পর্বলেখা- কিউপিড________________ফোনের রিংটা বেজে উঠলে প্রতিক্ষার কাঁচা ঘুম এক্কেবারে নষ্ট হয়ে যায়। ...
06/11/2024

গল্প|| প্রণয়ী||
৪র্থ পর্ব
লেখা- কিউপিড
________________

ফোনের রিংটা বেজে উঠলে প্রতিক্ষার কাঁচা ঘুম এক্কেবারে নষ্ট হয়ে যায়। শুরু হয় মাথার যন্ত্রণা। সারাদিন নিজের মানসিক স্থিতির সঙ্গে লড়াই করে একটু আরামে ঘুমাতে গিয়েও তার শান্তি হলো না। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে, মিতু কল করেছে। মিতুকে কয়টা কাঁচা গালাগাল দিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো প্রিয়া। সেই সাথে অবশ্য দুশ্চিন্তাও হচ্ছিলো এই ভেবে যে, মেয়েটা আবার বিপদে পড়লো কি না এই নিয়ে।

—“ হ্যালো।”

—“ হ্যালো আপু, আমি গেটের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি। একটু এসে গেটটা খুলে দাও না প্লিজ....”

—“ এতো রাতে!? তোমার না আজকে কোনো এক বান্ধবীর সাথে থাকার কথা ছিলো? আর.... রাতের ২:১৫ বাজে। তুমি এতো রাতে সেখান থেকে চলে আসলে? কোনো সমস্যায় পড়নি তো তুমি?”

—“ আপু আসলে... আমি নাইট ক্লাবে গিয়েছিলাম। তোমাকে আমি কথাটা বলতাম কিন্তু আন্টি সামনে ছিলো বলে বলতে পারিনি। আর আমার আসার কোনো প্ল্যান ছিলো না। হঠাৎ করে..... একজনের সাথে দেখা হয়... আর..... তাকেও... আমার সাথে.... নিয়ে এসেছি।"

—“ তাকে মানে কে? কোনো বান্ধবী?”

—“ আসলে....”

—“ আসলে কি? এক সেকেন্ড, তুমি সঙ্গে করে কোনো ছেলে আনোনি তো মিতু?

—“ আসলে... হ্যাঁ। আমার সঙ্গে একটা ছেলে আছে। লন্ডনে থাকে ও ওর ফ্যামিলিসহ। আজই লন্ডন থেকে এসেছিলো।”

—“ এতো কিছু কি আমি জানতে চেয়েছি মিতু? শোনো মিতু, আমি তোমাকে গেট খুলে দিচ্ছি। তুমি চুপচাপ তোমার ফ্ল্যাটে চলে যাও। কোনো প্রকার পুরুষ মানুষ তুমি বিল্ডিংয়ে ঢুকাতে পারবে না। যে এসেছে তাকে ফেরত যেতে বলো।

—“ আপু এমন করো না, প্লিজ... আপু...”

—“ তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে মিতু? যদি বিল্ডিংয়ের মানুষ জানতে পারে কোনোভাবে তাহলে তারা কি মনে করবে? তুমি আমার বাবাকে কি চিনো না, বাবা কিন্তু একেবারের জন্য তোমার এখানে আসা বন্ধ করে দিতে পারে।”

—“ আপু প্লিজ এমন করো না, এখন আপাতত একটু সাহায্য করে দাও। আমি আর কক্ষনো তোমাকে এভাবে বিরক্ত করবো না। প্লিজ আপু..... একটা বার শুধু।”

—“ মিতু, তুমি কি ভাবছো আমি আমার জন্য কথাগুলো বলছি? মিতু.... আমি তোমার ভালোর জন্য কথাগুলো বলছি তোমায়। কোথা থেকে কাকে না কাকে বাসায় এনে ঢোকাচ্ছো তুমি, যদি সে গুরুতরভাবে তোমার কোনো ক্ষতি করে দেয়, তখন?”

—“ আপু তুমি চিন্তা করো না। আমি কি এতোটাই বোকা নাকি? আমার আত্ম সুরক্ষার জন্য ব্যবস্থা আছে। তুমি শুধু প্লিজ আমাদের ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দাও প্লিজ....”

—“ সত্যি নিজের খেয়াল রাখতে পারবে তো তুমি?”

—“ হ্যাঁ, সেটা নিয়ে তুমি একদম চিন্তাই করো না। তুমি শুধু প্লিজ গেট টা খুলে দাও। প্লিজ.....”

—“ আচ্ছা, আমি আসছি। আজকে নেহাত দারোয়ান কাকা নেই বলে তুমি বেঁচে গেছো।”

—“ অনেক ধন্যবাদ তোমাকে আপু।”

বেশ বিরক্ত সহকারে প্রিয়া মাঝরাতের বেলার আলস্য ঝেড়ে উঠে চাবি হাতে চলে যায় বাসার মেইন গেটের দিকে। অন্যদিকে আদিত্য হলুদ বর্ণের স্ট্রিট লাইটের আলোতে এলাকার আশপাশটায় চোখ বুলিয়ে দেখছে। বেশ শান্ত সৃষ্ট একটা এলাকা। কোনো প্রকার শব্দ দূষণ কিছু নেই। আছে শুধু ছলমলে ঠান্ডা বাতাস, বৃষ্টিভেজা মাটির ঘ্রাণ আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ বাদে একরাশ নিস্তব্ধতা। এমন একটা জায়গা এবং এমন একটা সময়ে নিজের প্রিয় মানুষের সঙ্গে গল্প করে কাটানোর মধ্যে দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যাবে, সেটা মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ-উল্লাসকে হার মানাবে। আদিত্যের ধারণা সেটা। এমন সময় মিতু চুপিসারে আদিত্যের কানের কাছে এসে হালকা ফিসফিসিয়ে বলে—“ কি ভাবছো আদিত্য?” আদিত্য পিলে চমকে উঠে।

—“ ওহ..... তুমি তো আমাকে আচমকা ঝটকা দিলে দেখছি। আসলে তেমন কিছু না, আশপাশটা দেখছিলাম। কেমন একটা শান্ত সৃষ্ট এলাকা। দেখে খুব ভালো লাগছে।”

—“ হুমম..... আসলে আমাদের এই ১৫ নম্বর সেক্টর এলাকাটা এমনি। একদম নিরব-নিস্তব্ধ। কাউকে খুন করে এদিকে ফেলে রেখে গেলেও কেউ টের পাবে না।”

—“ O....M....G..... তাই?! তাহলে তো murderer দের জন্য খুবই সুবিধাজনক জায়গা এটা, লাশ দাফন করার খাতিরে।”

আদিত্যের কথা শুনে মিতু হেসে ওঠে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে-

—“ মন্দ বলোনি কথাটা তুমি।”

—" হুমম.... আচ্ছা, যাকে ফোন করেছো সে কি তোমার বোন হয়?”

—“ আরে নাহ.... ও হচ্ছে বাড়ির মালিকের মেয়ে। এই ২০ তলা ভবনটি দেখছো, এটা ওদেরই।”

—“ ওহ.... আচ্ছা...। আচ্ছা, উনি কি বয়সে তোমার থেকে অনেক বড়?”

—“ একদমই নাহ। একটা যুবতী মেয়ে ও। আমার থেকে এক বছরের বড়।”

আদিত্যের মনে মেয়েটি অর্থাৎ প্রিয়াকে নিয়ে একটু একটু করে আগ্রহ জন্মাতে থাকে। যুবতী মেয়ে যে কি না মিতুর থেকে বয়সে এক বছরের বড় অর্থাৎ ২১ বছর বয়সী। তারই সমবয়সী মেয়ে তাহলে। নিশ্চয়ই দেখতেও তেমন সুন্দরী হবে বটে।

—“ আচ্ছা, নাম কি ওর? আর সে কিসে পড়ে?”

—“ নাম প্রিয়া, অনার্স ২য় বর্ষে পড়ছে।”

—“ ওহ.... তো ওর সিবলিংস কয়জন?”

—“ ওরা এক বোন, দুই ভাই। প্রিয়া আপু তার বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা সন্তান।”

—“ ওহ..হো... একমাত্র মেয়ে!” দেখতে নিশ্চয়ই বেশ সুন্দরী। তাই না?”

—“ হুমম... সুন্দরী তো বটেই। বলতে পারো, এই ফ্ল্যাটের সবথেকে সুন্দরী একজন মেয়ে।”

আদিত্য মনে এক তীব্র আকর্ষণ অনুভব করছে প্রিয়াকে দেখার জন্য। অপেক্ষারত রয়েছে প্রিয়ার সৌন্দর্যকে একটিবার পরখ করতে। আসলে পুরুষের জাত চরিত্র তো...
আজকে তাদের বাড়ির দারোয়ান নেই। সে ছুটিতে গেছে একটা রাতের জন্য। সে জন্য, ভাগ্যকরে আজ মিতু বেঁচে গেছে। না হয়, এতক্ষণে এই খবর বাড়ির মালিক হাবিব উদ্দিন তালুকদারের কানে চলে যেতো। যদি একবার প্রিয়ার বাবা জানতে পারে, তাহলে কি ঝড় যে বয়ে যাবে তাদের ওপর দিয়ে তা কল্পনারতীত। প্রিয়ার গেট খোলার শব্দ শুনে মিতু আর আদিত্য গল্প থামিয়ে প্রস্তুত হয় ভেতরে যাওয়ার জন্য। আদিত্য তো বিশেষ করে প্রস্তুত হয়, রমণীটিকে একবার দেখার জন্য। গেটটা খুললে সবার আগে মিতু প্রবেশ করলে প্রিয়া মিতুর হাতে তার ফ্ল্যাটের চাবিটি ধরিয়ে দেয়। যেটা যাওয়ার সময় সে প্রিয়াকে দিয়ে গেছিলো এই বলে যে, আজকে রাতে সে তার বান্ধবীর বাড়িতে থাকবে।

—“ এই নাও চাবি, তাড়াতাড়ি নিজের ফ্ল্যাটে চলে যাও।”

—“ তোমাকে অনেক... অনেক... ধন্যবাদ আপু।"

—“ হয়েছে যাও, তাড়াতাড়ি যাও। গেটা লাগাতে হবে আমার।”

তারপর মিতু আদিত্যকে ভেতরে আসতে বলে। ভেতরে প্রবেশ করে আদিত্য প্রথমবারের মতো প্রিয়াকে দেখে। মিতু যা বলেছিলো, তা সত্যিই বলেছিলো। আসলেই প্রিয়া অনেক সুন্দরী। প্রথম দেখাতেই প্রিয়াকে আদিত্যের মনে ধরেছে। যদিও প্রিয়া একবারের জন্যেও আদিত্যের চেহারার দিকে তাকায়নি। তাকিয়ে আছে সে অন্যদিকে। আসলে প্রিয়ার ভীষণ রকমের বিরক্তবোধ হচ্ছিলো। সে চাইছে, কোনো রকমভাবে তাম-ঝাম মিটিয়ে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়বে।

—“ Hi, I'm Aditya.”

—“ মিতু... ও এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন? নিয়ে যাও ওকে সঙ্গে করে।”

—“ I'm sorry আপু। আসো, আসো।”

আদিত্য প্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলে প্রিয়া সেটা অগ্রাহ্য করে মিতুকে উদ্দেশ্য করে বলে, তাকে যেন তার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। এমনকি কথাটা বলার সময় প্রিয়া একটিবারের জন্যেও আদিত্যের মুখমন্ডলের দিকে তাকায়নি। আদিত্য বুঝতে পারে প্রিয়া কোনো একটা কারণে তার ওপরই ভীষণভাবে ক্ষেপেছে। তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মিতুর সঙ্গে চলে যায় তার ফ্ল্যাটে। যাওয়ার সময় কয়েকবার পেছন ফিরেও তাকায় প্রিয়ার দিকে আর প্রিয়া ছিলো তখন গেট আটকানোতে ব্যস্ত।

ফ্ল্যাটে পৌছেই কামের তাড়নায় আদিত্য মিতুকে বিছানায় ফেলে দেয়। জ্যাকেটটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তার শরীরের ওপর উঠে পড়ে আদিত্য। তারপর তারা দুজন গভীর ভাবে একে অপরের ঠোঁটে চুমু খেতে শুরু করে। চুম্বনের এক পর্যায় মিতু আদিত্যের ঠোঁটে হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়।

—“ কি হলো?”

—“ আদিত্য আসলে.... এটা আমার প্রথমবার কিন্তু...”

—“ ওহ.... এই ব্যাপার। Ok. No problem. I'll do it gently."

মিতু মাথা নেড়ে ঠিকাছে ইঙ্গিত দিলে দুজন নর-নারী মেতে ওঠে সেই আদিম অদ্ভুত শরীরী খেলায়।

বিছানার এদিক থেকে ওদিক গড়াগড়ি করেই চলেছে আয়ান। ঘুম তার চোখের ধারেকাছে দিয়েও নেই। অথচ মাঝরাত এখন। আর কাল সকালে তার ভার্সিটির ক্লাসও আছে। মাথায় তার শুধু আদিত্যকে নিয়ে চিন্তা ভাবনাই ঘুরছে। সেই সাথে আদিত্যের সামনে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার যে ব্যাপারটা, তার মাথায় আরো বেশি করে ঘুরপাক খাচ্ছে। লজ্জা আর অস্বস্তিতে বালিশে মুখ গুঁজে ফেলছে সে। একটা সময় মন থেকে সমস্ত চিন্তাভাবনা বাদ দেওয়ার জন্য বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসে। ড্রয়ের থেকে একটা ডায়েরি বের করে সেই ডায়েরিটা পড়তে লাগলো। হ্যাঁ, আয়ানের ডায়েরি লেখারও শখ রয়েছে। তবে ডায়েরিতে সে তার নিত্যদিনের ঘটনাগুলো লিখে না বাকি ৮-১০ জন মানুষ যারা ডায়েরি লিখতে ভালোবাসে তারা করে। সে শুধু ডায়েরিতে তার অতীতের সুন্দর স্মৃতিগুলো ও মনো- অনুভূতির কথা লেখে। যেহেতু অনুভূতির কথা হচ্ছে, সেহেতু ডায়েরিতে আদিত্যের অস্তিত্ব অবশ্যই বিদ্যমান। আয়ান অবসর সময়ে আদিত্যের সাথে কাটানো অতীতের সময়গুলো স্মৃতিচারণ করে তা ডায়েরিতে তুলে ধরতো এবং আদিত্যকে উদ্দেশ্য করে তার মনের কথাগুলো ডায়েরিতে প্রকাশ করতো। হঠাৎ আয়ানের মনে পড়লো, সে ঠিক করেছিলো আদিত্য আসলে তাকে কিছু একটা উপহার দেবে আয়ান। কিন্তু সে ইদানীং এই বিষয়টা মনে করেও, এতোদিন মনে করতে পারছিলো না। কিন্তু তার কাছে এখন অত টাকাও নেই যে ভালো কোনোকিছু একটা উপহার সে আদিত্যকে দেবে। কি দেবে, উপহারের টাকা কিভাবে পাবে ভাবতে ভাবতে মাথায় এলো তার একটা চমৎকার আইডিয়া। আর কোনো দেরি না করে, ড্রয়ের থেকে একটা বড় সাইজের আর্টের কাগজ, কিছু রং ও তুলি বের করে শুরু করে দেয় আদিত্যের জন্য উপহার তৈরীর প্রস্তুতি।

সময়টা ভোর ৫:৩০ টা। খালি গায়ে আদিত্য বারান্দায় থাকা দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে ধূমপান করছে। কালকে বৃষ্টি ছিলো আর আজকে আকাশ পরিষ্কার। কিন্তু বাহিরে এখনো আছে হালকা ঠান্ডা বাতাসের রেশ। মিতুও ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে, আদিত্যকে বারান্দায় আবিষ্কার করে তার কাছে যায়।

—“ good morning." (মিতু)

—“ oh.... Hey, good morning." (আদিত্য)

—“ খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লে?”

—“ হুম.... কি অবস্থা তোমার শরীরের? খুব বেশি ব্যাথা করছে না তো?”

—“ করছে একটু একটু। But, I'm Alright.”

—“ তাহলে তো ঠিকাছে।”

—“ হুম.. আচ্ছা, আমি কফি বানিয়ে আনি? কফি খেতে একসাথে গল্প করা যাক? নাকি?”

—“ হুম.... আমারো আসলে এই ভোর সকালে কফি খাওয়ার বড্ড ক্রেভিং হচ্ছে।”

—“ আচ্ছা, নিয়ে আসছি আমি তাহলে।”

মিতু গরম গরম কফি তৈরী করে এনে এক কাপ আদিত্যের হাতে তুলে দেয়। গরম গরম কফিটা হালকা একটু চুমুক দিয়ে খেয়ে দেখলো, কফিটা আসলে ভীষণ স্বাদের হয়েছে।

—“ বাহ... মিতু তুমি তো খুব ভালো কফি বানাতে পারো দেখছি।”

—“ Thank you."

—“ আচ্ছা মিতু... একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

—“ হুমম... অবশ্যই।”

—“ আচ্ছা প্রিয়া কি তোমার খুব ক্লোজ?”

—“ প্রিয়ার প্রতি বেশ আগ্রহ বাড়ছে মনে হয় তোমার?”

—“ হুমম... তুমি ঠিকই বলেছিলে। আসলেই সে খুব সুন্দরী। ভাবছি, ওর সাথে একবার কথা বলে দেখি। তবে গতরাতে যে অগ্নিমূর্তি দেখলাম ওর.... মনে হয়, একটু বুঝে-শুনে পা বাড়াতে হবে। বলো না, প্লিজ।”

—“ আসলে প্রিয়া আপু আর আমার মধ্যে তেমন কোনো ক্লোজ রিলেশন নেই। তবে মাঝে মধ্যে দরকারের জন্য ওর নাম্বারটা রেখে নিয়েছি শুধু। তবে হ্যাঁ, এটা কিন্তু ঠিকই বলেছো। ওর সঙ্গে কথা বলতে, বা মিশতে গেলে একটু বুঝে-শুনেই করতে হবে।

—“ খুব রাগী আর জেদি তাই না।”

—“ হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই বটে।”

—“ আমার কাছে রাগী মেয়েদের অনেক কিউট লাগে। কিন্তু.... গতরাতে ও রাগ হলো কি জন্যে আর কি নিয়ে?”

—“ মধ্যরাতে কেউ যদি তোমার ঘুম নষ্ট করে, তোমাকে কল করে বলে যে, সে নিচে দাঁড়িয়ে আছে এসে গেটটা খুলে দিতে। স্বাভাবিকতায়, তোমার রাগ তো হবেই তাই না? আর সেই সাথে, একজন অচেনা মানুষকে সঙ্গে করে নিয়ে আসার ব্যাপারটা যে কাউকেই রাগিয়ে দেবে। ও তো তাও প্রিয়া। আর প্রিয়া আপুর ব্যাপারে একটা জিনিস জানি আমি, অচেনা কোনো মানুষের মুখোমুখি হলে সে খানিকটা বিব্রতবোধ করে।”

—“ তারমানে, Introvert person. কারো সঙ্গে তেমন মেলামেশা করে না, তাই না?”

—“ আরে হ্যাঁ, এটাই তো তোমাকে বলতে ভুলে গেছি।”

—“ হুমম... বুঝলাম তাহলে। তবে জানো? কালকে ওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে যে রিজেকশন পেলাম তাতে অনেক ব্যাথিত হয়েছিলাম আমি। এমনকি রাগ করে আমার দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। তবে আরো একবার চেষ্টা করবো ওর কাছে যাওয়ার।”

—“ তুমি কি ওকে ইম্প্রেস করার চিন্তা ভাবনা করছো?”

—“ ধরে নাও তাই।”

—“ কিন্তু একটা.... কথা বলবো আদি, যদি কিছু মনে না করো তো?”

—“ হ্যাঁ বলো।”

—“ আচ্ছা, ওতো তোমাকে আর আমাকে একসাথে, একে ওপরের হাত ধরে ফ্ল্যাটের দিকে যেতে দেখছে। আর বন্ধ দরজার আড়ালে আমাদের মাঝে কি হয়েছিলো আশা করি ও সেটা বুঝতেই পেরেছে। তাহলে কি তোমার পক্ষে ওকে পটানো কি সম্ভব হবে?”

—“ সহজ হবে না, কিন্তু তাই বলে অসম্ভবও হবে না।”

—“ তুমি প্লিজ মাইন্ড করো না আমার কথায়। কিন্তু ও তো তোমার সম্বন্ধে খানিকটা অবগত হয়ে গেছে। ও নিজে সেটা পর্যবেক্ষণ করেছে। তাই বলছিলাম আর কি তুমি কিছু মাইন্ড করোনি তো?”

—“ আরে নাহ... কিচ্ছু মনে করিনি। তবে একটা কথা জানো কি মিতু? যে পুরুষের টাকা-পয়সা আর যে নারীর রুপ আছে সে যতোই অন্যায়-অবিচার করুক না কেন, পৃথিবীতে তার সাত খুন মাফ হয়ে যায়। আর সেই সাথে পুরুষটি যদি হয় সুদর্শন আর নারী যদি হয় ধনী, তাহলে তো হয়ে যায় Icing on the cake. যেমনটা ধরো আমি।”

—“ Icing on the cake মানে?”

—“ সোনায় সোহাগা।”

—“ ওহ.... আচ্ছা, দেখো তুমি। বুঝে শুনে পা বাড়িও।”

—“ হুমম... আসলে কি জানো তো? এসব মানুষদের ফাঁদে ফেলা বা পটানো খুবই সহজ, তোমাকে শুধু কিছুটা সময় তার পেছনে ব্যয় করতে হবে, তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য।”

—“ সেটা কিভাবে? তারা তো মানুষের সঙ্গে তেমন ভালো করে প্রয়োজন ছাড়া মেলামেশা করে না।”

—“ করে, করে। After all, তারাও তো সামাজিক জীব।তবে ওরা নিজেদের একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে অল্পসংখ্যক কিছু মানুষের সাথে মেলামেশা করে। আর তাদের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য, ওই অল্পসংখ্যক মানুষদেরই একজন হতে হবে। আরেকটা কথা কি জানো তো? ওরা কারো সঙ্গে না মিশলেও, ভেতর থেকে বড্ড একা। জাস্ট একবার যদি ওদের মনের ভেতর ঢুকে জায়গা নিতে পারো, তোমাকে আর কক্ষনো এরা ছেড়ে যেতে দিবে না।”

—“ বেশ ভালোই চেনো দেখছি, ইন্ট্রোভার্টদের।”

—“ হুম... সে সম্পর্কে আমার মোটামুটি ভালোমন্দ ধারনা আছে।”

—“ ok, wish you best of luck.”

—“ Thanks, babe. আচ্ছা ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে?”

—“ এতোটা ভেতরের কথা কি করে বলবো বলো?”

—“ ওর সাথে কখনো কোনো ছেলে দেখোনি?”

—“ আসলে নাহ... আর সেই দুঃসাহস কেউ করবে বলে আমার মনে হয় না।”

আদিত্য মিতুর কথায় হেসে ওঠে তার উত্তর দেয়—

—“ সিরিয়াসলি!?”

—“ হ্যাঁ, তুমি নিজেই দেখতে পাবে।”

—“ ঠিকাছে তাহলে। তবে এটার জন্য তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। যদি তোমার কথা না শুনে হোটেলে থেকে যেতাম তাহলে হয়তো এতো সুন্দর চাঁদের দর্শন পেতাম না। Thank you so much...”

—“ Ahh... nevermind. আসলে জানো কি? কালকে দেখলাম একটা couple gossip করছিলো হোটেলটা নিয়ে। যা শুনেছিলাম তাতে মনে হলো, হোটেলটা নিয়ে তারা ভালো কিছু বলছিলো না। আর হ্যাঁ, মেয়েটা সম্ভবত হোটেলের ম্যানেজার কে খুব গালাগাল দিচ্ছিলো।”

—“ এটা কখন হয়েছে?”

—“ তোমার আসার কিছু সময়ে আগে।”

—“ আচ্ছা, কি কি বলেছিলো মনে আছে তোমার?”

—“ আমার আসলে কিছু মনে নেই। আর কেন খারাপ বলছিলো সেটাও স্পষ্ট করে বলেনি মনে হয় তারা। তাই আমার মনে হলো, ওই হোটেলে থাকাটা আমাদের জন্য সেফ হবে না। সেজন্য, তোমাকে আমার বাড়ি নিয়ে এলাম।”

—“ আচ্ছা, ওই couple কে আর দেখেছো?”

—“ হুম... তোমার সঙ্গে আলাপ করার সময় তাদের বের হয়ে যেতে দেখেছিলাম।”

—“ ওহ, আচ্ছা.... But, I think তুমি খামোখা টেনশনে পড়ে গেছিলে। তেমন সিরিয়াস কিছু হবে বলে মনে হয় না।”

—“ তাহলে তো খুবই ভালো হয়।

—“ হুম..”

—“ আচ্ছা শোনো, ব্রেকফাস্ট করেই কিন্তু যাবে, কেমন? আর তোমার জন্য বোনাস পয়েন্ট, প্রিয়া আপু অধিকাংশ সময় ছাদে যায়। ৭টার সময় গেলে ওকে পাবে।”

—“ oh.... Thanks for the information.”

—“ mention not.”

কফি কাপের শেষ চুমুক টা নিয়ে মিতু চলে যায় রান্না ঘরে নাস্তা তৈরীর জন্য।

_______(চলবে)______

গল্প|| গানওয়ালা || লেখা:রাজা______________________উৎসর্গঃ আমার ক্রাশ আমার ছোট ভাই সামজীদকে  কিংবা সবাই আদর ভাইয়াকে।অনুপ্...
05/11/2024

গল্প|| গানওয়ালা ||
লেখা:রাজা
______________________

উৎসর্গঃ আমার ক্রাশ আমার ছোট ভাই সামজীদকে কিংবা সবাই আদর ভাইয়াকে।
অনুপ্রেরণাঃ একজন জার্মান গিটার বাদকের জীবনগল্প দ্বারা যিনি সমকামী হবার কারণে আজীবন ছন্দনামে গান লিখেছিলেন ও গেয়েছিলেন!]]

“ভাল্লাগে হাঁটতে তোর হাত ধরে
ভাবনা তোর আসছে দিন রাত ধরে
ভাল্লাগে হাঁটতে তোর হাত ধরে
ভাবনা তোর আসছে দিন রাত ধরে
এলোমেলো মনটাকে কি করে খেয়াল রাখে
কেন আমি এতো করে তোকে চাই
পারবো না আমি ছাড়তে তোকে
পারবো না আমি ভুলতে তোকে
পারব না ছেড়ে বাঁচতে তোকে
হয়ে যা রাজি একবার.......

ভোরবেলা ঘুম ভাঙতে বুঝলাম আমার এই শরীর জড়িয়ে শুয়ে আছে কাল সারারাতের সেই উদ্দাম আঠারো বছরের ছেলেটা। সারা গায়ে সমপ্রেমী
কামুক ট্যাটু করা। কাল দ্বিতীয়ার শো ছিলো কার্শিয়াং- এর কাছে। শোয়ের পর আচমকা কারোর তোয়াক্কা না ঘরে গ্রিনরুমে ঢুকে পরে এই ছেলেটা। ঘরে ঢুকেই সে তার আর্জি জানায়। আমি বাধ্য হয়ে আমার ম্যানেজার রুদ্রকে জানিয়ে ওকে নিয়ে হোটেলে আসি। কাল সারারাত দুইজনে নেশা আর একে অপরের শরীরে মত্ত ছিলাম, “উফফফ মাথাটা বহুত ধরেছে...”
মাথা ছিঁড়ে পড়ছে... রাতে শরীরের নেশায় কে কোথায় জামাকাপড় ফেলেছি খেয়াল নেই... বেড থেকে উঠে একপাশে নিজের আন্ডারপ্যান্ট দেখে পড়লাম...
“হ্যাঁ স্যার বলুন...”
“কড়া করে ব্ল্যাক কফি... চিনি ছাড়া...”
“ওকে স্যার... ব্রেকফার্স্ট কখন পাঠাব স্যার...”
“আমি বলে দেবো...”
একটা সিগারেট জ্বালিয়ে আমি ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম... হালকা শীতলতা বাতাস জুড়ে... দূরে উজ্জ্বলতা নিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে হিমালয়ের রানী কাঞ্চনজঙ্ঘা... হটাৎ বুঝলাম কালকের সেই ছেলেটা পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে...
“কি হয়েছে তোমার?”
“সকাল হয়ে গিয়েছে তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও... আমি গাড়ি বলে দিচ্ছি...”
“রাত শেষ... কাজ শেষ... রাতের বিছানা ভেজানো আমিও বিদায়... তাই তো?”
“কি চাও আমার কাছে? প্রেম? ভালোবাসা? সম্পর্ক?”
“কিছুই না... তোমার মনের মধ্যে একটু জায়গা... একটু সম্মান... আমি তো বেশ্যা নই...”
“হ্যাঁ... ওদের তো পেট চালানোর দায়... কিন্তু তোমার কি?”
“সেটা কি তুমি বোঝো না... কিংবা বুঝতে চাও না... আমি কাল নিজের পরিচয় দিয়েছিলাম... আমি তাও তোমার কাছে ছুটে এসেছি... তুমি কি কিছুই বোঝ না...”
“আমার সাথে একটা রাত বিছানায় কাটানোর ইচ্ছে ছিলো... আর কি দরকার? টাকা?”
“তুমি ভীষণ সস্তা...”
“আমি এখন উত্তরবঙ্গেই আছি... পুজো অবধি... যৌন খিদে মেটানোর ইচ্ছে থাকলে তুমি আসতেই পারো... ফ্রেশ হয়ে নাও... আমি কফি বলেছি...”
ছেলেটা ড্রেস পড়ছে... আমি কফি শেষ করে বাথরুমে গেলাম... একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে কাশির জন্য হাত থেকে সিগারেট পরে গেল... দেখলাম কাশির সাথে রক্ত বেরোচ্ছে...
আমি কি শেষ হয়ে যাচ্ছি?
আমি কি শেষ হয়ে যাবো?
আমার পরিণতি কি?
নাহ শেষ আমি হয়ে গিয়েছিলাম যেদিন আমি বাড়ি ছেড়ে অজানা-অচেনা অভিষ্যতের পথে হেঁটেছিলাম... আমার পাশে সেদিন কেউ ছিলো না... একা একদম একাকী এই কাঁটা বিছানো পথে হেঁটেছিলাম... লক্ষ্য একটাই ছিলো জীবনে সফল হতে হবে... উপায় জানা ছিলো না...
আমি মানে আমার এখনকার নাম মোজো... আসলে আমি নিজের আসলে নাম ভুলতে বসেছি... আমি মেহুল... হ্যাঁ আমার একটা বিশাল পারিবারিক ঐতিহ্য আছে... ক্লাসিক্যাল ঘরানার স্বনামধন্য শিল্পী ধীমান ব্যানার্জী আমার ঠাকুরদা... আমার বাবাও একজন বেতার তথা দুরদর্শন শিল্পী... পরিবারের মান রক্ষার্থে আমাকেও খুব ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীত শিক্ষা দেওয়া হয়... অবশ্য কিছুটা আমার জেদের কারণে আমি বাদ্যযন্ত্রও শিখি...
না না না... আমার কোনদিন গান শেখার দিকে উৎসাহ ছিলো না... হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরা আমাকে কোনদিন না টানলেও আজ তারা আমার অবলম্বন... যাকগে আমি কোনদিন আমাদের পরিবারের এই বিধিনিষেধ এই নিয়ম মানতে পারিনি... অবাক চোখে দেখতাম নিজের মাকে... আমার মা অবলীলাক্রমে বাবার গানের প্রতি ভালোবাসা এবং সংসারের প্রতি অবহেলা মেনে নিয়েছিলো মুখ বুজে... আমিও ছোটবেলা থেকে গায়ক হতে চাইনি কিন্তু বিধাতার তুলির টানে আমি আজকের আমি...
“তুতাই তুই কি বলছিস বাবা?”
“আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম তোমাদের... আমি সংসারের প্রতি বাবার এই অবহেলা সহ্য করতে পারছি না... আমি গায়ক হতে চাইনা... আমি আমার নিজের পথ বেছে নিতে চাই... আমি স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই... মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে চাই...”
“ওকে আটকিও না... ওকে ওর মতন জীবন বেছে নিতে দাও...”
“তুমি কোনদিন সংসারের দিকে মুখ তুলে তাকাও নি আমি কিছুই বলিনি... আমি তুতাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে ছিলাম... আজ আমি কি নিয়ে বাঁচব বলতে পারো...”
“তুমি চিন্তা করোনা মা... আমি একটা চাকরি নিয়ে তোমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবো...”
“তাই কর বাবা... তাই কর...”
জীবনযুদ্ধে পা রেখে বুঝতে পেরেছিলাম সংগ্রাম কতটা কঠিন... একটা চাকরির জন্য দোরে দোরে ঘুরেছি... মুটে, মজুরের কাজ করেছি দুমুঠো অন্নের জন্য... মাথা গোঁজার একটা ঠাই পাই উত্তর কলকাতার একটা বস্তিতে... আলাপ হয় বিকাশের সাথে...
“আমি!!! আমার দ্বারা হবে... তাছাড়া গান?”
“আবে গান্ডু তোর গলায় সুর আছে... একটা চেষ্টা করবি না... যদি হয়ে যায় তাহলে কেল্লা ফতে...”
“হ্যাঁ কিন্তু...”
“দেখ ভাই তুই তো নিজের পরিবার ছেড়ে এখানে এসেছিস... একটা কিছু করবি বলে... আমিও এসেছি প্রোডাকশান ম্যানেজার হবো বলে... তোর ভাগ্যে কিছু একটা হলেও আমারও কিছু হয়...”
“কিভাবে?”
“আমাকে তুই তোর ম্যানেজার রাখবি...”
“একটা লড়াই... একটা প্রতিবাদ... একটা বদলা...”
“কিসের রে?”
“জানিস... আমি কিন্তু সঙ্গীত একাডেমী পুরষ্কার পাওয়া ধীমান ব্যানার্জীর নাতি...”
“মাইরি... কি বলছিস তুই... এই কেলো করেছে...”
“সমস্যা নেই... এটা কি আর পাঁচজন জানে...”
“জানে না কিন্তু জানতে কতক্ষণ?”
“জানলে অবশ্য আমার মা কষ্ট পাবে... ছেলের এই পরিণতি... বাদদে... কবে কোথায় যেতে হবে?”
“এই দেখ বিজ্ঞাপন... কাল বাদে পরশু অডিশান... মেঘমল্লার স্টুডিওতে দুপুরে...”
একটা নতুন আশা নতুন কিছু... কিন্তু এখানেও বিধাতা একটু মুচকি হাসলেন... মাকে আমি ওই পারিবারিক পাঁক থেকে উদ্ধার করব বলেছিলাম... সময়ের ফেরে সেই মা আজ রাতে নিজেই পালিয়ে বাঁচলেন সব কিছু থেকে... রাত আটটা নাগাদ আচমকা হৃদস্পন্দন থেমে গেল কিংবা আর চলতে অস্বীকার করল... উদ্ধার আমি করলাম মাকে... বের করে আনলাম ওই বাড়ি থেকে কিন্তু সেটা আমার একার জোরে নয় বরং চারজনের কাঁধে চেপে... মা বেঁচে থাকতেও কাউকে ঝামেলায় ফেলে নি... মরবার সময়েও একা একাই চলে গেল...
“নিজেকে সামলা...”
“আমি ভীষণ একা হয়ে গেলাম বিকাশ...”
“একদম না... তোর মা তোকে জীবনে প্রতিষ্টিত দেখতে চেয়েছিলেন... তুই করে দেখা...”
“জানি না... কাল অডিশান কটার সময়ে?”
“দুপুরে... অসুবিধা নেই...”
বিজ্ঞাপন অনুসারে সেই ঠিকানায় পৌঁছে দেখি অনেক ছেলের লাইন... অনেকেই কাছা পড়া আমাকে দেখে একটু অবাক হয়ে তাকাচ্ছে... আসলে অডিশান নিচ্ছে ‘বাংলা গানের জগত’ নামে গানের চ্যানেল...
“চাঁদ কেন... আসেনা আমার ঘরে
চাঁদ কেন আসেনা আমার ঘরে
হো... চাঁদ কেন আসেনা আমার ঘরে
চাঁদ কেন আসেনা আমার ঘরে
সে অভিমানিনী আজো তো বলেনি
অভিমানিনী আজো তো বলেনি
আসবে কিনা সে ফিরে ওও...
চাঁদ কেন আসেনা আমার ঘরে...
চাঁদ কেন আসেনা আমার ঘরে
দিন যায় রাত যায়, বয়ে যায় সময়
ম্লান মুখে তার আজো সেই
চোখ চায়, মন চায় তবু ভাঙা হৃদয়
সবি আছে চাঁদ শুধু নেই
মেঘেরা যদি গিয়েছে দূরে সরে...
চাঁদ কেন আসেনা আমার ঘরে...”
“একটা প্রশ্ন ছিলো...”
“হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন...”
“কে মারা গিয়েছেন?”
“আমার মা... গতকাল রাতে...”
“ঠিক আছে তুমি একটু রিসেপশানে অপেক্ষা করো...”
“ঠিক আছে...”
শুরু হলো একটা অন্য পথ চলা... একটা লড়াই... এই প্রথম ক্যামেরার সামনে গান গাওয়া... সেই গানের প্রোগ্রামে আমি চতুর্থ হই... আসতে শুরু করল মাচার অনুষ্ঠান... সন্ধ্যেবেলা কিংবা মাঝরাতের জলসা... শহর থেকে শুরু করে গ্রাম বাংলা...
“তুই কি পাগল হয়েছিস বিকাশ...”
“দেখ ভাই... এইসব মাচার প্রোগ্রাম করে খুব বেশী কিছুই পাবি না... বরং এটা অনেক অনেক টাকা দেবে... অবশ্য তোর যদি বংশের মানসম্মান নিয়ে কোন...”
“আমি লাথি মারি ওই মানসম্মানে... তাই বলে বার সিঙ্গার... বিয়ের অনুষ্ঠান...”
“টাকাটা দেখ ভাই... তোর আমার দুইজনের হিল্লে হয়ে যাবে... সপ্তাহে তিনদিন... শুক্র, শনি আর রবি...”
“বুঝলাম...”
“বাকি দিনগুলো তুই চাইলেই মাচার প্রোগ্রাম ধরব...”
“যা ভালো বুঝিস কর...”
বস্তি ছেড়ে আমরা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম... আমরা মানে আমি আর বিকাশ... একটা বাইক কিনলাম... হাতে এখন অনেক টাকা... না হলেও মাসের শেষে নয় নয় করে পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার... শুরু করলাম মদ খাওয়া... একদিন সামপ্লেসেস এলেসে সন্ধ্যেবেলায় আমার গানের আগে ধর্মতলাতে সিগনালে একটা সাদা টি শার্ট আর ফেডেড জিন্স পড়া ছেলেকে দেখে থমকালাম... ছেলেটা ব্যাস্ত কলকাতাতে একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিলো... কি জানি কিসের তাড়নায় ছেলেটার পিছু নিলাম... ছেলেটা একটা বাসে উঠল... আমিও পেছনে... বৌবাজারে নেমে ছেলেটা একটা বাড়িতে ঢুকে গেল... মনে হলো ছেলেটার বাড়ি... দিন দুই কিংবা তিন বাদে একদিন সকাল সকাল সেই ছেলেটার বাড়ির সামনে একটা সিগারেট ধরিয়ে অপেক্ষা করছিলাম... কিছুক্ষণ বাদে সেই ছেলেটাকে দেখে বাইকটা এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ালাম...
“হাই আমি মোজো...”
“কি!!! মোজা... মানে জুতোর মোজা...”
“মোজো... আই মিন মেহুল... মেহুল ব্যানার্জী...”
“নমস্কার আমি তথাগত... তথাগত গাঙ্গুলি...”
“বাহ... দারুণ নাম তো...”
“কি দরকার?”
“দরকার মানে আমি তোমাকে দুইদিন ধরে ফলো করছি...”
“আমাকে ফলো... কেন?”
“কারণটা ঠিক জানি না... মানে হয়ত সেইদিন ধর্মতলায় একজন বয়স্ক মানুষকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দেওয়া কিংবা তোমার মন মাতাল করা হাসি... আমি ঠিক জানিনা... বলতে পারব না...”
“এটা মেয়ে পটানো আই মিন ছেলে পটানোর নতুন কায়দা...আমার আগে কতজন ছেলেকে এই একই কথা বলেছেন?”
“সত্যি কথা বললে কি বিশ্বাস করবে... তাহলে জেনে কি লাভ?”
“আমি এইসব পছন্দ করিনা...”
“মানে ছেলে ছেলে সম্পর্ক নাকি?”
“দেখুন আমি স্ট্রেইট অবশ্য সেইরকম কোন ছেলে দেখলে পাগল হবো না তা নয়... কিন্তু...”
“আমাকে পছন্দ হয়নি...”
“সেটা নয়... আমি এইগুলো পছন্দ করি না... মানে একদম অচেনা-অজানা একজনকে রাস্তা আটকে উপরি আলাপ...”
“আমি কিন্তু সেইরকম কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি... যাই হোক তোমার পছন্দ নয় তাই দুঃখিত... আমি চলে যাচ্ছি...”
প্রায় মাসখানেক বাদে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সোশ্যালে আমাকে গাইবার চান্স দেওয়া হয়েছে... স্টেজের বাইরে একটা সিগারেট টানছি হটাৎ দেখলাম সেই ছেলেটাকে... ও আমাকে দেখেছে কিনা জানি না... একটা ভালোলাগা তৈরি হলো...
জীবন পথের মোড়ে,
বেঁচে থাকার গানে,
খুঁজতে গিয়ে মান্‌
পেলাম না তো হাতের ছোঁয়া একাকী সংগোপনে।
তবুও প্রদীপের নিচে,
স্বপ্ন যারা বেচে,
রাতের নেশায় নিঝুম হবো ছেঁড়া কাঁথার নিচে।
উড়োচন্ডি পথে,
স্কেল পেন্সিল হাতে,
কাঁটাতারের বেড়া পার হবো একসাথে।
মাঝরাতের শেষ ট্রেনে,
অবশ্যম্ভাবী জেনে,
নীলাকাশের সমঝোতা দরদস্তুর মেনে।
“হাই আমি...”
“হ্যাঁ বলো... আজ এই রাস্তায় ছেলেদের সাথে গায়ে পড়া একটা গে ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে...”
“আমি সেইদিনের ব্যবহারে দুঃখিত...”
“দুঃখের মাত্রা কি আজকের গান শুনে বাড়ল নাকি...”
“কফি হাউজে একসাথে কফি খাবে?”
“আমার আপত্তি নেই...”
“দেখো তথা আমি গে কিনা জানি না কিন্তু তোমাকে প্রথমদিন দেখে আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি...”
“আমি সেদিন বুঝতে পারিনি... কিন্তু তারপর অনুতাপ করেছি... আজ তোমাকে প্রথমে দেখে কথা বলতে একটু দ্বিধাবোধ ছিলো... কিন্তু গান শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি...”
“আমি জানি না আমাদের এই সম্পর্ককে কি তকমা দেবো...”
“দেখো ভারতে এখনও ছেলে ছেলে সম্পর্ক মেনে নেয় না সমাজ...”
“হ্যাঁ ৩৭৭ ধারার কষাঘাত আছে আমাদের ওপর... কিন্তু পকেটে পয়সা থাকলে সমাজ একটু সমঝে চলে...”
“সেটা হয়ত ঠিক...”
“গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে ভেবেছিলো একটি পাখী
হটাৎ বুকে বিঁধল যে তীর স্বপ্ন দেখা হলো ফাঁকি
গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে ভেবেছিলো একটি পাখী
হটাৎ বুকে বিঁধল যে তীর স্বপ্ন দেখা হলো ফাঁকি
গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে ভেবেছিলো একটি পাখী”
আজ আমাদের এই সম্পর্ক চারমাস হলো... তথাগত একটা স্বচ্ছ পাহাড়ি ঝরনা... উচ্ছল, উদ্দাম, বেপরোয়া... আমি তথাগতকে ছুঁতে ভয় পেতাম... অনেকদিন ও আমার কাঁধে মাথা রেখে যখন গল্প করত আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম... দাদার কথা খুব মনে পড়ত... আমার থেকে বছর দুয়েকের বড় আমার দাদা... একই স্কুলে পড়তাম... দাদার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, স্কুল থেকে ফেরা, একসাথে পড়াশুনা, খেলাধুলা, একসাথে রাতে ঘুমিয়ে পড়া... আমার মাধ্যমিক, দাদার তখন উচ্চমাধ্যমিক... কয়েকদিনের অজানা জ্বরে আমাকে একলা রেখে না ফেরার দেশে পাড়ি দিলো আমার দাদা...
“এসো বাবা... বসো...”
আজ আমি তথাগতদের বাড়িতে এসেছি... তথাগতের বাবা কলেজের অধ্যাপক মা স্কুল শিক্ষিকা... আমি ঢুকে দুইজনকে প্রণাম করে বসলাম... তথাগতের কথামতন পাঞ্জাবী পড়ে এসেছি...
“দেখো বাবা আমি বা তথাগতের মা সমাজের আর পাঁচজনের জন্য নই... তোমরা দুইজন দুইজনের ভালো বন্ধু... তোমরা হয়ত সারাজীবন একসাথে কাটানোর অঙ্গীকার করেছো... না না আমাদের সেই ব্যাপারে আপত্তি নেই... তোমরা দুইজনেই প্রাপ্তবয়স্ক... তোমরা নিজের ভবিষ্যত সিদ্ধান্ত নিজেরাই নেবে তাতে আমাদের কি আর বলবার আছে... কিন্তু...”
“কিন্তু কি কাকু...”
“দেখো বাবা... তুমি পাড়ার স্টেজ, বার, জন্মদিন এইসবে গান গাইছ... এইভাবেই কি সারা জীবন চলবে...”
“আমি প্লেব্যাকের চেষ্টা করছি... আশা করছি হয়ে যাবে...”
“আমার মনে হয় তোমাদের একবার ভেবে দেখা উচিৎ... দেখো কি করবে...”
আমাদের দুইজনকে রেখে তথাগতের বাবা-মা ভেতরে চলে গেলেন...
“তোমার নিশ্চয় একই মতামত...”
“হ্যাঁ... কারণ এটার কোন ভবিষ্যত নেই... আমি আর পাঁচজনকে তোমার কি পরিচয় দেবো বলতে পারো...”
“ঠিক কথা... হোটেলে, বারে, পাড়ার মাচায় গান গেয়ে বেড়ায়... এটা বললে তো এই সমাজ ভুরু কোঁচকাবে...”
“সঙ্গীত একাডেমী পুরস্কারে ভূষিত পণ্ডিত...”
“প্লিজ... আমি আমার পরিবারের পরিচয়ে আগেও বাঁচিনি আজকেও বাঁচতে চাইনা... আমাকে আমার আজকের পরিচয়ে মেনে নিতে তোমার আপত্তি... ঠিক আছে আমি আর তোমার সামনে কোনদিন আসব না...”
“তাই গান শোনাতে হায় কণ্ঠ কেঁপে যায়
তাই গান শোনাতে হায় কণ্ঠ কেঁপে যায়
তারে হাসিমুখে যেতে দাও শেষবার শুনে নাও
মনে রেখো মনে রেখো তার এই শেষ গান...”
“এই মেহুল... কি করছিস তুই...”
“নিজেকে শেষ করে দিতে চাই আমি... আমার বাঁচার ইচ্ছে নেই...”
“দেখ এটা জীবনের শেষ নয় বরং শুরু... তুই একদিন ঠিক তোর লক্ষ্যা পৌছাবি... সেদিন দেখবি তোর পেছনে...”
“সবাই আসবে শরীরের বিনিময়ে কিছু পেতে... সেটা হয় টাকা না হয় কোথাও একটা সুযোগ... ভালোবাসা কি পাবো আমি?”
“হয়ত পাবি কিংবা নাও হতে পারে...”
বাথরুম থেকে বেড়িয়ে রুমে আসার পর দেখলাম সেই ছেলেটা রেডি হয়ে গিয়েছে...
“একটা কথা বলব...”
“সেক্স ছাড়া অন্য কিছু বললে আমার ইন্টারেস্ট নেই...”
“আমি তোমার পাশেপাশে থাকতে চাই... এই কয়েকদিন থাকতে দাও যদি মনে হয় দূর করে তাড়িয়ে দিও...”
“তুমি কি চাও বলতো... পুরুষ লিঙ্গ, শরীর, টাকা নাকি অন্য কিছু...”
“তোমার সঙ্গ...”
আমার মাথা একটু ঘুরে গেল...
“আপনার শরীর খারাপ লাগছে... রিসেপশানে বলব... ডাক্তার...”
“না আসলে... মাথাটা একটু...”
ছেলেটা আমাকে ধরে সোফাতে বসিয়ে দেয়... সেই সময়ে বিকাশের ফোন আসে...
“কিরে ঘুম ভাঙল তোর?”
“হ্যাঁ অনেকক্ষণ... বল...”
“আসলে এখানকার একটা স্কুলে যাবার কথা ছিলো...”
“কখন...”
“বারোটা নাগাদ...”
“আমাকে অ্যাড্রেস পাঠিয়ে দে... আমি চলে যাবো...”
“কাল রাতের ছেলেটার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছি...”
“দরকার নেই কারণ ও আমার সাথে দিন কয়েক থাকবে...”
“বাবা... আরে আমার মোজো বাবা একই ছেলের সাথে একাধিক রাত থাকবে...”
“বিকাশ ছেলেটা ভালো...”
“এই বিকেল থেকে পাঁচটা পুজো প্যান্ডেলে উদ্বোধন আছে... সব শিলিগুড়ি... তুই হোটেল চেক আউট করে সোজা স্কুলে যাস... ওখান থেকে সোজা শিলিগুড়ি...”
“ঠিক আছে... এই কনডম ব্যবহার করছিস তো...”
“মনে নেই...”
“মেহুল সেক্স কর আর যাই কর সেফটি আগে...”
“সকাল সকাল জ্ঞান দিস না... মাথা ধরেছে...”
“রোজ এতো মদ খাস না... একটু শরীরের দিকে খেয়াল রাখ... কাল থেকে টানা দশমী অবধি অনুষ্ঠান আছে কিন্তু...”
“আমি ফোন রাখছি...”
বমি আসতে আমি আবার বাথরুমে গেলাম... বমি হলেও সাথে রক্ত বেরোল...
আমার কি হলো?
আমি কি ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছি?
কিন্তু আমি প্রথম শেষ হয়েছি যেদিন বছর দশেক আগে আমি বাড়ি ছাড়ি... আমি সেইদিন শেষ হয়েছি যেদিন আমি প্রেমে প্রাত্যাখ্যাত হয়েছি... দ্বিতীয়বার আমি কোন ছেলেকে প্রেম করবার কথা ভাবিনি... ভেবেছি তাদের বিছানায় সঙ্গী, যৌন লিপ্সা মেটাতে...
প্রায় নয়-দশ বছর আগে সেইদিন তথাগতের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সোজা গেলাম ধর্মতলার একটা বারে... আকণ্ঠ মদ খাওয়ার পর বিকাশের ফোন...
“আমাকে কি করতে হবে...”
“মেহুল মুখাগ্নি করবে কে?”
“কেন ওনার গান, ওনার মাদ্যযন্ত্ররা করবে...”
“দেখ আর যাই হোক উনি তোর বাবা... এটা করিস না...”
বাড়ি ছাড়ার পর নিজের বাবাকে একবারই দেখেছিলাম... মায়ের মারা যাবার দিন আর শ্রাদ্ধের দিন... আবার আজ শ্মশানে দাহ করবার আগে... দেখে কেমন একটা মায়া লাগছিলো... কেমন একটা শুকিয়ে গিয়েছে... প্রথমে বড় ছেলের মৃত্যু, তারপরে আমার বাড়ি ছাড়া এবং শেষে স্ত্রীর মৃত্যু ওনাকে একা নিঃসঙ্গ করে দিয়েছিলো...
“গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে ভেবেছিলো একটি পাখী
হটাৎ বুকে বিঁধল যে তীর স্বপ্ন দেখা হলো ফাঁকি
যার গান শুনে একদিন কণ্ঠে পড়ালে মালা
আজ তোমাদের সভা হতে তার বিদায় নেবার পালা
ঝড়ে কত তারা আলোকে মনে রাখে বলো কে?
ঝড়ে কত তারা আলোকে মনে রাখে বলো কে?
ছিল কত সুখ বুকে তার জানিবে না কেহ আর
মনে রেখো মনে রেখো তার এই শেষ গান...”
“এই মেহুল এই দেখ?”
“কি এটা?”
“আরে রিয়ালিটি এন্টারটেনমেন্ট...”
“কারা?”
“আবে বোকাচোদা এরা দুই নম্বর ফিল্ম আর মিউজিক প্রোডাকশান হাউজ...”
“কি চাইছে?”
“নতুন মুখ... সামনের শনিবার অডিশান... অবশ্য আগে ছবি সহ গানের সিডি চাইছে...”
“তুই বুঝেশুনে পাঠিয়ে দে...”
বাইপাসের ধারে সোনার বাংলা হোটেলে আজ সন্ধ্যেবেলা অডিশান... হাজার খানেক অবেদনের মধ্যে দশজনকে বাছাই করে ডাকা হয়েছে... সিলেক্ট করবে একজন কিংবা দুইজনকে... পাঁচজনের পর আমার গানের পর আমাকে ১০১৬ রুমে অপেক্ষা করতে বলা হলো... জীবনে প্রথমবার নামকরা ফাইভস্টার হোটেলের সুইট... কিছুক্ষণ বাদে রুমে এলেন সেই মধ্য চল্লিশের মানুষ...
“রিল্যাক্স হয়ে বসো...”
“আমি আসলে একটু টেনশানে আছি... এতো বড় প্রোডাকশান হাউজ...”
“কি খাবে উইক্সি, ভদকা নাকি শ্যাম্পেন...”
“উইক্সি ঠিক আছে...”
“কাবার্ডে গাউন আছে চেঞ্জ করে নাও... আমিও ফ্রেস হয়ে আসছি...”
কি আছে কপালে... কিসের আহ্বান কিসের চাহিদা...
“তারপর বলো... কি নাম যেন তোমার?”
“মেহুল... মেহুল ব্যানার্জী...”
“ইয়েস ইয়েস পণ্ডিত ধীমান ব্যানার্জির সুযোগ্য নাতি... কিন্তু নিজেকে এভাবে নষ্ট করছ কেন... তোমার গানের গলা আছে তোমার ভরা যৌবন আছে...”
“আমাকে কি করতে হবে মিঃ...”
“মিঃ নয় আমি আদিত্য... এই প্রোদাকশান হাউজের মালিক...”
“আমি কি করতে পারি...”
“অনেক কিছু যা আমি ওই বাকি নয়জনের কাছে চাইনি...”
আমি বুঝলাম ওই আদিত্য সোফাতে আমাকে ঘেঁষে বসল... আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো... আদিত্যের শরীর আমার লিঙ্গকে উত্তেজিত করে তুলছিলো... আমি পেছনে একপাশে দেখলাম বাবা তানপুরা বাজাচ্ছে অন্যদিকে মা মুখ গুঁজে কুটনো কাটছে... আদিত্যের লাল ঠোঁটে ঠোঁট ডোবাতে কেমন যেন সব কোথায় মিলিয়ে গেল... মাঝরাতে যখন প্রায় বার্ষিক ৩০-৩৫ লক্ষের কনট্র্যাক্ট সই করলাম তখন আমার লিঙ্গ আদিত্যের শরীরে ক্লান্ত হয়েছে...
“আজ থেকে মেহুল মৃত... মানে এই সমাজের কাছে...”
“তাহলে... কি নাম দেবে তোমার আমাকে...”
“মোজো...”

__________________
শুরু হলো মোজোর পথচলা... একবছরের কন্ট্র্যাক্ট অনুসারে আমার তিনি-চারটে অ্যালবাম বের হয়... তাতে প্রথমটার টাইটেল ট্র্যাক সুপারহিট...
আমি একটু বিতর্কিত
আজ একটু আলাদা কিছু হোক
পত্রিকার শব্দ ধাঁধায় আমি তোমাদেরই লোক।
তোমার আমি কাঁচের মতন
ফেলে দেওয়া টুকরো বিড়ি
অনুভূতির আবর্জনায় অচল দেওয়াল ঘড়ি।
তুমি কি প্রশ্ন?
নাকি উত্তর?
কিন্তু অমানিশা নয়
আমি আজো কান্নাভেজা আশ্রয়।
আমার নেশায় গাঁজার ছিলিম
মনমাতানো তিস্তা
আমার গান সস্তা পাতা
কানাকড়ি দিস্তা।
সপ্তাহে দুটো, তিনটে কিংবা সারা সপ্তাহ অনুষ্ঠান... বাইক ছেড়ে গাড়ি কিনলাম, ভাড়াবাড়ি ছেড়ে বহুতল ফ্ল্যাট... শুরু হলো নেশায় আসক্তি আর রোজ কমবয়সী পুরুষ শরীর ভোগ...
আমার চলার পথ আর আমার মন
একমনে লিখে চলে জীবনের গান
ল্যাম্পপোস্টের তলা রোজ
পরাজয়ের মুখ ঢাকে।
আমি হারতে শিখেছি
রক্তেলেখা চিঠির হলুদ পাতায়
আমার আপন সত্তা
নির্বাসিত পাহাড়ের ছাতায়।
সব ধরণের নেশা মানে মদ, গাঁজা, হেরোইন ইত্যাদি ইত্যাদি... অসুস্থ হই, শো ক্যান্সেল করতে হয়... গত নয়-দশ বছরে বার কয়েক রিহ্যাবিলিটেশানে গিয়েছি... কিন্তু বদলায়নি কিছুই... বদলেছে কন্ট্র্যাক্ট... বদলেছে রোজকার বিছানায় কমবয়সী ছেলেগুলো... আমি কিন্তু প্রতিদিন একটু একটু করে শেষ হয়েছি... প্রত্যেকবার নতুন কন্ট্র্যাক্ট... আরো বেশী টাকা, আর একটা নতুন আদিত্যের শরীরে বীর্যপাত... আরো দামী মদ, দামী গাড়ি... কিন্তু আমি মরমে কুরেকুরে মরেছি প্রতি লহমায়...
“গাড়ি চলে এসেছে...”
“হ্যাঁ তুমি নিচে যাও আমি আসছি... আর হ্যাঁ সামনের দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনো...”
“ঠিক আছে...”
আমি আয়নাতে নিজেকে একবার দেখে নিচে নামলাম... আমি আমার আজকের আমিকে চিনতে পারিনা... এটাই কি সেই মেহুল যে স্বপ্ন দেখত... আজ আমার কাছে গাড়ি-বাড়ি, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, নাম-যশ সব আছে কিন্তু নেই ভালোবাসা নেই একটা কাঁধে রাখবার মতন হাত...
এই দশ বছরে আমি কিন্তু আমার প্রথম ভালোবাসাকে খুঁজি নি কিন্তু তাকে ভুলতেও পারিনি... আজ দশ বছর বাদে কেন জানিনা এই এক রাতের বিছানার সঙ্গী এই মৃদুলের আহ্বানে সাড়া দিলাম... কেন দিলাম জানিনা...
“তুমি কি চাও আমার থেকে...”
“তোমার অবহেলা... তোমার ঘৃণা... কিন্তু দূরে ঠেলে দিও না...”
“আমি কি আর দিতে পারব তোমাকে... আমার জীবন খাতার পাতাগুলো খালি... রঙ নেই, বর্ণ নেই, অক্ষর নেই...”
“আমরা দুইজনে কি সাজাতে পারিনা...”
আমি জানলার বাইরে চোখ রাখলাম... আস্তেআস্তে কাঞ্ছনজঙ্ঘার ওপর থেকে মেঘের আস্তরণ সরে গিয়ে আলোর ছটায় শায়িত বুদ্ধ উজ্জ্বল হয়ে উঠল... মৃদুল আমার হাতের ওপর নিজের হাত রাখল, আমি নিজের হাত সরিয়ে নিলাম না... আজ তৃতীয়া, আজকের পর পঞ্চমী থেকে একটানা রোজ শো... সবই মোটামুটি শিলিগুড়ির আশেপাশে...
“হ্যালো...”
“কোথায়?”
“এইতো প্রায় শুকনার আশেপাশে...”
“ঠিক আছে... আমি অপেক্ষা করছি...”
“এই আজ আর কাল মংপু রিসোর্ট বুক কর...”
“ওখানকার লোকাল কোন ছেলে লাগবে নাকি...”
“বললাম না মৃদুল থাকবে আমার সাথে...”
“তুই কি সিরিয়াস মেহুল...”
“আমি বোধহয় বাঁধা পড়েছি...”
“তাহলে ভালোই... তোর একটা হাত দরকার... একটা কাঁধে মাথার রাখার লোক দরকার... বেস্ট অফ লাক...”
“কুজঝটিজাল যেই
সরে গেল মংপু-র
নীল শৈলের গায়ে
দেখা দিলো রংপুর।”
“জানো মৃদুল এই পাহাড়ের নিচে এলে আমার মন কোথায় একটা হারিয়ে যায়...”
“আমারও... আমি তো বছরের বেশিরভাগ শিলিগুড়িতে থাকি তাই সময় পেলেই এখান থেকে ঘুরে যাই...”
“একটা কথা বলব...”
“তোমার সব কথা আমি শুনব...”
“আজ কোথাও দশ বছর ধরে দোরে দোরে ঘুরে বেড়ানো এই বাঁধনহারাকে তুমি আশ্রয় দিয়েছ...”
“আমি তো তোমার মাঝে নিজেকে হারাতে চাই...”
“এতোটা ভালোবাসো?”
“আমার থেকেও বেশী... তাই তো আমি আমার বয় ফ্রেন্ডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বারবার তোমার নানান অনুষ্ঠানে গিয়েছি... দেখা করবার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি... কিন্তু আমি হাল ছারিনি...”
পড়ন্ত সুর্যের ছটায় আজ সমপ্রেম নতুনভাবে সেজে উঠল... সিক্ত হলো মাতাল মন... সেইদিন রাতে অনেকদি বাদে মদ খেলাম না... অনেকক্ষণ দুইজনে গল্প করলাম... সকালে উঠে দেখি মৃদুল ঘুমিয়ে আছে... ওর মিষ্টি মুখের ওপর সকালের সুর্যের ভালোবাসার রঙ ছড়িয়ে পড়েছে... আমি ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে বাথরুমে গেলাম... আবার সেই কাশি সঙ্গে রক্ত... আমি ভয় পেয়ে গেলাম... বাথরুম থেকে বেড়তে গিয়ে মাথা ঘুরে পাশের টেবিলে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম...
“আ...আ...আমি...আমি... কোথায়...”
“এই এই আপনি ব্যাস্ত হবেন না... আপনি ভালো আছেন...”
চোখ খুলে বুঝলাম এটা কোন নার্সিংহোম... স্যালাইনের নল, যন্ত্রপাতি, নার্স... দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা আলাদা কেবিন... কিছুক্ষণ বাদে রুমে ডাক্তারের সাথে বিকাশ আর মৃদুল ঢুকল... মৃদুলের চোখ কেঁদে কেঁদে ফুলে গিয়েছে...
“মিঃ মেহুল আপনি এখন ভালো আছেন... কোন চিন্তানেই...”
“আমার কি হয়েছে ডাক্তার...”
কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম গলাতে কষ্ট হচ্ছে...
“বিশেষ কিছু না... আমরা টেস্ট করেছি... আপনি ওদের সাথে কথা বলুন আমি আবার পরে দেখে যাবো...”
“বিকাশ...”
“তুই রেস্ট নে...”
“আমার কি হয়েছে...”
“কাশির সাথে রক্ত পড়ছে আমাকে বলিস নি কেন... মৃদুল না থাকলে... তুই এতোটা দায়িত্বজ্ঞানহীন...”
“আমার গলায় কিছু...”
“আমি জানি না... রিপোর্ট আসুক...”
“কাল থেকে প্রোগ্রাম?”
“কিছুই মাথায় আসছে না... বাইরে মিডিয়া অপেক্ষা করছে... ওইদিকে আজ তোর একজন ভদ্রমহিলার সাথে দেখা করবার ছিলো... মানে সেই যিনি প্রায় মাস খানেক ধরে বারবার কাকুতিমিনতি করছেন...”
“তাহলে পাঠিয়ে দে...”
“এখন এখানেই কথা বলবি?”
“হ্যাঁ...”
বিকাশ বেড়িয়ে গিয়ে একজন ভদ্রমহিলাকে নিয়ে আসলেন...
“বলুন কি দরকার... আপনি একমাস ধরে দেখা করার চেষ্টা করছেন...”
“আসলে খুব বিপদে পড়ে এসেছে মানে আপনার সাহায্য চাইছি... আমার স্বামীর লাস্ট স্টেজ ক্যান্সার... চিকিৎসার খরচ প্রায় ২০-২৫ লক্ষ... তাই কয়েকটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে গিয়েছিলাম... তারা আপনাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলো যদি এইবারের পুজোর অষ্টমীর অনুষ্ঠানটা চ্যারিটি করতেন...”
“চ্যারিটি আমি সেই অর্থে...”
“আসলে আপনার কাছে আসার কথা আমার স্বামী বলেছেন...”
“আপনার স্বামী আমাকে চেনেন?”
“তাকে আপনিও চেনেন... আমি ডাকব...”
“এখানে এসেছেন?”
“হ্যাঁ আসলে একটু শরীর খারাপ তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছি...ডাকব?”
“হ্যাঁ ডাকুন...”
ভদ্রমহিলা বাইরে গিয়ে যাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল তাকে দেখে আমি কষ্টে চোখ বুজে ফেললাম... আমার সেই ভালোবাসা যে আমাকে ভুল বুঝেছিলো, যে ভালোবাসা আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলো আমাকে দিগভ্রান্ত করেছিলো...
“পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে,
স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে,
ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী...
ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে,
যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে,
ঘুচে গেছে বেশ কাল সীমানার গন্ডি...
ভেবে দেখেছো কী,
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে,
তারো দূরে,
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে..”
“সত্যিই দুনিয়া গোল কিংবা খুব ছোট...”
“মেহুল আমাকে অপমান করো কিংবা যা ইচ্ছে কিন্তু ফিরিয়ে দিও না...”
“তাই কি তথাগত!!!”
“সারি সারি মুখ আসে আর যায়,
নেশাতুর চোখ টিভি পর্দায়,
পোকামাকড়ের আগুনের সাথে সন্ধি...
পাশাপাশি বসে একসাথে দেখা,
একসাথে নয় আসলে যে একা,
তোমার আমার ভাড়াটের নয়া ফন্দি...
ভেবে দেখেছো কী,
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে,
তারো দূরে,
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে..”
“বিকাশ অষ্টমীর উদ্যোক্তাদের সাথে আর ওই সংগঠনের সাথে যোগাযোগ কর... এই প্রোগ্রাম চ্যারিটি হবে...”
“সব ঠিক আছে কিন্তু...”
“আর হ্যাঁ কলকাতায় টাটা ক্যান্সার হসপিটালে যোগাযোগ করে তথাগতের অ্যাডমিশান কনফার্ম কর...”
“ডাক্তার কিন্তু তোর গলায় একটা গ্রোথ পেয়েছে...”
“মানে!!!”
“সেটা যা কিছুই হতে পারে... এমনকি তুই...”
“আমি আর গান গাইতে পারব না...”
মৃদুল কান্না লুকায়, বিকাশ চুপচাপ হয়ে যায়... তথাগত হতবাক হয়ে সোফাতে বসে পড়ে...
“স্বপ্ন বেচার চোরাকারবার,
জায়গাতো তো নেই তোমার আমার,
চোখ ধাঁধানোর এই খেলা শুধু বঙ্গী...
তার চেয়ে এসো খোলা জানালায়,
পথ ভুল করে কোন রাস্তায়,
হয়তো পেলেও পেতে পারি আরো সঙ্গী...
ভেবে দেখেছো কী,
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে,
তারো দূরে,
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে..”
“আমার প্রিয় স্রোতাবন্ধুরা... আপনারা এতদিন গায়ক মোজোর গান শুনেছেন, আমাকে ভালোবাসা দিয়েছেন... আজ এই মহাষ্টমীর সন্ধ্যাতে আপনারা বাদক ও গায়ক মেহুলের গান শুনুন... বাবা-মায়ের দেওয়া নাম মেহুল... আজ আমি আমার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার জন্য গান গাইব... আজ আমি আমার আজকের সাথী আমার মৃদুলের জন্য গান গাইব... আমি আর কোনদিন গান গাইব কিনা কিংবা গাইতে পারব কিনা জানি না... কিন্তু কথা দিচ্ছি আমি আপনাদের মাঝেই থাকব...”
“ও গানওয়ালা, আর একটা গান গাও
আমার আর কোথাও যাবার নেই,
কিচ্ছু করার নেই।
ছেলেবেলার সেই, ছেলেবেলার সেই
বেহালা বাজানো লোকটা,
চলে গেছে বেহালা নিয়ে
চলে গেছে গান শুনিয়ে।
এই পাল্টানো সময়ে, এই পাল্টানো সময়ে
সে ফিরবে কি ফিরবে না জানা নেই..
গানওয়ালা, আর একটা গান গাও
আমার আর কোথাও যাবার নেই,
কিচ্ছু করার নেই।
কৈশোর শেষ হওয়া, কৈশোর শেষ হওয়া
রঙ চঙ্গে স্বপ্নের দিন
চলে গেছে রঙ হারিয়ে,
চলে গেছে মুখ ফিরিয়ে।
এই ফাটাকাবাজির দেশে,
এই ফাটাকাবাজির দেশে
স্বপ্নের পাখিগুলো বেঁচে নেই ..
গানওয়ালা, আর একটা গান গাও
আমার আর কোথাও যাবার নেই,
কিচ্ছু করার নেই।
ও গানওয়ালা, আর একটা গান গাও
আমার আর কোথাও যাবার নেই,
কিচ্ছু করার নেই ...”

________(সমাপ্ত)__________

Address

Rajpur
700064

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when অন্য-পুরুষের গল্প posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Videos

Share

Category