17/12/2024
#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#স্বপ্ন_হলেও_সত্যি
#সৌম্য_ভট্টাচার্য
#পর্ব_২১
্রকাশনী
রাজা প্রসেনজিৎ এবং তাঁর ভক্তদের মতে, উত্তরকূটের সব কিছুই খুব ভালো ভাবে চলছে। প্রসেনজিতের যোগ্য নেতৃত্বে উত্তরকূট তরতর করে উন্নতির পথে অগ্রসর হচ্ছে। তবে উত্তরকূটের প্রজা বা নাগরিক সবাই সে কথা মনে করে না। মুক্তধারার সদ্যনির্মিত বাঁধের চারিধার অতি মনোরম। সদ্য উন্মোচিত যন্ত্ররাজ বিভূতির আলোকোজ্জ্বল প্রকাণ্ড মূর্তি আকাশ ছুঁয়ে সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে। ঝর্নাকে আটকে তৈরি দিগন্তবিস্তারী জলাধার লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাঁধের ধারে রচনা করা হয়েছে ফুলের কেয়ারি করা সুন্দর পথ। সেখানকার শীতল সান্ধ্য বাতাসে উত্তরকূটের কিছু নাগরিক পদচারণা ও পারস্পরিক আলাপে মগ্ন ছিলেন। এরা পরস্পরের প্রতিবেশী এবং পরিচিত।
প্রথম নাগরিক হারু বললেন – জায়গাটা দিব্যি বানিয়েছে ভাই চারু আর লাইটও লাগিয়েছে দারুণ। এই ছোকরা ভবভূতিটার এলেম আছে কিন্তু।
দ্বিতীয় নাগরিক চারু সম্মত হলেন না। বললেন দাদা, হ্যাঁ, এখানে প্রচুর
লাইট দিয়েছে ঠিকই কিন্তু আমাদের জীবনে তো ব্যাটারা লোড-শেডিং করে ছেড়ে দিয়েছে। সেখানে তো ঘোর অন্ধকার! এই হারামজাদা পোসেনজিৎটা সিংহাসনে চড়ার পর লাইফ তো একেবারে হেল করে দিল দাদা!
হারু সশঙ্কে বললেন – চুপ! চুপ! ভাই দেয়ালেরও কান আছে। এ সব কথা এখানে বোলও না। তোমায় লোকে দেশদ্রোহী বলবে যে?
তৃতীয় নাগরিক মদন সায় দিয়ে বললেন – ঠিক! ঠিক! আজকাল যাকে তাকে দেশদ্রোহী বলে চালান দিচ্ছে। চারু, তুমি ভাই মুখ বুজে থাক।
চারু সম্মত হলেন না - দাদা, তোমাদের আমি গত বিশ বচ্ছর ধরে চিনি। তোমাদেরও একটু প্রাণের কথা বলতে না পারলে বুক যে আমার ফেটে যাবে? কি বল হারুদা ?
থাক ভাই, তোমার আর বুক ফাটিয়ে কাজ নেই। চুপ করে থাকো। টুঁ শব্দটি কোরও না।
চারু আর্তস্বরে বললেন – হারুদা, চুপ করে আর মুখ বুজে থেকে, সব কিছু সয়ে সয়েই তো আমাদের এই হাল! দেশে অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, স্বাস্থ্য নেই, চাকরি নেই আর এদিকে এই সব বাঁধ আর মূর্তি গড়ে নিত্যনতুন তামাশা চলছে! সরকারের মুখে খালি বড় বড় দেশপ্রেমের বাত। এখন শুনছি শিবতরাইদের সঙ্গে যুদ্ধ চালাতে নতুন করে সরকার ট্যাকসো বসাচ্ছে। বাড়ি, বাড়ি সোনাদানার খোঁজ চলছে।
মদন উত্তেজিত হয়ে বললেন – ট্যাক্স তো বসাতেই হবে। রাজকোষে যে টাকা নেই। মোহিত শ্রেষ্ঠী, সরব শ্রেষ্ঠী, অজয় শ্রেষ্ঠীরা তো শুনলাম দেশের সব টাকা ঝেড়ে বিদেশে পালিয়ে গেছে।
হারু সতর্ক, প্রবীণ, প্রাজ্ঞ। অনেক তিনি দেখেছেন, অনেক তিনি শুনেছেন। স্থির কণ্ঠে তিনি বললেন - এ সব কথাবার্তা প্রকাশ্যে বলে তোমরা কি মার খেতে বা ফাটকে আটক হতে চাও?
দাদা, মার তো আমি একলা খাবো না। মার আমাদের সকলের কপালে নাচছে !
এ কথা কেন বলছ চারু ?
দাদা, আপনি নাগরিক পঞ্জির নাম শুনেছেন?
মানে? কী সেটা?
দাদা, আপনি যে উত্তরকূটের আদি বাসিন্দা তার প্রমাণ কী? কোটালের দূত এসে যদি আপনাকে গ্রেপ্তার করে তাহলে কী ভাবে প্রমাণ করবেন যে আপনি শিবতরাইয়ের গদ্দার, অনুপ্রবেশকারী নন ?
বল কি ভাই চারু ? সেরকম প্রমাণ দেখতে চাইছে নাকি ?
অবশ্যই চাইছে দাদা। কোটালের লোক বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুধু ট্যাক্সের নামে
সোনা-দানা টেনে বের করছে তাই নয়, প্রত্যেকের বার্থ সার্টিফিকেটের পর্যন্ত তল্লাশ করছে !
প্রবীণ হারু, নবীন চারুর এই বক্তব্য শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বললেন –
আমার জন্ম রাজা রণজিতের আমলে। তখন তো এ সব বার্থ সার্টিফিকেটের বালাই ছিল না ?
শুধু আপনার নয় দাদা, আপনার বউ, বাচ্চা, ছেলে, মেয়ে, নাতি, পুতি, দাদু,
দিদিমা – সক্কলের বার্থ সার্টিফিকেট দেখতে চাইছে।
আর দেখাতে না পারলে চারু ?
দাদা, তাহলে কোটাল আপনাকে সিধে ঠান্ডি গারদে চালান করে দেবে। আমার চেনা-জানা বেশ কিছু লোককে এর মধ্যেই আটক করেছে। শুধু তাই নয়, পুরনো ঠান্ডি গারদে ছুঁচো গর্ত করে রেখেছিল। সেখান থেকে শুনছি সম্প্রতি কিছু বন্দি পালিয়েছে। তাই নতুন ঠান্ডি গারদ খোলার বন্দোবস্ত হচ্ছে।
হারু অত্যন্ত বিস্মিত এবং রাগান্বিত হয়ে বললেন – উঃ! জ্বালিয়ে খেল! এর
থেকে দেখছি মহারাজ অভিজিতের আমল ঢের ভালো ছিল !
(ক্রমশ)