12/06/2024
যদি ফিরে পেতাম [ শিক্ষণীয় ]
বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় একদিন বাপের বাড়িতে এসে মাকে বললাম, আমি আর সংসার করব না।আজ থেকে এ বাড়িতেই থাকব।
মা শুনে বলল,-অসুবিধে কি আছে আর! তোর বাবার এত বড় বাড়ি, এমনিই তো পড়ে আছে।
তা এসেছিস যখন সব জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে এসেছিস তো?
আমি বললাম,-না। কিছুই তো আনিনি।
-সে কি? এভাবে কেউ খালি হাতে আসে? তা এসেছিস যে, জামাই জানে?
-আমি না বলেই এসেছি।
-জামাইকে বলে আসবি তো! শাশুড়ি মানুষটা খারাপ জানি, জামাই তো ভালো। ওকে না বলে চলে আসাটা ঠিক হয় নি তোর। তুই ফিরে যা। জিনিস পত্র সব গুছিয়ে নিয়ে চলে আয়। সেই সঙ্গে জামাইকেও নিয়ে চলে আয়। শাশুড়িকে জব্দ করতে হলে ছেলেকে ঘরে রেখে এলে হবে না। বর ভালো হলে ঘর ছাড়লেও বরকে কখনো ছাড়তে নেই। ঘর বর দুটোই ছেড়ে দিলে মেয়েদের জীবন থেকে তো সংসারটাই চলে যাওয়া। জামাই তোর কথা ফেলতে পারবে না। বরং জামাইকে নিয়েই তুই এ বাড়িতে থাক।
মায়ের কথা শুনে তো আমি অবাক। মা কখনোই এই সুরে কথা বলেনি। হঠাৎ এই ভাবে কথা বলাতে মা'কে বললাম,-তুমি বলছ এ সব? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না! এত দিন পর তুমি আমার দুঃখটা বুঝতে পারলে মা।
-যতই হোক, তুই আমাদের একমাত্র মেয়ে।শাশুড়ির অত্যাচার কত আর সহ্য করবি বল তো?তোর বাবাও চায় তুই এই বাড়িতে এসে থাক। এক কাজ কর জামাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে চলে আয়। তবেই তোর শাশুড়ি জব্দ হবে।
-ঠিক বলেছো। কিন্তু তোমার জামাই মনে হয় রাজী হবে না।
-সব হবে। কায়দা করে বলবি, দেখবি বরফ গলে জল হয়ে গেছে।
মায়ের কথা শুনে আমি সেদিনই শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গেলাম। বুঝলাম মা যে বুদ্ধিটা দিয়েছে ওটাই প্রয়োগ করতে হবে। জীবনে কি চেয়েছিলাম আর কি হয়ে গেল সেটাই তখন ভাবছিলাম। আমার বিয়ের জন্য যখন দেখাশোনা শুরু করল আমার বাবা, আমি তখন মা'কে বলেছিলাম,-আমি বিয়ে করব না মা, ব্যাচেলর থাকব।
আমার এমন কথা শুনে মা তো হেসে লুটোপুটি।বাবাকে ডেকে বলল,-তোমার গুণধরী মেয়ের কথা শোনো। বলে কি ব্যাচেলর থাকবে? আরে পাগলী মেয়ে, মেয়েরা কখনো ব্যাচেলর থাকে না। ছেলেরা বিয়ে না করলে তাদের ব্যাচেলর বলে।
এদিকে বাবাও হাসছে। বুঝলাম ব্যাচেলর শব্দটা মেয়েদের জন্য নয়। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
-মেয়েরা বিয়ে না করলে তাদের কি বলে?
মা বলল,-অত জানি না। মেয়েদের একটা সংসার দরকার হয়। মেয়েদের বিয়ে দিতে হয়।
বাবা বুঝিয়ে বলল,-শোন মা, বড় হয়েছিস। এবার তো বিয়ের কথা ভাবতে হবে। তোর নিজের একটা সংসার হবে। তোর নিজের একটা ঘর হবে।
বাবাকে বললাম,-নিজের ঘর তো এটাই। বিয়ের পর কি ওখানে নিজের মত করে থাকতে পারব?
-মেয়েরা সব পারে মা। পরকে আপন করার ক্ষমতা আছে মেয়েদের।
-যদি না পারি, আমার মনের মত না হলে আমি কিন্তু চলে আসব আবার। তখন আমাকে জোর করে পাঠাতে পারবে না।
বাবা শুনে বলেছিল,-বেশ। তোর জন্য এই বাড়ির দরজা মুক্ত রইল।
বাবা মায়ের কথা শুনে বুঝেছিলাম, মেয়ে বড় হলে তার বিয়ে দিয়ে হয়, তার একটা সংসার করে দিতে হয়। আমার ইচ্ছে ছিল না বিয়ে করে সংসারী হতে।নিজের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্যের বাড়িতে গিয়ে থাকা, অন্যের বাবা মাকে বাবা মা বলে ডাকা, কেমন যেন একটা বাধ্য জীবন। আমি এমনিতেই বাবা মায়ের আদুরে মেয়ে। তার ওপর স্বাধীন ভাবে থাকতে ভালোবাসি। আমার ওপর কেউ নজরদারি করবে, কারো হুকুমে চলতে হবে এটা ভাবলেই যেন কেমন লাগত। তার পরেও আমার কপালে বিয়েটা লেখা ছিল। তা নাহলে বিয়েটা হয়? অথচ বিয়ের আগে মা বাবাকে আমি বুঝিয়েও পারিনি।অত গুলো দিন পরেও মা বাবা যে আমার সমস্যা বুঝে গিয়েছিল এটাই অনেক।
যাইহোক, মায়ের কথা মত শ্বশুরবাড়িতে ফিরেই শাশুড়ির সাথে তুমুল ঝগড়া করলাম সেদিন।ঝগড়া করতে কারণ লাগে না। কোনো একটা ছুঁতো পেলেই হল। বর অফিস থেকে ফিরতেই যা ঘটল, তার থেকে একটু বাড়িয়েই বললাম। বলতে বলতে কেঁদে ফেললাম। ও শুনে তখন চুপ করে আছে। চুপ করে থাকতে দেখে বললাম,-এ বাড়িতে তোমার মায়ের সাথে ঝগড়া করে কিছুতেই থাকতে পারব না।
ও শুনে বলল,-তাহলে উপায়?
-উপায় আর কি। আমি ভেবেছি আমি আর তুমি আমার বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকব। আর ওখান থেকে তোমার অফিস যেতেও সুবিধা হবে।
আমার কথা শুনে আমার বর বলল,-ঠিকই বলেছো। এত অশান্তির মধ্যে থাকা যায় নাকি? অফিস থেকে ফিরে সেই রোজ রোজ অশান্তি।
এ বাড়িতে থাকলে অশান্তি আরো বাড়বে। তুমি ঠিক ডিসিশন নিয়েছো। আমি তোমার সাথে ওখানে গিয়েই থাকব। অশান্তির থেকে শান্তি ভালো।
বুঝলাম ছেলেও মাকে চিনে নিয়েছে। শাশুড়ির সাথে ঝগড়াঝাঁটি করে পরের দিন বেরিয়ে এলাম।দেখলাম শাশুড়িও বেশ খুশিতেই আছে। নিজের ছেলেও যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে কোনো আক্ষেপ নেই। মনে মনে ভাবছিলাম,মা তো? নাকি পাষাণী? পরে ভাবলাম, হাতে টাকা আছে তো।টাকাই ভুলিয়ে রাখবে। শ্বশুর মশাই ভালো চাকরি করতেন, পেনশনের মোটা টাকা হাতে পাচ্ছেন, তার আবার মায়া মমতা? ছেলেরও মায়ের প্রতি ভালোবাসা নেই। নিজের বাড়ি ছেড়ে বেরোচ্ছে মানে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে। এতদিন মায়ের মুখের ওপর কোনো কথা বলেনি, কিন্তু সেটা কাজে করে দেখিয়ে দিল। কিছু জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে এলাম বাপের বাড়িতে। মনে মনে ভাবলাম, আর তো অশান্তি নেই। এবার থেকে জীবনে শান্তি আর শান্তি।
এক সপ্তাহ বেশ ভালোই কাটল। বাবা বাজার করছে, মাছ মাংস থেকে শুরু করে নানান জিনিস নিয়ে আসছে প্রতিদিন। মা জামাইয়ের জন্য ভোর বেলা উঠে রান্না করছে, টিফিন বানাচ্ছে, রাতের খাবার যে গুলো খেতে ভালোবাসে সে গুলোই মা নিজে হাতে করছে। আমিও সকাল বেলা কোনো দিন ন'টায়, কোনো দিন দশটায় উঠছি। একদম আরামের জীবন। এরকম সুখের জীবনটাই তো চেয়েছিলাম। এই করে আরো পনেরো দিন মত কেটে গেল। এদিকে আমার বরও বেশ দিব্যি আছে, না বাজার দোকান করতে হচ্ছে, না অন্য কোনো কাজ করতে হচ্ছে, কিছুই না। এদিকে মায়ের যেমন কাজ বেড়েছে, তেমনি আমার বাবার খাটুনিও বেড়েছে। ছুটির দিন গুলোতে আমার বর আমার থেকেও বেশি দেরি করে ঘুম থেকে উঠছে।অথচ নিজের বাড়িতে দেখতাম সাত সকালে উঠে সব কাজ করত। ছুটির দিন মানেই কত কাজ ছিল। অথচ এ বাড়িতে এসে এই আয়েশি হয়ে ওঠাটা আমার ঠিক ভালো লাগছিল না। অথচ আমার বাবা মায়ের খাটুনি দেখে খারাপ লাগত।রবিবারের একদিন সকালে প্রচণ্ড চিৎকারে আমার ঘুম ভাঙল। নিচে নেমে গিয়ে দেখি আমার বাবার সাথে বরের কথা কাটাকাটি চলছে। আমার বর দেখি বাবাকে ভীষণ উল্টোপাল্টা কথা বলে অপমান করছে। দেখে তো ভীষণ খারাপ লাগলো।
বরকে বললাম,-তুমি মানুষ না অমানুষ? দেখতে পাচ্ছ একজন বয়স্ক মানুষ। তুমি এভাবে বলছ তোমার লজ্জা করে না?
আমার বর বলল,-তোমার তো বলার কোনো অধিকার নেই এখানে। তুমি যখন আমার মায়ের সাথে এই রকম খারাপ কথা বলতে, আমি তো তোমাকে কখনো কিছুই বলিনি। পরে তোমাকে শান্ত মেজাজে বুঝিয়েছি। তুমি কিন্তু আমার কথা বোঝনি। তাহলে আমাকে তুমি বোঝাচ্ছ কেন?আজ যদি এই টুকুতে তোমার খারাপ লাগে, তাহলে এই চার পাঁচ মাস ধরে আমার মাকে কত খারাপ কথা বলেছো, ভাবো তাহলে আমার কতটা খারাপ লেগেছে? আমি তো তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করিনি, তাই আজ তুমিও এভাবে আমাকে বলতে পারো না।
এই ব্যাপারটার পর থেকে দেখলাম বাবা মায়ের মধ্যে প্রায়ই ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। মায়ের বয়স বাড়ছে। সকাল সকাল উঠে রান্না করাটাও মায়েরও কষ্ট হচ্ছে। নিজেরই খারাপ লাগছিল বেশি। ভাবলাম আমিও সকাল সকাল উঠে মায়ের হাতে হাতে আমিও কাজটা করে দেব। ক'দিন করার চেষ্টা করলাম। দেখলাম আমার কাজ মায়ের ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। মা কথায় কথায় বলতে লাগল, আমার সংসারে কাজ কম্ম আমি যতটা ভালো বুঝি, তুই অতটা বুঝবি না। গভীর ভাবে ভাবলাম এ সংসারটা আমার মায়ের, আমার নয়। মাকে কিছু বললাম না আর। ভুল বুঝতে পারলাম। নিজের মা যদি তার সংসারটা ছেড়ে না দেয়, শাশুড়িই বা সহজে ছেড়ে দেবে কেন?সংসারের দায়িত্ব পেতে গেলে শাশুড়ির কাছ থেকে পাওয়াটাই পরম্পরা। উপলব্ধি করলাম, মায়ের কষ্টটা যতটা সহজে বুঝতে পেরেছিলাম, শাশুড়িকে সেভাবে বুঝতে পারিনি। হয়তো আমাকে অনেক কথা বলেছে, কিন্তু তার থেকেও তো বেশি বলেছি আমি। খারাপ লাগছিল নিজের ভুলের জন্য। ক'দিন পর বরকে বললাম,-এখানে থাকব না। ও বাড়িতেই ফিরে যাব।
বর বলল,-কেন? এখানে তো ভালোই আছি।
-আমি ভালো নেই।
-তাতে কি! আমি তো আছি।
বরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে একদিন সকালে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বেরোব বলে রেডি হয়েছি, দেখলাম আমার মায়ের মুখটা বেশ হাসি হাসি। আমি যে চলে যাচ্ছি তাতে মায়ের কোনো আক্ষেপ নেই।
মা শুধু বলল, আবার আসিস। একটি বারের জন্য আটকালো না। আমি ফিরলাম শ্বশুর বাড়িতে।
আমি ফিরে যাওয়াতে শাশুড়ি দেখলাম দারুণ খুশি। দুপুরে আমার পছন্দ মত রান্না করেছেন।আমি যেটা ভালোবাসি সেটাই রেঁধেছেন। আলু পোস্ত, মুসুর ডাল, বেগুন ভাজা আর আমের চাটনি। কি তৃপ্তি করে খেলাম। খাওয়ার পর শাশুড়ি আমার পাশে এসে বললেন,
-এটা সংসার। এখানে এভাবেই যুদ্ধ করে থাকতে হয়। তরকারির কোনোটাতে ঝাল বেশি হবে, কোনোটাতে কম ঝালেও ভালো লাগে। তাই বলে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলে হবে? ঝগড়া তো হবেই।ঝগড়া করো সংসারে থেকেই। সংসার থেকে বেরিয়ে গেলে যেখানেই যাও দুদিনের জন্য সেখানে ভালো লাগবে। কিন্তু তোমাকে কেউ সংসার দেবে না। মেয়েদের নিজের একটা সংসার লাগে। সেই সংসারটা তুমি এখানেই পাবে, আমি যেমনটা পেয়েছি আমার শাশুড়ির থেকে। বৌমাদের পছন্দের মানুষ শাশুড়ি কখনো হয় না। আর শাশুড়ির পছন্দের মানুষ বৌমা কখনো হবে না। খুব কম মানুষই আছে দুজনের পছন্দে দুজন আছে। এই লড়াই চলে আসছেই সেই কোন কাল থেকেই। কোথাও কম, কোথাও বেশি। তারপরেও থাকতে হবে, সংসার করতে হবে। ঘটি বাটি পাশাপাশি থাকলে ঠোকাঠুকি তো হবেই। তাই বলে বেরিয়ে যেও না। এটাই জীবন। টোনা টুনির সংসারে শাশুড়ির মত চড়ুই পাখি একটা লাগে।তবেই না সংসার? ভালো আর মন্দ দুই মিলেই জীবন।
তারপর থেকে তিরিশ বছর কাটিয়ে ফেলেছি।নিজের একটা সংসার হয়েছে। শাশুড়ির সাথে ঝগড়া করেছি। হয়তো দুদিন কথাও বলি নি। তবে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যাইনি। আজ পাঁচ বছর হলো শাশুড়ি নেই। ভীষণ মিস করি শাশুড়ি নামক প্রতিদ্বন্দ্বীকে। আজ খেলার মাঠ পুরো ফাঁকা।ভালো লাগে না এই ফাঁকা মাঠে গোল দিতে।জীবনটা ফুটবল খেলার মত। সংসার হল বড় মাঠ।প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে গোল দিয়ে কি মজা? অত বড়ো বাড়িটায় আমি একাই খেলছি। এ খেলাটা ঠিক জমছে না আর। কারণ জমানোর মানুষটাই তো নেই। মানুষটা ঝগড়া করত। শাসন করত।মাঝে মধ্যে রণ চণ্ডীর মূর্তি ধরে বাড়ি মাথায় করত।কিন্তু আমার অসুখ বিসুখ করুক, জ্বর সর্দি হোক, তুলসী পাতার রস, বাসক পাতার পাচক, জ্বরে মুখ খারাপ হয়ে গেলে পলতা পাতার বড়া, এগুলো মুখের কাছে ধরত ওই মানুষটাই। আমার জ্বর হলে মাঝ রাতে উঠে এসে দরজায় কড়া নেড়ে ছেলেকে বলত, মিটারটা দিয়ে দেখ। জ্বরটা আর আছে কিনা? আমার শরীর খারাপ দেখলে ছেলেকে বলত, রোজ রোজ কিসের অফিস। কামাই কর একদিন। তোর বৌ তুই না দেখলে কে দেখবে?
আজ এত গুলো বছর পরেও পুরো বাড়িটাই আমার নিজের, পুরো সংসারটাই আমার নিজের।কিন্তু মন খারাপের একরাশ দুঃখ বুকের মধ্যে জমেছে। যার থাকাটা মাঝে মধ্যে অস্বস্তি লাগত, তার না থাকাটা কিছুতেই স্বস্তি দিচ্ছে না। আমরা মেয়েরা বাবার বাড়িতে যতটা অধীনে থাকি, তার থেকে বেশি মুক্ত থাকি নিজের সংসারে। শাশুড়ি মারা যাওয়ার আগে আমার মা চলে গেল পরপারে। তারপরে একদিন শাশুড়িও মায়া কাটিয়ে চলে গেল। শাশুড়ির বেশ কিছু গয়না, মারা যাওয়ার বছর তিনেক আগে আমাকে দিয়ে গেল। বলল, এগুলো সব তোমার। এই সীতা হারটা শুধু দুলকিকে দিও। দুলকি মানে আমার একমাত্র মেয়ে। আমার মেয়েরও বিয়ের ঠিক হয়েছে।সামনের ফাল্গুনে ওর বিয়ে। সেদিন সীতা হারটা বের করতে গিয়ে শাশুড়ির কাপড় জামা রাখার যে বাক্সটা ছিল ওটা খুলেছিলাম। আমাকে দেওয়া গয়না গুলো ওতেই আছে। গয়নার বাক্স বের করতে বাক্সের এক কোণে সযত্নে রাখা একটি চিঠি। চিঠিটা লিখেছে আমার মা আমার শাশুড়িকে। তখন তো আর মোবাইল ছিল না।চিঠিটা পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করলাম তিরিশ বছর আগের একটি সত্যকে। মনের মধ্যে যা ছিল আবছা এক লহমায় সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল।
আমার মা লিখেছে,
প্রিয় দিদি,
মেয়ে আমার বাড়িতে পৌঁচেছে। তোমার কথা মত কাজ শুরু করে দিয়েছি। কথা দিচ্ছি এক মাসের মধ্যেই তোমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে পারব।বুঝতেই তো পারছো মেয়ে আমার উড়নচণ্ডী। এই উড়নচণ্ডী মেয়েকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। তোমার কথা মতই আমি ওকে বলেছি ওই বাড়ি ছেড়ে চলে এসে এখানে থাক। যেমনটি বলেছো ঠিক তেমনটিই করছি সব। ভয় হয় খুব, ওই মেয়ে কি করে সংসার করবে। তবে তুমি যখন আছো চিন্তা নেই। শ্বশুরবাড়িটা মেয়েদের বড় সম্মানের জায়গা।আমি চাই ওর একটা নিজের সংসার হোক। আর যাই হোক বাপের বাড়িতে মেয়েরা দিনের পর দিন থাকলেও মেয়েদের সংসারটা কিন্তু ওখানে হয় না।
মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই তিরিশ বছর আগে মায়ের কথা গুলো। মা যখন বলেছিল, সব ছেড়ে চলে আসতে, অবাক হলেও মায়ের ওই কথা গুলোর মধ্যে যে নিপুণ কৌশল ছিল, আমি সেদিন ধরতেই পারিনি। ধরতে পারিনি আমার বরের নিপুণ অভিনয়ও। ভেবেছিলাম মা আমাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।আমার ধারণাটাই ভুল ছিল। শ্বশুর বাড়ি থেকে যখন চলে এসেছিলাম তখন শাশুড়িমাকে দেখেছিলাম মুচকি মুচকি হাসতে, আবার শ্বশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে যখন ফিরছিলাম তখন মায়ের মুখেও ছিল হাসি। চিঠি পড়তে পড়তে বুঝতে পারছিলাম হাসির কারণটাও। শাশুড়ি মায়ের বুদ্ধির তারিফ না করে থাকতে পারছিলাম না তখন। সত্যিই তো ওই কৌশল প্রযোগ না করলে এমন সুন্দর করে সংসারটাও যে হত না আমার।এই দুই মা আমাকে উপহার দিয়ে গেছে নিজের একটা সংসার। শুধু মনের মধ্যে রয়ে গেছে এই দুই মায়ের জন্য শূন্যতা, একটা আক্ষেপ, যদি আবার ফিরে পেতাম।