28/02/2024
পরিচয়
*********
সকালবেলা চোখ খুলতে না খুলতেই কাজের এক অলিখিত ফর্দ সামনে এসে দাঁড়ায়
দু বছরের ছেলে আর স্বামী তখন ঘুমে কাদা
ঘড়িতে বাজছে পাঁচটার এর্লাম..
পাশের ঘর থেকে আসছে শ্বশুরের নাক ডাকার আওয়াজ
আরো একটু চোখটা বুজে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিলো অহনার..না না এরপর শুয়ে থাকলে অনেক দেরী হয়ে যাবে.
বাসি জামাকাপড় ছেড়ে রান্নাঘরে ঢুকতে হবে এটাই নাকি নিয়ম , ছেলেটার জন্য দুধ গরম করে ওকে ঘুমের মধ্যেই খাওয়াতে হয় অহনাকে, না হলে সাত সকালে খিদের চোটে উঠে পড়লে সকলের ঘুম ভাঙালে আর রক্ষে নেই, যা দুষ্টু হয়েছে !তারপর দোতলার জানলা দিয়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে দেয় খবরের কাগজ আর দুধের জন্য, তারপর চা করা বাড়ির সবাইকে ডেকে তোলা,অসুস্থ শাশুড়ির সেবা মানে ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া ওষুধ দেওয়া..এসব করতে করতেই বাজে আটটা তারপর আবার নীলের অফিসের তাড়া, ছেলের বায়নাক্কা , রান্না সবই একা হাতে সামলায় অহনা, ঠিকে কাজের লোক অবশ্য একজন আছে, তবু কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যায় নিজেও বুঝতে পারে না৷ নিজের দিকে তাকানোর অবকাশ আর হয় না তার আর ইচ্ছেটাও আস্তে আস্তে কমে আসছে৷
তাও নীল প্রায়ই বলে সারাদিন করটা কি? একটু সেজেগুজে থাকতে পারো না, দেখে মনে হয় ঘরের কাজের লোক, অথচ ঘরে তো কিছূ অভাব নেই৷
এখন সন্ধ্যে সাতটা, নীল অফিস থেকে ফিরে ল্যাপটপ খুলে বসে পড়েছে, অহনা ছেলেকে খাওয়াতে খাওয়াতে বকবক করছে নীল যেন শুনেও শুনছে না, খুব কান্না পাচ্ছে অহনার ,সারাদিন সবকিছু সামালোনোর পর নীলের ভালোবাসাও যেন ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে! সংসারের সব দায়ভার যেন অহনার! কথায় কথায় শুধু একটাই কথা সারাদিন করটা কি! খাও দাও আর ঘুম ছাড়া আর কোন কাজই তো থাকে না একজন হাউস ওয়াইফের!
আগের কথা খুব বেশী করে মনে পড়ছে অহনার৷কতদিন রবিঠাকুরের কবিতা পড়েনা অহনা৷ কত ভালো আবৃত্তি করতো, লেখালিখি করতো সব এখন অতীত৷
ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে পড়তে ওদের দুজনের বন্ধুত্ব,পড়াশুনায় তুখোড় ছিলো অহনা আর যথেষ্ট সুন্দরীও৷ তারপর একসময় ওরা বুঝতে পারে কখন দুজন দুজনের মন জুড়ে বসেছে, তারপরে পাশ করার পর দুজনেই ভালো চাকরী পায়, অহনা খুব মেধাবী ছাত্রী ছিলো, নীলের থেকে ওর চাকরীটাও ছিলো মোটা মাইনের..দুবাড়ির সম্মতিতেই বেশ ধূমধাম করে ওদের বিয়ে হয়৷
তার কিছুদিন পরেই নীলের মা অসুস্থ হয়ে পড়ে, একটা মেজর হার্ট অ্যাটার্ক৷ নীল অহনাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে তুমি চাকরীটা ছেড়ে দাও অনা, আমার মা কে কি করে আয়ার কাছে রেখে যাবো, তাছাড়া আমি যা রোজগার করি, তাতে তো ভালোই চলে যায়, আমি তো তোমার পাশে আছি সবসময়, পরে না হয় মা সুস্থ হলে..আর তাছাড়া বাবার শরীরটাও ঠিক থাকে না, মা বাবাকে কার ভরসায় রাখি বলো,
অহনা নীলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলো আমি আছি তো, দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে
সত্যি ঠিক কি আর কিছু হয়, এরপর একবছর পর সে অন্তঃসত্ত্বা হয়, এবং কোল আলো করে জন্ম নেয় ওর স্বপ্ন ওর সন্তান,
প্রথমে প্রেমিকা, তারপর নীলের স্ত্রী তারপর বিট্টুর মা, আসতে অহনা পরিচয়ের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যেতে থাকে৷ ততদিনে সে পুরোদস্তুর গিন্নী হয়ে উঠেছে৷
শাশুড়ি আগের থেকে অনেকটা সুস্থ, ছেলেও তো দেখতে দেখতে বছর দুয়েকের হলো,
তবে অহনা পাল্টে যাচ্ছে ক্রমশঃ, যে অহনা ঘন্টার পর ঘন্টা রূপচর্চায় ব্যস্ত থাকতো, বইপড়া, আড্ডায় জমিয়ে রাখতো প্রিয়জনদের, আজ সে আয়নার সামনে দাঁড়ায় না, গান শোনে না, ঝগড়া করে না,স্বপ্ন দেখে না শুধু কর্তব্য করে চলে নিষ্ঠার সাথে৷ কারণ সে যে গৃহবধূ, সে নারী৷ এযেন নারীর সাথে পুরুষের এক অলিখিত চুক্তি মানিয়ে নিতে হয়, প্রয়োজনে তুমি মা হবে, আবার কখনো হবে ঘরের বৌমা, আবার স্বামীর কাছে হবে আদুরে প্রেমিকা, তোমাকে হতেই হবে, ইচ্ছে অনিচ্ছের দায়ভার থেকে কবেই তোমাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে৷
অহনার মাতো সবসময় বলেন, ওরা যখন চাইছে না তখন কি দরকার বল চাকরি করার, তোর অভাব তো নেই কিছু৷
অহনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে পুরোটাই যে অভাব মা৷ আমি মেয়ে বলে, ওদের সংসারের বৌ বলে আমার নিজের পরিচয়টাই যে ওরা মুছে দিচ্ছে , নীলও তো চাকরীটা ছাড়তে পারতো ..
অহনার মা বলেন মাথা ঠান্ডা করতো, সংসারের জন্য মেয়েরা কতকিছু করে।
দেখতে দেখতে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর৷
অহনা গাড়ী ড্রাইভ করতে করতে ভাবছিলো পুরোনো কথা, আজ সে অহনা, শুধুই অহনা! নীলের সাথে ডিভোর্স হয়েছে বেশ কিছু বছর যদিও শাশুড়ি মারা যাবার পর সে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলো! কারণ সে বুঝেছিলো নীল তাকে কোনদিন চাকরী করতে দেবে না! একটা মেয়ে তার থেকে এগিয়ে যাবে এটাই তার ইগোতে বাঁধছিলো বাকীটা পুরোটাই অজুহাত!
ছেলে ও এখন বেশ বড়,সেও ইঞ্জিনীয়ার, ছেলে মা মিলে একটা ফার্ম ও খুলেছে!
বেশ ভালোই আছে তারা নিজের পরিচয়ে৷
ঝাপসা চশমাটা একবার মুছে নিয়ে সেই প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতটা চালালেন " ভালোবেসে সখী নীরবে নিভৃতে ..আমার নামটি লিখো"
অহনা,হ্যাঁ শুধুই অহনা তার আজ কোন পদবীর দরকার নেই৷