06/10/2021
|| অথ মহালয়া-কথা ||
আজ পিতৃপুরুষকে তর্পণ করার দিন, সকলের পিতৃপুরুষকে আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি ও ভারাক্রান্ত প্রণাম!
আজ কোনো শুভ অনুষ্ঠানের দিন নয়, আজ স্বর্গত পিতৃপুরুষদের শ্রাদ্ধকর্ম সম্পন্ন হয়, আজ শোক উদযাপনের দিন।
আজকের দিনটি পিতৃপুরুষকুলকে "মহৎ আলয়" প্রদান করার দিন নিজের তর্পণ এর জোরে!
শ্রাদ্ধকর্মের দিনকে শুভ বলতে নেই, তা অশৌচ কর্ম সম্পন্ন করার দিন।
দেবীর মর্ত্যে আগমন আজ নয়, ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যে বেলা মা আসেন পুত্র কন্যা সহ, বেলতলায় এসে মহাদেব রেখে যান। তাই ওইদিন বেলতলায় অর্থাৎ বেল গাছের নিচে ধুপ ধুনো দিয়ে মাকে বরণ করা হয়।
মহালয়া আগমনীর শুভ শুরু নয়, তিরোহিত পিতৃপুরুষকুলকে, চোখের জলে স্মরণ করে তাদেরকে স্বর্গে জল ও অন্ন দেবার দিন।
কথিত আছে দানবীর কর্ন যখন মৃত্যুর পরে স্বর্গে যান, ওনাকে খাদ্য হিসেবে সোনা, রত্ন, বস্ত্র এসব দেওয়া হয়। উনি যখন এর কারণ জানতে চান, ওনাকে জানানো হয়, মর্ত্যে থাকতে উনি যা দান করেছেন, স্বর্গে এসে সেটাই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, যেহেতু উনি কোনোদিন খাদ্য-জল দান করেন নি এবং পিতৃকুলকেও জল দেননি তাই ওনাকে এইসবই দেওয়া হবে ।
তখন কর্ন জানান, উনি মৃত্যুর মাত্র একদিন আগে জানতে পারেন নিজের পিতৃকুল-পরিচয়, তাই পিতৃপুরুষকুলকে তর্পণ করার সময় পাননি।
ওনার কথার সত্যতা স্বীকার করে যমরাজ কর্নকে বলেন, দেবীপক্ষ শুরু হওয়ার আগেই তুমি গিয়ে তর্পণ করে এসো, তবেই তুমি ও তোমার পিতৃপুরুষকুল জল পাবে।
কর্ন তাই এইদিন স্বর্গ থেকে এসে তর্পণ করে যান, এবং তাই এই দিনটি মৃত পিতৃপুরুষকূলের প্রতি তর্পণের জন্য খ্যাত।
এটি কোনও শুভ ঘটনাবহ দিন নয়।
'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠানটি বেতারে এই দিনই সম্প্রচারিত হয়, তাই অনেকে দেবী দুর্গার আগমনের দিন হিসেবে ভুল করেন। দেবীপক্ষ আজ নয়, আগামী কাল থেকে শুরু, আজ পিতৃপক্ষের অবসান।
শ্রোতাদের চাহিদা পূরণে সেই সময় ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার সম্পাদক সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী আইডিয়া দিলেন শ্রীশ্রীচণ্ডীর কাহিনীভিত্তিক শ্লোক ও গান সংকলন ও রচনা করে এবং নতুন আঙ্গিকে একটি প্রভাতী অনুষ্ঠান করার। পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রীর সহায়তায় ১৯৩২-এ শ্রীশ্রীমার্কণ্ডেয় চণ্ডীর বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে একটি চম্পূ* রচনা করলেন বাণীকুমার। ওই বছরেই চৈত্রের শুক্লা অষ্টমীর প্রভাতে বাসন্তী ও অন্নপূর্ণা পুজোর সন্ধিক্ষণে তা সম্প্রচারিত হয়। রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গীত পরিচালনা, বাণীকুমারের কতিপয় শ্রীশ্রীচণ্ডীর শ্লোক আবৃত্তি, হরিশচন্দ্র বালীর সুর-সর্জনে রাগ বসন্ত, দেশী, দেবগিরি, বরাটী, তোড়ী, ললিত ও হিন্দোলীর সঙ্গে বাণী সংযোগে অন্যান্য গানে পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুর, নাট্যকথাসূত্র ও গীতাংশে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অংশগ্রহণ এই অনুষ্ঠানকে বিপুল জনপ্রিয় করে তোলে। এই জনচিত্তজয়ী ‘বসন্তেশ্বরী’ই মহিষাসুরমর্দিনীর উৎস। সংস্কৃত রূপকের অন্তর্গত ‘বীথী’ (oratorio) নাট্য রচনাশৈলীর অনুসরণে মহিষাসুরবধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাণীকুমার রচিত নতুন গীতি-আলেখ্য প্রচারিত হয় আশ্বিন ১৩৩৯ (১৯৩২) দেবীপক্ষের মহাষষ্ঠীর প্রভাতে। তখনও তা ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নামে প্রচারিত হয়নি।
এর পর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং কোনও বছর ষষ্ঠীর দিন আবার কোনও বছর মহালয়ার দিন এই ভাবে এই ‘প্রত্যুষ প্রোগ্রাম’ (বেতার জগতে এই শিরোনামই উল্লেখিত) প্রচারিত হতে থাকে। সম্ভবত ১৯৩৬-এ এসে অনুষ্ঠানটি পরিপূর্ণতা পায়।
মহিষাসুরমর্দিনী হল আকাশবাণী থেকে সম্প্রচারিত একটি জনপ্রিয় বাংলা প্রভাতী বেতার অনুষ্ঠান। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানটি প্রতিবছর মহালয়ার দিন সম্প্রচারিত হয়ে আসছে, যা ভারতের বেতার ইতিহাসে দীর্ঘতমকাল ধরে সম্প্রচারিত একটি স্থায়ী বেতার অনুষ্ঠান।
এটির জনপ্রিয়তা এতই যে এটি আজ ও সম্প্রচারিত হয়, এবং আজীবন এটা না শুনলে আপামর বাঙালির হৃদয়ের একটা বিশাল অংশ ফাঁকা হয়ে যায়।
তবে এটির সাথে আজকের পিতৃপক্ষের অবসান দিবসের কোনও ধর্মীয় যোগাযোগ নেই।
ঋণ স্বীকার:
• মহিষাসুরমর্দিনী বেতার অনুষ্ঠান
• Wikipedia
*[চম্পূ (বিশেষ্য পদ) - গদ্য-পদ্যময় কাব্যগ্রন্থ]
© অস্মিতা দাস ভাদুড়ী
(কিশলয় এবং অস্মিতা দাস ভাদুড়ী কর্তৃক সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত, লেখাটি কোথাও ব্যবহারের জন্য লেখিকার নাম ব্যবহার আবশ্যক)