07/01/2024
শীতের মরশুমে কলকাতা থেকে মাত্র একশো কিলোমিটার দূরে টেরাকোটা মন্দির, পুরোনো রাজবাড়ী, ঠাকুর দালান, দেউল ও দামোদর নদ দেখে দুর্দান্ত বাঙালি খাবার খেয়ে একদিনেই ঘুরে আসবেন চলুন Wayfarers’ foodprint এর সাথে গুরাপ - দশঘরা - সাত দেউল
https://yt.openinapp.link/42hm8
24শে ডিসেম্বর ক্রিসমাস ইভের আমেজে সকাল 8টা নাগাদ বেড়িয়ে পড়লাম কলকাতা থেকে 80কিলোমিটার দূরে গুরাপের উদ্যেশ্যে। (চাইলে হাওড়া বর্ধমান কর্ড লোকাল ধরে গুরাপ থেকে অটো বা গাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে পারেন।) তবে আমরা তো রোড ট্রিপ ভালোবাসি তাই কলকাতা থেকে গাড়িতেই বেড়িয়ে পড়লাম। সিক্স লেনের কাজ চলায় দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে ডাইভার্সনে ভরা হলেও রাস্তা বেশ মসৃন আর গড় গতিবেগ ও ভালোই ছিলো। ঘন্টা দুয়েক সময়ে পৌঁছে গেলাম গুরাপ। আমাদের ব্রেকফাস্ট স্টপ হিন্দুস্তান ধাবা। এখানের কচুরি আমাদের বড্ড প্রিয়। এখন শীতকালে পেলাম গরম গরম করাইশুঁটির কচুরি সাথে কাজু কিসমিস দেওয়া তরকারি ও মসলা ধোসা খেয়ে হাইওয়ে ছেড়ে গুরাপ স্টেশনের দিকে ঢুকলাম। প্রথম গন্তব্য ছিলো নন্দদুলাল জিউ মন্দির।
মূল মন্দিরের পাঁচিলের বাইরে একটি রথ ও আরেকটি ছোট্ট মন্দিরও রয়েছে। মন্দিরটি ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান রাজের অমাত্য রামদেব নাগ প্রতিষ্ঠা করেন। আটচালা টেরাকোটার এই মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির অন্যতম। ২৭৫ বছরের পুরনো এই মন্দিরের অপূর্ব সুন্দর কারুকাজ কিছুটা নষ্ট হয়ে গেলেও ভালোমতো সংরক্ষন করায় তার বেশিরভাগই মন্দির দেওয়ালে অবশিষ্ট রয়েছে। খিলানের দুপাশে বারোটি করে মোট চব্বিশটি শিবমন্দিরের টেরাকোটার কাজ রয়েছে, এছাড়াও রয়েছে রাজা, নর্তকী ও দেবী সরস্বতী সহ প্রচুর দেবদেবী, সাপ, পাখিদের সূক্ষ্ম কারুকাজ।
মূল মন্দিরে রাধা কৃষ্ণের নিয়মিত পূজা হয়, সামনেই রয়েছে নাট মন্দির, রবিবার সকালে সেখানে আঁকার ক্লাস চলছিল।
এছাড়াও পাশেই রয়েছে আরো শিব মন্দির, সেখানে খুবই সামান্য নিদর্শন রয়েছে। গুরাপের এই মন্দিরের অদূরেই আছে গনিতজ্ঞ কেশব চন্দ্র নাগের বাড়ি, সেটাও চাইলে দেখতে পারেন, তবে আমরা এগিয়ে গেলাম দশঘরা ঘুরতে।
সুন্দর তারকেশ্বর গুরাপ রোড ধরে দশঘরায় প্রথমেই এলাম বিশ্বাসদের জমিদার বাড়ি। উড়িষ্যার জগমোহন বিশ্বাস, তাঁর হাত ধরেই হুগলী জেলার দশঘড়ায় জমিদারবাড়ি বা বিশ্বাস বাড়ি গড়ে ওঠে।
দশঘড়া বিশ্বাস বাড়ির দেবীতে দুর্গাপূজায় উড়িষ্যার জয়দুর্গা মূর্তির আদলে নির্মিত চতুর্ভূজা
দুর্গা মায়ের পুজো হয়, যার চার হাতে থাকে তরোয়াল, ঢাল, সাপ ও খোঁচ। মায়ের দেবী মূর্তির কাছে থাকে কার্তিক-গণেশ এবং লক্ষ্মী-সরস্বতী থাকে একটু দূরে। বিশ্বাস বাড়িতে মহালয়ার পরের দিন দেবীর বোধন হয় এবং ষষ্ঠীর দিন থেকে শুরু হয় মূর্তিপুজা। সপ্তমী অষ্টমী সন্ধিক্ষণে হয় পাঠা বলি আর এরসঙ্গে ছাঁচি কুমড়ো, লেবু, আখ বলি দেওয়ার প্রথা এই বাড়িতে রয়েছে।
দেবী মা শাক্ত মতে এখানে পূজিত হন।
এই বাড়িতে পুজোর সময় ছাড়া ঢোকা যায়না।
তবে পিছনের সরু রাস্তা দিয়ে বিশ্বাস বাড়ির কুলদেবতা গোপীনাথ জিউর এবং রাধারানীর মন্দির দেখা যায়। যেখানে টেরাকোটার কাজ দেখতে পাওয়া যায় এবং প্রতিবছর দোল পূর্ণিমার দিন রাধাকৃষ্ণ এখানে পূজিত হন। দোল মঞ্চের পাশেই রয়েছে রাসমঞ্চ যেখানে কার্তিক পূর্ণিমায় রাধাকৃষ্ণের পুজো করা হয়।
যে কারণে এই বিশ্বাস পরিবারের পুজো এত জনপ্রিয় সেই বলির বিশেষত্ব হল বলির সময় তাঁদের কুলদেবতা গোপীনাথ জিউর ও রাধারানীকে কানে তুলো দিয়ে শয়নে রাখা হয়। কারণ এই বলির আর্তনাদ নাকি বিশ্বাস পরিবারের কুলদেবতা সহ্যকরতে পারেন না। কাছারি বাড়ির পাশে রয়েছে আটচালা শিবমন্দির। প্রতিটি মন্দিরের গায়ে অসম্ভব সুন্দর টেরাকোটার কাজ দেখতে পাওয়া যায়।
রায়বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা শ্রী বিপিন কৃষ্ণ রায়। বিপিনবাবু কর্মসূত্রে কলকাতা বন্দরে যুক্ত ছিলেন। এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রভূত ধন সম্পত্তির মালিক হন এবং এই বিশাল বাড়ির প্রতিষ্ঠা করেন। রায়পাড়া ঢুকতেই চোখে পড়বে বিশাল তোরণদ্বার।
দ্বারের বাম দিকে একটি অষ্টভুজাকৃতি ঘড়িঘর। ওপরে বিদেশি মূর্তি সহ চারদিকে চারটি বিশাল লোহার ঘড়ি এবং বাকি চারটি দেওয়ালে সেই আমলের চারটি খড়খড়ি দেওয়া জানালা। কোলকাতার ঘড়ি নির্মাতা J. M Dass এই বিশাল ঘড়িটির নির্মাণ করেন, যার ঢং ঢং আওয়াজ কিছু বছর আগেও প্রায় 4-5 কিলোমিটার দূরথেকেও শোনা যেত। তোরণদ্বার পেরিয়ে সরু পথ দিয়ে একটু এগিয়েই দেখবেন রাস মঞ্চ ও চাতাল। এর পরেই এক চমৎকার দ্বিতল বাড়ি। বাড়ির ভিতরেই দুর্গামন্দির। সামনে প্রকাণ্ড ঝিল। এই বাড়িতে হয়েছে একাধিক বাংলা সিনেমার শুটিং। তারমধ্যে অন্যতম হলো হীরের আংটি, বাড়িওয়ালী ও বাঞ্ছারামের বাগান। তবে এখানেও পুজোর সময় ছাড়া ভিতরে ঢোকা যায়না। তাই বাইরে থেকেই দেখে ফিরে চললাম।
এই পাশেই আছে হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেট বার্ডলি বার্টের বাংলো, ভগ্নপ্রায় বাড়ির ফলকে প্রতিষ্ঠাতা বিপিন কৃষ্ণ রায়ের নাম লেখা।, সামনে একটা পুকুর ও আছে, তবে এখন সম্ভবত স্থানীয় লোকজন থাকেন এখানে।
দশঘরা থেকে সুন্দর রাস্তা দিয়ে এলাম চকদিঘী জমিদার বাড়ি। সিংহ রায় বাড়ির ইতিহাস আমরা সেভাবে জানতে পারলে ও সুদৃশ্য বাড়ি আর সামনের তারকার ন্যায় ফোয়ারা দেখে তাক লেগে যায়। যদিও এখন রক্ষণাবেক্ষণের অভাব স্পষ্ট। ব্রিটিশ বড়লাট লর্ড কার্জন ও অনেকবার এসেছিলেন এখানে, সিংহরায় পরিবারের সাথে পরিচয় ঘনিষ্ঠ থাকার জন্য।
এই অংশে পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়, সিংহ রয় পরিবারের সাথে লাইব্রেরী ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, তবে এখন সবই নষ্ট হয়ে গেছে। বাড়ির পিছনে দুর্গা দালান ও আছে, এখানে এখনো পুজো হয়। শুনেছি বাইরে এরকম হলেও, ভিতরে বেলজিয়াম কাঁচে সাজানো এই বাড়িতে এখনো নিয়মিত সিনেমা ও সিরিয়ালের শুটিং হয়। এখানে সত্যজিৎ রায়ের ঘরে বাইরের শ্যুটিং হয়েছিল, সম্প্রতি দেবের গোলন্দাজ সহ অনেক শুটিং হয়েছে। এর পরে এগিয়ে গেলাম জামালপুরের দিকে। পাশ দিয়েই বয়ে গেছে দামোদর নদ, তাই আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে গ্রামের মধ্যে দিয়ে এলাম নদের বাঁধের ওপরে, এই গাছের ছায়াতে আলো আঁধারীর নদের রূপ অনেকদিন মনে থাকবে। নদের বুকে প্রচুর পাখি ভেসে বেড়াচ্ছে। কিছু মাছ ধরার নৌকা ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাঁশের সাঁকো দিয়ে মানুষ পারাপার করছে। এই জায়গা আমাদের এতই পছন্দ হল, যে অনেকটা সময় এখানেই বসে থাকলাম। চাইলে সূর্যাস্তের সময় এখানে আসতে পারেন, বা একটু এগিয়ে বেগর মুখে যেতে পারেন। তবে আমরা ফিরে চললাম হাইওয়ে, এবার দেখবো সাত দেউল।
NH2 পেরিয়ে এলাম আঝাপুরের সাত দেউল। কথিত প্রায় ১০০০বছর আগে পাল যুগের রাজা শালিবাহন এই অঞ্চলে সাতটি জৈন মন্দির বা দেউল নির্মাণ করেন। দেউল শব্দের অর্থ দেবালয়, ৬০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝে বাংলার পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও বর্ধমান এলাকায় জৈন ধর্মে অপরিসীম প্রভাবে এই দেউলগুলো গড়ে ওঠে। যদিও তার বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। উড়িষ্যার রেখা দেউল স্থাপত্য শৈলীর অনুপ্রেরণায় প্রাচীন বাংলার জৈন কৃষ্টির এই অমূল্য সম্পদ আজ বয়সের ভারে জরাজীর্ণ।
Asi সংরক্ষিত এই মন্দিরটির ভিত পঞ্চ রত্ন আলেখ্যতে তৈরি, এর বিশেষত্ব হলো চারদিকে বিশাল বাঁকানো সুউচ্চ টাওয়ার ও মাঝের প্রবেশদ্বারে ধনুকাকৃতি গেট। প্রবেশদ্বারের উপরে বাইরের দেওয়ালে সুন্দর কারুকাজ করা চৈতন্য জানলা। যদিও এখন এই ভিতরে কোনো বিগ্রহ নেই।
আমরা পড়ন্ত বিকেলে ছবি তুলে আজকের ঘোরাঘুরি শেষ করে এবার চললাম লাঞ্চ করতে। এই রাস্তায় বেশ কয়েকটি ভালো রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা তার অনেকগুলোতেই খেয়েছি। আজকে যাবো নতুন একটা জায়গায়, হাইওয়ের পাশেই ফুড এক্সপ্রেসের সর্ষে পোস্ততে। অনেকদিন ধরে নাম শুনেই আসা সুন্দর সাজানো এই রেস্টুরেন্টে। মেনু কার্ডে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে অর্ডার দিলাম।এখানে নানারকমের থালি ছাড়াও ala carte মেনু আছে। অনেক রকমের মাছ যেমন ইলিশ, গলদা চিংড়ি, পাবদা থেকে আমরা ভেটকি পাতুরি আর পমফ্রেট সর্ষে নিলাম আর ভেজ মিল। খাবার আসার আগে গন্ধরাজ ঘোল খেয়ে ঘোরাঘুরির ক্লান্তি কেটে গেল।সেদিন ভেজ মিলে ছিল বাসমতি চালের সুন্দর ভাত, ঝুরঝুরে আলুভাজা, গন্ধরাজ লেবু, স্যুক্ত, মুগের ডাল, আলু পোস্ত, চাটনি, পাঁপড় ও স্যালাড। এ বলে আমায় দেখে ও বলে আমায়, যেমন ভালো সুক্ত আরো ভালো ডাল আর আলু পোস্ত। এর সাথে এলো প্রমাণ আকারের মাছ। মশলাদার পাতুরি মুখে লেগে থাকবে, খুবই দারুন স্বাদ ও গুনমান, পমফ্রেট তাও কোনো অংশে কম নয় একদম তাজা মাছের রান্নাটাও জম্পেশ হয়েছে। হাইওয়েতে এত ভালো বাঙালি খাবার বিরল।
তারপরে ইচ্ছে ছিল আরো কিছু ঘুরতে যাওয়ার তবে আলো পরে আসায় ফিরে এলাম কলকাতায়।
আবার নাহয় একদিনের ট্রিপের খোঁজ নিয়ে wayfarers ফুডপ্রিন্ট ফিরে আসবে। পাশে থাকবেন আর ভালো লাগলে সাবস্ক্রাইব করতে ভুলবেন না।
https://yt.openinapp.link/42hm8