17/04/2022
দরিদ্র, অভাবী এবং অনাহারীদের অবস্থা বুঝার সাথে রোজার কোন সম্পর্ক নেই। যদি তাই হতো তাহলে গরীব মিসকিনদের উপর রোজা ফরজ করা হতো না। রোজার মধ্যে দরিদ্রদের সাথে সমতা বা সাদৃশ্য খুঁজে কোন লাভ নেই তোমার। ইফতার ও সেহরীতে তুমি দরিদ্র ও অভুক্তদের মত কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখাটাই মূল বিষয়। এটা একটি তুর্কী প্রবাদ
ইবনু উমার রাঃ থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামনে ঢেকুর তুললে তিনি বলেন: তুমি আমাদের থেকে তোমার ঢেকুর প্রতিরোধ করো। কারণ যারা পার্থিব জীবনে ভুরিভোজ করে তারাই হবে কিয়ামতের দিন অর্ধেক ক্ষুধার্ত। তিরমিযী ২৪৭৮, সহীহাহ ৩৪৩, মিশকাত ৫১৯৩
আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহ্র রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ পূর্ণ মু’মিন হবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য বা তার প্রতিবেশির জন্য তাই পছন্দ করবে, যা সে তার নিজের জন্য পছন্দ করে। বুখারী ১৩, মুসলিম ৪৫, তিরমিযী ২৫১৫,
প্রথম হাদীসে আমরা দেখতে পাচ্ছি আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে উদরপূর্তি করে খাবার জন্য নিরুৎসাহিত করছেন। অন্যদিকে দ্বিতীয় হাদিস আমাদের মুমিন ভাই ও প্রতিবেশীর হকের প্রতি যত্নবান হবার জন্য কঠোরভাবে আদেশ দিচ্ছে।
রমজান মাস আত্মশুদ্ধির মাস, ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হবার মাস। সহমর্মিতা এবং সমব্যথীত হবার শিক্ষা গ্রহনের মাস।
অত্যন্ত দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে আমরা এই রমজান মাসেই নিজের অজান্তেই অন্য মুমিন ভাইয়ের মনো কষ্টের কারণ হচ্ছি। কি ভাবে হচ্ছি তা নিজের একটা ঘটনা দিয়ে বলছি।
ছোটবেলা আমি তেমন একটা খেতে চাইতাম না কিন্তু টিভিতে কোন খাবার দেখলে লোভ হতো। তখন আম্মুর কাছে বায়না ধরতাম আমাকে টিভির মতো করে মুরগী রান্না করে দাও। তো আম্মু রান্না করে দিলেও আমি বলতাম টিভির মতো দেখতে না কেনো।
পরে আম্মু সুন্দর করে খাবারটা পরিবেশ করতো তখন খেতাম। আম্মু বলতো এটাতো পেটের ক্ষুধা না চোখের ক্ষুধা। আসলেই আমাদের চোখের ক্ষুধার বলতে একটা জিনিস আছে, এটা কি জানেন?
আমরা বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট খেতে যাই কারন আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড তার ফেসবুকে কোন একটা ভালো খাবারের ছবি পোস্ট করেছে সেটা দেখে আমাদের মাঝে সেই খাবার খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়।
তো সেই খাবারটি আসলে আমরা পেটের ক্ষুধার কারণে খাই না বরং আমাদের চোখকে তৃপ্ত করতে খাই,চোখের ক্ষুধা মিটাই।
এবার আসুন মূল কথায়, যদি শুধুমাত্র ফেসবুকে খাবারের ছবি দেখে আমাদের খেতে মন চায় তাহলে ১/২ দিন যারা অনাহারে আছে তাদের সেই খাবারের ছবি দেখে কেমন লাগে একটু চিন্তা করুন। কখনো কি ভেবেছেন আপনার মুখরোচক দামী খাবারের ছবি দেখে কতোজন আকাশের দিকে তাকিয়ে আফসোসের ঢেকুর গিলে।
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন -খেজুরহীন ঘরের মানুষেরা যেন অনাহারী। সহীহ্, সহীহা (১৭৭৬), মুসলিম
আসলে ফেসবুকে আমরা যেই ছবি পোস্ট করি তা সকল শ্রেনীর মানুষ দেখে, সবার সমান সামর্থ থাকে না। অনেক মধ্যবিত্ব পরিবার আছে যারা নিজেদের অভাবের কথা কখনো প্রকাশ করতে পারে না।আমার পরিচিত কয়েকজন বলে বন্ধুরা যখন রেস্টুরেন্ট বসে পিৎজার ছবি পোস্ট দেয় আমি তখন দুপুরে কি খাবো সেটা নিয়ে চিন্তা করি।
এটাতো গেলো মধ্যবিত্বের কথা আর আপনার গ্রামের গরীব আত্নীয় যে আপনাকে ফেসবুকে ফলো করে, যার ঘরে দুপুরের খাবার আছে তো রাতের খবার নেই সে যখন আপনার পিৎজার ছবিটি দেখে তার মনের অবস্থাটা কি হয় কখনো কি ভেবেছেন? বিবেক কি কখনো নাড়া দিয়েছে?
আমি নিজেও এরকম খাবারের ছবি সপ্তাহে ২/৩ বার পোস্ট করতাম কিন্তু এক ভাই আমাকে এ বিষয়ে সচেতন করছিল, যদিও তা আমলে নেই নি।কিন্তু পরে বিষয়টি সত্যি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তারপর থেকে গত দুই বছর ধরে আর তেমন কোন খাবারের ছবি পোস্ট করি না। আর অন্য সময় ছোটখাটো কিছু শখের বশে করলেও এই কঠিন সময়ে মোটেই করা উচিত নয়
করোনা পরিস্থিতিতে কারনে দেশের সব মানুষেরই অর্থনৈতিক ভাবে মন্দা যাচ্ছে। অনেক মধ্যবিত্তের ইনকাম লকডাউনে বন্ধ। গতবছর থেকে অনেকেই চাকরি হারা। এই মানুষগুলো তাদের পরিবার নিয়ে কোনরকম টানাটানি করে রমজান মাসটা পাড় করছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। আর দিন এনে দিন খায় মানুষদের কষ্টের কথা বলার দরকার আছে বলে মনে করি না। বুঝতে পারছেন তাদের কি করুন অবস্থা।
তাই দয়া করে মুখরোচক ইফতারের ছবি ফেসবুক সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন। আপনার এই ছবি যেনো অন্যের বাচ্চার কান্নার বা আফসোসের কারন না হয়, যেমনটা টিভির খাবার দেখে আমার হতো।
আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিতঃ শেষ যমানায় দুর্ভিক্ষ হবে। যে ব্যক্তি সেই যুগ পাবে, সে যেন ক্ষুধার্ত প্রাণীদের প্রতি অবিচার না করে।আদাবুল মুফরাদ,৫৬২
দেশে অনেকটা দুর্ভিক্ষই চলছে তাই দয়া করে ক্ষুধার্ত মানুষের মনে কষ্ট বাড়িয়ে দিয়ে অবিচার করবেন না।
আবূ মূসা আশ’আরী রাঃ থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও, রোগীর সেবা কর এবং কষ্টে পতিতকে উদ্ধার কর। আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৩৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৩৩
এই দূর দিনে পারলে তাই অসহায় মানুষের পাশে দাড়ান। তাদের জন্য কিছু করুন, তাদের জন্য করলে তার বিনিময়ে কি পাবেন সেটা নিয়ে ভাবছেন?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে ঈমানদার ব্যক্তি কোন ক্ষুধার্ত ঈমানদার ব্যক্তিকে খাদ্য দান করে, কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তা’আলা তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। যে মু’মিন ব্যক্তি কোন তৃষ্ণার্ত মু’মিন ব্যক্তিকে পানি পান করাবে কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তা’আলা তাকে সীলমোহর করা খাঁটি “রাহীক মাখতূম” পান করাবেন। যে মু’মিন ব্যক্তি কোন বস্ত্রহীন মু’মিন ব্যক্তিকে পোশাক দান করে, কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তা’আলা তাকে জান্নাতে সবুজ পোশাক পরাবেন। মিশকাত ১৯১৩ আবূ দাঊদ ৩০
ইনশাআল্লাহ আপনি যদি এই রমজান মাসে কোন অভাবী পরিবারের পাশে দাড়ান বা কোন ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার খাওয়ান বা ইফতার করান তার বিনিময়ে হাদিসে বর্নিত সুসংবাদ আপনার জন্য। জান্নাতের ফল আপনার অপেক্ষায়।আর রোজাদারদের ইফতার করানোর ফজিলত তো আছেই
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ কোন রোযা পালনকারীকে যে লোক ইফতার করায় সে লোকের জন্যও রোযা পালনকারীর সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে। কিন্তু এর ফলে রোযা পালনকারীর সওয়াব থেকে বিন্দুমাত্র কমানো হবে না।-সহীহ্, ইবনু মা-জাহ(১৭৪৬) জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং ৮০৭
আরও একটি অনুরোধ, ঈদের শপিংয়ের ছবি, পোস্ট করা, শশুর বাড়ি থেকে ইফতারের পসরা উপহার নেয়া এবং দেয়া, এরকম নানা ধরনের শো-অফ থেকে দয়া করে সচেতন মুমিন হিসেবে দূরে থাকুন প্লিজ।
আল্লাহ আমাদের সকলের, সীয়াম,কীয়াম,দান-সাদাকা কবুল করে নিক।
✍️লেখা: মুহাম্মদ ইরফান হাওলাদার।