24/07/2024
(মরিচ ঝাঁপি কান্ড সম্পর্কে কিছুটা জানতাম। লেখাটা ফেসবুকেই পেলাম, পুরোটা সত্যি কি না জানি না। যদি পুরোটা সত্যি হয় তো ভয়ঙ্কর ঘটনা। অনেক বড় লেখা, সময় নিয়ে পড়বেন)
********************
👇👇👇
বাস্তবের মুখোমুখি সুন্দরবন ও মরিচঝাঁপি।
একদিকে গঙ্গা, অন্যদিকে মেঘনা তো অপর দিকে ব্রহ্মপুত্র। তিন নদী ও নদের অববাহিকায় তৈরি বদ্বীপ অঞ্চল বিশ্বের বৃহত্তম ডেল্টা। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্য়ানগ্রোভ অরণ্য এই সুন্দরবন।
#নামকরণ
বাংলায় সুন্দরবনের আক্ষরিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা বন অথবা বনভূমি। বিশ্বের বৃহত্তম ডেল্টাকে সুন্দরী গাছের স্বর্গরাজ্য বলা হয়। সেই থেকে এর নামও নাকি সুন্দরবন। জলপথে সেই স্থানে পৌঁছে সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় অবশিষ্ট থাকে না।
#ভৌগলিক গঠন
প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার অংশ রয়েছে বাংলাদেশে। ওপার বাংলার খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট জেলা সুন্দরবনের অন্তর্গত। এপার বাংলার উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটা অংশ জুড়ে রয়েছে সুন্দরীর জঙ্গল। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ বা ১৮৭৪ বর্গকিলোমিটার অংশে নদী-নালা, খাঁড়ি, বিলের একাধিপত্য। বাকিটা স্থলভাগ। বনের ঘনত্ব ও ব্যাপকতা এতটাই যে, ১৯৯২ সালে ইরানের রামসার কনভেনশনে সুন্দরবনকে বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্বের বৃহৎ ডেল্টাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা দেয় ইউনেস্কো।
#ইতিহাস
কথিত আছে, মুঘল আমলে এক স্থানীয় রাজা গোটা বনের ইজারা নেন। ১৭৫৭ সালে মুঘলদের হাত থেকে সুন্দরবনের দখল কার্যত চলে যায় ইংরেজদের কাছে। সুবিশাল বনের মানচিত্র তৈরি করে ফেলা হয় রাতারাতি। ১৮২৮ সালে খাতায়-কলমে স্থানের স্বত্বাধিকার পায় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৮৬০ সালে সুন্দরবনকে সাংগঠনিক ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। ১৮৭৯-তে বনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন বাংলা প্রদেশের নবনির্মিত বন বিভাগকে।
বলা হয়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন বর্তমান অবস্থার নাকি দ্বিগুন ছিল। জনসংখ্যার চাপ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বনের আয়তন সঙ্কুচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। সেসব জানতে জানতেই জলপথে পৌঁছে যাওয়া বনভূমিতে।
এবার আসি জনসংখ্যার বিপুল চাপ ও শরনার্থীদের আগমনে আবিষ্কার হলো মরিচঝাপি জঙ্গল।আসলে এটা ঝিলা কম্পাটমেন্ট একাদিকে গাড়াল নদী অপর দিকে ঝিলা নদী আর উওর দিকে কুমীরমারি নদী। আর মরিচঝাপির ওল্টোদিকে গ্রাম বলতে সাতজেলিয়া দ্বীপের চরঘেরী,কাকমারী,দাস পাড়া,পরশমনি, সর্দার পাড়া, কাঙ্জিলালের ঘের,মেটেরদুনে হুলো। ছোটমোল্লাখালীর নয় নম্বর, পঞ্চরাম কুমীরমারীর পালামারির খেয়াখাট থেকে পশ্চিম ও পূর্ব পাড়া পর্যন্ত।
এবার আসি বাস্তবের মুখোমুখি #মরিচঝাঁপি
দুই যুগের উদ্বাস্তু জীবন শেষে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাংলাদেশ লাগোয়া সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে শেষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। নির্বাচনে জেতার জন্য উদ্বাস্তুবান্ধব জ্যোতি বসুর বাম দলই তাদের ডেকে এনেছিলো। জ্যোতি বসু খোদ একসময় রিফ্যুজি সমস্যা নিয়ে দেনদরবার করেছেন বিধান রায় সরকারের সঙ্গে, নিজের ভাবনাচিন্তা বাতলেছেন, সম্ভাব্য পুনর্বাসনের রূপরেখা দিয়েছেন যার মধ্যে সুন্দরবনও ছিলো। ‘৭৫সালের ২৫ জানুয়ারি ভিলাইয়ে এক জনসভায় নিজে বলেছেন, সিপিএম পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে, উদ্বাস্তুদের সেখানে নিয়ে যাবে। ক্ষমতায় আসার বছরখানেক আগে সিপিএম সরকারের মন্ত্রী ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা রাম চ্যাটার্জি সহ কয়েকজনকে দণ্ডকারণ্যে পাঠিয়ে এসব রিফ্যুজিকে পশ্চিমবঙ্গ ফেরার আমন্ত্রণ জানানো হয়। বলা হয় পশ্চিমবঙ্গের পাঁচ কোটি বাঙালী দশ কোটি হাত তুলে তাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। মালকানগিরিতে রাম চ্যাটার্জি আবেগঘন বক্তৃতায় বললেন : মাতৃভূমি তোদের দুহাত তুলে ডাকছে, ওরে অবুঝ সন্তান, তোরা ছুটে আয় । মিঠে সেসব মিছে কথাকে সত্যি ভেবে ভুলেছিলো রিফ্যুজিরা।
১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে উদ্বেল হয়ে ওঠে তারা। এবার তারা ফিরতে পারবে, এমন জায়গায় যেখানে তাদের মতো বাংলায় কথা বলে মানুষ। ১৯৭৮ সালের মার্চ নাগাদ সহায় সম্বল যা ছিলো বিক্রি করে দণ্ডকারণ্য থেকে স্বপ্নের এলডোরাডোতে রওয়ানা হয় দেড় লাখ রিফ্যুজি। কিন্তু সেখানে অপেক্ষায় ছিলো ভিন্ন এক বাস্তবতা। নির্বাচনের আগের বামফ্রন্ট আর ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টের কথাবার্তায় তখন ব্যাপক ফারাক। বদলে গেছে তাদের পলিসি। নেতারা বললেন, তারা বললেই চলে আসতে হবে নাকি! পুলিশ পিটিয়ে খেদালো অনেককে, জেলে পুরলো অনেককে। ভাঙা হৃদয় নিয়ে ফিরে এলো অনেকে। কিন্তু মরিয়া কিছু থেকে গেলো। উদ্বাস্তু সমিতি অনেক আগেই খোঁজখবর নিয়ে বসত গড়ার জন্য পছন্দ করে এসেছিলো মরিচঝাঁপি, যার ঠিকানা দিয়েছিলেন বাম নেতারাই। কলকাতা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের লাগোয়া ১২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি দ্বীপ। ’৭৮ এর শেষ নাগাদ সেখানে ঠাঁই নিলো ৩০ হাজার সর্বহারা মানুষ।
চরঘেরী গ্রামের ধীরেন্দ্র নাথ মন্ডল, কালীপদ মৃধা,কিরন মন্ডল বিভিন্ন তথ্য উঠে এলো।
- ওরা শুধু দন্ডকারন্য নয় বাংলাদেশ থেকেও অনেক এসেছিলো ও দেশের হিন্দু ও মুসলিম গন্ডগোল পাশাপাশি একটি ভালো থাকার জন্যে। আমাদের সাথে অনেকের আত্মীয় সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো। এমন কি অনেক টাকা পয়সা আমাদের জমা রেখে যেতো। কখন কি হয় সে ভয়। ভশ তো সব সময় ছিলো। এ দিকে সরকারের সাথে লড়াই আবার অপর দিকে বাঘের সাথে লড়াই।
- ওরাই বলে ধীরেন হাট বাজার তো সব সরের পারে।কি করে কি যে করি।
- এক কাজ করো তোমাগো তো ণৌকা আছে। তোমাগো গ্রাম থেকে যদি হ্যালেঙ্চা, মাটিপড়া শাক, কচু শাক, নোনা চাপড়ি যদি নিয়ে যাও তাহলে লোক গুলো অন্তত শাক সেদ্ধ করে খেতে পারবে।
- কি বললবো আমাদেরই তো সংসার চলে না। আটা ঘোটা, খুদের ভাত খেয়ে অধিকাংশ দিন যায়। বাবা লোকের বাড়ি ধানে মাইনে খাটে। সে সময় গেছে। মনে করলেই। ভয় হয়। সে সব দিন যেন আর না আসে।
- য়াইহোক আমরা কজন মিলে মরিচ ঝাঁপির জন্যে চালকো ব্যাবসা শুরু করি। পাঁচ - ছয়জন মিলে প্রতিদিন দুই থেকে তিন বস্তা চাল তৈরী করা হতো। ধান সেন্ধ, ওঠোনে রোদ দেওয়া, তারপর ঢেঁকি তে পাদ দেওয়া, দুজন ঢেঁকিতে পাদ দেওয়া ধান ওল্টে দেওয়া আর একজন কূলোতে চাল পরিষ্কার করা। অনেক খাটনি ছিলো।এদিকে ভোরের জোয়ারে এক হালি আর দুই দাড়ি নৌকা নিয়ে পৌঁছে যেতাম।গাড়াল দিয়ে কাকসাঁর ভিতর দিয়ে যেতে হতো। কেনাকাটা করে আসতে আসতে প্রায় বিকেল হয়ে যেতো। তখন চালের দাম ছিল 1 টাকা 50 পয়সা থেকে 1 টাকা 70 পয়সা যা পরিশ্রম হতো পয়সা উসুল হত না কিন্তু কি করব কাজ তো কিছু করতে হবে সব আতকপালি বিক্রি করা হতো আর যখন আমরা চাল নিয়ে যেতাম সঙ্গে বুনো কচু কলার-থোর কলার মোচা নিয়ে যাওয়া হতো তারপরে অবশ্য দুটো বাজার হয়েছিল একটা বড় বাজার আর একটা ছোট বাজার নামে পরিচিত ছিল।
সে সব অনেক গপ্পো।
কিন্তু ক্ষমতায় গিয়েই জ্যোতিবাবুরা ভুলে গেলো প্রতিশ্রুতি। লাখ খানেক উদ্বাস্তুকে ফেরত পাঠালো দণ্ডকারণ্যে। কিন্তু হাজার চল্লিশেক তবু রয়ে গেলো মাটি কামড়ে। বাঘের কামড় খাবে, তবু দণ্ডকারণ্যে ফিরে যাবে না। দুর্গম দ্বীপ মরিচঝাঁপিতে বসতি গড়লো তারা। সরকারকে সাফ জানিয়ে দিলো, কোনো সাহায্য লাগবে না, শুধু বাধা না দিলেই খুশি।
এদেরও কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো। জ্যোতি বসু উদ্বাস্তু নেতাদের বললেন, যাচ্ছো ঠিক আছে, কিন্তু তোমাদের কোনো রকম সহায়তা করা হবে না। যা করার নিজেদেরই করে নিতে হবে। রিফ্যুজিরা মেনে নিয়েছিলো । একদম সহায়তা করেনি তাও ঠিক নয়। এদের বেকারি এবং ফিশিং লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিলো, যা ছিলো একরকম মেনে নেওয়ারই নামান্তর। সাত মাসের নিরলস পরিশ্রমে ফসল ফলালো রিফ্যুজিরা। আবাদী জমিতে ফসল ফলানোর পাশাপাশি মাছের ঘের তুলে বছরে ২০ কোটি রূপি সরকারকে লাভ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলো তারা। মরিচঝাঁপির সাফল্য উঠে এলো গণমাধ্যমেও। নিজেরাই সেখানে গড়ে তুললো জনপদ। মাটির রাস্তা তৈরি করলো, নদী থেকে নোনা মাছ ধরে খায়, বড় মাছ পেলে পাশের কুমীরমারি, ছোট মোল্লাখালি,সাতজেলিয়া বাজারে বিক্রি করে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তায় নিজেরাই স্কুল বসালো। স্বপ্ন দেখলো নতুন করে।
আমি বর্মন সুবল হাউলী, সুবল হাউলী প্রভাসপাইক, নিহার রঞ্জন মন্ডল আমরা এই সময় মরিচঝাঁপি কেটে ফেলা গাছ৫০ পয়সা মন কিনে নিতাম. সেই গাছ মানে জ্বালানি বাসন্তী, গোসাবা হাড়োয়া, কানমারী বিক্রি করতাম সেই সময় আটটা মন কাঠ বিক্রি করা হতো। একটা নৌকা ৮০মণ করে কাট যেত। সপ্তাহে আমরা দুটো করে খেপ দেওয়া হতো। তবে এটা ঠিক একটা জঙ্গলের গরান, ধুঁধুল, পশুর গোমো গাছ সব গাছ কেটে এক নিমেষে পরিষ্কার করে ফেলেছিল এগুলো তো সব আমাদের চোখের সামনে দেখা।
কোনো রকম সরকারী সাহায্য ছাড়া, পার্টির আনুকূল্য ছাড়াই জঙ্গলে অশিক্ষিত ছোটজাতের মানুষ স্বনির্ভর হয়ে উঠছে। এটা হয়তো তার মার্ক্সবাদের অলিখিত লঙ্ঘন। এই উদাহরণ লালদের জন্য ব্যাপক সমস্যা। নির্দেশ পাঠালেন, এদের জায়গা ছাড়তে হবে। এরা সুন্দরবনের পরিবেশ নষ্ট করছে, বাঘের অভয়ারণ্য এদের কারণে বিপন্ন! সব যুক্তিতেই বাকোয়াস্ ছিলো তা। রিজার্ভ ফরেস্টের মানচিত্রে মরিচঝাপির ওই জায়গাটুকু অন্তর্ভূক্ত ছিলো না কোনোকালেই। আমরা যদি দেখি এটি হ্যামিল্টন আবাদ নামেই পরিচিত। গুগল ম্যাপ সার্চ করলেই দেখতে পাবেন।
সিদ্ধান্তটা সার্বিকভাবে আরেকটু আগেই নেওয়া হয়েছিলো। ‘৭৮এর ১লা জুলাই সিপিএমের রাজ্যকমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো- যেসব উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে হলেও তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। চালালো নারকীয় তাণ্ডব। বামফ্রন্টের শরীকদলের নেতাই যাকে বর্ণনা করেছেন ‘জালিয়ানওয়ালাবাগকেও হার মানানো তাণ্ডব’ বলে!
বাঘ নয়, বামফ্রন্ট সরকারই খেলো তাদের। রাতের আঁধারে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হলো মরিচঝাঁপি থেকে। পাঠিয়ে দেওয়া হলো দণ্ডকারণ্যে আবার। আর সেই রাতের আঁধারে কতো লোক মারা পড়লো তা কেউ জানে না। অভিযোগ আছে বস্তায় করে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় টাইগার প্রজেক্টে, বাঘের খাদ্য হিসেবে। আর বাকীগুলো ফেলে দেওযা হয় গভীর সমুদ্রে।
উদ্বাস্তুরা যখন মরিচঝাঁপিতে আশ্রয় নিয়েছিলো, তখন পশ্চিমবঙ্গের বাবুরা অনেকেই জানতেন না । কিন্তু অনেকেই জানতেন, খবর রাখতেন। শঙ্খ ঘোষ একাধিক কবিতা লিখেছেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একাধিকবার সশরীরে গিয়েছেন মরিচঝাঁপিতে, আনন্দবাজারে লিখেছেন তাদের দুর্দশার কথা। অনেক সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকার কর্মীও ছিলেন উদ্বাস্তুদের পাশে।
কিন্তু জ্যোতি বসু সরকার একাই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন।ধর্মের বলি হওয়া লাখো বাঙালির কান্নার মরিচঝাঁপি, জ্যোতি বসু সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা আর নৃশংসতার মরিচঝাঁপি, বাঘের মতো মনোবল নিয়ে তবু বেঁচে থাকা বাঙালি হিন্দুর বার বার মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াবার মরিচঝাঁপি, আমাদের খুব অন্তর্গত বেদনা, কান্না আর লজ্জার মরিচঝাঁপি।
সাতচল্লিশে ভারতে নমঃশূদ্ররা যায় নি। অধিকাংশই থেকে গিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। কী নির্মম নির্যাতন সহ্য করে থেকেছে–মারা গেছে–শেষ মেষ চলে গেছে ভারতে–মরিচঝাঁপির মত এলাকায়। একাত্তরে লবণহ্রদে এই নমশূদ্ররা পশুর চেয়েও অধম জীবন যাপন করেছে। তখন মৃত্যু ছিল নিত্যসঙ্গী।
নমশূদ্রদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে–সবাই। বৃটেন, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ– কে করে নি তাদের সঙ্গে অমানবিক ব্যবহার।বাম রাজনীতিক জ্যোতি বসুতো সাম্যবাদী নেতা ছিলেন। এইছিলো তাঁর সাম্যবাদের নমুনা।শুধু তা নয় আজও যদি আমরা দেকি সুন্দরবনের পৌন্ড্র খএিয় ও নমঃ শুদ্র যারা আছে তাদেরকেও সরকার মানুষ বলে মনে করে কিনা সন্দেহ আছে। চারিদিকে শুধু উন্নয়নের বন্যা। তাইতো প্রতি বছর নদীর বাঁধ ভেঙে হাজার হাজার উর্বর চাষের জমি নোনা জলে ভেসে যায়।অতীত থেকে বর্তমান শুধু সেই আর্তনাদের আর্তচিৎকার বাড়ি গেলো, মিষ্টি জলের পুকুর গেলো, মাঠের শষ্যে গেলো। শুধু থাকলো ভোটের কার্ড,রেশন কার্ড,আধার কার্ড। ব্যাঙ্কের বই। ভোট আসে যায় ভিক্ষা কিন্তু পেছন ছাড়ে না। সরকারের আদৌ সুস্হায়ী উন্নয়নের কি চিন্তাভাবনা আছে। ভালো আছি ভালো থেকো ভোট এলে খবর দিও।
তখন এতো খবর সবর বেরোতো না।তবে স্হানীয় পার্টিরা এদের সাথে রাজনীতি করতো। তখন তো এখানে আর এস পি জোর বেশি। হঠাৎই করে জানতে পারলাম ওদের মুখে। যে এপারের লোক ও পারে যেতে পারবে না। চাল, শাক সব্জী, মিষ্টি জল দেওয়া যাবে না। হাটে হাটে পার্টির লোক ক্যানেসএা পিটিয়ে ডেড়ি দিচ্ছে। ওপারপ গেলে তাকে শাস্তির মুখে পড়তে হবে। চরম দুর্দশার চিত্রটা শুধু মনে পড়ে। রাতে ওরা এসে বলে ছেলেমেয়েগুলো তোমরা রাখো। আমাগো যা হয় হবে। গ্রামের লোকেরা কিছু করতে পারছে না পার্টি র ভয়ে।
আমার ও সে বছর বড়ছেলে হয়। আর্থিক অনটন। চিন্তায় ঘুম হয় না। ওরা মাঝে মাঝে চিতকার করে ওঠে। রাতের দিকে এই আওয়াজ আরো প্রবল হয়ে উঠে।এক একটা রাত আমাদের কাছে হয়ে উঠে বিভীষিকাময়।
আমার শ্বশুর মশাই হরেন্দ্রনাথ মন্ডল আমার কাছে দেড় হাজার টাকায় জমি বন্ধক রেখে মরিচঝাঁপি গিয়েছিল। বেশি জমি পাবে বলে। পেয়েও ছিল বাংলাদেশের সতীশ গোলদারের কাছে১৫০০ টাকা দিয়ে একটি ১০ বিঘার প্লট পায়
ম্যাপ অনুযায়ী যদি আমরা দেখি তাহলে ছোটমোল্লাখালি ৯ নম্বরের ঠিক উল্টো দিকে
। ঘরবাড়ি করে আট মাস বসবাস করেছিল। পরে পুলিশের তাড়া খেয়ে নদী সাঁতরে স্বামী-স্ত্রী চলে আসে। খুবই প্যাথেটিক ঘটনা। সেই সময়ে মিষ্টি জলের জন্য প্রথমে ওরা কুমিরমারি থেকে পুকুরের জল আনতো।একসময় পুকুরের জল কমতে থাকায়। পুকুরের মালিকেরা আর জল দিতে চায় না। তখন মরিচঝাঁপি সাতটি টিউবওয়েল বসানো হয়। জলের সমস্যা অনেকাংশেই মিটলো কিন্তু জলই তো শেষ কথা নয় বাঁচতে গেলে তো আরো অনেক কিছুরই দরকার। তবে সে সুযোগটা তারা আর বেশিদিন পায়নি।
১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু উৎখাতের প্রথম পর্যায়। ২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হলো অর্থনৈতিক অবরোধ। ৩০টি লঞ্চ অধিগ্রহণ করে মরিচঝাঁপিকে ঘিরে ফেললো জ্যোতি বসুর পুলিশ।
গাড়াল ঝিলা আর ও দিকের কুমীর নদীতে লঞ্চে লঞ্চে ছয়লাপ। সুন্দরবনের মানুষ কোনদিন এই রকম আক্রমণ দেখিনী। গ্রামের লোকজন সব ভেড়ির ওপর দাড়িয়ে দেখতো পুলিশের সব কান্ডকারখানা। পার্টির লোককে খাঁকি জামা আর হাফপ্যান্ট পরিয়ে পুলিশ বানিয়ে দিয়েছিল হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল মোটা মোটা বেতের লাঠি।
সংবাদমাধ্যমের জন্য জারি হলো ১৪৪ ধারা, মরিচঝাঁপি তাদের জন্য অগম্য এবং নিষিদ্ধ। এ নিয়ে কিছু লেখা যাবে না, বলাও যাবে না। রিফ্যুজিদের টিউবওয়েল থেকে শুরু করে ক্ষেতিজমি, মাছের ঘের, নৌকা সব নষ্ট করে ফেলা হলো। বৃষ্টির জল ধরে রেখে তা পান করে। প্রাণ বাচানো চেষ্টা করছিলো। তারা ও সেখানে বিষ মিশানো হলো। সে বিষে মরলো অসংখ্য শিশু। বাইরে থেকে খাবার আনার কোনো জো নেই, রসদ পাওয়ার জো নেই। ৩১ জানুয়ারি কিছু মরিয়া যুবক পাশের কুমীরমারি থেকে খাবার আনতে সাঁতরে ব্যারিকেড ভাঙলো। পুলিশের গুলিতে মরতে হলো তাদের ৩৬ জনকে। মানুষ ততদিনে বাঁচার জন্য ঘাস খেতে শুরু করেছে!
বিপন্ন এই মানবিকতায় উদ্বিগ্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গের যারাই সাহায্যের হাত বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছেন, তাদের সে হাত ঠেকিয়ে দিয়েছে বামফ্রন্ট। সরকারী এবং দলীয় তরফে। জগদ্দরদী মাদার তেরেসা পর্যন্ত জানালেন, আক্রান্ত মরিচঝাঁপিতে কিছু করতে তিনি অপারগ! সাহায্যপ্রার্থী সুব্রত চ্যাটার্জিকে বললেন, সর্যি উই কান্ট গো, নাইদার উই কান এক্সপ্লেইন হোয়াই উই কান্ট…। এদিকে অনাহারে মরতে শুরু করেছে মানুষ। যা-তা খেয়ে অসুখে মরছে শিশু এবং বৃদ্ধরা। গুলিতে যাদের মারা হচ্ছে, তাদের লাশ নগদে গুম করে ফেলা হচ্ছে। হয় লঞ্চে তুলে জলে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, নয়তো ডাম্প করা হচ্ছে টাইগার প্রজেক্টে। বাঘের আহার জোগাতে। জ্যোতি বসু ওদিকে সংবাদ মাধ্যমে বলে চলেছেন- সুন্দরবনে এসব উদ্বাস্তু আসলে সিআইএর চক্রান্ত বাস্তবায়ন করছে, তারা সশস্ত্র ট্রেনিং নিচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে লোক এসে এখানে আশ্রয় নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ঘাত ঘটানোর ষড়যন্ত্র করছে বলে তার কাছে পাকা খবর আছে।
মে মাসের শুরুতে যাকে বলে ফাইনাল অ্যাসল্ট। কাহিনীটা খতম করার সিদ্ধান্ত নিলেন জ্যোতি বসু। পুলিশের হাত শক্ত করতে যোগ দিলো সিপিএম ক্যাডাররা। পার্টির নির্দেশ বলে কথা! আশেপাশের দ্বীপগুলোতে কঠোর আদেশ জারি হলো- এতদিন যা সাহায্য করার করেছো, খবরদার আর নয়। ১৩ মে মরিচঝাঁপিতে নরক ভেঙ্গে পড়লো। গভীর রাত থেকে সেখানে শুরু হলো বর্বর এক নৃশংসতা। টানা তিনদিন চললো আক্রমণ। নৌকা করে লোক যখন পালাচ্ছে তখন তার ওপর লঞ্চ তুলে দেওয়া হলো। লাশগুম এবং নৌকা ভাঙার জন্য থাকলো আলাদা পুরষ্কার- নগদ টাকায়। লেলিয়ে দেওয়া পার্টিজান গুণ্ডারা ঘরে ঘরে আগুন দিলো, সামনে যে পড়েছে তার ওপর চললো আঘাত, নারী হলে তাকে হতে হলো ধর্ষিতা। আগুনে পুড়ে ছাই হলো শ’খানেক শিশু। তাদের তুলে আনার সময়টা দেওয়া হলো না মায়েদের। পলায়নপরদের ওপর গুলি চলছে পুলিশের। দুঃস্বপ্নের একাত্তরই ফিরে এলো মরিচঝাঁপির ওই বাঙালী রিফ্যুজিদের ওপর। তফাৎ এরা ধর্মেও এক, ভাষায়ও।
অবশেষে সাফ মরিচঝাঁপি। সম্পূর্ণ এলাকায় কোনো স্থাপনা নেই যা দাঁড়িয়ে আছে। ধংসস্তুপ কথাটার আক্ষরিক এক প্রদর্শনী চারদিক জুড়ে। পোড়া ছাইয়ের মাঝে হয়তো উকি মেরে আছে ঘুমের মধ্যেই লাশ হয়ে যাওয়া কোনো শিশুর রোস্ট। সরকারী নিষেধাজ্ঞার ঘেরে ক্যাজুয়ালটির সঠিক সংখ্যাটা এখনও অজানা। কারো মতো শয়ে শয়ে, কারো মতে হাজারে হাজার। লাশ জলে ভেসে গেছে,
- অনেকে বলে বাঘে খেয়েছে কিন্তু আমরা জানি গাঙের ধারে দিনরাত জঙ্গলের ওপর আমাগো সংসার চলে। বাঘ গাঙে ভেসে যাওয়া মড়া মানুষ খায় না। সে সময় তো সাপে কাটতো মাঝে মধ্যেই।
এক কথায় সাপের উৎপাত ছিলো। মশারি টানিয়ে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হতো যদি মা মনসার কৃপায় বেঁচে যায়। তখন ডাক্তার বৈদ্য তেমন ছিলো না। কখনো কখনো দেখেছি কলার ভেলা জঙ্গলের পাশে জোয়ারে পাড়ের গায় লেগে আছে। আমরা তখন নদীর মাঝে গেরাপি করে রান্নাবান্না করছি। বাঘ ঐ ভেলার ধারে বসে আছে। কিন্তু শোকাশুকি কিছুই করছে। খানিকক্ষণ বাদে লম্বাচওড়া হাই তুলে বনের ভিতর ঢুকে গেলো।
কিন্তু বহু লোক ও অল্প বয়সী ছেলেদের তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। বিভিন্ন সাংবাদিকদের প্রচারিত হিসাব অনুসারে ২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু অবরোধ থেকে ১৩ মে পর্যন্ত অনাহারে ৯৪ জন এবং বিনা চিকিৎসায় ১৭৭ জন শিশু মারা গেছে। ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা ২৪ জন, মারা গেছেন ২৩৯ জন। অনাহারে আত্মহত্যা করেছেন ২ জন। আহত ১৫০, নিখোজ ১২৮ জন এবং গ্রেফতার হয়ে জেলে গেছেন ৫০০ জন। অন্যান্য ভাষ্যে সংখ্যাটা কয়েকগুণ। এদের অনেকেই দন্ডকারণ্যে আবার ফিরে গেছেন। কেউবা পালিয়ে কলকাতায় এসে এখন ফুচকা বিক্রি করেন, হকারি করছেন। অনেকেই জানেন না তার স্বজনদের কে কোথায় আছে, বেচে আছে কিনা মরে গেছে। মেয়েরা হয়ে গেছেন পতিতা!বারাসাতের, হ্রদয়পুর রেললাইন ও কদম্বগাছি এলাকায় এদের অনেককেই পাওয়া যাবে। প্রকৃত লড়াই করা মানুষগুলোর অনেক বয়স হয়েছে। কেউ বা মারা গেছেন। মরিচ ঝাঁপির কথা তুললেই চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে। আবার অনেকে ভয়তে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।ও সব শুনে আপনার কি হবে। কি করতে পারবেন। ছাড়ুন না, ও সব কথা। তবে অনেকে লুকিয়ে থেকে সাতজেলিয়া,ছোটমোল্লাখালি, কুমীরমারি,পুইজালি,পারঘুমটে। মরিচঝাঁপির কত কাঠানোর জন্যে পুনরায় ঝড়খালি জঙ্গল কেটে ওপার বাংলা ও এপার বাংলার বহু পরিবারকে টাকার বিনিময়ে জায়গা দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়।
মরিচঝাঁপি অভয়ারন্য নষ্ট হচ্ছিল। আর ঝড়খালি বুঝি সুন্দরবনের বাইরের কোন জেলা মনে হয়।
@ উমাশঙ্কর মন্ডল।
ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।