25/03/2024
আপনি কী উদযাপন করেন?
দোল, হোলি ,বাহা পরব, বসন্ত উৎসব ❓
দোল, হোলি, রঙ খেলা... বিভিন্ন নামে এবং একই দিনে পালিত হলেও বসন্ত উদযাপনের এই উৎসবের পিছনে অনেকগুলো প্রেক্ষাপট আছে।
আপনি কি উদযাপন করেন? সে সম্পর্কে সচেতন তো?
প্রকৃতি পূজক মানব সভ্যতার প্রায় সমস্ত প্রাচীন উৎসবের মতই এই ফাল্গুনী রঙ উৎসবটিও কৃষিকেন্দ্রিক। এর আঙ্গিক পর্যবেক্ষণ করে গবেষকরা জানাচ্ছেন কৃষির সাথে প্রাচীন সম্পর্কের কথা। জমির উর্বরতা বৃদ্ধির কামনায় নাকি এই উৎসব। অঘ্রানে ফসল ঘরে ওঠা আর পরবর্তী বর্ষার ফসল রোপণের মাঝে জমিকে চাষযোগ্য করে নেওয়া আর জমির উর্বরতা পুনর্ণবীকরণের সময়টা গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের আগে এই বসন্ত। শীতের ঝরা পাতা, শুকনো ডালপালা আর জমিতে পড়ে থাকা নাড়া পোড়ানো; ছাইয়ের মাধ্যমে দ্রুত মাটিতে মিশে যায় প্রয়োজনীয় অজৈব উপাদান সমূহ, যা আগের ঋতুতেই জমি থেকে নিয়েছিল গাছ গুলো। এই বীক্ষা স্থান নিয়েছে অধুনা ‘চাঁচর’, ‘নেড়া পোড়ানো’ বা ‘হোলিকা দহনে’র আঙ্গিকে; এটা পালিত হয় রঙ উৎসবের আগের সন্ধ্যায়। উৎসব প্রতিস্থাপিত হয়েছে কৃষিক্ষেত্র থেকে দেবালয় সংলগ্ন প্রাঙ্গণে। রঙ-উৎসবের সাথে যোগ আছে পশু বলি দিয়ে তার রক্ত মাটিতে ছড়ানো ও গায়ে মাখার প্রাচীন প্রথার সাথে। ঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা-খরা যেমন কৃষিকে ক্ষতি করে তেমনই প্রাণ বলি নেয়। তাই প্রকৃতির নিয়মের ব্যাখ্যা না জানা প্রাচীন মানুষ অগ্রিম বলি নিবেদন করত তাদের তুষ্ট করতে। কৃষিও ছিল যৌথ, তাই ন্যাড়া পোড়ানোও যৌথ, বলিদানও যৌথ - কোনটাই ব্যক্তিগত নয় - সামাজিক উৎসব।
লোক কাহিনী অনুসারে
ভারতবর্ষে আর্য অনুপ্রবেশ কালে সুর অসুর যুদ্ধ ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। আর্যরা ভারতবর্ষের দিকে অগ্রসর হলে প্রবল পরাক্রান্ত রাজা হিরন্যকশিপু তার রাজত্ব রক্ষা করার জন্য রুখে দাঁড়ায়। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং ইন্দ্রের নেতৃত্বে ব্রাহ্মনকুল হিরন্যকশিপুকে বেদ, বিধি, শৌচাচার মেনে নিয়ে ব্রাহ্মণের বশ্যতা শিকার করতে চাপ দিতে থাকে। তারা হিরন্যকশ্যপকে শর্ত পাঠায় যে হিরন্যকশিপু যদি ব্রাহ্মণদের যজ্ঞ করার অধিকার, জমি, খাদ্য শস্য, গরু, মদ এবং নারী পাঠায় তবে তাকে যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হবে না। হিরন্যকশিপু এই অমর্যাদাকর শর্ত না মেনে নিজের রাজত্ব রক্ষা করার জন্য প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি যখন সৈন্য শিবিরে ছিলেন তখন হিরন্যকশিপুর রাজধানী আক্রান্ত হয় এবং গর্ভবতী রাজমহিষী কায়াধু (কাপারু) অপহৃত হয়। রাজমহিষীর স্থান হয় আশ্রমে। সেখানেই জন্ম হয় প্রহ্লাদের এবং ছোটবেলা থেকেই প্রহ্লাদ শিখে নেয় “নারায়ণ- নারায়ণ” বুলি। প্রহ্লাদ বড় হলে হোলিকা তাঁকে সত্য ঘটনা খুলে বলেন এবং প্রহ্লাদকে ব্রাহ্মণদের খপ্পর থেকে মুক্ত করেন। প্রহ্লাদও পিতা হিরন্যকশিপুর পথ অবলম্বন করে ব্রাহ্মণদের উপহার দেওয়া বন্ধ করে দেন। রাজ্যের মধ্যে যজ্ঞ নিষিদ্ধ করেন। গুপ্তচর মাধ্যমে ব্রাহ্মণেরা জানতে পারেন যে হোলিকার পরামর্শেই প্রহ্লাদ এই নীতি ঘোষণা করেছেন। তারা হোলিকাকে কারারুদ্ধ করেন এবং দিনের পর দিন খাদ্য এবং পানীয় বন্ধ করে দেন। হোলিকার এই নিদারুণ কষ্টের কথা শুনে প্রজারা খাদ্য এবং পানীয় নিয়ে প্রহ্লাদের কাছে ছুটে যান। প্রহ্লাদ নিজের সৈন্যের সাহায্যে হোলিকাকে মুক্ত করেন। কিন্তু সেই রাতেই ব্রাহ্মণেরা তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে একটি খোলা মাঠে গাছের খুঁটির সাথে বেঁধে ঘাস পাতা দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। এই ঘটনাই পালিত হচ্ছে আজও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির বিজয় উৎসব হিসেবে হোলিকা দহনের প্রতীকের মাধ্যমে। ‘হোলী হ্যায়’ - আপাত নিরীহ এই শব্দবন্ধের অন্তরালে রয়ে গেছে হত্যার উন্মত্ত উল্লাস। লোকায়ত সংস্কৃতির মধ্যে এই পুরাতনী বার্তা গভীর ভাবে প্রথিত হয়ে আছে। জনগণ রাজা হিরন্যক ও হোলিকার এই মৃত্যু দিনকে শোক দিবস হিসেবে পালন করার এক পরিক্রমা শুরু করে। এই শোকপালনের অনুষ্ঠানের একটি পারম্পরিকতা তৈরি হলে বামুনেরা গুপ্ত যুগে কাল্পনিক বিষ্ণুর নরসিংহ অবতারের কাহিনী তৈরি করে প্রাচীন ঐতিহাসিক তথ্য ধ্বংস করে দেয়। কল্পকাহিনীতে রেহাই দেওয়া হয় প্রহ্লাদকে। বিষ্ণু নামস্মরণে প্রহ্লাদের বিপযুক্তির কাহিনী ব’লে বার্তা দেওয়া হয় আর্যসংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পণের।
কৃষি উৎসবকে প্রতিস্থাপন করছে বাংলার দোলযাত্রা
বাংলার উৎসবটি দোল। রাধা ও গোপীদের সাথে কৃষ্ণের আবির ও গুলাল খেলার কাহিনীকে কেন্দ্র করে রাধাকৃষ্ণের মূর্ত্তি দোলায় চাপিয়ে শোভাযাত্রা বের করার উৎসবটি অনুসূত হয় বাংলায়। নরসিংহের আগ্রাসী রূপের বদলে কৃষ্ণের কোমল রূপই এখানে প্রধান। “দোলায়’ চেপে যাত্রা থেকেই দোল উৎসব। ভক্তি আন্দোলনের পুরোধা, বর্ণ ভেদের কু-প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী চৈতন্যের জন্মও এই ফাল্গুনী পূর্ণিমায়। বাংলায় বৈষ্ণব প্রভাব গভীর, তাই দোলও এইরীতি অনুসারী এবং এর চল মধ্যযুগে, বৈষ্ণব পদাবলী রচনার যুগ থেকে - সাহিত্যে মুক্ত প্রেম ঘোষণার যুগ থেকে - মুক্ত প্রেমের মান্যতা আদায়ের জন্যে লড়াইয়ে হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল রাধাকৃষ্ণের প্রেম কাহিনী আর সুপ্রাচীন রঙ উৎসব। বাংলায় এইরূপে প্রচলন নিশ্চিতভাবেই মধ্যযুগে - অন্ততঃ নবম শতাব্দীর পরে - কেননা তার আগে বাংলায় ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের তেমনভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেনি।
ধর্মনিরপেক্ষ বসন্ত উৎসব
নেহাতই ঋতু উৎসব
ধর্মীয় আচরণের এই ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করে দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উৎসবকে একটি সেকুলার উৎসবে পরিণত করেন। সঙ্গীত রচনা করলেন বসন্ত ঋতুকে স্বাগত জানিয়ে, বসন্তের ফুলকে কেন্দ্র করে। সেখানে স্থান নেই কোন কৃষ্ণের, নেই কোন রাজকাহিনীর, নেই প্রকৃতির ব্যাখ্যা না জানা মানুষের প্রাচীন অভ্যাসেরই অন্ধ অনুকরণ। এর মাধ্যমে সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরী করা আর ভারতীয় জনগণের সংখ্যাগুরু মানুষের গ্লানির ইতিহাস খানিক হলেও মুছে ফেলা সম্ভব। যদিও কবিগুরু এই ফুলের উৎসবের ভাবনাটা পেয়েছিলেন এদেশের বৃহৎ জনপুঞ্জের লোকাচার থেকেই; আদিম সুসভ্য জাতিগুলোর আজ অবধি বহমান প্রকৃতির সাথে সুসম্পর্কের ফর্মুলা থেকেই ধার করে তিনি সেই প্রজ্ঞা নিয়ে আনলেন যন্ত্র সভ্যতার মানুষের মনের দরজায়। বসন্ত মানেই ফুল। আর ফুল হল ঘুমন্ত বিবেকের প্রকাশ। ফুল ছিল উৎসবের অঙ্গ, কবিগুরু সেই ফুলকে বানালেন উৎসবের কেন্দ্র। সাঁওতালী, মুণ্ডা, কুরমী প্রভৃতি সমাজে ‘বাহাবোঙা’ বা ‘শাহরুল পরব’ যা বসন্তে প্রকৃতির পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর উৎসব-সেগুলো সবই পলাশ, শিমুল ফুল সহযোগে ধামসা, মাদলের তালপ্রয়োগে বাঁশির মাধ্যমে সুর প্রয়োগে জীবন্ত হয়ে ওঠে। তাই উৎসবটি প্রকৃতই বসন্ত উৎসব, ঋতু উৎসব। প্রকৃতির উপাদান আর তার সাথে নিজের চেতনাকে, অনুভূতিকে মিলিয়ে নেওয়ার একটা কড়া বস্তুবাদী প্রায়াস।
প্রকৃতির সাথে আমাদের জীবনের আর জ্ঞানের বিচ্ছিন্নতা ক্রমবর্ধমান। বসন্ত উৎসবই হয়ে উঠতে পারে সে অর্থে সে অভিমুখী হওয়ার সম্বিৎ ফেরানোর প্রথম পদক্ষেপ। আমাদের ঝোঁকটা এখানেই স্পষ্ট; নেহাত হুজুগ নয় - বরং খোঁজার চেষ্টা করছি অন্য কিছু।
লেখা - Arijit Chakraborty
ডিজাইন - Raja