21/03/2024
রিকশায় পাশে বসা মেয়েটাকে ঘন্টাখানেক আগে বিয়ে করেছি আমি,তাও সম্পূর্ণ অনাকাঙ্খিতভাবে। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু রিয়াদের বোন অনামিকা। আজ ওর বিয়ে খেতেই রিয়াদের বাড়ি গিয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয় আরকি! অনামিকার হবু স্বামী তার প্রেমিকার সাথে পালিয়ে গিয়ে বিপদে ফেলে দিলো আমাকে। আমার সকল অসুবিধার কথা জেনেও রিয়াদ যখন আমার সামনে হাত জোড় করলো, ফিরিয়ে দিতে পারিনি আর। তবুও বলেছিলাম,
--আমার সব তুই জানিস,রিয়াদ। এখনও এমবিএ কমপ্লিট করতে পারলাম না,নিজে চলি টিউশনি করে। থাকি চাচার বাসায়। এর মধ্যে তোর বোনকে নিয়ে থাকবো কোথায়? খাওয়াবো কি?
জবাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে রিয়াদ বলেছিলো,
--আমার বোনও কোন রাজরানী নয়,আবির। অভাবের সাথে যুদ্ধ করে বড় হয়েছে ও। সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে পারবে, তুই দেখিস। আমি তো তোকে জানি,আমার বোনকে কখনও কষ্ট দিবিনা তুই।
ওর এসব কথাতেই অনামিকাকে আমার নিসঙ্গ জীবনের সাথে জড়াতে হলো।
অনামিকার মুখের দিকে তাকাতেই আমার হাতের উপর থেকে ওর হাত সরিয়ে নিলো। ধীর কন্ঠে বললো,
--এত দুশ্চিন্তা করবেন না। আল্লাহ সব ঠিক করে দিবে।
ওর সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলাম। ওতো আর আমার পরিস্থিতি জানে না।
মা-বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে চাচা চাচীর কাছেই থাকি আমি। চাচা অনেক শান্ত স্বভাবের মানুষ।কিন্তু চাচী ঠিক তার উল্টো। ভয়ংকর রাগী মানুষটাকে জমের মতো ভয় পাই আমি। পান থেকে চুন খসলেই এমন অবস্থা করে যেন ক্যাক করে গলাটা টিপে দেবে। অবশ্য চাচীকে নিজের ছেলের সাথেও কখনো আহ্লাদ করতে দেখিনি আমি। তাই বুঝতে পারিনা আমাকে ভালোবাসেন নাকি ঝামেলা মনে করেন।আট দিন হলো আমার সেই চাচীর জরায়ুর অপারেশন হয়েছে। আজ চাচীকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেয়ার কথা। চাচা অনেক বলেছিলো, বিয়েতে না গিয়ে রিলিজের সময় চাচার সাথে থাকার জন্যে। কিন্তু আমিই জোর করে গিয়েছিলাম,রিয়াদের বোনের বিয়ে বলে কথা! এতক্ষণে হয়তো চাচীকে নিয়ে এসেছে।
রিকশা থেকে নেমে দাড়ালাম। প্রচন্ড ভয় নিয়ে কলিংবেল বাজালাম। আমার পাশে দাড়িয়ে চোখ বুলিয়ে চারপাশ দেখছে অনামিকা।
চাচার ছোট্ট একটা একতলা বাড়ি। বসার ঘর আর রান্নাঘর ছাড়া একটা মাত্র শোবার ঘর আছে। শোবার ঘরটা চাচা-চাচীর। বসার ঘরের একপাশে সোফা আর অন্যপাশে একটা সিঙ্গেল খাটে আমি ঘুমাই।খাটের সাথে লাগোয়া ছোট টেবিলে একটার উপর একটা বই রেখে পাহাড় বানিয়ে রাখি।
আমার বিয়ে নিয়ে যতোটা ঝামেলা হবে ভেবেছিলাম,ততটা হলো না। চাচীকে বরং খুশিই মনে হলো। অপারেশনের কারনে বেডরেষ্টে থাকা অবস্থায় একজন হেলপার অবশ্য তার দরকার ছিলো। চাচা শুধু রাগান্বিত স্বরে একবার বললো,
--এজন্যেই আজ এতো তাড়া ছিলো তোর?থাকবেই তো,বিয়ে তো আর খেতে যাসনি,করতে গিয়েছিলি।
আমি সাথে সাথে মুখ কাচুমাচু করে বললাম,
--বিয়ে তো আরও ১৫ দিন আগে করেছি,চাচা। চাচী নেই দেখে বাসায় আনিনি। আমার আর কে আছে বলো,চাচীই তো আমার সব।
চাচা-চাচী একে অন্যের মুখের দিকে তাকালো। কিছু বললো না। বালিশের নিচ থেকে চাবি নিয়ে অনামিকার দিকে বাড়িয়ে দিলো চাচী।
--যাও,একটা শাড়ি নিয়ে বেনারসি টা পাল্টে নাও। ১৫ দিন আগে বিয়ে করে আজ আবার বউ সাজা কেন শুনি?যত্তসব ঢং!
অনামিকা কিছু না বলে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো। আমি আর চাচা বেরিয়ে এলাম বাইরে। মনে স্বস্তি পেলাম আমি,যাক ঝামেলাটা মিটেছে।
সবুজ রঙের একটা জামদানি শাড়ি পরে অনামিকা যখন বেরিয়ে এলো,আমার নিঃশ্বাস কিছুক্ষনের জন্যে আটকে গেলো। ও কি আসলেই এত্ত সুন্দর? কই আগে তো এমন লাগেনি। নাকি এখন আমার বউ বলে লাগছে?
আমার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিলো, হয়তো চাচী বলবেন, "যেমন বিয়ে করেছো তেমন রাখোগে বউকে নিজের বিছানায় ঠেলাঠেলি করে। আমার ঘরে জায়গা নেই।" কিন্তু চাচী আমার আশায় জল ঢেলে দিয়ে চাচাকে বসার ঘরের মেঝেতে বিছানা করতে বললো।তারমানে অনামিকা চাচীর সাথে ঘুমাবে। চাচা মিনমিন করে একবার বললো,
--ওদের নতুন বিয়ে,একসাথে থাকা উচিত না?
--১৫দিন হলো বিয়ে করেছে, একসাথে না থেকে বাকি রেখেছে বুঝি? হাজার হোক,তোমার ভাইপো বলে কথা!
চাচীর কথায় অবাক হয়ে চাচার দিকে তাকালাম আমি। চাচা মুখ ফিরিয়ে নিলো।
ওই মুহুর্তে আমার নিজেকে কষে ২টা থাপ্পর লাগাতে মন চাইছিলো। কি দরকার ছিলো ১৫ দিন আগে বিয়ে করেছি বলার??
চাচা বিছানা করে শোবার ঘরে যেতেই অনামিকাকে ডাক দিলাম আমি,
--অনু,তোমার ভাই ফোন করেছে, একটু এসো তো।
অনু ধীর পায়ে এসে আমার পাশে আমার ছোট্ট বিছানায় বসলো। এতো ভালো লাগছিলো আমার, নিজেকে অনেক সুখী মনে হচ্ছিলো।
--ফোন কোথায়? অনুই প্রথম বললো।
--তোমার আসতে দেরী হচ্ছিলো,তাই রেখে দিলো। নির্দ্বিধায় মিথ্যা বললাম আমি।
অনু উঠতে যাচ্ছিলো,ওর হাতটা ধরলাম আমি।
--একটু বসো। চাচা আসলে যেও।
অনু বসলো মাথাটা নিচু করে। আমি ওর হাতটা ছাড়লাম না। শক্ত করে ধরে রাখলাম। এতো অস্থির লাগছিলো আমার,ইচ্ছা করছিলো ওর মাথায় তুলে দেয়া আচঁলটা ফেলে দেই। ওর চুলের ঘ্রাণ নেই। আমি কখনও মেয়েদের চুলের ঘ্রাণ নেইনি। জানিনা সেটা কেমন হয়। কিন্তু আজ জানতে ইচ্ছা করছে। কি বলবো ভেবে না পেয়ে বললাম,
--চাচীর কথায় মন খারাপ করো না। উনি এমনই।
অনু কিছু বললো না। আগের মতোই বসে রইলো। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম,
--ক্ষুধা লেগেছে?কিছু খাবে?
--না। খেতে ইচ্ছা করছে না। মনে মনে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম আমি। অনু খেতে চাইলে ওকে খাবার দেয়া আমার জন্য এখন একরকম অসম্ভব ছিলো।
চাচা আসার সাথে সাথেই চলে গেলো অনু। আর আমার শুরু হলো অস্থিরতা। ঘুম আসার নাম নেই। বারবার মনে হচ্ছিলো সব ঠিক থাকলে আজ আমাদের বাসর হতো! প্রথমবার নিজের এতিম হওয়ায়,একটা ঘর না থাকায় প্রচন্ড আফসোস হলো। আহারে, বিয়ে ভাঙার টেনশনে মেয়েটা রাতেও হয়তো কিছু খায়নি। এতো বড় একটা রাত না খেয়ে কাটাবে!! সারা রাত একফোঁটা ঘুম হলোনা আমার। নিজেরই অবাক লাগছিলো,হচ্ছে কি এসব? কাল পর্যন্ত তো আমার একটা বউ ছিলো না। আর আজ বিয়ে হতে না হতেই বউকে কাছে পাবার এতো আকুলতা কেনো?
চাচা আর চাচাত ভাই দুজনই সিলেটে কাজ করে। ওখানেই থাকে। ছুটি পেলে বাড়ি আসে। এবার চাচীর অপারেশনের জন্যে ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিলো চাচা। আমি মনে মনে অপেক্ষা করছিলাম,চাচা সিলেট চলে গেলে হয়তেো অনু বসার ঘরে থাকবে,আমার সাথে। কিন্তু আমার সে আশাও গুড়েবালি। চাচা যাওয়ার পরও চাচী অনুকে নিজের সাথেই রাখলেন। আর আমি অনুর এতটুকু ছোঁয়া,একটু দেখা পাওয়ার আশায় তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে থাকি।জীবনটা পুরো পুরি বদলে গেল আমার।চাচী সংসারের পুরো হাল ছেড়ে দিলেন অনুর উপর। রান্না থেকে শুরু করে সব সিদ্ধান্ত নেয়ার ভারও অনুকে দিলেন। আর অনু?দিনভর কাজ করেও রাতে চাচীর সেবা যত্নে বিন্দুমাত্র অলসতা নেই তার। স্বামীর সোহাগ ছাড়া সংসারে মনের সুখে ঘরকন্না করছে সে। এদিকে আমি ক্যাম্পাসে জোড়া জোড়া কপোত কপোতি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। প্রচন্ড আফসোস হয়,নিজের প্রতি। ভাগ্যটা এত্তো খারাপ কেন আমার। প্রায় প্রতিদিনই বাসায় চাচীর বকা খাই, অনুর পেছনে ঘুরঘুর করার অপরাধে!! নিজেকে অনেক বেশি অসহায় লাগে,যখন দেখি চাচীর বকা দেয়া দেখে অনুও মুখ টিপে হাসে! মাঝে মাঝে এতো অস্থির লাগে মনে হয় অনুকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাই,অন্তত ওকে কাছে তো পাবো।
এভাবেই কাটছিলো সময়। আমার বিয়ের মাস ছয়েক পরের কথা। আমি তখন বিসিএসের জন্য হুলস্থুল পড়ছি। এক সপ্তাহ পরেই প্রিলি। যদি কোনভাবে পাশ করে যাই। যদি একটা সরকারি কোয়ার্টার পাই!! অনু আর আমার সত্যিকারের সংসার শুরু হবে তখন! স্বপ্ন বাস্তব করতে দিনরাত এক করে পড়ছি। এরমধ্যে বর্ষার এক রাতে প্রচন্ড জ্বর এল আমার। বই রেখে কম্বল মুড়ি দিলাম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখি কপালে জলপট্টি,আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অনু। মুহূর্তের মধ্যে নিজের উতপ্ত হাত দিয়ে ওর হাতটা মুঠো করে নিলাম। ভাঙা স্বরে বললাম,
--চাচী দেখেনি আসতে?
একহাতে চোখের পানি মুছে অনু বললো,
--দেখেছে। বলেছি যে আপনার অনেক জ্বর,নিজে এসে দেখেও গেছে। তাই আর কিছু বলেনি।
বাইরে তখন বর্ষার তুমুল বর্ষণ। বামহাতে জলপট্টিটা নিয়ে নিজের মাথাটা অনুর কোলে তুলে দিলাম আমি। দুহাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে পেটে নাক ডুবালাম। মনে মনে ভাবলাম, জ্বর এতো ভালো কেন? এই জ্বর আমার আগে হলোনা কেনো? সেরাতে আমার আফসোসগুলো দিক পরিবর্তন করে ক্যাম্পাসের সেই প্রেমিকদের প্রতি চলে গেলো। পার্কে বসে হাত ধরে,বাদাম খেতে তো সবাই পারে; এমন বর্ষার রাতে প্রচন্ড জ্বর নিয়ে প্রেয়সীর কোলে মাথা কয়জন রাখতে পারে??
#আফসোস
Sumaiya Siya