13/10/2023
ইজরাইল ও প্যালেসটাইনের যুদ্ধের ইতিহাস
দ্বিতীয় পর্ব
জিউসরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস শুরু করেছে কিন্তু তাদের কোন দেশ ছিলনা একথা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। প্যালেসটাইন থেকে রোমানরা জিউসদের কয়েক'শ বছর আগেই তাড়িয়ে দিয়েছে। ১৮৯৭ সালে জিওনরা প্রচার করা শুরু করে প্যালেসটাইন জিউসদের হোমল্যান্ড অর্থাৎ তাদের ওই জায়গায় বসবাস করা জন্মগত অধিকার । কিন্তু এতদিন জিউসদের কেন মনে পরেনি যে প্যালেসটাইন জিউসদের হোমল্যান্ড?
এর সহজ উত্তর হল মধ্যপ্রাচ্য সারা বিশ্বের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে চারটি কারনে।
১) সিল্ক রুট
২) সুইজ খাল।
এই সুইজ খালে অঢেল টাকা ঢেলেছে ব্রিটেইন আর ফ্রান্সের পুঁজিবাদীরা।
৩) তেলের খনি একটার পর একটা মধ্যপ্রাচে পাওয়া যাওয়া।
প্রথম তেল পাওয়া যায় ১৮৪৭ সালে পেনসেলভিয়া, দ্বিতীয় বার তেলের খনি পাওয়া যায় ১৮৬০ সালে রোমানিয়া। তৃতীয়বার তেল পাওয়া যায় ১৯১০ সালে ইরান।
ঠিক তখুনি ইহুদীদের মনে পরল প্যালেসটাইন তো আমাদের হোমল্যান্ড ওই হোমল্যান্ড আমাদের চাই।
৪) ১৯১৭ সালের রাশিয়া রেভ্যুলেশনে কমিউনিজমের রাশিয়ায় শাসন। আর রাশিয়া হল মধ্যপ্রাচ্যের তেলের খনির দেশের বর্ডার।
কমিউনিজমের জয় সমগ্র পৃথিবীতে পুঁজিবাদীদের মাথা ঘুরিয়ে দেবার প্রধান কারন।
মুসলিম ও কমিউনিজমের মতবাদে বেশ কিছু মিল পাওয়া যায়। কিন্তু মুসলিমরা কমিউনিজমের বিপক্ষে শুধুমাত্র কমিউজম আল্লাহ্ কে স্বীকার করেনা এখানেই মতভেদ।
ব্রিটিশ ফ্রান্সের পুঁজিবাদীরা ভাবনায় পরে গেল মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ গুলো আর কমিউনিজম যদি এক হয়ে যায় তাহলে আমাদের টিকে থাকা দায় হয়ে যাবে।
অন্যদিকে ইহুদীরা পুঁজিবাদী ভাবনা চিন্তার তারা বরাবরই চরা সূদ নিয়ে ব্যবসা করে তারফলে দীর্ঘকালীন এই পুঁজিবাদী সূদ ব্যবসায় সারা পৃথিবীর ব্যঙ্ক সিস্টেম তাদের হাতের মুঠোয়। ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের পুঁজিবাদীরা জিউসদের ব্যবহার করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়না। নীতিগত দিগ থেকে মুসলিমরা সূদ খায়না (কিন্তু অনেক মুসলিম যদিও সুদের ব্যবসা করে) এখানেই ইহুদী আর মুসলিমদের বিরোধ।
উপরোক্ত চারটি কারন ইজরাইলের জন্ম হবার কারন হিসাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে।
এরপর আসে ১৯১৪ সাল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক সময়ে-
মিশরের বফাত পার্টির লিডার জগলুল পাশা অন্যদিকে সৌদি আরব তখন নাম ছিল হিজাজ । হিজাজের লিডার ছিল মহম্মদ হুসেইন।
জগলুল কে ইংরেজরা বলল মিশর থেকে ব্রিটিশ সেনা সরিয়ে নেব আর অন্যদিকে হুসেইন কে ব্রিটিশরা বলল তোমাদের জন্য আরব দেশ গঠণ করে দেব।
দুজনই ব্রিটিশদের সাথ দিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে।
এরপরই চার নম্বর ঘটনাটি ঘটে ১৯১৭ সালে, রাশিয়ায় শাসন কমিউনিস্টরা নিজের হাতে পায়। ব্রিটিশরা ভয় পেয়ে যায় রাশিয়ার কমিউনিস্টদের সাথে মধ্যপ্রাচ্য এক হয়ে গেলে সব তেল তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে।
এই ভয় থেকেই ব্রিটিশ ফরেন মিনিস্টার আর্থার বেলফর ডিক্লায়ার করেন প্যালেসটাইন জিউসদের হোমল্যান্ড। তখনো প্যালেসটাইনে কোন জিউস থাকে না।
আরব প্রথম দিকে বাঁধা দিল যে এখানে কোন জিউস নেই তাহলে ইহুদী দেশ হবে কী করে?
১৯২০ সালে ব্রিটিশ ও ফ্রান্স যৌথ উদ্যোগে ম্যানডেট সিস্টেম চালু করে। আগের পর্বে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এর ভাগাভাগি বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
হিজাজ, প্যালেসটাইন এগুলো ব্রিটিশদের প্রটেকশনে থাকবে অন্যদিকে সিরিয়া ফ্রান্সের প্রটেকশনে থাকে।
আরবদের ব্রিটিশরা কথা দেয় মুসলিমদের কোন সমস্যা হবেনা সেটি লক্ষ্য রাখা হবে। হুসেইন কে সন্তুষ্ট করতে হিজাজ ওদের হাতে ছেড়ে দেয়।
কিন্তু প্যালেসটাইন নিজের হাতে রাখে এবং ইহুদীদের ধরে ধরে এনে এখানে রাখা শুরু করে। মুসলিমরা এত ইহুদী দেখে অবাক হয়ে যায়। তারওপর মুসলিম ও ইহুদীদের মতভেদ সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে এখানে সমস্যা তো হবারই কথা আর সেটা ব্রিটিশরা ভালো করেই জানতো।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করতে হয় -
পশ্চিমি পুঁজিবাদী দেশগুলোর আয়ের উৎস হল অস্ত্র বিক্রি করা, যাদের সারা বিশ্ব ন্যাটো বলে জানে।
অস্ত্র কেনার ক্ষমতা তারাই রাখে যাদের টাকা আছে।
এবার মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ গুলোর হাতে প্রচুর টাকা আছে তেলের কারনে।
আর এই তেলের টাকা সারা পৃথিবীতে রোটেশন করে ইহুদীরা।
সৌদি আরব আমেরিকা থেকে প্রচুর অস্ত্র কেনে। আর লড়াই করে ইরানের সাথে। ইরান যদি নিউক্লিয়ার প্রজেক্ট বৃদ্ধি করে তাহলে সমস্যায় পরবে সৌদিআরব।
ইজরাইল জন্ম দিয়ে ব্রিটিশদের অভিসন্ধি পূরণ হয়েছে নিঃসন্দেহে। কারন ইজরাইল জন্ম নিলে দুই পক্ষের নীতিগত মতবাদে যুদ্ধ বাঁধবে সে বিষয়ে ব্রিটিশরা নিশ্চিত ছিল।
মধ্য প্রাচ্যের সৌদিআরব, ইজিপ্ট, লিবিয়া , ইরান কোন দেশ হাতিয়ার বানায়না। কিন্তু তাদের হাতে তেল বিক্রির প্রচুর টাকা আছে। তারা সেই টাকা দিয়ে প্রচুর হাতিয়ার কেনার ক্ষমতা রাখে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলো যদি তেল বিক্রির টাকা সাইন্স এন্ড টেকনোলজিতে ব্যবহার করে, রিসার্চ সেন্টারের জন্য ব্যবহার করে তাহলে রেভ্যুলেশন হয়ে যাবে। যেমন ভাবে রেভ্যুলেশন হয়েছে ইউরোপে। তাদের হাতে যখন প্রচুর টাকা এল তারা রয়্যাল সোসাইটি তৈরি করেছিল। তাই তারা আজ বিশ্বের প্রথম সারিতে।
মুসলিমরা যদি ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বেড়িয়ে যায় এবং বিজ্ঞান কে নিয়ে গবেষণা শুরু করে দেয় সবচেয়ে বড় সমস্যায় পরবে ইউরোপীয় দেশ গুলো। ন্যাটো এটা কোন মতেই চায়না মুসলিমরা ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বেড়িয়ে যাক। তাদের অর্থ/টাকা গুলোকে খরচ করাতে হবে ধর্মীয় ভাবে যুদ্ধে ব্যস্ত রেখে। এতে ইউরোপীয় দেশ গুলোর আর্থিক ভাবে লাভবান হবে এবং তাদের সাথে বিজ্ঞান ও গবেষনা নিয়েও থাকবেনা কোন প্রতিদ্বন্দ্বী।
ইউরোপীয় দেশ গুলো তাদের হাতিয়ার বিক্রি করে ইন্ড্রাস্ট্রি তৈরি করছে, ব্যঙ্ক তৈরি করছে, বৈজ্ঞানিক গবেষণার তৈরি করছে সবই আরব দেশ গুলোর টাকায়। কিন্তু আরবদেশ গুলো এই বিষয়টিকে কোন আমল দিতে চাননা কারন তাদের ধর্মীয় ভাবে বোঝানো হয় কোরানই বিজ্ঞান আর সেখানেই অধিকাংশ মুসলিম ব্যস্ত হয়ে যায়।
ব্রিটিশরা ইজরাইলকে জন্ম দিয়ে বুঝিয়ে দিতে লাগল আরব দেশ গুলোর ওপর আক্রমণ নেমে এসেছে। এবার আরবরা ইজরাইলের সাথে যুদ্ধে জড়াবে আর অস্ত্র কিনবে আমেরিকা থেকে।
তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো তেল বিক্রি করে টাকা পেল আরব দেশ গুলো, যুদ্ধে জড়িয়ে পরল ইজরাইলের সাথে। যুদ্ধ করতে গেলে অস্ত্র কিনতে হবে আমেরিকার কাছে। অবশেষে তেল বিক্রির টাকা পৌঁছে গেল আমেরিকার কাছে।
এবার আসি মূল বক্তব্যে-
১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির শাসন হাতে নিলে হলোকাস্ট তৈরি হয়ে গেল - ব্রিটিশের এখানে শাপে বর হল।
ইহুদীরা আসতে শুরু করল প্যালেসটাইনে মুসলিম ইহুদী সমান সমান হয়ে গেল। এই দুই জাতির মতভেদ এতটাই একে অপরের বিরুদ্ধে যে একসাথে এক দেশে থাকা অসম্ভব হয়ে গেল। এরা এক সাথে এক দেশের জন্য লড়াই করার মানসিকতাতেই আসতে পারবে না। তিন হাজার আরবী অধিবাসী মারা যায় দুই ধর্মের মানুষের লড়াইয়ে। ব্রিটিশরা মিলিটারি শাসন চালু করতে বাধ্য হয়।
এরপর ১৯৩৬ সালে পিল কমিশনের নিযুক্তি হয় এবং প্যালেসটাইনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। আগের পর্বে ভাগাভাগির বর্ণনা করা হয়েছে।
আরবরা এই ভাগাভাগি মেনে নিতে চায়নি। কারন ব্রিটিশরা পূর্বে কথা দিয়েছিল কোন আরবীদের কোন সমস্যা হবেনা জিউসরা এখানে থাকলে।
ব্রিটিশরা বলে এখন সমস্যা হয়ে গেছে কিছু করার নেই ভাগাভাগি ছাড়া উপায় নেই।
১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ ও ফ্রান্স দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক ভাবে ভেঙে পরে। ভাগাভাগির দায়িত্ব ইউনাইটেড নেশনের হাতে ছেড়ে দিয়ে এরা হাত তুলে জানান দেয় আমরা এই সমস্যার মধ্যে আর নেই। এবার তোমাদেরটা তোমরা বুঝে নাও। ব্রিটেইন আর ফ্রান্স গা ঢাকা দিল।
এবার আমেরিকা নামে এক নতুন শক্তি এই ঘটনার মাঝে প্রবেশ করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকা অফিসিয়ালি ১ লক্ষ জিউস প্যালেসটাইনে পাঠায় এইসব জিউসরা সারা বিশ্ব জুড়ে রিফিউজি ছিল।
ব্রিটেইন সরে যাবার পর ১৯৪৮ সালে ডেভিড গোরিয়ান ইজরাইল দেশের ঘোষণা করে। তৈরি হয়ে গেল নতুন দেশ ইজরাইল।
আমেরিকাও আরব দেশ গুলোকে এমন ভাবে ভাগাভাগি করে রাখলো যেন এরা লড়াই করতে থাকে। লড়াই না করলে আমেরিকা থেকে অস্ত্র হাতিয়ার এখানে বিক্রি হবে না।
মুসলিম দেশ গুলো হাতিয়ার কেনে কয়েকটি কারনে -
১) ইসলামকে প্রমোট করার জন্য
২) প্রতিবেশি দেশের সাথে লড়াই করার জন্য।
আর প্রতিবেশি দেশের সাথে লড়াই করার পরিবেশ তৈরি করা হয়ে গেছে।
এই দুই পর্ব সংক্ষেপে আলোচনা করার অর্থ হল পরের পর্বে ইজরাইল ও প্যালেসটাইনের বিবাদ শুরু করা হবে এই পর্ব দুটো না জানলে পরের পর্ব গুলো সঠিক ভাবে নির্ণয় করতে অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন পড়ুয়ারা।
(চলবে)
লেখায়: সৈকত গোলদার