10/06/2023
সাহেবগঞ্জের ঝর্না - পর্ব ২
আমেরিকা ফেরার পর থেকেই অসীমবাবু ভাবছিলেন, সাহেবগঞ্জের ডায়েরির প্রসঙ্গটা তুলে এক দিন দিলীপকে ফোন করলে হয়। যোগাযোগটাও থাকবে আর ঘটনাটা তো ইন্টারেস্টিং বটেই। শেষে এক দিন একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলেন,
“দিলীপ, সে দিন এয়ারপোর্টে তোর ফোনটা পেয়ে খুব ভাল লাগল। সিয়াটলের সঙ্গে কলকাতার সাড়ে বারো ঘন্টার তফাত। তোকে কোন সময় ফোন করলে সুবিধে, জানাস। আমাদের '৬৬ ব্যাচের আর কার সঙ্গে যোগাযোগ আছে? কোনও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে কি? এর পর তো দেশে করে যাওয়া হবে, জানি না। রিটায়ারমেন্টের পর তুই এক বার ঘুরে যা। মজা হবে। সে দিন হিন্দুস্তান পার্কের বাড়ি খালি করার সময় একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল। সিক্সটি সেভেনের একটা ডায়েরিতে দেখলাম, তুই, আমি আর কাঞ্জিলাল এক বার সাহেবগঞ্জের ঝর্না দেখতে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে আমাদের মন্দার হিল্স বলে কোথাও একটা যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঝর্নায় এমন কিছু একটা ঘটে যে, মন্দার না-গিয়ে তুই আর আমি সেই রাতেই কলকাতার ট্রেন ধরি। অথচ কাঞ্জিলালের কী হল, সেটা লেখা নেই। আমার স্মৃতি থেকে ঘটনাটা পুরো মুছে গেছে। এমনকি, ঝর্নাটাও মনে করতে পারলাম না। কী ঘটেছিল রে? সিরিয়াস কিছু? তোর নিশ্চয়ই মনে থাকবে। খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তোর ফটোগ্রাফি কেমন চলছে? কাঞ্জিলালকে আমার শুভেচ্ছা জানাস।'
মেসেজটা পাঠিয়েই অসীমবাবুর মনে হল, কাঞ্জিলালকে যে চিনতে পারেননি, সেটা স্বীকার করে নিলেই হত। এত
দিন পর মনে না-ই থাকতে পারে! কাজটা ঠিক হল না।
আমেরিকার কর্মব্যস্ততা মানুষকে ফুরসতই দেয় না। দিন পনেরো হয়ে গেল, দিলীপের উত্তর না-পেয়ে অসীমবাবুর সাহেবগঞ্জের ঘটনার আগ্রহটা কমে এসেছে। এ-ও ভেবেছেন, যেহেতু ডায়েরিতে লেখা আছে অন্যায়টা দিলীপেরই ছিল, ও ইচ্ছে করেও উত্তর না দিতে পারে! আগের মতো সম্পর্ক তো আর নেই!
সে দিন আবহাওয়ার পূর্বাভাসে তুষারপাত ছিল। শুতে যাওয়ার আগে অসীমবাবু জানলা দিয়ে দেখলেন, গ্যারাজের
সামনে বরফ জমেছে। কাল তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ট্রেনেই অফিস যেতে হবে। ঘরের আলোটা নেভাতেই, মোবাইল
ফোনের স্ক্রিনে দিলীপের মেসেজ।
'অসীম, আজ ৯ই নভেম্বর। সাহেবগঞ্জের ঘটনার ফর্টি-সেকেন্ড অ্যানিভার্সারি। ঘটনাটা তোর মনে না থাকারই কথা। কারণ, আমিই তোকে ভুলে যেতে বলেছিলাম।
“ট্রেন থেকে ভোরবেলা সাহেবগঞ্জ স্টেশনে নেমেই আমরা একটা রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ঝর্না কত দূর। ঝর্নাটা ছিল স্টেশনের পিছনেই। পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। কিন্তু রিকশাওয়ালা ভাড়ার লোভে বলেছিল, দূর আছে। সামনেই একটা বছর দশেকের দেহাতি বাচ্চা ছেলেকে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুই একটা টাকা দিয়ে বলেছিলি, “যাও কুছ খা লো।””
'আমাদের ভাগলপুরের ট্রেন ধরার তাড়া ছিল। পাঁচ টাকা ভাড়া রফা করে তিন জনেই রিকশায় উঠলাম। মিনিট পনেরো ঘুরে রিকশাটা যখন আবার স্টেশনের পাশ দিয়েই যাচ্ছে, ওই বাচ্চাটা আমাদের দেখে হেসে কুটোপাটি। রিকশাওয়ালাকে টিপ্পনী কাটল, “ক্যায়া চাচা, পান খিলায়া?" আমাদের মধ্যে তুই-ই কথাটার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে রিকশাওয়ালাকে খুব একচোট নিয়েছিলি। বিহারে মামার বাড়ি হওয়ায় সুবাদে তোর হিন্দির দখলটা ভালই ছিল।
'সাহেবগঞ্জের ঝর্নাটা ছিল অপূর্ব! ঘন সবুজ জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে নিকষ কালো পাথর ধাপে ধাপে আকাশে উঠে গেছে। সেখান থেকে অঝোরে জল নীচে লাফিয়ে পড়ে পাথরে আওয়াজ তুলছে, ঝম ঝম ঝম। তুই তো বরাবরই হিরো। টারজানের মতো সঙ্গে সঙ্গে জলে নেমে গেলি। কাঞ্জিলাল অতি সাব্বানে জলের কাছাকাছি পৌঁছে একটা পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই তুই আচমকা ওকে জোর করে টেনে জলে নামালি। ও প্রচণ্ড ভয় পেয়ে তোকে জড়িয়ে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করতে গেলে, তুই সরে গেলি। হয়তো মজা করেই। কিন্তু ও একটা পাথরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। ঝর্নার জলটা যেখানে মাটিতে জমেছিল, সেখানে তোর কোমর জল। কিন্তু ওখান থেকেই প্রচণ্ড কয়েকটা স্রোত জঙ্গলের আড়ালে বয়ে গেছে। আমি ক্যামেরায় তোদেরই ফটো তুলছিলাম। হঠাৎ লেপের ভিতর দেখি, কাঞ্জিলাল নেই। তুই একা দাঁড়িয়ে, চোখে-মুখে উদ্বেগ। আমি চিৎকার করে উঠলাম, “অসীম, কাঞ্জিলাল কই?” তুই চুপ। আমি এগিয়ে জলের কাছে গিয়ে কাঞ্জিলালকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। তুই স্থির দাঁড়িয়ে। ঝর্নার এক টানা কম ঝম শব্দটা জঙ্গলের নিস্তব্ধতাকে সেই মুহূর্তে যেন আরও গম্ভীর করে তুলছিল। হঠাৎ কারও আওয়াজ পেয়ে আমি চমকে পিছন ফিরে দেখি, সেই দেহাতি বাচ্চাটা! জঙ্গলের দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে, “উ উধার ডুব গৈল।”
“সেই অপরিণত বয়সে, জঙ্গলের পরিবেশে, ঘটনার আকস্মিকতায় আমাদের তখন আত্মরক্ষা ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসেনি। অপরাধীর মতো আমি আর তুই জামা-কাপড়গুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে স্টেশন পালিয়ে এসেছিলাম। যত ক্ষণ পর্যন্ত না ট্রেনে উঠেছি, তত ক্ষণ ভয় পেয়েছি, যদি ঘটনার এক মাত্র সাক্ষী ওই বাচ্চাটা আমাদের পুলিশে ধরিয়ে দেয়।
'কাঞ্জিলালকে যে তোর মনে আছে, জেনে অবাক লাগছে। কলেজে ওর সঙ্গে আমার তখন নতুন বন্ধুত্ব। বাবা-মা নেই। এক আত্মীয়ের আশ্রয়ে থেকে এটা ওটা করে কলেজের খরচ জোগাত। আমিই ওকে বলেছিলাম, “চল, ঘুরে আসবি। সব খরচ আমার।”
“কলকাতায় ফিরেও আমার পুলিশের আশঙ্কাটা পুরো মাত্রায় ছিল। সব সময় ভয় পেতাম, বাচ্চাটার কাছে শুনে পুলিশ
যদি আমাদের ধরে, কাঞ্জিলালের ব্যাপারে কিন্তু তোকেই দায়ী করবে। মাসিমার কাছে মুখ দেখাব কী করে? তাই
তোকে এক দিন বাড়িতে ডেকে বুঝিয়েছিলাম, “যদি কেউ কখনও প্রশ্ন করে, জেনে রাখ, তুই কোনও দিন আমার
সঙ্গে সাহেবগঞ্জ যাসনি আর কাঞ্জিলাল নামে তুই কাউকে চিনিস না। সাহেবগঞ্জের ঘটনাটা মন থেকে মুছে ফেলিস।”
দিন পনেরো পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে কেউ কোনও দিন কাঞ্জিলালের খোঁজ করেনি। হঠাৎ এক দিন ক্লাসের মধ্যে কাঞ্জিলালকে ঢুকতে দেখে চমকে উঠলাম। ও আমার পাশে বসেই বলল, “দিলীপ, সে দিন অসীম ঠিকঠাক ফিরেছিল তো?”
"আমি ওর প্রশ্নটা সন্দেহের চোখে দেখেছিলাম। প্রশ্নটা কি পুলিশের? সঙ্গে সঙ্গে ওকেই দোষী সাব্যস্ত করার জন্য প্রশ্ন
করলাম, “তুই কি সাঁতার জানতিস?”
"না।"
“তা হলে তোর ও ভাবে একা একা ঝর্নার জলে নামাটা কি উচিত হয়েছিল? যদি কিছু হয়ে যেত?”
“ও হেসে বলেছিল, “ধুর, আমার কিছু হয়ে গেলে কার কী! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে অসীমের জন্যই খুব চিন্তা হচ্ছিল।”
'কাঞ্জিলাল বলেছিল, তোর এই এক টাকার বাচ্চাটাই নাকি জঙ্গল থেকে আদিবাসীদের ডেকে এনে ওকে উদ্ধার করে,
সুস্থ করে তোলে। এমনকি, ট্রেনের ভাড়াও ওরাই জোগাড় করে দেয়।
“এ বার কি তোর কিছুটা মনে পড়েছে?"
অসীমবাবু ঘড়িতে দেখলেন, রাত সাড়ে বারোটা। কাল তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ট্রেন ধরতে হবে। হোয়াটসঅ্যাপেই জবাবে
লিখলেন,
“দিলীপ, ঘটনাটা আবছা মনে পড়েছে। কিন্তু তোর গল্পের সঙ্গে ডায়েরির পাতাটা এক জায়গায় মিলছে না। পাতার ফটোটা দেখে তোর কমেন্ট জানাস। কাঞ্জিলাল যখন তোকে মা'র মৃত্যুর খবর জানিয়েছে, ওর নিশ্চয়ই আমাকে মনে আছে। ও এখন কোথায়? কী করে? জানাস।'
সকালে অসীমবাবু যখন রেল স্টেশনে পৌঁছোলেন, তখনও অন্ধকার। বরফ পড়েই চলেছে। ওভারকোটেও ঠান্ডা
আটকাচ্ছে না। ট্রেনে বসেই মোবাইলে দেখলেন, দিলীপের উত্তরটা কাল রাতেই এসেছে।
“অসীম, ডায়েরির পাতাটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। দেখে হাসি পেল। পাতার শেষ লাইনটা ভাল করে দেখলেই বুঝবি, তোর হাতের লেখা নয়। চলন্ত ট্রেন বলেই লেখাটা পুরোপুরি মেলেনি। নইলে, স্কুলে তোর লেখা আমি হুবহু নকল করতে পারতাম। বাঙ্কে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, কাঞ্জিলালের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে তুই যে নির্দোষ, আমিই দায়ী, পুলিশের কাছে সেটা কী করে প্রমাণ করা যায়? শেষমেশ তুই যখন ঘুমিয়ে পড়েছিস, আমিই তোর ডায়েরিতে লাইনটা জুড়ে দিয়েছিলাম। পুলিশের কাছে প্রমাণটা কাঁচা হলেও আমাদের বন্ধুত্বের গভীরতার প্রমাণ পেয়ে গর্ব হল বইকি!
'কাঞ্জিলালের একটা আইডি কার্ড আমার কাছে ছিল। ওটারই ছবি পাঠালাম। কার্ডে ওর সব পরিচয়ই আছে। যেটা নেই সেটা হল, ওর স্ত্রীর ক্যান্সার। বেচারা জেরবার হয়ে যাচ্ছে।'
অসীম আইডি কার্ডে কাঞ্জিলালের নীল ইউনিফর্ম পরা ফটোটা দেখেই সোজা হয়ে বসল। আরে! এ তো হিন্দুস্তান পার্কের বাড়ির সিকিয়োরিটি গার্ড। সে দিন বাড়ির চাবি হ্যান্ডওভার করে যখন বেরিয়ে আসছি, হাত জোড় করে বলল, “স্যর, পারলে বছরে পুজোর ক'টা দিন অন্তত কলকাতায় কাটিয়ে যাবেন। মাসিমাকে আমিই হুইল চেয়ারে বসিয়ে পাড়ার ঠাকুর দেখিয়ে আনতাম। সে সুযোগ আর পাব না।”
অসীমবাবুর অফিসের চার পাশ বরফে সাদা। অফিসে ঢুকতে গিয়েও কী মনে হল, ভাবলেন একটু হেঁটে আসবেন। ছেলেবেলা, বাবা, মা, হিন্দুস্তান পার্কের বাড়ি সব হারিয়ে কদিন মনটা খুব খারাপ ছিল। আজ কেমন যেন মনে হল, জীবনে যা হারিয়েছেন, তুলনায় পেয়েছেন অনেক বেশি। একটা কফির দোকানে ঢুকে দিলীপকে মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে বুক ভরা আনন্দ নিয়ে অফিসে ঢুকলেন,
'দিলীপ, শোন, একটা সাহায্য চাইছি। তোকে ছাড়া আর কাকেই বা বলব? ব্যাপারটা কিন্তু আর্জেন্ট। হিন্দুস্তান পার্কের বাড়ি বিক্রির টাকাটা তোর সরকারি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টেই পড়ে আছে। আমি ওই টাকা থেকে বাড়ির সিকিয়োরিটি গার্ডের স্ত্রীর ক্যান্সারের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ মেটাতে চাই। ওষুধ, পথা যা লাগে। যখন যেমন প্রয়োজন, তোকেই কিন্তু টাকাটা তুলে দিতে হবে। তুই ব্যাঙ্কের লোক। আমার কী করণীয়, জানাস প্লিজ। পারলে আজই।
“আর শোন, আইডি কার্ডের কাঞ্জিলালকে আমি কিন্তু চিনতে পারিনি।'