17/05/2019
এঁরা বুদ্ধিজীবী ।
সম্প্রতি এঁরা প্রেস ক্লাবে মমতা বন্দনায় বসেছিলেন । আনন্দবাজার পত্রিকায় তিন দশক কাটানোর সুবাদে এই বুদ্ধিজীবীদের খুব কাছ থেকে দেখার এবং শোনার সুযোগ আমার হয়েছিল । এক সময় সরকারের পৃষ্ঠপোষক তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের ব্যঙ্গ, বিদ্রুপও করা হত । কিন্তু এঁদের নিয়ে মস্করা ? এই স্তরে হত না যা এখন হচ্ছে ।
এই অবনমনের একটা বিশেষ কারণও আছে ।
একটা ঘটনার কথা বলি ।
দেশ পত্রিকার তিনতলার কাঁচে ঘেরা ঘরে একদিন সুনীল গাঙ্গুলী, দিব্যেন্দু পালিত, শীর্ষেন্দু মুখার্জি, জয় গোস্বামী এবং আরও দু-একজনের আড্ডা চলছিল এক বিকেলে । সুনীল গাঙ্গুলীর টেবিলে ডাঁই করা মুড়ি আর চা-এর কাপ । গণতান্ত্রিক শিল্পী সংঘের এক প্রতিনিধি ঢুকলেন । একথা সেকথা বলার পর শেষে বামফ্রন্টের জন্য একটি ঘোষণাপত্রে সুনীল গাঙ্গুলির সই চাইলেন । ঘোষণাপত্রটি হাতে নিয়ে সুনীলবাবু বারদুয়েক মনযোগ দিয়ে পড়লেন । শেষকালে সেই প্রতিনিধিকে হতাশ করে বললেন এই ঘোষণাপত্রের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ সহমত নই । নির্দিষ্ট দুটী বিষয় উল্লেখ করে বললেন সংশোধিত হলে তবেই সই করবেন, নচেত নয় । সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত ঘোষণাপত্রটি পড়ে সুনীল গাঙ্গুলীর সঙ্গে সহমত হলেন । কিছুটা হতাশ সেই প্রতিনিধিকে সুনীল গাঙ্গুলী বললেন আমার মতামত আমি বুদ্ধদেবকে বলে দেব । চিন্তা করবেন না ।প্রতিনিধিটি ফিরে গেলেন ।
সুনীল গাঙ্গুলীর সেদিনের সেই ভুমিকা আজ বড়ই প্রাসঙ্গিক ঠেকে । শুভাপ্রসন্ন, চিত্রশিল্পী হয়ে খ্যাতিবান হয়েছেন । একটা দাঁড়কাক একে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন । বাম আমলের শেষপর্যায়ে তার ইনিয়ে বিনিয়ে বামপন্থীদের কট্টর সমালোচনা দাগ কাটতো মানুষের মনে । মমতা ব্যানার্জি ২০০৯ এ রেলমন্ত্রী হয়েই তাঁকে রেলের উপদেষ্টা কমিটিতে ঢুকিয়ে মাসে দেড় লক্ষ টাকা আয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন । তারপর চিটফান্ড কান্ডে তার বৈষয়িক উত্থান নজরবন্দী হয়েছিল ইডি আর সিবিআইয়ের । দিল্লীর সৌজন্যে লকআপে না গিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন শুভাপ্রসন্ন । সম্প্রতি প্রেস ক্লাবে তিনি আবার বুদ্ধিজীবী সাজলেন । মমতার হয়ে ব্যাটিং শুরু করলেন নতুন করে ।
জয় গোস্বামী একসময় কট্টর বামপন্থী ছিলেন । ২০০৮-০৯ বাংলায় বাম সরকারের কট্টর সমালোচনা করে কবিতা লেখায় বুদ্ধদেব বলেছিলেন – আমাদের সরকারের ত্রুটি থাকতে পারে, তার সমালোচনা করুন । কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না জয় গোস্বামী পাঁচিল টপকাতে পারেন ।
.................... সেই জয় গোস্বামী শেষ পর্যন্ত পাঁচিল টপকালেন । মমতা তাকে সরকারে এসে শিশু কিশোর সাহিত্য একাদেমির চেয়ারম্যান করে দিলেন । সঙ্গে মাসিক ৮০০০০ টাকার রোজগার । নীল আলো জ্বালানো এসি গাড়ি, এয়ার কন্ডিশন ঘর । জয় গোস্বামীর বিপ্লব শেষ । কবির এক প্রিয়জন জয়কে পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর প্রশ্ন করেছের্ন – একটা স্থানীয় নির্বাচনে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে পঙ্গু করে কোটি কোটি আনুষের অধিকার লুঠ হল । ৭২ জন মানুষ মারা গেলেন । জয়দা আপনার কবি মন কাঁদেনি ? বিবেক প্রতিবাদী হতে বলেনি ?? জয় গোস্বামীর উত্তর ছিল – সব বুঝি, এই বয়সেও এসে আমার রোজগারটা বড় দরকার । আমি বড় অসহায় । যা বলেননি তা হল এই নীল আলো জ্বালানো গাড়ি, এয়ার কন্ডিশন ঘর এবং সরকারি নানান সুবিধায় আচ্ছন্ন থাকা নানা প্রলোভন আজ তাঁকে প্রতিবাদী হতে ভুলিয়েছে ।
এভাবেই কাত হয়েছেন শাঁওলি মিত্র, দশচক্রের স্রস্টা শম্ভু মিত্রের কন্যা । দ্বিতীয় সারিতে বসে মুখটা দেখিয়ে রেখেছেন প্রেস কনফারেন্সে । দিনের শেষে মমতা দেখবেন তো সেই ক্লিপিংস ! যে মমতা তাঁর সমস্ত উপার্জনের মালিক এখন, এই বঙ্গে ।
অরুণাভ ঘোষ – ২০০৯-১০ সাল থেকে একটা কথা বলতেন ‘এঁটো-কাটা কমিটি’ । অর্থাৎ এঁটো- কাটা কমিটির উপভোক্তা এঁরা অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীরা । খাবার পাতের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণকারি এরা । আজ বুঝি অরুণাভ ঘোষের কথার গভীরতা । মমতা এই কেমিস্ট্রিটাই ভালো বুঝে গেছেন ।
আর এই জাদুমন্ত্রেই পাইয়ে দেওয়ার ইকুয়েশনে এককালের কট্টর বামপন্থী চিত্রনির্মাতা অরিন্দম শীল মমতা-প্রেমী হয়েছেন । সুবোধ সরকার ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে মমতা দেবীর চেয়ারের জল মুছছেন । আর অভিরুপ সরকার সরকারি কর্মীদের প্রাপ্য এবং সঙ্গত অধিকার আটকাতে প্রলম্বিত পে- কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে দিব্যি দিন কাটাচ্ছেন । এটা-ওটা-সেটা এবং উপরিতে মজে আছেন তথাকথিত এই বুদ্ধিজীবীরা । মমতা লক্ষ্য রাখছেন এই দাসত্ব এবং আত্মসমর্পন কতটাগভীর তার দিকে । সন্তুষ্ট হলে রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার প্রাইজ গিফটও দিয়েও দিতে পারেন । সেদিন শুনছিলাম হুগলীর এক বড় ব্যবসায়ী তৃণমূল নেতাকে সুবোধ সরকার ধরেছেন । কাকুতি মিনতি - আপনার সঙ্গে তো মমতাদির ভালো যোগাযোগ আছে । এত লড়ছি আমি । রাজ্য সভার একটা সিট ............... ।
আসলে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একটা ভালো জিনিস বোঝেন - মধ্যবিত্ত বাঙালিরা জীবনের সব সঞ্চয়ের অলংকার যেমন ব্যাঙ্কের লকারে রাখতে ভালবাসেন ঠিক তেমনি এই রাজ্যের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা বহু পরিশ্রম ও মেধায় অর্জিত বিবেক ও সুনামকে সরকারের কাছে বন্ধক রাখতে কোন দ্বিধা করেন না, শুধু বিশেষ কিছু পাওনার লোভে । এরাজ্যের প্রতারিত গরীব মানুষকে সাইকেল, চাল কিংবা জুতো দিয়ে যেমন বধ করা যায় তেমনি বুদ্ধিজীবীদের ‘এঁটো-কাটা কমিটি’র ‘প্রধান’ করে উপরি রোজগার দিয়ে বশ করে রাখা যায় ।
একটা মন্ত্রীত্ব দিলে এককালে মমতাকে গালিগালাজ করা ইন্দ্রনীল সেন মমতার হয়ে সুর ভাজেন । একটা সাংসদ পদ দিলে “প্রতিবাদে, প্রতিরোধে আমি তোমাকে চাই’এর স্রস্টা সুমন চট্টোপাধায় আনুগত্য বহন করে বেড়ান । একটা মন্ত্রিত্ব দিলে ব্রাত্যর মত চাটুকার এ সমাজে পাওয়া সহজ হয় । বাংলার বুদ্ধীজিবিদের এই শ্রেণী চরিত্রটা মমতা সবার থেকে ভাল বোঝেন । তাই তিনি এত অনাচারের পরেও কিছু বুদ্ধিজীবী ম্যানেজ করতে সাক্সেসফুল ।
তাঁর সৌজন্যে রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিতের বাংলায় মিমি-নুসরত-মুনমুন কিংবা শতাব্দী রায়রাও ‘বুদ্ধীজীবী’ হয়ে যান । “তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ, তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়”–এর স্রষ্টা কবি শ্রীজাত কত সহজে নিজের শিড়দাঁড়াটা বিক্রি করে দেন । কলিযুগের কালিমায় বুদ্ধিকে পণ্য করেন তথাকথিত সুশীল সমাজ ।
আর দিনের শেষে শেষপর্যন্ত এই সুশীল সমাজের হাতে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হয়ে যান সাধারণ মানুষ । এই বুদ্ধিজীবীদের পরিচয়কে যাঁরা মান্যতা দিয়ে বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন ।
শুধু তারই মাঝে ‘সত্য’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেই বলিষ্ঠতা, যেখানে অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী অনায়াস দক্ষতায় বলতে পারেন - বামপন্থী আদর্শের প্রতি আমি অনুরক্ত । অনেকে হয়তো কিছু পাওয়ার লোভে দিক বদল করেছে । আমি তো কিছু পেতে আসিনি, আদর্শকে ভালবাসি বলে দিতে এসেছি ।
বুদ্ধিজিবীরা শুনছেন ??