21/07/2023
*সুরা ইখলাসের অর্থসহ উচ্চারণ, বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলত**
সুরা ইখলাসের অর্থসহ উচ্চারণ, বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলত
সুরা ইখলাস। কুরআনুল কারিমের ১১২তম ও ছোট সুরা এটি। যে সুরা তেলাওয়াতের মাধ্যমে মানুষ সবচেয়ে বেশি ফজিলত ও নেয়ামত পায় সেটি হলো সুরা ইখলাস। আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরা ৪ আয়াত বিশিষ্ট ছোট্ট সুরাটি হিজরতের আগে মক্কায় অবতীর্ণ হয়। সুরার নামের অর্থ থেকেই এর ফজিলত, মর্যাদা ও নেয়ামত প্রকাশ পায়।
সুরাটির উচ্চারণ, অর্থ, মর্যাদা ও তেলাওয়াতের ফজিলতগুলো তুলে ধরা হলো-
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ - اللَّهُ الصَّمَدُ - لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ - وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ
উচ্চারণ : কুল হুয়াল্লাহু আহাদ। আল্লাহুচ্চামাদ। লাম ইয়ালিদ ওয়া লাম ইউলাদ। ওয়া লাম ইয়াকুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ।’ (মাখরাজসহ বিশুদ্ধ উচ্চারণ শিখে নেয়া জরুরি )
অর্থ : (হে রাসুল! আপনি) বলুন, তিনিই আল্লাহ, একক। আল্লাহ অমুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি। আর তার সমতুল্য কেউ নেই।’ (সুরা ইখলাস)
সুরার নাম ‘ইখলাস’। যার অর্থ হলো- একনিষ্ঠতা, নিরেট খাঁটি বিশ্বাস, ভক্তিপূর্ণ উপাসনা। দুনিয়ার সব বিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার একত্ববাদের ওপর খাঁটি ও নিরেট বিশ্বাসী হওয়াকে ইখলাস বলে।
সুরার নামকরণ
সুরার প্রকৃত মর্মার্থের ভিত্তিতেই সুরাটির নামকরণ করা হয়েছে। এ সুরাটিতে মহান আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এ সুরাটি মানুষকে নিশ্চিত শিরক থেকে মুক্তি দিয়ে একত্ববাদের উপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস স্থাপনে মানুষ হয় মুখলিস বান্দায় পরিণত হয়।
সুরার বৈশিষ্ট্য
সুরাটির অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার শেখানো ভাষায় তাঁর পরিচয় তুলে ধরেছেন। যে পরিচয় তুলে ধরতে আল্লাহ তাআলা নিজেই এ সুরাটি নাজিল করেছেন। এ সুরার মতো কোনো সুরায় আল্লাহর একত্ত্ববাদের বিষয়টি বর্ণিত হয়নি। আল্লাহর সৃষ্টিরহস্যের নিরসণ করা হয়েছে এ সুরায়।
সুরাটি নাজিলের কারণ
- হজরত আনাস রাদিয়ল্লাহু আনহু বলেন, ‘খায়বারের কয়েকজন ইয়াহুদি একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে বলল- হে আবুল কাসেম! আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের নূর থেকে, আদমকে মাটি থেকে এবং পৃথিবীকে পানির ফেনা থেকে সৃষ্টি করেছেন। এখন আপনার রব সম্পর্কে আমাদের জানান, তিনি কোন বস্তু থেকে সৃষ্ট?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন কোনো জবাব দেননি। অতপর (তাদের উত্তরে) হজরত জিবরিল আলাইহিস সালাম সুরা ইখলাস নিয়ে হাজির হন।
- হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদিন নাজরানের সাতজন খ্রিস্টান পাদ্রি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। অতপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন-
‘আমাদের বলুন, আপনার রব কেমন? তিনি কিসের তৈরি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার রব কোনো জিনিসের তৈরি নয়। তিনি সব বস্তু থেকে আলাদা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা সুরা ইখলাস নাজিল করেন।
সুরা ইখলাসের বিষয়বস্তু
আল্লাহ তাআলা তার পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে সুরা ইখলাসের ৪ আয়াতের মাধ্যমে ৪টি বিষয় তুলে ধরেছেন। আর তাহলো-
- আল্লাহ এক। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তার একত্ববাদের সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন।
- তিনি অমুখাপেক্ষী। এ আয়াতে তিনি কোনো কিছুতেই মুখাপেক্ষী নন। কারো কাছে তার কোনো প্রয়োজন নেই। সব কিছুতেই তিনিই যথেষ্ট।
- তার জন্ম-সৃষ্টিতে কারো কোনো হাত নেই। তিনি কারো জনক নন আবার তাকে কেউ জন্ম দেননি। তিনি জন্ম-সৃষ্টি দেয়া ও হওয়া থেকে পূত-পবিত্র এবং মুক্ত।
- জন্মের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই এবং চতুর্থ আয়াতে বলা হয়েছে, তিনি অতুলনীয়। চারটি আয়াতের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদ।
- তার সমকক্ষ কেউ নেই। অর্থাৎ তিনি যে এক ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। তার ওপর তাকিদ করা হয়েছে, সত্যয়ন করা হয়েছে যে, তার সমকক্ষ কেউ নেই।
সুরাটির মর্যাদা
সুরা ইখলাস অনন্য মর্যাদা সম্পন্ন ৪ আয়াত বিশিষ্ট ছোট্ট একটি সুরা। সুরাটিকে কুরআনের ৩ ভাগের এক ভাগ ঘোষণা করা হয়েছে। হাদিসে এসেছে-
- হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘এক ব্যক্তি রাতের বেলা অন্য ব্যক্তিকে বার বার সুরা ইখলাস পড়তে শুনেছেন। সকাল হলে বিষয়টি রাসুলু্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবহিহত করা হয়। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ওই সত্তার শপথ! যার কুদরতি হাতে আমার প্রাণ। অবশ্যই এ সুরা কুরআন মাজিদের এক-তৃতীয়াংশের সমান।’ (বুখারি, আবু দাউদ, নাসাঈ, মুয়াত্তা মালেক)
- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন সাহাবিদের বললেন, তোমারা কি এক রাতে কুরআন মাজিদের ৩ ভাগের একভাগ পড়তে পারবে? সাহাবিরা এ প্রস্তাবকে খুবই কঠিন মনে করলেন। ফলে তারা বলল, আমাদের মধ্যে এ কাজ কে করতে পারবে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, সুরা ইখলাস কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান।’ (বুখারি, নাসাঈ)
- হজরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা কুরআনকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। আর এ সুরাটি (সুরা ইখলাস)-কে একটি ভাগে পরিণত করেছেন।’ (মুসলিম, তিরমিজি)
- হজরত ওকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি তোমাদেরকে এমন তিনটি সুরার কথা বলছি, যা তাওরাত, ইঞ্জিল, জবুর এবং কুরআনে অবতীর্ণ হযেছে। রাতে তোমরা ততক্ষণ ঘুমাতে যেয়ো না, যতক্ষণ সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস না পাঠ কর। ওকবা বলেন, সেদিন থেকে আমি কখনও এ আমল পরিত্যাগ করিনি।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)
সুরা ইখলাসের ফজিলত
সুরা ইখলাস-এর ভাব ও মর্মার্থ বুঝে পড়লে তাতে বান্দার অন্তরে আল্লাহর গুণাবলী গেঁথে যাবে। মনে প্রাণে ওই ব্যক্তি হয়ে উঠবে শিরকমুক্ত ঈমানের অধিকারী হবে। আর তার বিনিময়ে সে লাভ করবে দুনিয়া ও পরকালের অনেক উপকারিতা ও ফজিলত।
>> আল্লাহর ভালোবাসা লাভ
কোনো এক যুদ্ধের সেনাপতি জামাআতে নামাজ পড়ার সময় সুরা ইখলাস দিয়ে নামাজ পড়ান। যুদ্ধ থেকে ফিরে সৈন্যরা বিষয়টি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তা অবহিত করেন। তিনি তাদের বললেন, ‘তোমরা তাকে জিজ্ঞাসা কর কেন সে এরূপ করেছে। তখন সে সেনাপতি জানান, এ সুরায় আল্লহার গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে বিধায় আমি এ সুরাকে ভালোবাসি।’ বিষয়টি জানার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের জানান, ‘তোমরা তাকে গিয়ে বলো, আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন।’ (বুখারি, মুসলিম, নাসাঈ)
>> জান্নাত লাভ
একবার এক সাহাবা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি সুরা ইখলাসকে ভালোবাসি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বলেন, এ ভালোবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।’ (বুখারি, তিরমিজি)
>> গোনাহ থেকে মুক্তি
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রতিদিন ২০০ বার সুরা ইখলাস পড়বে, তার ৫০ বছরের গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। তবে ঋণগ্রস্ত হলে তা ক্ষমা হবে না।’ (তিরমিজি)
>> দারিদ্র্যতা থেকে মুক্তি
হজরত সাহল ইবন সাদ সায়েদি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে দারিদ্র্যতার অভিযোগ করল তিনি বললেন, ‘যখন তুমি ঘরে যাও তখন সালাম দেবে এবং একবার সুরা ইখলাস পড়বে। এ আমল করার ফলে কিছু দিনের মধ্যে তার দারিদ্র্যতা দূর হয়ে যায়।’ (তাফসিরে কুরতুবি)
>> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পাঠ করে তা তাকে বালা-মসিবত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট হয়।’ (ইবনে কাসির)
>> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে সুরা ইখলাস তেলাওয়াত করতে শুনলেন। তিনি বললেন, ‘এটা তার অধিকার।’ সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, তার অধিকার কী? তিনি উত্তরে বললেন- ‘তার অধিকার হচ্ছে জান্নাত।’ (মুসনাদে আহমাদ)
উল্লেখ যে, অনেকেই বলে থাকেন, সুরা ইখলাস ৩ বার পাঠ করলে সম্পূর্ণ কুরআনুল কারিম তেলাওয়াতের সাওয়াবের অধিকারী হয় বা কুরআন খতমের সমান। আসলে বিষয়টি এমন নয়। হাদিসের কোথাও সাওয়াব প্রাপ্তি কিংবা সম্পূর্ণ কুরআন খতম হওয়ার বিষয়টি বলা হয়নি।
বরং যে ব্যক্তি এ সুরাটির মর্মার্থ বুঝে আল্লাহর বিশেষ গুণাবলীগুলো হৃদয়ে ধারণ করবে সে আল্লাহর একত্ত্ববাদ ও ক্ষমতায় একনিষ্ঠ বিশ্বাসী হিসেবে বেড়ে উঠবে। সে হবে প্রকৃত ঈমানদার। আল্লাহ তাআলার দরবারে এ গুণাবলীর বিশ্বাসই তাকে মর্যাদাবাদ করে দেবে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুরা ইখলাসের ভাব ও মর্মার্থ নিজেদের মধ্যে ধীর বিশ্বাস স্থাপন করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহর একত্ত্ববাদ ও ক্ষমতায় পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করার তাওফিক দান করুন। হাদিসে ঘোষিত মর্যাদা ও ফজিলত লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।