আবাদভূমি - Abadbhumi

আবাদভূমি - Abadbhumi 'আবাদভূমি' শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা
(4)

আবাদভূমি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক (ABADBHUMI - A Trimonthly Magazine on Art, Literature and Culture) Editor and Publisher : Rajesh Datta

01/11/2023

সুকুমার রায়ের সম্পূর্ণ 'আবোল তাবোল' (৫৩টি ছড়া) পাঠ | বাচিকশিল্পী : রাজেশ দত্ত | 'আবোল তাবোল'-এর শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে কবির অমর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি | The legendary poet Sukumar Ray's 'Abol Tabol', the most iconic Bengali book for kids | Recited by Rajesh Datta | All nonsense rhymes of the book | A humble tribute to the poet celebrating 100 years of this unique work of literary nonsense verse.
📕✒️ছড়ার সূচি:—
আবোল তাবোল
খিচুড়ি
কাঠ-বুড়ো
গোঁফ চুরি
সৎ পাত্র
ভাল রে ভাল
কাতুকুতু বুড়ো
গানের গুঁতো
শব্দ কল্প দ্রুম
খুড়োর কল
লড়াই-ক্ষ্যাপা
বাবুরাম সাপুড়ে
ছায়াবাজি
কুম্‌ড়োপটাশ
সাবধান
বুড়ীর বাড়ী
প্যাঁচা আর প্যাঁচানি
হাতুড়ে
কিম্ভূত
চোর ধরা
বোম্বাগড়ের রাজা
নেড়া বেলতলায় যায় ক’বার?
ঠিকানা
বুঝিয়ে বলা
একুশে আইন
হুঁকোমুখো হ্যাংলা
বিজ্ঞান শিক্ষা
নারদ! নারদ!
কি মুস্কিল!
ডানপিটে
ভূতুড়ে খেলা
দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম
রামগরুড়ের ছানা
আহ্লাদী
হাত গণনা
গন্ধ বিচার
কাঁদুনে
অবাক কাণ্ড
হুলোর গান
ভয় পেয়ো না
নোট বই
গল্প বলা
ট্যাঁশ্ গরু
ফস্‌কে গেল
পালোয়ান
শিরোনামহীন ৭টি খুচরো ছড়া
আবোল তাবোল
———————————

৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী (২৪ অক্টোবর, ২০২৩) উপলক্ষে সশ্রদ্ধ স্মরণে বরণে অমিতা বসু। এক অলোকসামান্যা বঙ্গবিদূষী। জন্ম ১৯৩৩ সালে...
25/10/2023

৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী (২৪ অক্টোবর, ২০২৩) উপলক্ষে সশ্রদ্ধ স্মরণে বরণে অমিতা বসু। এক অলোকসামান্যা বঙ্গবিদূষী। জন্ম ১৯৩৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি উত্তর কলকাতার এক বিদগ্ধ বনেদি পরিবারে। তাঁর বাবা শ্রদ্ধেয় সুধীর কুমার বসু ছিলেন তৎকালীন হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের খ্যাতকীর্তি আইনজীবী এবং আইন-গবেষক, যিনি পরবর্তী জীবনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট ও ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’র সদস্যপদ লাভ করেন। অমিতার পিতামহ ছিলেন ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’র সদস্য একজন যশস্বী প্রাচ্যবিদ শ্রদ্ধেয় জে.সি.বসু, যিনি ভারত সংক্রান্ত গবেষণার জন্য কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান-পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। অমিতা বসুর জীবনাবসান হয় ১৯৯২ সালের ২৪ অক্টোবর। রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে। কলকাতা থেকে সুদূর পূর্ব ইউরোপের রোমানিয়া। গঙ্গা থেকে দানিয়ুব – স্রোতস্বিনী দুই নদীর মতোই সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে এক বিস্ময়কর তাঁর অভিযাত্রা, যা তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও সম্মান এনে দিয়েছে। বাংলা তথা ভারত এবং রোমানিয়ার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির মিলনের সাঁকোর ছিলেন তিনিই প্রথম কারিগর। জীবনের উত্থানপতন ও নানা প্রতিবন্ধকতাকে পেরিয়ে আজীবন দুই দেশের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের মহান ব্রতে আত্মনিবেদিত অমিতা বোস ছিলেন বহুমুখী সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, অনুবাদক, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও দর্শনের গবেষক, সংস্কৃতজ্ঞ, রোমানীয় ভাষাবিদ এবং সংস্কৃত-রোমানীয় অভিধানকার। রোমানিয়ার জাতীয় কবি ও দার্শনিক মিহাই এমিনেস্কুর রচনায় ভারতীয় দর্শনচিন্তার প্রভাব এবং রবীন্দ্রসাহিত্য ভাবনার সঙ্গে কবি এমিনেস্কুর সৃজন ও কবিসত্তার তুলনামূলক আলোচনা সংক্রান্ত গবেষণায় তিনি ১৯৭৫ সালে বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর এই অসাধারণ গবেষণাকর্মটি ১৯৭৮ সালে রোমানিয়ার ইয়াসি (Iasi) শহরের Junimea Publishing House থেকে Eminescu si India [Eminescu and India] নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
এশিয়া মহাদেশে অমিতা বসুই প্রথম এমিনেস্কুর কবিতা সংকলন অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। বাংলায় অনূদিত এই কবিতা সংকলনটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৯৬৯ সালে কলকাতার ঐতিহ্যমণ্ডিত ‘জেনারেল প্রিন্টার্স’ প্রকাশনী থেকে। আমাদের পরিবারের গৌরবের বিষয়, এই মূল্যবান বইটির প্রকাশক ছিলেন কলকাতার লেনিন সরণি-স্থিত এই সুখ্যাত প্রাচীন প্রকাশনী ‘জেনারেল প্রিন্টার্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা-কর্ণধার আমার দাদু (আমার মায়ের মেজো মেসোমশাই) শ্রদ্ধেয় শ্রী সুরেশচন্দ্র দাস মহাশয়। ‘জেনারেল প্রিন্টার্স’-এর অধুনা কর্ণধার আমার মামা শ্রদ্ধেয় শ্রী সুরজিৎচন্দ্র দাস ছিলেন অমিতা বসুর বন্ধু। ‘এমিনেস্কুর কবিতা’ শিরোনামে বইটি ‘অমিতা রায়’ (বিবাহ-পরবর্তী পদবী) নামে প্রকাশিত হয়।
রোমানিয়াতে তিনি ‘Amita Bhose’ নামে পরিচিত। তিনি বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। মাত্র ৫৯ বছরের স্বল্পায়ু জীবনকালে তাঁর সাহিত্য-সৃজন কর্মের সম্ভারের ব্যাপ্তি সুবিস্তৃত। তিনি সংস্কৃত-রোমানীয় এবং বাংলা-রোমানীয় অভিধানও রচনা করেন। এছাড়াও বাংলা প্রবাদ, রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, রবীন্দ্র নাটক, নজরুল ইসলামের কবিতা, গান, লোকসংগীত, প্রাচীন ভারতীয় নাট্যশাস্ত্র, চণ্ডীদাসের পদাবলী, গৌতম বুদ্ধের ধর্ম, দর্শন ও শিক্ষা, কালিদাসের কাব্য, শূদ্রকের সংস্কৃত নাটক ‘মৃচ্ছকটিকম’ ইত্যাদি রোমানীয় ভাষায় অনুবাদ করে বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে সে-দেশে তুলে ধরেন।
রোমানিয়া ও অন্যান্য দেশের পত্রপত্রিকায় তাঁর প্রায় ৫৬টি রোমানীয় সাহিত্যের বঙ্গানুবাদ ও বাংলা সাহিত্যের রোমানিয়ান ভাষান্তর এবং প্রায় ৯০-এর অধিক সংখ্যক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। রোমানিয়াতে শিক্ষিত সাহিত্যপ্রেমী সমাজ বাংলা তথা ভারত বলতে মির্চা এলিয়াদ ও মৈত্রেয়ী দেবীর সেই অবিস্মরণীয় মর্মস্পর্শী প্রেমাখ্যান ছাড়া আর যাঁকে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত করে স্মরণ করেন তিনি ইন্দো-রোমানীয় সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের পথিকৃৎ এই অনন্যসাধারণ বঙ্গতনয়া অমিতা বসু। বুখারেস্টে অমিতা বসুর নামে ফাউন্ডেশন তৈরি হয়েছে, যার প্রধান কাজ বাংলা তথা ভারতের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা। ২০০৯ সালে তাঁর ছাত্রী কারমেন মুসাতকোমান Stargaz publisher প্রতিষ্ঠা করে অধ্যাপক অমিতা বসুর কাজগুলি প্রকাশ করার শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
গভীর পরিতাপের বিষয়, অমিতা বসু তাঁর জীবনাবসানের ২৭ বছর পরে আজও অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালি তথা ভারতীয়দের কাছে অপরিচিত, অবজ্ঞাত বা বিস্মৃত রয়ে গেলেন।
বাংলা ও বাঙালির গর্ব শ্রদ্ধেয়া অমিতা বসুর অমর, উজ্জ্বল স্মৃতির প্রতি অন্তরের গভীর ভালোবাসায় শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই। 🙏🙏🙏🌻🌹❤️💐
👉 ✅ বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ২০০৮ সালে আমার এক রোমানিয়ান বন্ধু বিয়াত্রিস রাইলয়ানু (Beatrice Raileanu) আমাকে প্রথম অধ্যাপক অমিতা বসু সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যাদি জানান। চিকিৎসক পরিবারের কন্যা ইয়াসি নিবাসী বিয়াত্রিস পেশাগতভাবে ‘হেমাটোলজিস্ট’ হলেও, তাঁর আগ্রহ ও পাঠাভ্যাসের বিষয় ছিল ইন্দো-রোমানীয় সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি। তিনি নিজেও সাহিত্যের বিদ্যার্থী এবং অমিতা বসুর মনস্বিতার গুণমুগ্ধ ছিলেন। তাঁর কাছে আমি আন্তরিভাবে কৃতজ্ঞ। 🤝🙏 - রাজেশ দত্ত। Dear Beatrice, Multam frumos!
©️ Rajesh Datta
✅ Photographs Courtesy: page Amita Bhose https://www.facebook.com/amitabhose.ro/
✅ অমিতা বসুর সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে নীচের লিঙ্কে ক্লিক করে পড়ুন...
http://amitabhose.net/Works.asp
****************************************
📖 ✍️সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ’ থেকে অমিতা বসুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের স্মৃতিচারণার কিছু অংশ উদ্ধৃত করলাম...
“রুমানিয়ানরা শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান-দর্শন-জ্ঞান চর্চায় যথেষ্ট উন্নত। সেই জাতির এরকম শোচনীয় অবস্থা কেন? শুধু আজ নয়, পাঁচ-সাত বছর ধরেই নানা অনটন চলছে। এর জন্য দায়ী শুধু চাউসেস্কু আর তার দলবল? এই দুষ্টচক্রকে নিবৃত্ত করার কোনও উপায় এখানকার রাষ্ট্রব্যবস্থায় ছিল না?
রুমানিয়ার চাষিরা এক সময় যথেষ্ট সম্পন্ন ছিল। ১৯৬৫ সালের সংবিধানে সমস্ত চাষের জমিকে সামাজিক সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে চাষিদের বাধ্য করা হয় রাষ্ট্রীয় খামার কিংবা সমবায়ে যোগ দিতে। চাষিদের মনস্তত্বের কোনও গুরুত্ব দেওয়া হল না, সমাজতান্ত্রিক চেতনা গড়ে তোলার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হল না, একটা ব্যবস্থা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হল ওপর থেকে। সব কিছু চলতে লাগল এক কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায়, যা আসলে সমাজতন্ত্র-বিরোধী।
রুমানিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল চাউসেস্কু আর একটা উদ্ভট কাণ্ড করেছিলেন। গ্রামের চাষিদের বাড়িঘর ভেঙে-গুঁড়িয়ে সেখানে তৈরি করিয়েছিলেন লম্বা লম্বা ফ্ল্যাটবাড়ি। যে-সব চাষিরা নিজস্ব বাড়িতে ফুলগাছ-টমেটো গাছ, গোরু-ছাগল-মুরগি নিয়ে থাকত, তারা সেইসব নিয়ে উঠে যাবে দশতলার ফ্ল্যাটে? যত ছোটই হোক, তবু একটি পরিবারের নিজস্ব বাসস্থান নির্বাচন ও ইচ্ছেমতন সাজাবার স্বাধীনতাটুকুও যদি না থাকে, তবে তা কীসের সাম্যবাদ।
দ্রুত বড় বড় কলকারখানা স্থাপন করে দেশটাকে শিল্পোন্নত করার ঝোঁকে কৃষি মার খেয়েছে। ড্যানিয়ুব নদী থেকে বিশাল খাল কাটা কিংবা বুখারেস্টে মেট্রো রেল বানাবার জন্য এত অর্থের বিনিয়োগ হয়েছে যা দেশের অর্থনীতির পক্ষে অনুপযুক্ত। তবু এ দেশের জাতীয় উৎপাদনের একত্রিশ ভাগই কৃষিদ্রব্য, সুতরাং দেশের মানুষের খাদ্যাভাব থাকার কথা ছিল না। কিন্তু রুমানিয়ার সরকার বিদেশি মুদ্রা অর্জনের জন্য খাদ্যদ্রব্য, পেট্রল, খনিজ অন্যান্য দেশে চালান দিয়ে দেশের মানুষকে বঞ্চিত করেছে বছরের পর বছর। কাগজেকলমে দেখানো হত যে এই সব রপ্তানি করে রুমানিয়ার বৈদেশিক ঋণ অনেক কমিয়ে ফেলা হয়েছে, এখন অবশ্য প্রকাশ পাচ্ছে যে, ওইসব বিদেশি মুদ্রা দিয়ে চাউসেস্কু আর তার পত্নী অঢেল ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়েছে, বাথরুমে পর্যন্ত নিয়েছে সোনার কল।
হাঙ্গেরিতে থাকার সময় আমরা লক্ষ করেছি, রুমানিয়ার সাধারণ মানুষদের এ রকম দুরবস্থা নিয়ে কারুর কোনও মাথাব্যথা নেই। বরং রুমানিয়ানদের সম্পর্কে হাঙ্গেরিতে অবজ্ঞা বা বিদ্বেষের ভাব বেশ প্রবল। ট্রানসিলভানিয়া নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটা ক্ষত আছে বটে, কিন্তু এই দুই সমাজতান্ত্রিক দেশের সাধারণ মানুষও পরস্পরের প্রতি কোনও সমভ্রাতৃত্ব বোধ করে না? শ্রেণিহীন সমাজের আদর্শ যারা গড়তে চায়, সেখানেও জাতিভেদ!
হাঙ্গেরিতে একজনও বাঙালি বা ভারতীয়ের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি। একদিকে বাঙালিদের ঘরকুনো বলে বদনাম আছে, আবার পৃথিবীর বহু দুর্গম অঞ্চলেও বাঙালির সন্ধান পাওয়া যায়। আফ্রিকার নাইরোবি শহরের টিমে আমি একজন বাঙালির নাম দেখেছিলাম। আমার দেখা জায়গাগুলোর মধ্যে শুধু বুলগেরিয়া আর সাংহাই শহরে কোনও বাঙালির খোঁজ পাইনি। অতিশয় জনবহুল সাংহাই শহরে কোনও ভারতীয়ের সন্ধান পাওয়াও দুষ্কর। হাঙ্গেরিতে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-চারজন ভারতীয় আছে বটে, কিন্তু কেউ তাদের ঠিকানা বলতে পারেনি, ভারতীয় দূতাবাসে ফোন করেও কিছু সুবিধে হয়নি।
রুমানিয়ায় এসে আমরা আমাদের দূতাবাসে ফোন করে কোনও ভারতীয়ের সন্ধান চাইলাম। ওঁরা যে মহিলার নাম ও ঠিকানা দিলেন, তিনি একজন বাঙালি। গোটা রুমানিয়ায় দূতাবাসের বাইরে ভারতীয় বলতেও ওই একজনই। শ্রীমতী অমিতা বসুর নামের সঙ্গে আমরা আগেই পরিচিত, তিনি একজন লেখিকা, 'দেশ'-'আনন্দবাজারে' তাঁর বেশ কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
আমাদের ফোন পেয়েই অমিতা বসু আগ্রহের সঙ্গে বললেন, আপনারা যেখানে আছেন, সেখানেই থাকুন, আমি আপনাদের কাছে চলে আসছি।
অমিতা বসু অনেক বছর আগে তাঁর স্বামীর সঙ্গে এসেছিলেন এ দেশে। স্বামী এসেছিলেন চাকরির সূত্রে, অমিতা অবসর সময়ে রুমানিয়ার ভাষা শিখে নিয়েছিলেন, তারপর ওই ভাষা থেকে কিছু কিছু অনুবাদ করেন বাংলায়। বছর দু-আড়াই বাদে এই দম্পতি ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। কিছুদিন বাদে অমিতা আবার একা রুমানিয়াতে যান একটা অনুবাদক-সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে। তারপর থেকে তিনি এই দেশের সঙ্গে যেন একটা অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন। বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে অমিতা এখানে একা-একা রয়ে গেছেন দীর্ঘকাল। চাউসেস্কুর আমলের যাবতীয় কাণ্ডকারখানা ও গণঅভ্যুত্থান তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, চরম দুঃসময়ে আতঙ্কিত অবস্থায় দিন কাটিয়েছেন।
গত শতাব্দীর রুমানিয়ার প্রখ্যাত কবি, বলা যায় রুমানিয়ার জাতীয় কবি মিহাইল এমিনেস্কু-কে নিয়ে গবেষণা করেছেন অমিতা। মিহাইল এমিনেস্কুর খ্যাতি এখন আন্তর্জাতিক, যদিও আমাদের বাংলাতে তেমন পরিচিত নন। এই কবি বেঁচেছিলেন মাত্র ঊনচল্লিশ বছর, লিখেছেনও খুব কম, তাতেই তিনি চিরস্মরণীয়। রুমানিয়ান ভাষা ল্যাটিন ভাষার অন্তর্গত, কিছু কিছু শ্লাভিক শব্দ এর মধ্যে ঢুকে গেলেও এই ভাষার আত্মীয়তা অনেকটাই ফরাসি-ইতালিয়ানের সঙ্গে। এখানকার কবি-সাহিত্যিকরা এককালে পশ্চিম ইউরোপের সাহিত্য দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, কেউ কেউ পশ্চিমি সাহিত্যকেও মাতিয়েছেন। ফ্রান্সে সিম্বলিজম-এর পূর্ববর্তী যে ডাডাইজম, তার অন্যতম প্রবক্তা ত্রিস্তান জারার জন্ম রুমানিয়ায়। একালের বিখ্যাত নাট্যকার ইউজিন আয়েনেস্কোও রুমানিয়ান। আমাদের জানাশোনা সাহিত্য পরিধির মধ্যে আরও দুটি তথ্য উল্লেখযোগ্য। রোমান আমলে সম্রাট অকটোভিয়ান অগাস্টাস মহান ল্যাটিন কবি ওভিদ-এর ওপর রাগ করে তাঁকে রুমানিয়ার কৃষ্ণ উপসাগরের তীরে নির্বাসন দিয়েছিলেন। আর পঞ্চদশ শতাব্দীতে এখানকারই এক পরগণার রাজকুমার শত্রুদের ছিন্নমুণ্ড বর্শার ডগায় গেঁথে, কোনও রাসায়নিক দ্রব্য মাখিয়ে জীবন্তর মতন করে রাখতেন। তাঁকে নিয়েই কাউন্ট ড্রাকুলার গল্প প্রচলিত হয়, আয়ার্ল্যান্ডের ঔপন্যাসিক এই চরিত্রটি নিয়ে ভ্যাম্পায়ারের গল্প লিখে বিখ্যাত হন।
মিহাইল এমিনেস্কু অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ফরাসি সাহিত্য থেকে। আবার রুমানিয়ার প্রাচীন গাথা ও উপকথা, দেশের মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকসাহিত্যের প্রতিও ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। এই দুই ধারা মিশিয়ে তিনি রুমানিয়ান সাহিত্যে এক নতুন রূপ এনে দেন। দুঃখের বিষয়, এই প্রতিভাবান কবি বেশিদিন বাঁচলেন না, ব্যর্থ প্রেম, পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারা, নৈরাশ্যবোধ থেকে শেষপর্যন্ত এক পাগলাগারদে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর পরেও ফরাসি সাহিত্য ও রুমানিয়ার লোকসাহিত্যের একটা মিশ্র রূপ এখানে চলে আসছিল, পরবর্তীকালে অবশ্য সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব যথেষ্ট দেখা যায়।
অমিতা বসু এখানে একজন এমিনেস্কু বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। আবার রবীন্দ্রনাথকে এ-দেশের মানুষের কাছে সম্পূর্ণভাবে উপস্থিত করার জন্য তিনি রবীন্দ্র রচনাবলি অনুবাদেও হাত দিয়েছেন। রুমানিয়ান ও বাংলা, এই দু-ভাষাতে লেখাতেই তিনি সিদ্ধহস্ত। এখানকার বাংলার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে তিনি বাংলা-রুমানিয়ান অভিধান একটা তৈরি করেছেন, সেটা খুবই মূল্যবান কাজ।
এক সময় আমি জিগ্যেস করলাম, আপনার বাংলা বিভাগ কেমন চলছে? ক'জন ছাত্রছাত্রী?
উত্তর না দিয়ে তিনি চুপ করে চেয়ে রইলেন।
আমাদের ডাক শুনে চলে আসবার পর অমিতার সঙ্গে অল্পক্ষণেই ভাব জমে গেল। শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি সবদিকেই সজাগ এই মহিলার রসিকতাবোধ খুব প্রবল। আমাদের সঙ্গে নিয়ে বুখারেস্ট শহরটি দেখাবার সময় তিনি গত বছরের ভয়াবহ দিনগুলির কথা বলতে-বলতে নানারকম কৌতুক কাহিনিও শোনাচ্ছিলেন। কিন্তু লক্ষ করছিলাম, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলতে চান না। সে বিষয়ে প্রশ্নও করা যায় না। একবার শুধু বলেছিলেন, আপনারা চারজন বাঙালি এসেছেন, আপনাদের তো একদিন আমার ফ্ল্যাটে রান্না করে খাওয়ানো উচিত। কিন্তু কিছুই যে পাওয়া যায় না এখানে।
বাংলা বিভাগ সম্পর্কে আমার কৌতূহলের উত্তরে, একটু সময় নিয়ে, নির্লিপ্ত গলায় তিনি বললেন, এখন বুখারেস্টে কোনও বাংলা বিভাগ নেই। উঠে গেছে!
বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও হিন্দি পড়াবার ব্যবস্থা ছিল। গত এক-দেড় বছর ধরে হিন্দির কোনও অধ্যাপক ছিল না, হিন্দি জানা এক রুমানিয়ান মহিলা সেই ক্লাস নিচ্ছিলেন। তা নিয়ে আমাদের দূতাবাসের হিন্দিওয়ালাদের খুব মাথাব্যথা দেখা দিল। হিন্দির কেউ নেই, অথচ বাংলার একজন দেশি অধ্যাপিকা রয়েছে, এ কখনও হতে পারে? হিন্দি রাষ্ট্রভাষা, হিন্দির দাবি আগে! হিন্দি প্রেমিকারা এই নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে বারবার উত্যক্ত করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাংলা-হিন্দি দুটো বিভাগই তুলে দিয়েছেন।
অর্থাৎ আমাদের সঙ্গে যখন দেখা হয়, তখন অমিতার কোনও জীবিকা নেই।
এরপর যে প্রশ্নটা আমাদের সকলেরই মনে এসেছিল সেটা অসীম জিগ্যেস করল, চাকরি নেই, তা হলে আপনি এখানে চালাবেন কী করে?
অমিতা বললেন, যেমন করে হোক আমি চালাব। দেশে ফিরব না। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে ভালোবাসে। চরম বিপদ আর দুঃখের দিনগুলিতে আমি ওদের সঙ্গে থেকেছি। এখন ওদের ছেড়ে চলে যেতে পারব না। শেষপর্যন্ত কী হয়, আমি দেখতে চাই।

আস্তে-আস্তে কথা বললেও তাঁর কণ্ঠস্বরে একটা তীব্র জেদ ফুটে ওঠে। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে এমন সাহসিনী খুব কমই দেখা যায়।”
****************************************
-- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ‘ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ’।
#অমিতাবসু

ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক মনুবাদীদের অসভ্য কুপ্রথা ‘কুমারী পূজা’ কেন বন্ধ হবে না? নারীর অসম্মানের বিরুদ্ধে কেন সোচ্চার হবে না ...
22/10/2023

ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক মনুবাদীদের অসভ্য কুপ্রথা ‘কুমারী পূজা’ কেন বন্ধ হবে না? নারীর অসম্মানের বিরুদ্ধে কেন সোচ্চার হবে না একুশ শতকের শিক্ষিত মানবিক সমাজ?
————————————
আদিবাসীরা যখন মেয়েদের ‘ডাইনি’ বানান, তখন সেটা বর্বর প্রথা, মধ্যযুগীয় কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস বলে বিরোধিতা করা হলে, বন্ধ করা হলে, শিশুকন্যাদের ‘দেবী’ বানিয়ে ‘কুমারী পূজা’র ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক মনুবাদীদের এই অসভ্য কুপ্রথা কেন বন্ধ হবে না? এই কুমারী পুজোকে ‘পরম্পরাগত শাস্ত্র বিধান’ এবং হিন্দু ধর্মীয় ‘ঐতিহ্য’ বলে অজুহাত দিয়ে ‘মহিমান্বিত’ করে টিকিয়ে রাখা কেন হবে? এটি ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক মনুবাদীদের সৃষ্ট নারী অবদমনের কেন একটি বর্বর প্রথা, সেটা যাঁরা প্রথাটা এখনো এই একুশ শতকেও মর্যাদার সঙ্গে নিষ্ঠাভরে পালন করে চলেছেন, তাঁদের ভালো করে জানা ও বোঝা দরকার।

‘কুমারী পুজোর প্রথা’র মধ্যে মেয়েদের চরম অসম্মানের ব্যাপারটা কোথায় তা বুঝতে হলে আমাদের একটু প্রাচীন ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে।
কুমারী পুজোর ইতিহাস ও উদ্ভব বহু শতাব্দী প্রাচীন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন রূপে এর প্রচলন থাকলেও মূল বিষয়টি জড়িয়ে আছে প্রধানত কৃষিকেন্দ্রিক আদিম ‘জাদু বিশ্বাস’ বা ‘ফার্টিলিটি কাল্ট’ বা উর্বরতাতন্ত্রের সাথে। সেই আদ্যিকালে সভ্যতা ও বিজ্ঞানের বিকাশের অনেক আগে অজ্ঞানতার আঁধারে ঢাকা গোষ্ঠীবদ্ধ কৃষিজীবী সমাজে কুমারী পুজোর মাধ্যমে প্রকৃতিকে বা ধরিত্রীকে পুজো করা হত। মেয়েদের রজঃস্বলা হওয়াকে তারা চাষজমির উর্বর হওয়ার সাথেও তুলনা করত। নারীকে ‘ধরিত্রী’ ও ‘প্রকৃতি’র সাথে তুলনা করে, সেই প্রকৃতিরই বা ধরিত্রীরই আর এক রূপ ‘কুমারী মেয়ে’দের মধ্যে আরোপ করা হত। কামনা ছিল উর্বর জমি ও ভালো ফসল। মূলত আদিম অন্ধবিশ্বাস থেকেই এই আচারের উদ্ভব।
পরবর্তীকালে এই আদিম জাদু বিশ্বাস উর্বরতাতন্ত্রের সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগ হারিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচারের মধ্যে শাস্ত্রবিধানে ‘পরিশীলিত’, ‘পরিমার্জিত’ ও ‘পরিবর্তিত’ হয়ে, নিছক প্রথাসর্বস্বতায় পরিণত হয়ে পাকাপাকিভাবে স্থান করে নেয়। ‘কুমারীত্ব’ বা ‘ভার্জিনিটি’র ধারণাকে মহিমান্বিত করতে ‘মনুস্মৃতি’রও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভারতবর্ষের দুটি জায়গার কথা এখানে উল্লেখ করাই যায়, যেখানে ‘কুমারী’রূপেই দেবীকে পুজো করা হয়। একটি মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী দেবী মন্দিরে, অন্যটি কন্যাকুমারীতে। এছাড়াও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নানারূপে ‘কুমারী কন্যা’ রূপে দৈব-আরাধনা করা হয়।
সনাতনী শাস্ত্রবিধানের প্রচলিত বিশ্বাস – “কুমারী পুজো’ ছাড়া হোম-যজ্ঞ করেও দুর্গাপুজোর সম্পূর্ণ ফল পাওয়া যায় না”। শাস্ত্রে এক থেকে ষোলো বছর পর্যন্ত মেয়েদের কুমারী পুজোর কথা বলা আছে। বয়স অনুসারে কুমারীদের বিভিন্ন নামও যেমন দেওয়া আছে। তেমনই রয়েছে সেই সব পুজোর এক-একটি আলাদা নামও।
ব্রাক্ষণ্যতন্ত্রে শাস্ত্র বলছে, কুমারী পুজোর জন্যে ‘আদর্শ কুমারী’দের বয়স হল ৫ বছর থেকে ৭ বছর (মতান্তরে ৫ থেকে ১০)। কারণ, শাস্ত্রমতে, এই সময় তারা প্রকৃত ‘কুমারীত্ব’র মধ্যে অর্থাৎ যাকে বলা যায় ‘অরজঃস্বলা’ বা ‘অসূর্যস্পশ্যা’ (সাবেকি ব্যাখ্যায়)। যে নারীর তথাকথিত ‘কুমারীত্ব নষ্ট’ হয়েছে, শাস্ত্রমতে তারা ‘শুদ্ধ’ বা ‘পবিত্র’ নয়! অর্থাৎ সেই সব মেয়েদের ‘অশুদ্ধ’ বা ‘অপবিত্র’ তকমা দিয়ে শাস্ত্রকারদের নির্দেশে হীন-দৃষ্টিতেই দেখা হয়ে থাকে। এমনকি মনুর অনুগামী ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক রক্ষণশীল সমাজ-সংস্কৃতিতে ধর্মীয় বিধানে মেয়েদের ঋতুস্রাবকে-ও খুব ঘৃণার নজরে দেখা হয়ে থাকে। রজঃস্রাবের দিনগুলিতে ঋতুমতী মেয়েদের ‘অশুচি’ গণ্য করা হয়।
মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিকদের ‘শুদ্ধ নারী’ হল একমাত্র তারাই, যাদের শাস্ত্রকথিত ‘কুমারীত্ব’ রয়েছে অর্থাৎ শাস্ত্রমতে যারা ‘অক্ষতযোনি’ তারাই ‘শুদ্ধ’ ‘পবিত্র’ নারী। ‘অরজঃস্বলা’ ও ‘অসূর্যস্পশ্যা’ মেয়েদের ‘অক্ষতযোনি’ হওয়ারও সম্ভাবনা বেশি, তাই তারা শাস্ত্রমতে ‘পবিত্র’! তাই ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রমতে, সেই কুমারী কন্যারাই তথাকথিত ‘শুদ্ধতা’ বা ‘পবিত্রতা’র প্রতীক! সেই ‘অরজঃস্বলা’ বা ‘অসূর্যস্পশ্যা’ রূপকে ‘দেবী’জ্ঞানে চিন্তা করেই ভক্তিরসাশ্রিত হিন্দু ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক ভাববাদী চিন্তায় চলে আসছে কুমারী বালিকা পুজোর ধারা।
হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, ব্রাহ্মণদের অবিবাহিত কন্যা অথবা অন্য গোত্রের অবিবাহিত কন্যাকেও পুজো করার বিধান রয়েছে। কুমারী পুজোর আগে পুরোহিত কুমারীকে নতুন বস্ত্র,ফুলের মালা ও মুকুটে সাজান। পায়ে আলতা, কপালে সিঁদুর ও চন্দন ফোঁটায় সাজিয়ে ‘দেবী’ বলে বালিকাকে উপাসনা করা হয়। শাস্ত্রবচন ও শাস্ত্র নির্দেশ অনুসারে, সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান মেনে পুজো শেষে পুরোহিত ওই কুমারী মেয়েটিকে ‘দেবী জ্ঞানে’ আহার করান।

১৯০১ সালে বেলুড় মঠে কুমারী পুজোর প্রচলন করেছিলেন বিবেকানন্দ। আজও ধর্ম-মাদকে আচ্ছন্ন সমাজে সেই রীতি মেনে দুর্গাপুজোর অষ্টমী তিথিতে বেলুড় মঠে, বনেদি বাড়ি থেকে বারোয়ারি মণ্ডপে মণ্ডপে কুমারী পুজোর আয়োজন করে শিশুকন্যাদের উপর ‘দেবীত্ব’ আরোপের মনুবাদী ‘ট্র্যাডিশন’-এর অন্ধ কুসংস্কারের বর্বর প্রথা সমানে চলে আসছে!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুপ্রেরণায় প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ঊনবিংশ শতাব্দীর পটভূমিকায় রচনা করেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটোগল্প ‘দেবী’। এই কাহিনি অবলম্বনে আজ থেকে ছয় দশক আগে ১৯৬০ সালে বিশ্ববরেণ্য চিত্রনির্মাতা ও পরিচালক সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন তাঁর অবিস্মরণীয় ষষ্ঠ কাহিনিচিত্র ‘দেবী’। ১৯৬০-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি শর্মিলা ঠাকুর, ছবি বিশ্বাস, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ অভিনীত সাড়াজাগানো এই ‘দেবী’ ছায়াছবিটি মুক্তি পায়। গ্রামের জমিদার কালীকিঙ্কর রায় (ছবি বিশ্বাস)-এর মতো উগ্র ধর্মান্ধ কালীউপাসক স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে যখন তাঁর কনিষ্ঠা পুত্রবধূ দয়াময়ী (শর্মিলা ঠাকুর)-র উপর ‘কালী’র মহিমময় ‘দেবীত্ব’ আরোপ করেন, তখন সেই ধর্মোন্মাদ বৃদ্ধের অবচেতন মনের মানসিক বিকারগ্রস্ততাকে সত্যজিৎ রায় যুক্তিনিষ্ঠ মনোবৈজ্ঞানিক ও সমাজ-সাংস্কৃতিক বীক্ষায় নিপুণ দক্ষতায় বিশ্লেষণ করেন। তিনি এই ছবিতে সনাতনী হিন্দু ধর্মের গোঁড়া ভক্তিরসাশ্রিত, যুক্তিবিবর্জিত চিন্তাধারার বশবর্তী হয়ে মানুষের উপর মনগড়া ‘দেবত্ব’ বা ‘ঐশী’ শক্তি আরোপের নিষ্ঠুর, নির্মম অমানবিক মধ্যযুগীয় মনোভাবকে নিরাসক্ত ও নির্মোহ দৃষ্টিতে তুলে ধরেন। দয়াময়ীর মৃত্যুর মর্মান্তিক পরিণতিতে অন্ধ ধর্মীয় কুসংস্কার, সাধারণ মানুষের উপর যুক্তিহীন ধর্মীয় মৌলবাদী আবেগে ‘দেবত্ব’ আরোপ এবং কাল্পনিক ‘অলৌকিক’ শক্তির উপর অন্ধবিশ্বাসকে সত্যজিৎ তির্যক ভঙ্গীতে তীব্রভাবে কশাঘাত করেন। তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ ও ‘প্রগতিশীল’ বাঙালি নাগরিক সমাজ আজ তেষট্টি বছর ধরে ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে, টিভিতে ও ইন্টারনেটে বারবার দেখেছেন, আপ্লুত হয়েছেন, প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়েছেন।
তবু এই ছবির অর্ধ শতাব্দীর অধিক সময় পরেও অত্যাধুনিক সভ্যতার শিখরে আসীন জ্ঞানবিজ্ঞানে আলোকিত এই একবিংশ শতাব্দীর সমাজেও আমরা, তথাকথিত ‘প্রগতিশীল শিক্ষিত’ বাঙালি নাগরিক সমাজ নির্বিকার ঔদাসীন্যে, নিস্পৃহভাবে বেলুড় মঠ ও অন্যান্য স্থানে ‘কুমারী পুজো’র কুপ্রথার শুধু নীরব সাক্ষী হয়েই থাকছি না, ‘ঐতিহ্য’-এর দোহাই দিয়ে এই ‘কুমারী পুজো’য় যোগ দিচ্ছেন ‘সত্যজিৎ-প্রেমী’ তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ বাঙালি সমাজ!!

কবে বন্ধ হবে এই বর্বর অমানবিক আদিম কুপ্রথা? কবে বন্ধ হবে নগর-সভ্যতার এই অসহনীয় ভণ্ডামি? কবে ‘কালীকিঙ্কর’দের অন্ধবিশ্বাস ও মনোবিকারের হাত থেকে রক্ষা পাবে অসহায় ‘দয়াময়ী’রা? তাই বিতর্ক, আলোচনা আরো বেশি করে হোক।
ছোটো ছোটো ‘দয়াময়ী’দের এই ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের হাত থেকে বাঁচাতে শুধু গণবিজ্ঞানকর্মী, যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী সংগঠন ও মুক্তচিন্তকেরা নন, এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে এগিয়ে আসুন নারীমুক্তি আন্দোলনকর্মীরা, মানবাধিকারকর্মীরা, মুক্তমনা প্রগতিশীল লেখক-শিল্পী-বিদ্বজ্জনেরা, সমাজ ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা, শিক্ষিত ও প্রগতিশীল তরুণ ও ছাত্র-ছাত্রীরা। শিশু মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজ মনস্তাত্ত্বিকরা সমাজ ও মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে আলোকপাত করুন, সমাজকে শিক্ষিত করুন। আন্তরিক আবেদন জানাই সকল শুভ মূল্যবোধসম্পন্ন সকল সমাজ সচেতন মানুষকে।
— রাজেশ দত্ত

শতবর্ষ পেরিয়ে মনোরঞ্জন চৌধুরী : এক বিস্মৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মরমী গায়কের জীবন কথা-----------------------------সুভাষ...
20/10/2023

শতবর্ষ পেরিয়ে মনোরঞ্জন চৌধুরী : এক বিস্মৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মরমী গায়কের জীবন কথা
-----------------------------
সুভাষচন্দ্র বসুর বৈপ্লবিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পরাধীন দেশে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সবার মনে মুক্তিমন্ত্রের ‘দীপালী জ্বালাতে’ সংসারের মায়ার ‘বাহুডোর’ খুলে ‘পৃথিবী আমারে চায়, রেখো না বেঁধে আমায়’ বলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। ধরা পড়েছিলেন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে। তারপর কারারুদ্ধ। তাঁর কণ্ঠে ছিল গান। আর অন্তরে ছিল বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। তাঁর নাম মনোরঞ্জন চৌধুরী, কিংবদন্তী গায়ক সত্য চৌধুরীর মেজোভাই, ইতিহাসে আজ বিস্মৃতির অন্তরালে। এই মহৎপ্রাণ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সংগীত সাধকের জীবনকাহিনি লিখেছেন রাজেশ দত্ত। 'কুলায় ফেরা' ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত। প্রকাশকাল: ১৮ অক্টোবর, ২০২৩। মুদ্রণ মাধ্যম বা ইন্টারনেট মাধ্যমে এই লেখাটিই মনোরঞ্জন চৌধুরীর পূর্ণাঙ্গ জীবনী নিয়ে লেখা প্রথম অন্বেষণ মূলক নিবন্ধ। সহযোগিতায় মনোরঞ্জন চৌধুরীর পুত্র পরমানন্দ চৌধুরী।
নীচের লিংকে ক্লিক করে রাজেশ দত্তের লেখাটি পড়ুন...👇🏻
https://kulayefera.com/%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b6%e0%a6%ac%e0%a6%a8-%e0%a7%aa/%e0%a6%b6%e0%a6%a4%e0%a6%ac%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%b7-%e0%a6%aa%e0%a7%87%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a7%87-%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%b0%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9c%e0%a6%a8/

'কুলায় ফেরা' ওয়েবজিনে রাজেশ দত্তের লেখাটির শেষে প্রদত্ত ইউটিউব লিংকে ক্লিক করে শুনতে পাবেন মনোরঞ্জন চৌধুরীর অপূর্ব সুন্দর কন্ঠে অতুলনীয় গানগুলি। এই দুর্লভ রেকর্ডগুলিও পরমানন্দ চৌধুরীর সৌজন্যে প্রাপ্ত। 🙏🌹🙏

বিশ্ববন্দিত গণসংগীতশিল্পী পিট সিগারের জীবন এবং তাঁর জীবনের শেষ সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত আবাদভূমি - Abadbhumi পত্রিকার প...
22/09/2023

বিশ্ববন্দিত গণসংগীতশিল্পী পিট সিগারের জীবন এবং তাঁর জীবনের শেষ সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত আবাদভূমি - Abadbhumi পত্রিকার পিডিএফ কপি সংগ্রহ করতে নীচের গুগল ড্রাইভ লিংকে ক্লিক করে পত্রিকাটি ডাউনলোড করুন...👇
https://drive.google.com/file/d/1dg67hPbkdvvPAJY8uROPp26PpAUMxc2L/view?usp=drivesdk

শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক 'আবাদভূমি' পত্রিকার বিপুল জনপ্রিয় 'চার্লি চ্যাপলিন স্মরণ সংখ্যা' পড়ুন ও ডাউনল...
22/09/2023

শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক 'আবাদভূমি' পত্রিকার বিপুল জনপ্রিয় 'চার্লি চ্যাপলিন স্মরণ সংখ্যা' পড়ুন ও ডাউনলোড করুন নীচের লিংকে ক্লিক করে....👇
https://drive.google.com/file/d/1M7GuRNZAiXbpflejeDlt0OzXJNVRGCeg/view?usp=drivesd

'আবাদভূমি' পত্রিকার মুখ্য সম্পাদক ও প্রকাশক রাজেশ দত্তের মা, আমৃত্যু একনিষ্ঠ আদর্শপরায়ণ আপোসহীন নাস্তিক ও যুক্তিবাদী, সর...
29/07/2023

'আবাদভূমি' পত্রিকার মুখ্য সম্পাদক ও প্রকাশক রাজেশ দত্তের মা, আমৃত্যু একনিষ্ঠ আদর্শপরায়ণ আপোসহীন নাস্তিক ও যুক্তিবাদী, সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানবতাবাদী এবং গণবিজ্ঞান আন্দোলনের প্রেরণা বিগতপ্রাণ শ্রদ্ধেয়া সুব্রতা দত্তের অমর ও চিরউজ্জ্বল স্মৃতির প্রতি উৎসর্গীকৃত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন বিশিষ্ট কৃষিবিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী ও লেখক ড: অনুপম পাল। আলোচনার বিষয় ছিল: জিন শস্যের ভালো-মন্দ। অনুষ্ঠানের উদ্বোধনে রাজেশ তাঁর কথায় ও স্বরচিত গানে মাতৃস্মৃতিচারণ করেন এবং পরিবেশ সুরক্ষায় সবুজায়নের চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি স্বরচিত গণসংগীত পরিবেশন করেন।
গত ১৫ জুলাই ২০২৩, শনিবার সন্ধ্যায় চন্দননগরের বাগবাজারে 'গিরিদূত সভাগৃহ'-তে অনুষ্ঠিত বিগতপ্রাণ শ্রদ্ধেয়া সুব্রতা দত্তের স্মৃতিতে আয়োজিত এই মননশীল, তথ্য ও যুক্তিঋদ্ধ আলোচনা সভার উদ্যোক্তা: চন্দননগরের 'বিবর্তন বিজ্ঞান সংস্থা'।

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বনামধন্য চিকিৎসক ও সমাজকর্মী ডা: প্রবুদ্ধ ঘোষ। অনুষ্ঠানের সমাপ্তিতে পরিবেশ সচেতনতার বিষয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন বিশিষ্ট বাচিকশিল্পী ও সমাজকর্মী বিজ্ঞানবন্ধু ভট্টাচার্য।
ড: অনুপম পালের বক্তৃতার এই ভিডিওটি ইউটিউবে শেয়ার করেছেন বন্ধুবর অমিত চন্দ্র। তাঁকে আমাদের পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

কৃষিতে অতি বিপদজনক বিষ ।কৃষিতে ব্যাপক কীট/ছত্রাকনাশক স্প্রে, আগাছানাশক প্রয়োগ করার ফলে ভারতের কৃষিজমি ও মানুষ গ...

Address

Tarapada Das Lane, Kalupukur
Chandannagar
712136

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when আবাদভূমি - Abadbhumi posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to আবাদভূমি - Abadbhumi:

Videos

Share

Category

শেকড়ের সন্ধানে

হঠাৎই একদিন নিরুদ্দেশ হলেন শশাঙ্কশেখর। পেশায় অধ্যাপক। নেশায় ইতিহাসের গবেষক। প্রাচীন শিলালিপির অবোধ্য আখরমালার পাঠোদ্ধারে ছিলেন নিমগ্ন। দৈনন্দিন জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কাটত পড়ার ঘরে। ঘরের দেয়াল জুড়ে কাঠের বুক-শেল্‌ফ্‌। খোপে খোপে অজস্র বই ঠাসা। ধুলোটে, বিবর্ণ। অগোছালো পড়ার টেবিলেও স্তূপীকৃত বই। রাশি রাশি কাগজপত্রে লেখাজোখা, আঁকিবুকি। হাতলহীন একটি চেয়ার। এই চেয়ারে বসেই কাল থেকে কালাতীতে যাত্রা। অনন্ত অন্বেষণ। সিন্ধু সভ্যতার সীলমোহরে খোদিত গূঢ়-গহন প্রহেলিকার রহস্যময় জগতের আনাচকানাচে বিচরণ। স্ত্রী সুধাময়ী, ছেলে অমু, দুই মেয়ে ঝুমা ও রুমাকে নিয়ে সুখের সংসার। বৈভবে নয়, শান্তি ও স্বস্তির আটপৌরে গেরস্থালি জীবনের আনন্দ। তবু চলে গেলেন শশাঙ্ক। পরিবার-প্রিয়জনদের ছেড়ে নিঃশব্দে চলে গেলেন। কোনও চিঠি নেই, খবর নেই। হঠাৎই হারিয়ে গেলেন এক বৃষ্টিভেজা রাতে। কোথাও তাঁর হদিশ মিলল না। একরাশ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা ও বেদনার কালো মেঘ ঘনিয়ে এল পরিবারে। কেন চলে গেলেন ঘর ছেড়ে? কাউকে কিছু না জানিয়ে কোথায় গেলেন? বাবার স্নেহ থেকে তো কখনও বঞ্চিত হয়নি ছেলেমেয়েরা। গভীরভাবে ভালোবাসতেন স্ত্রী সুধাকে। কত আনন্দঘন মুহূর্ত, কত মধুর স্মৃতি ফেলে রেখে গেলেন। সুধার বুকের ভেতর উথালপাথাল ঝড়। আশা-নিরাশার দোলাচল, নিদারুণ দুশ্চিন্তা আর ব্যাকুল প্রতীক্ষায় কেটে যায় একের পর এক অশ্রুসজল দিন। শশাঙ্ক ফেরেন না। পাড়ার তল্লাট ছাড়িয়ে কলকাতার অলিগলি থেকে রাজপথ, থানা-পুলিশ থেকে হাসপাতাল, মর্গ — তন্নতন্ন করে খোঁজাখুঁজি। অক্লান্ত ছোটাছুটি। সবই ব্যর্থ হল। শুধু শূন্য হৃদয়ে এক অজানা রহস্যের পিছনে নিষ্ফল দৌড়। শশাঙ্কের এই অকস্মাৎ অন্তর্ধান ঘিরে ঘনীভূত হয় জটিল এক রহস্য। যে রহস্যের পরতে পরতে হাজারো সংশয়, প্রশ্নচিহ্ন। মানুষটাও তো চিরকালই ছিলেন রহস্যময়। চারপাশের দুনিয়া থেকে যেন আলাদা। ছেলেমেয়েরা দেখেছে, বাবা কখনও তপোধীর, কখনও প্রচণ্ড চঞ্চল। কখনও অধ্যয়নে নিবিষ্ট, কখনও অস্থির পদচারণা। কখনও মুখর, কখনও মৌন। মনে হত, কী যেন এক অব্যক্ত অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। কী যেন এক অদম্য আবেগ, চাপা অনুভূতি বিস্ফোরিত হতে চাইত। শুধু বলতেন, ‘এ যে কী কষ্ট, বুঝবি না, বুঝবি না। একটা অঙ্কের উত্তর না মেলার মতো। কয়েকটা ব্যঞ্জনবর্ণ আমি পেয়ে গেছি, শুধু যুক্তাক্ষর মেলাতে পারছি না।’ আজ ওরাও যেন বাবার মতোই কঠিন অঙ্ক মেলাতে পারছে না। সিন্ধু-সভ্যতার লিপিমালার মতোই দুরূহ দুর্বোধ্য এক গাণিতিক ধাঁধা। শিলালিপির মতোই খণ্ডিত স্মৃতিতে গাঁথা বাবার এক অস্পষ্ট অবয়ব। যেন ‘জিগ্‌স্য পাজল্‌’-এর মতো টুকরো টুকরো ছবি দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু সব মিলিয়ে ধরতে পারছে না সম্পূর্ণ মানুষটাকে। যে রহস্যভেদ না করতে পারার যন্ত্রণায় ওরা কাতর, বাবাও হয়তো এমনই এক অসহনীয় যন্ত্রণায় কষ্ট পেতেন অহোরাত্র। খুঁজে না পাওয়ার যাতনা। রুমা একবার বলেছিল, ‘এসব পুরোনো জিনিস ঘেঁটে ঘেঁটে কী পাও? ওসব জেনেই বা কী লাভ?’ শশাঙ্ক বলে উঠেছিলেন, ‘সে কী রে! পিতৃপরিচয় জানবি না? তাহলে যে নিজেকেই জানা হবে না।’ ওই অতীত, ওই হারানো ইতিহাস, ওটাই পিতৃপরিচয়, আত্মপরিচয় — বাবা আজ নিজেই হারিয়ে গিয়ে সেকথা বুঝিয়ে দিলেন। শশাঙ্ক বলতেন, ‘শিকড় থাকলে তবেই তো গাছ পাতা ফুল ফল। অথচ শিকড়টার কেউ খোঁজ রাখে না। একটু একটু করে একদিন হয়তো সভ্যতার শিকড়টাই শুকিয়ে যাবে, আর তখন যা-কিছু চোখে দেখতে পাচ্ছো, তা একটা প্রকাণ্ড ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাবে। এখন আমরা যেমন ইতিহাসের পাতায়, পাথরের গায়ে, মাটির তলায় সেই সভ্যতা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি, কিন্তু শিকড়টা খুঁজে পাচ্ছি না। পাচ্ছি শুধু বাড়িঘর, মূর্তি কিংবা মমি, কঙ্কাল, দুর্বোধ্য লিপি।’ শশাঙ্ক খুঁজতেন সেই শেকড়টাকে। খুঁজে বের করতে চাইতেন ইতিহাসের এক বিস্মৃত অধ্যায়, যা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে যুগ যুগ ধরে। স্বজনেরা ওঁর এই অন্বেষার নেশাকে বুঝতে পারেননি। কোন হারানো ঐশ্বর্যের সন্ধানে শশাঙ্কের নিরলস সাধনা? মাটি খুঁড়ে বের করা ভাঙাচোরা মূর্তি, প্রস্তরখণ্ড, পোড়ামাটির সীল — এসবের মধ্যে দামি কী থাকতে পারে ওরা কেউই বোঝেনি। এতো আর সোনাদানা নয়। তাই সুধাময়ীর কাছেও এসব ছিল ‘মাটি পাথরের জঞ্জাল’, ‘আঁস্তাকুড়’। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের কাছে এই আত্মভোলা শশাঙ্ককে নিয়ে ‘গর্ব’ করার মতো কিছুই ছিল না। নেহাতই ছাপোষা মানুষ। ভাড়াবাড়িতে বসবাস। যৎকিঞ্চিৎ উপার্জন। হিসেব করে সংসারের খরচপাতি। মাসকাবারে অনটন। আর্থিক কৌলীন্য, পেশাগত পদমর্যাদা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা বা খ্যাতি কোনওটাই ছিল না শশাঙ্কের। নাগরিক সমাজের প্রচলিত ‘স্ট্যাটাস’-এর মানদণ্ডে নিতান্ত ‘মূল্যহীন’। বড়ো হীনমন্যতায় ভুগতেন সুধাময়ী। ভগ্নীপতি রেবতী নামী কোম্পানির ঊর্ধ্বতন অফিসার। হাল-ফ্যাশনের দামি আসবাবে সুসজ্জিত ফ্ল্যাট। কত নামডাক, ঠাটঠমক, পসার-প্রতিপত্তি। নিজেদের খুব ‘ছোটো’ বলে মনে হত। তাই অপূর্ণ সাধ মেটাতে বাড়িটা একটু পরিপাটি করে সাজাতে চেয়েছিলেন। শুরু হল, সংসার খরচ বাঁচিয়ে একটু একটু করে টাকা জমানো। পুরোনো মান্ধাতা আমলের আসবাব বিদায় করে দিয়ে এল নতুন জিনিসপত্র। ডাইনিং টেবিল এল। বৈঠকখানায় সোফা এল। টিভি এল। এল ফ্রিজ। এমনকি শশাঙ্কের পড়ার ঘরের জং-ধরা লোহার র‌্যাকগুলো বদলে ঝকঝকে পালিশ করা মর্ডান ডিজাইনের কাঠের বুক-শেল্‌ফ। আধুনিক নাগরিক সমাজে শশাঙ্ককে ‘দামি’ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু ভালো করে বাসা সাজানোর বিভ্রমে ভুলে থেকে ভালোবাসার মানুষটা যে কত দামি, বোঝেননি সুধা। এখন এসবই নিরর্থক, মূল্যহীন। আসবাবপত্রগুলোর যতই দাম হোক, মানুষটা যে অমূল্য ছিলেন, তা আজ উপলব্ধি করেন সুধাময়ী। শশাঙ্ক বলতেন, ‘একটা সভ্যতার সর্বনাশের বীজ তার মধ্যেই থাকে। কোনটা দামি আর কোনটা দামি নয়, সেটা ভুলতে শুরু করে। তারপর এক সময় তার স্মৃতিভ্রংশ হয়ে যায়, মূল্যহীন জিনিসগুলোই হয়ে ওঠে মূল্যবান। আজকের সভ্যতাও তাই।’… “সামান্য একটা চাষিও জানে কোন জিনিসটা তার কাছে সবচেয়ে দামি, ‘বীজধান’! তাই বীজতলাকে সে প্রাণপণে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে, আমাদের এই সভ্যতা সেই বীজ চেনে না, কোথায় আছে জানতেও চায় না।”…‘আজকের এই অর্থহীন সভ্যতা ছুটে বেড়াচ্ছে। সে জানে না, তার আসল গর্ব কোথায়। যেদিন সেটা নিঃশব্দে চলে যাবে, নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, সেদিন তার জন্যে থাকবে শুধু হাহাকার। বীজধান নষ্ট হয়ে গেলে চাষির যেমন হয়।’— একথাও বলেছিলেন শশাঙ্কশেখর তাঁর ছেলেমেয়েদের। কিন্তু এতকাল ধরে কাছে পেয়েও বাবাকে কখনও ঠিকঠাক বুঝতে পারেনি অমু-ঝুমা-রুমারা। ভেতরের মানুষটাকে চেনবার তো কোনওদিন চেষ্টাও করেনি। ওঁর সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা-বেদনা, অভিমান — সবই ছিল ওদের কাছে অচেনা, অধরা। শশাঙ্ক যেন এক ‘অধর মানুষ’ দূরের মানুষ কাছে এলে চেনা যায়। কিন্তু কাছ থেকে দূরে হারিয়ে গেলেও যে এমন নিবিড় করে চেনা যায়, সেও তো অজানাই ছিল। সারা বাড়ি জুড়ে এক অসীম শূন্যতা ছড়িয়ে দিয়ে শশাঙ্ক যেন নিজেকে চিনিয়ে দিলেন। নিজের মূল্যটা বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। আজ নিখোঁজ বাবা আছেন ওদের স্মৃতি সত্তা মননে তাঁর অশরীরী অস্তিত্ব নিয়ে। এ যেন ‘দিবসে সে-ধন হারায়ে’, খুঁজে পাওয়া ‘আঁধার রাতে’। আজকের স্মৃতিভ্রষ্ট সমাজ ও সভ্যতার সর্বনাশের ‘বীজ’টি কোথায়, শশাঙ্কশেখরের অন্তর্ধানকে কেন্দ্র করে সেই কাহিনীই অসামান্য নিপুণতায় তুলে ধরেছিলেন রমাপদ চৌধুরী পঁয়ত্রিশ বছর আগে লেখা তাঁর অবিস্মরণীয় উপন্যাস ‘বীজ’-এ, যে আখ্যান আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে এই একুশ শতকে বিশ্বায়নের সংস্কৃতির আগ্রাসনের কালে। নয়া উদার অর্থনীতির যুগে দুনিয়া জুড়ে মানুষের এখন একটাই পরিচয় — সে ‘ক্রেতা’। ষাটের দশকের শেষের দিকে প্রাক্তন মার্কিন বিদেশ সচিব হেনরি কিসিংগার বলেন, ‘বিশ্বে আমরা নতুন মানুষ তৈরি করতে চলেছি।’ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের যুগে এই ‘নতুন মানুষ’ হল মানবিক সত্তাবিহীন, চেতনা-মননহীন, আত্মবিস্মৃত পণ্যবিলাসী ক্রেতা, যাদের জীবন আবর্তিত হয় নিছক ভোগের চাহিদা ঘিরে। সাধারণ মানুষের পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছে-অনিচ্ছে, সাধ-আহ্লাদ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আবেগ-অনুভূতি — সবকিছুরই নিয়ন্তা একচেটিয়া পুঁজিনির্ভর মুক্ত বাজার অর্থনীতির কোলে লালিত পণ্যমুখীন ভোগবাদী সংস্কৃতি। স্থূল ভোগসর্বস্ব বিশ্বায়নী সংস্কৃতির মোহ মানুষকে টেনে আনছে ধ্বংসাত্মক প্রতিযোগিতায়। এক অবক্ষয়ী মূল্যবোধের তাড়নায় দিগ্‌ভ্রান্ত আমাদের সমাজ যেন এক মৃত্যুবিলাসী রোমসম্রাটের অ্যাম্ফি থিয়েটারে পরিণত। যেখানে আমরা সকলেই সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের ‘দাস’ হয়ে গ্ল্যাডিয়টরের মতোই নিজেদের মধ্যে এক প্রাণঘাতী লড়াইয়ে মেতেছি। আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের জীবনশৈলী, আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি আজ গভীর সংকটের মুখোমুখি। সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে দেশজ সংস্কৃতির শিকড় অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত। মানব সংস্কৃতির বিশ্বজনীন রূপে রয়েছে দেশ-অঞ্চল-সমাজ ভেদে স্থানিক স্বকীয়তা ও বিভিন্নতা। এই বহুবর্ণময় বৈচিত্র্যই মানব সংস্কৃতির প্রাণশক্তি। প্রত্যেক জনজাতির কঠিন জীবন সংগ্রামে এই সংস্কৃতিই প্রাণময়তা ও প্রণোদনের উৎস। প্রাকৃতিক পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখতে যেমন জীববৈচিত্র্যের দরকার, তেমনই মানব সমাজকে বাঁচাতে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সম্ভার। বিভিন্ন অঞ্চলের জনজাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। সেই সংস্কৃতিই জাতির নিজস্ব সম্পদ, তার আত্মপরিচয় — যার ধারা লোকপরম্পরায় প্রবহমান। কিন্তু বিশ্বায়নের সংস্কৃতি এই শিকড় থেকেই মানব সভ্যতাকে উপড়ে ফেলতে চাইছে। ধ্বংস করছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে। আমাদের যা কিছু নিজস্ব, আমাদের দেশজ শিল্প ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার, বিশ্বায়নের অদৃশ্য হাতে কৃত্রিম একমুখী ছাঁচে গড়ার অপচেষ্টা চলছে। দেশিবিদেশি বৃহৎ পুঁজির বাজার-বর্গীদের হানাদারিতে মানুষ শুধু ভিটেমাটি, খেতখামার, জমি-জঙ্গল থেকেই উচ্ছিন্ন হচ্ছে না, ছিন্নমূল হচ্ছে তার সাংস্কৃতিক ‘আবাদভূমি’ থেকেও। মানবজমিন আজ বন্ধ্যা, বিপন্ন। শশাঙ্কশেখর ফিরে আসেননি। কিন্তু শশাঙ্কের পরিবার খুঁজে পেয়েছিল ওঁদের হারানো বিশ্বাস। হারিয়ে যাওয়া যা কিছু মূল্যবান, সবকিছুই আছে। সেগুলো ফিরে পাওয়ার গভীর এই আস্থাটাকেই বাঁচিয়ে রাখা দরকার। এ এক মহত্তম জীবনবোধ। শশাঙ্কের কথায়, ‘যা মূল্যবান, সেটাকে চিনে নেওয়া চাই, দাম দেওয়া চাই।… যেদিন সেটা থাকবে না, সেদিনও বিশ্বাস রাখতে হবে, আছে। কোথাও আছে, তা না হলে এই তেরতলা বাড়ি, উজ্জ্বল আলো, এই উপকরণের সভ্যতা ভবিষ্যতে একটা ভীষণ সুন্দর প্রকাণ্ড ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাবে।’ অনুদ্দিষ্ট ‘শশাঙ্কশেখর’দের ফিরে পাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে আমাদেরও পথচলা শুরু হল এক অনন্ত অনিবার অন্বেষণে। এই বিশ্বাসের ‘বীজধান’ অন্তরের ‘আবাদভূমি’তে রোপণ করেই আমরা এক অনাগত ‘নবান্নে’র প্রতীক্ষায়। (‘আবাদভূমি’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়। অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০১৩) আবাদভূমি - শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক ABADBHUMI - A Trimonthly Magazine on Art, Literature and Culture Editor and Publisher : Rajesh Datta

‘আবাদভূমি’ পত্রিকার শেষ প্রকাশিত সংখ্যা ‘অসুর আখ্যান’ (তৃতীয় বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা)-এর প্রচ্ছদ। প্রকাশকাল: এপ্রিল, ২০১৭। এই সংখ্যাটি বর্তমানে নিঃশেষিত।

Nearby media companies


Other Chandannagar media companies

Show All