06/06/2024
*আমাদের জমি যুদ্ধে ধ্বংস -- পরিণতি ভয়ংকর*
-------বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় ও রাহুল রায়
*কথা শুরুর কথা*
‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পরিবেশ রক্ষার সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক দিবস। ১৯৭২ সালের স্টকহোম সম্মেলনের পর জাতিপুঞ্জের ইউনাইটেড নেশনস্ এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম-এর নেতৃত্বে ১৯৭৩ সাল থেকে এই দিবস প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। পরিবেশ রক্ষার প্রচারের জন্য পৃথিবীর বৃহত্তম মঞ্চে এটি পরিণত হয়েছে। আবিশ্ব কয়েক লক্ষ মানুষ এই বিশেষ দিনটি পালন করে। প্রতি বছর দূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (বিশেষত প্লাস্টিক বর্জ্য), জীববৈচিত্র্য রক্ষা, মিঠাজল সংরক্ষণ, শক্তি সংরক্ষণ থেকে শুরু করে টেকসই ভোগবাদ ইত্যাদি নানান পরিবেশগত উদ্বেগের উপর আলোকপাত করার জন্য একটি নির্দিষ্ট বিষয় বেছে নেওয়া হয়। ২০২৪ সালে বিশ্ব পরিবেশ দিবস-এর বিষয় ‘ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুকরণ এবং খরা স্থিতিস্থাপকতা’। বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে ১৯৭৪ সাল থেকে জাতিপুঞ্জ বিশ্বজুড়ে পরিবেশ সংকটের গভীরতার নিরিখে মানুষকে সচেতন করে তুলতে একটি পরিবেশ বার্তা প্রতি বছর তাদের সামনে রাখে। ২০২৪ সালের জাতিপুঞ্জের পরিবেশ বার্তা -- ‘আমাদের ভূমি, আমাদের ভবিষ্যৎ’।
এই পরিবেশ বার্তাগুলি ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যায়, একই পরিবেশ বার্তা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পরিবেশ সংকটের গভীরতার বিচারে একাধিকবার এসেছে। এই বছরের যে পরিবেশ বার্তাটি দেওয়া হয়েছে, জাতিপুঞ্জ আগেও ১৯৭৭ সালে (ভূমিক্ষয়, মাটির উৎকর্ষ হ্রাস), ১৯৮৪ সালে (মরুকরণ) এবং ২০০৬ সালে (শুকনো অঞ্চলকে মরুতে পরিণত কোরো না) মানুষকে দিয়েছিল। কিন্তু অতি আশ্চর্যের বিষয়, পৃথিবীর মানুষ জাতিপুঞ্জের কাছ থেকে আজ অব্দি ৫১টি পরিবেশ বার্তা পেলেও বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ বা সন্ত্রাস বন্ধ করার কোনও বার্তা পায়নি। অথচ কে না জানে যুদ্ধে বা সন্ত্রাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবেশ! এ বছর চন্দননগর পরিবেশ আকাদেমি-র তরফ থেকে জাতিপুঞ্জের কাছে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বিশ্ববাসীকে এক বার্তা দেবার আবেদন জানানো হয়েছিল। কিন্তু জাতিপুঞ্জ সে কথায় কান দেয়নি। কারণ পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলি যুদ্ধ করে। এরাই এই গ্রহটির ওপর সুকৌশলে তাদের আধিপত্য কায়েম করতে চায়। জাতিপুঞ্জকেও তাদের মতো করে কথা বলতে বাধ্য করে। জাতিপুঞ্জ এদের হাতে খাঁচাবন্দি তোতা।
*যুদ্ধ ও আধিপত্যবাদ*
মানুষের ইতিহাসের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়েই রয়েছে সন্ত্রাস, যুদ্ধ ও আধিপত্যবাদ কায়েম করার ইতিহাস। পৃথিবীতে মানুষ যেদিন অন্যান্য প্রাণীদের ওপর প্রভুত্ব করতে সফল হয়েছিল, তা-ও এসেছিল এক ধরনের সংগ্রাম থেকে। অন্যান্য শক্তিশালী প্রাণীদের সঙ্গে লড়াই করে। তা সে লড়াই শক্তিরই হোক, কি বুদ্ধির। সেদিনের সেই পরিবেশে এটিও ছিল একপ্রকার আধিপত্যবাদ। প্রাণীকুলের ওপর মানুষের আধিপত্য, কর্তৃত্ব। সময় বদলেছে। মানুষ বর্তমানে প্রকৃতি ও অন্যান্য প্রাণী ছাড়াও নিজেদের মধ্যেই সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছে। সৃষ্টি হয়েছে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় বিপর্যয় -- যুদ্ধ। ইতিহাস বলে, মানুষ বিগত প্রায় ৩০০০ বছর ধরে সশস্ত্র যুদ্ধ করছে। এর মধ্যে মাত্র ৩০০ বছর সশস্ত্র যুদ্ধ হয়নি। যুদ্ধ মাত্রই এক নিষ্ঠুর, অনৈতিক ব্যাপার। এটি একপ্রকার সন্ত্রাস। কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এক ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে চাপ সৃষ্টি করা। কোন ব্যক্তিমানুষ যেমন এই পথ ধরতে পারে, তেমনই কোন সংগঠন এমনকী রাজনৈতিক কোন ভাবনা চাপিয়ে দিতে রাষ্ট্রকেও এই পথ ধরতে দেখা গেছে। প্রকৃতিতে প্রাণীজগতে একমাত্র মানুষে-মানুষেই যুদ্ধ চলে। এর সৃষ্টি হয়েছে প্রতিযোগিতা থেকে। কীসের প্রতিযোগিতা? জমির ওপর, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর, মানুষের ওপর অধিকার কায়েম করার প্রতিযোগিতা।
*পুঁজিবাদ, বিশ্বায়ন ও আতঙ্কবাদ*
পুঁজিবাদ এমন এক শক্তি যা আবিশ্ব সীমাহীন মেকি চাহিদার এক মানসিক ঝোঁক গড়ে তুলে নিজে ক্রমশই ফুলেফেঁপে ওঠে। এর প্রধান কাজ মানুষের মধ্যে এক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা। এই বিচ্ছিন্নতার বৃত্ত যতই সম্পূর্ণ হবে, পুঁজিবাদের সত্তা ততই প্রকট হবে। মানুষ নিজের অজ্ঞাতেই এক বন্ধন ও দাসত্বের শিকলে বাঁধা পড়বে। জন্ম নেবে এক বিচ্ছিন্নতাকামী অসুস্থ মানসিকতা। ঠিক এই পর্বেই পুঁজিবাদ রূপ নেয় আতঙ্কবাদের। পুঁজির বিকাশের সাম্প্রতিকতম পর্ব হল বিশ্বায়ন।
উত্তর-আধুনিক কালের আতঙ্কবাদের উদ্দেশ্য হল এক ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে তাকে মানুষের সামাজিক, মানসিক ও রাজনৈতিক জগতে জিইয়ে রাখা। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর এমন এক পুনর্বিন্যাস ঘটানো, যাতে আতঙ্কবাদ ও আতঙ্কবাদী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ আরও মজবুত হয়। সাধারণ নিরীহ মানুষই এদের আক্রমণের লক্ষ্য, যাতে জনজীবনে ভয়ের এক আবহ সৃষ্টি হয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়। এখানে একটি জরুরি কথা বলার, বিশ্বায়নের প্রযুক্তিগত সকল সুযোগ-সুবিধা নিয়েই আতঙ্কবাদীরা সারা পৃথিবীজুড়ে এক শক্তিশালী জাল বিছিয়েছে। এখন এরা এতটাই শক্তি ধরে যে, পৃথিবীর কোন একটি রাষ্ট্রের পক্ষে এদের মোকাবিলা করা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিবাদের ধর্মই হল সনাতন সকল কিছু ভেঙে মানুষকে তার শিকড় থেকে উপড়ে এনে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। আজ আবিশ্ব আতঙ্কবাদীরা পুঁজিবাদের এই কাজটিই করার চেষ্টায় রত।
*আতঙ্কবাদ ও যুদ্ধ -- প্রাণ যায় পরিবেশের*
নিউ মেক্সিকো-র মরুভূমিতে ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই সকাল সাড়ে পাঁচটায় পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে আতঙ্কবাদের এক নতুন চেহারা দেখা গেল, আর এর ঠিক ২১ দিনের মাথায় ৬ অগাস্ট সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে যখন মার্কিন বিমান বি-২৯ এনোলা গে-র দরজা খুলে পরমাণু বোমা ‘লিটল বয়’ ফেলা হল জাপান-এর হিরোসিমা-য়। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষার বিভিন্ন পর্বে তেজস্ক্রিয়তার ফলে মানুষ সহ নানান জীবপ্রজাতির মারাত্মক স্বাস্থ্যসংকট দেখা দেয়। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র মজুতি ও তা পরীক্ষার সময়ে পরিবেশে ব্যাপকভাবে এর তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে বিপর্যস্ত হয় বাস্তুতন্ত্র।
যুদ্ধের পরিণামে পৃথিবীর পরিবেশ ও প্রাণীজগৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ কথা ঠিক। কিন্তু বার-বার যুদ্ধের প্রস্তুতি, যুদ্ধের মহড়ায় তা বিপর্যস্ত হয় আরও বেশি। আর এই না-হওয়া যুদ্ধের বিপদটাই আরও বেশি। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এর ক্ষয়ক্ষতির কোনও হিসেব কষা হয় না।
ঠিক দু’দশক আগে ২০০৪ সালের নভেম্বরে ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে ফালুজা-য় মার্কিন সেনা ব্যবহার করেছিল ফসফরাস গোলা। এই গোলা যেখানে ফেলা হয়, তার দেড়শো মিটারের মধ্যে সকল প্রাণীর বিনাশ ঘটে। ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয় জীববৈচিত্র্য। পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর যুদ্ধের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবের দিকটি মানুষ বিগত ১৯৯০-৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের আগে বড় একটা তলিয়ে দেখেনি। এই যুদ্ধে ইরাক পারস্য উপসাগরের জলে প্রায় এক কোটি ব্যারেল কুয়েতি তেল ঢেলে দিয়েছিল। ১৯ জানুয়ারি, ১৯৯১ সালে মিনা-আল-আহমাদি অঞ্চলে তেলবাহী জাহাজে পাঁচটি প্রচণ্ড জোরালো বোমা বিস্ফোরণে চতুর্দিক তেলে ডুবে গিয়েছিল। ওই দিনেই কুয়েত-এ তেলের পাইপ লাইনও বোমার আঘাতে ভেঙে যাওয়ায় দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রায় ১৫০০ বর্গ কিলোমিটারের বেশি অঞ্চলজুড়ে এই দু’টি ঘটনায় তেল ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় ওই একই সময়ে ইরাকের মিনা আল-বক্স তৈলক্ষেত্রেও তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছিল। এর ফলে ভয়ানক বিপর্যস্ত হয়েছিল সেখানকার জলজ বাস্তুতন্ত্র। সকল সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সারা শরীরে তেল মাখা এক বিপন্ন পানকৌড়ি পাখির অসহায়তার ছবি আজও আমাদের কষ্ট দেয়।
উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাক ইচ্ছা করে কুয়েত-এর ৭৩২টি তৈলকূপ জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তৈলকূপের দহনে ঘন ধোঁয়ায় ভয়াবহ বায়ুদূষণ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। আকাশ থেকে অম্লবৃষ্টি হয়েছিল। তৈলকূপের দহনজাত ধোঁয়ায় থাকে নানাপ্রকার বিষাক্ত পদার্থ, যেমন- কার্বন মনোক্সাইড, না-পোড়া হাইড্রোকার্বন, পলি অ্যারোম্যাটিক হাইড্রোকার্বন, পলিক্লোরিনেটেড ডাইবেনজো ডায়োক্সিন, ফিউরান, কার্বন ঝুল, সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, রেডন এবং কার্বন ডাই অক্সাইড। এদের মধ্যে প্রথম দুটি পদার্থের সংস্পর্শে অল্প সময়ের জন্য থাকলেও তার পরিণাম প্রাণঘাতী হতে পারে। কার্বন ঝুল এবং পলি অ্যারোম্যাটিক হাইড্রোকার্বনের প্রভাবে ক্যানসার রোগ ঘটতে পারে। অন্যান্য পদার্থগুলোও মানুষ ও পশুপাখির স্বাস্থ্য, গাছপালা, ফসল, এমনকী ঘরবাড়ি, প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্রের পক্ষেও যথেষ্ট ক্ষতিকারক। ভীষণভাবে ব্যাহত হয়েছিল ফসল উৎপাদন। প্রায় ৫৬০ কিলোমিটার উপসাগরীয় সৈকতভূমি তেলের প্রভাবে দূষিত হয়ে পড়ে। উত্তর-আরব্য উপসাগর তেলে ভরে যায়। আন্তঃ জোয়ার-ভাটা সেখানে পুরোপুরি ব্যাহত হয়। বিনষ্ট হয় সেখানকার জলজ বাস্তুতন্ত্র।
বিপক্ষ সেনাকে ছত্রখান করতে মাটিতে ভূমিবোমা পুঁতে রাখা হয়। বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে ইওরোপ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়াজুড়ে পুঁতে রাখা অনেক সক্রিয় ভূমিবোমার খোঁজ মিলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন মহাদেশে ভূমিবোমা ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। লিবিয়া-র এক-তৃতীয়াংশ স্থলভাগই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের না-ফাটা গোলাবারুদ ও ভূমিবোমায় ভর্তি। এসব ভূমিবোমা ফাটলে শুধু যে মানুষ ও পশুপাখি মারা পড়বে তা নয়, বিপর্যস্ত হবে সেখানকার মাটির স্তর, ব্যাহত হবে নদীপ্রবাহ, বিপন্ন হবে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র। ভূমিবোমার হাত থেকে বাঁচতে মানুষ নিজের জায়গা ছেড়ে অনেক সময় প্রান্তিক অঞ্চলে আশ্রয় নিয়ে জীবনধারণের জন্য সেই প্রান্তিক পরিবেশের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের ওপরেই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এতে ক্রমশ বিপন্ন হয় সেখানকার জীববৈচিত্র্য। সামরিক বাহিনীর নানান কার্যকলাপ, যেমন- সেনা যাতায়াত, বিমান থেকে বোমা ফেলা, সেনাবাহিনীর নানারকম ভারী যানবাহন ও সাঁজোয়া গাড়ি চলাচলের ফলে মাটির নিচের জমাটবদ্ধ স্তর ভেঙে যায়, মাটির ওপরের স্তর আলগা হয়ে পড়ে এবং বহু গাছপালা ধ্বংস হয়। এর ফলে মাটির ক্ষয় বাড়ে। এটিই চরম বিস্ময়ের যে, ২০২৪ সালের পরিবেশ দিবসের বিষয় ‘ভূমি পুনরুদ্ধার’ হলেও যুদ্ধজনিত ভূমিক্ষয়ের ব্যাপারে জাতিপুঞ্জের মুখে কুলুপ।
সম্প্রতি আমরা রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ দেখেছি। এই যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে নাকি আপাত-বিরতি, তা এখনও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। এখন রোজ সকালে সংবাদপত্রের পাতাজুড়ে দেখা যায় ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইন-এর মধ্যে এক মারণযজ্ঞ চলছে। এই যুদ্ধে রোজই গুঁড়িয়ে যাচ্ছে নার্সারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাকেন্দ্র, ঐতিহ্যময় স্থান সবই। বিধ্বংসী সব গোলাবারুদ আছড়ে পড়ছে শক্তিকেন্দ্র, জল-সরবরাহ কেন্দ্র, বাঁধ, জনস্বাস্থ্য পরিষেবাকেন্দ্র, জনবহুল নানান এলাকা ও বাজারে। জল-সরবরাহ কেন্দ্রগুলি ধ্বংস হওয়ায় পানীয় জলে টান পড়ছে। হাসপাতালগুলিতে দেখা দিচ্ছে প্রচণ্ড জলকষ্ট। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পরিষেবা জলসংকটে বাধা পাওয়ায় দূষণের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। জনবহুল এলাকাতে চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে মানুষের চিকিৎসাবর্জ্য, খাদ্যবর্জ্য এবং বিশেষ করে বোমায় ভেঙে পড়া বাড়িঘরদোরের টুকরো। ধোঁয়া-ধুলোয় ক্রমশ বিষিয়ে উঠছে বায়ু।
*টেকসই উন্নয়ন ও সুরক্ষা -- কথা হয়েছিল, কিন্তু কেউ রাখেনি*
১৯৮৭ সালে মজবুত উন্নয়ন নিয়ে ব্রান্টল্যান্ড কমিশন এক প্রতিবেদন পেশ করে, নাম ‘Our Common future’। জাতিপুঞ্জ প্রতিবেদনটি বের করে। পৃথিবীর উত্তরের এবং দক্ষিণের ধনী ও গরিব দেশের পরিকাঠামোগত অসাম্যের কথা এখানে পরিষ্কার বলা আছে। এই একই সময়ে পাম (Palme) প্রতিবেদন বেরোয়, যার শিরোনাম ‘Our Common Security’। ইওরোপের মিসাইল নিয়ে নানান বিতর্ক এবং পারমাণবিক যুদ্ধের বিপদ এই প্রতিবেদনের প্রধান আলোচনার বিষয়। এই প্রতিবেদনটির প্রভাব ব্রান্টল্যান্ড কমিশনের প্রতিবেদনেও স্পষ্ট রয়েছে। ব্রান্টল্যান্ড কমিশনের একটি গোটা অধ্যায়ে সমরবাদের সমালোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশ অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে দূরে থাকুক। তাদের চিন্তাভাবনা থেকে যুদ্ধ-সংস্কৃতি দূরে সরিয়ে রাখুক। শুধু তাদের ‘Common future’-এর দিকে নজর দিক। ‘Common’ কী? Common হল এই গ্রহের সব সম্পদ। পৃথিবীর সব মানুষের জন্যই এ সম্পদ রয়েছে। এ সম্পদ কারোর ব্যক্তিগত নয়। নয় কোনও বিশেষ রাষ্ট্র বা দেশের।
ব্রান্টল্যান্ড কমিশনের প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে যে, বিশ্ব পরিবেশের পক্ষে যে কোন প্রকার পরমাণু যুদ্ধ বা সমরবাদ বিপজ্জনক। পাম প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছিল, পরমাণু যুদ্ধের খারাপ প্রভাবে কীভাবে জীবজগৎ বিপদগ্রস্ত এবং পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। পৃথিবীকে পারমাণবিক যুদ্ধের বিপদ থেকে বাঁচাতে ব্রান্টল্যান্ড কমিশনের প্রতিবেদনে তাই বলা হয়েছিল- ‘পৃথিবীর নানান জ্বলন্ত সমস্যাগুলোকে ঠিকভাবে মোকাবিলা বা সমাধান করতে না পেরে, চরম হতাশা ও অকর্মণ্যতা বোধ থেকে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলো পারমাণবিক যুদ্ধের খেলায় মেতেছে।’
*অতঃকিম্*
ব্রান্টল্যান্ড প্রতিবেদনে পরিষ্কার বলা হয়েছে, যুদ্ধের বদলে দেশের নিরাপত্তার কথা ভেবে আন্তর্জাতিক চুক্তি হোক। অস্ত্রের বোঝা কমানো হোক। বিভিন্ন জাতীয় সরকার অস্ত্রের উৎপাদন, আমদানি ও রপ্তানিতে উৎসাহ দেওয়া বন্ধ করুক। যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে ব্রান্টল্যান্ড ও পাম দুটি প্রতিবেদনেই স্পষ্ট করে বলা আছে- ‘Military is an impediment to future development’। তাই ‘military industrial complex’ গড়ে তোলা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক।
পৃথিবীর পরিবেশ যুদ্ধের প্রস্তুতি, যুদ্ধের মহড়া এবং যুদ্ধের পরিণামে বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে। যুদ্ধনীতির অঙ্গ হিশেবে একে ধ্বংস করা হয়েছে। যুদ্ধের হাতিয়ার হিশেবে একে ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও যুদ্ধের সংগে পরিবেশের নিবিড় যোগাযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আড়ালে থেকেছে। টাকার অংকে যুদ্ধের ফলে পরিবেশ ধ্বংসের মূল্য যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের থেকে অনেক বেশি। তবুও এই জরুরি বিষয়টিই চরম উপেক্ষিত। যুদ্ধের কুপ্রভাব যে নির্দিষ্ট কোন ভৌগোলিক সীমায় আটকে থাকে না, দেরিতে হলেও এ ব্যাপারে বিশ্বজোড়া সচেতনতা বাড়ছে। আমাদের প্রত্যেককে বুঝতে হবে যে, যুদ্ধের প্রভাবে পরিবেশ বিপর্যস্ত হওয়ায় আমরা কোন না কোন প্রকারে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত। আগামী দিনের যুদ্ধজনিত আরও বড় বিপর্যয়কে তাই যে কোনও মূল্যে ঠেকাতেই হবে। কবির সুরে সুর মিলিয়ে, আসুন, পৃথিবীর সকল শান্তিকামী মানুষ আমরা প্রত্যেকেই শপথ নিই --
‘যে কেড়েছে বাস্তুভিটে, সেই কেড়েছে ভয়,
আকাশ জুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয়।
হিংসাজয়ী যুদ্ধে যাব, আর হবে না ভুল
মেখলা-পরা বোন দিয়েছে একখানা তাম্বুল।’
ঋণ- বিহান, বইমেলা সংখ্যা, ২০০৬।
বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়, সমাজ ও পরিবেশকর্মী,
চলভাষ- ৮৪২০৫২৯৯৬৬
এবং
রাহুল রায়, পরিবেশকর্মী,
চলভাষ- ৯৪৩৩৫৭৫৩৬৪