23/10/2023
📌ইনকিলাব জিন্দাবাদ!! এই শব্দ দুটি শুনলে কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তাই না? এই শব্দ দুটি জনপ্রিয় করেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিং। ১৯৩১ সালের ২৩শে মার্চ নির্ধারিত সময়ের আগেই বিপ্লবী ভগৎ সিংএর ফাঁসি হয়। আপনি কি জানেন তাঁর এই ফাঁসি বেআইনি ছিল? শুনে অবাক হলেন? যে ব্রিটিশ সরকারের আমলেও ফাঁসি কি করে বে আইনি হয়? তাহলে আরো একটা কথা শুনলে আরো অবাক হবেন যে মহাত্মা গান্ধী ভগৎ সিং এর ফাঁসি রোধ করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত। অথচ তাদের মধ্যে মতাদর্শের প্রচুর অমিল ছিল। মহাত্মা গান্ধী ছিলেন অহিংসা বাদী, আর ভগত সিং ছিলেন সহিংস বিপ্লবী। আসুন আজকের এই পোস্টে হোয়াটসঅ্যাপ এ ফরোয়ার্ড হওয়া ভুয়ো গল্পঃ বাদ দিয়ে ভগৎ সিং এর আসল ইতিহাস ও রহস্য জানা যাক।
🔵ভগৎ সিং 27 সেপ্টেম্বর 1907 সালে একটি পাঞ্জাবী শিখ পরিবারে জন্মগ্রহন করেছিলেন পাঞ্জাবের বাঙ্গা নামের একটি গ্রামে যেটি তখনকার ব্রিটিশ ভারত এবং বর্তমানে পাকিস্তান। ভগৎ সিং- এর বাবা কিষান সিং এবং তার চাচা অজিত সিং তখনকার সময়ে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। 1907 সালে Canal Colonization Bill এবং পরে 1914 সালের গদর আন্দোলনেও তারা যোগ দিয়েছিলেন।
🔥4ই সেপ্টেম্বর ১৯২০ সাল। মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। 1923 সালে ভগৎ সিং লাহোরের ন্যাশনাল কলেজে যোগদান করেন, যা দুই বছর আগে অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসাবে লালা লাজপত রায় তৈরি করেছিলেন, এটি ভারতীয় ছাত্রদের ব্রিটিশ ভারত সরকার কর্তৃক ভর্তুকি দেওয়া স্কুল ও কলেজগুলি পরিত্যাগ করার ডাক দেয়। ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদের মত বিপ্লবীরা মহাত্মা গান্ধীর সাথে এই অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু 1922 সালের ফেব্রুয়ারিতে, চৌরিচৌরা ঘটনা হিংসাত্মক রূপ নেয়। সহিংসতার এই ঘটনার কথা শুনে, মহাত্মা গান্ধী অবিলম্বে এই আন্দোলন বন্ধ করার আহ্বান জানান।" কারণ তিনি হিংসার বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু এটা করার ফলে অনেক বিপ্লবী হতাশ হয়ে পড়েন। অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী আলাদা আলাদা দল তৈরি করেন। 1926 সালে, ভগত সিং নওজওয়ান ভারত সভা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল ভারতের প্রথম দিকের বামপন্থী সংগঠনগুলির মধ্যে একটি।
পরে তিনি হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দেন। 1928 সালে এটি হিন্দুস্তান রিপাবলিকান সোশ্যালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনে পরিনত হয়।
💥সেই বছরই মানে 1928 সালে, সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ চলছিল। সত্যাগ্রহের সময়ে পুলিশ সুপার জেমস স্কট, লাঠিচার্জের নির্দেশ দেন। সেখানে একজন ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা লাজপত রায়। সেখানে তিনি আহত হন। আর পরে সেই ক্ষতের কারণেই তিনি শহীদ হন। এই ঘটনা নিজের চোখে দেখেছিলেন ভগৎ সিং। হত্যার বদলা নিতে 1928 সালের ডিসেম্বরে, তিনি এবং তার কমরেডরা স্কটকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এখানে তাদের একটু ভুল হয়, তারা ভুল করে সহকারী পুলিশ সুপারকে হত্যা করে। তিনি ছিলেন 21 বছর বয়সী, জন স্যান্ডার্স। এই ঘটনার সময় একজন ভারতীয় পুলিশ কনস্টেবল চরণ সিং যিনি ব্রিটিশদের হয়ে কাজ করতেন রাজগুরু ও ভগৎ সিংকে ধরতে ছুটে যায় কিন্তু চন্দ্রশেখর আজাদ আত্মরক্ষা হিসাবে তাকেও গুলি করে। এই পুরো ঘটনাটিকে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা বলা হয়।
💥এরপরে 1929 সালের এপ্রিল মাসে আরো একটি ঘটনা ঘটে।ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে বোমা ফেলে। সরকার সে সময় কেন্দ্রীয় পরিষদে দুটি বড় বিল পাস করছিল। জননিরাপত্তা বিল এবং বাণিজ্য বিরোধ বিল। সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের প্রতিবাদ আন্দোলন বৃটিশ সরকার বেআইনি করে দেওয়ার জন্য এই বিল। সেই সভায় ভগত সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত আসেন এবং সভার মাঝখানে একটি বোমা ফেলে। এবং স্লোগান দেয়। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। সেখানে তারা বোমা ফেলার পরও পালিয়ে না গিয়ে সারেন্ডার করে। তারা এই বোমা ফেলে কাউকে হত্যা করতে চায়নি।বোমার আঘাতে ছয়জন সামান্য আহত হয়েছিল।আর কেউ নিহত হয়নি । গ্রেফতারের পর ১৯২৯ সালের ৭ মে তাদের বিচার শুরু হয়। সরকার ভগৎ সিং কে ফাঁসাতে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনেন।
আদালতে ভগৎ সিং কিছু আইনি পরামর্শ নিয়ে নিজের প্রতিনিধিত্ব করেন। আর বটুকেশ্বর দত্তের প্রতিনিধিত্ব করেন কংগ্রেস সদস্য ও বিশিষ্ট আইনজীবী আসিফ আলী। প্রায় 1 মাস পরে, ব্রিটিশ আদালত তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। 14 বছরের জেল। এর সাথে সাথে স্যান্ডার্স হত্যার জড়িত প্রমাণ ও পাওয়া যায়। শিব ভার্মা, জয়দেব কাপুর, রাজগুরু এবং অন্যান্য বিপ্লবীদের গ্রেফতার করা হয়।" ভগৎ সিং যখন জেলে ছিলেন, ব্রিটিশরা লাহোর এবং সাহারানপুর বোমা কারখানা খুঁজে পায়। এই কারখানা Hindustan Socialist Republican Association এর সাথে যুক্ত বিপ্লবীরা তৈরি করেছিলেন। যে বিপ্লবীদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের মধ্যে কয়েকজন ব্রিটিশ সরকারের চাকরে পরিণত হয় এবং সবকিছু বলে দেয়।
ভগৎ সিং যিনি আগে থেকেই জেলে ছিলেন সেন্ট্রাল আসেম্বলির বোমা হামলার জন্য, তিনি আবার স্যান্ডার্স হত্যার জন্য আবার দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাঁকে অন্য কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।
সেই জেলে থাকাকালীন তাকে যেনো রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে দেখা হয় আর সব বন্দীর প্রতি সমান আচরণের দাবি জানান তিনি। ভালো খাবার, ভালো পোশাক, বই এবং তাদের সবাইকে দৈনিক সংবাদপত্র দেওয়া উচিত, এমন দাবিও জানান তিনি। কিন্তু ব্রিটিশরা চেয়েছিল ভগৎ সিংকে একজন সাধারণ হিংস্র অপরাধী ও দেশদ্রোহী হিসেবে বিবেচনা করা হোক। যেমন করে এখন করা হয় , কেউ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই তাকে দেশ দ্রোহী বানিয়ে দেওয়া হয়, আর সঙ্গ দেয় মিডিয়াও। যাই হোক এই দাবি না মানায় জন্য ভগৎ সিং আমরণ অনশন শুরু করেন । এই খবর সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি হয়ে ওঠেন দেশের জাতীয় আইকন। দিন দিন, অনশন দীর্ঘ হওয়ার সাথে সাথে, ভগৎ সিং-এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
ভাইসরয় আরউইন এই বিষয়টা খুব তাড়াতাড়ি মেটাতে চাইছিল। এই কারণেই সন্ডার্স হত্যার বিচার শুরু হয়েছিল 1929 সালের জুলাই মাসে।বিপ্লবীরা নিজেদের বিচার বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেন।১৯২৯ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর অনশনের ৬৩ দিন পর যতীন্দ্রনাথ দাস শহীদ হন। সুভাষ চন্দ্র বসু তাঁর মরদেহ কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সেখানে তার শেষ কৃত্যে 500,000 মানুষ অংশ নিয়েছিল।" কিন্তু এর পরেও লাহোর বন্দীদের সাথে অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে ভগৎ সিং অনশন চালিয়ে যান। অনশনের 116 দিন পর, 1929 সালের 5ই অক্টোবর তিনি তার ধর্মঘট শেষ করেন। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম অনশন ।এর ফলে ভগৎ সিংয়ের গল্প ভারত ছেড়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু চার বিপ্লবী জয় গোপাল, হংস রাজ ভোহরা, ফনীন্দ্র নাথ ঘোষ এবং মনমোহন ব্যানার্জি ব্রিটিশ সরকারের দেখানো লোভে পড়ে বিচারে সবাই ভগৎ সিংয়ের বিরুদ্ধে কথা বলে। ভাইসরয় বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে।
🔵এরপরেই 1930 সালের 4 মে মহাত্মা গান্ধী ভাইসরয়কে চিঠি লিখে এই বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন। কিন্তু সেই সমালোচনা মূলক চিঠির কোনো গুরুত্ব না দিয়েই তিন দিন পর ১৯৩০ সালের ৭ই অক্টোবর জন সন্ডার্স এবং চরণ সিং হত্যা মামলায় ভগৎ সিং, রাজগুরু ও সুখদেবকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং বটুকেশ্বর দত্তকে সভায় বোমা হামলার ঘটনায় 14 বছরের জন্য কালা পানিতে পাঠানো হয়েছিল। এই মৃত্যু দণ্ডের রায়ের সপক্ষে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সমর্থন ছিলনা। তাই এই রায় অনেকটাই বেআইনি ছিল। ভগৎ সিং একজন বিপ্লবী হিসাবে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তার মৃত্যু দণ্ডের আদেশের বিরুদ্ধে জীবন বাঁচানোর দাবি জানিয়ে শুধু ভারতই নয় ,বিদেশ থেকেও ভাইসরয়ের কাছে আবেদন আসে । 31শে জানুয়ারী 1931 সালে মহাত্মা গান্ধী এলাহাবাদে আবার এই মৃত্যু দণ্ডের বিরুদ্ধে ভাষণ দেন। 18ই ফেব্রুয়ারি মহাত্মা গান্ধী আরউইনের সাথে দেখা করেন এবং তাকে বলেছিলেন যে তিনি যদি চান দেশের পরিস্থিতি তার অনুকূলে থাকুক, তাহলে তার উচিত ভগত সিংয়ের ফাঁসি স্থগিত করা। আরউইন এর সেক্রেটারি এ বিষয়ে বলেছিলেন মহাত্মা গান্ধী প্রথমে ফাঁসি স্থগিত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং যখন পরিস্থিতি ঠিক হবে তখন আর যাতে সময় পাওয়া যায় ফাঁসির আদেশ বাতিল করার।তাই প্রথমে এটি স্থগিত করা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহাত্মা গান্ধী আসিফ আলীকে লাহোরে পাঠান যাতে তিনি ভগৎ সিং এর সাথে কথা বলে তাদের অঙ্গীকার করাতে পারেন যে তারা মানে ভগৎ সিং এবং তার কমরেডরা সহিংসতা ত্যাগ করে। কিন্তু ভগৎ সিং নিজেই চাইতেন যাতে তাকে সব থেকে বড় শাস্তিই দেওয়া হয়। তিনি আসিফ আলীকে না বলে ফিরিয়ে দেন। ১৭ই মার্চ নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আজাদ ময়দানে এক বিশাল সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।জনগণের সামনে তিনি সেই দাবি তুলে ধরেন ভগৎ সিং-এর ফাঁসি স্থগিত করা হোক। পরের দিন ১৮ই মার্চ ভগৎ সিং-এর পক্ষের আইনজীবী প্রাণ নাথ মেহতা ভগত সিং, রাজগুরু এবং সুখদেবকে অনুরোধ করেন যাতে তারা ক্ষমার আবেদন লেখে । ভগৎ সিং দরখাস্ত লেখেন। কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার বদলে যাতে তাকে ফাঁসিতে ঝুলানোর বদলে গুলি করে মৃত্যু দণ্ড দেওয়া হয় এমন দাবি জানালেন।
পরের দিন ১৯শে মার্চ, মহাত্মা গান্ধী আবার আরউইনের সাথে দেখা করলেন ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি বন্ধ করার জন্য। কিন্তু ভাইসরয় কোনো ভাবেই রাজি হননি। পরের দিন বিশে মার্চ, মহাত্মা গান্ধী স্বরাষ্ট্র সচিব হার্বার্ট এমারসনের সাথে দেখা করেন। কিন্তু সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। পরের দিন ২১শে মার্চ আবার তিনি ভাইসরয় আরুইনের সাথে দেখা করেন। কিন্তু এবারেও ভাইসরয় রাজি হননি। 23শে মার্চ সকালে মহাত্মা গান্ধী আবার আরউইনের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। এবারেও তিনি ব্যর্থ হন।
✨যে জায়গায় এই ফাঁসির অর্ডার 24 তারিখে হওয়ার কথা ছিল, সেটা 11 ঘণ্টা আগিয়ে নিয়ে আসা হয়, 23শে মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় লাহোর জেলে রাজগুরু, সুখদেব এবং ভগৎ সিংকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তারা ভারতের জন্য শহীদ হয়ে যান। ব্রিটিশ সরকার আশঙ্কা করেছিলো যে , ভগৎ সিং এর সমর্থকেরা ফাঁসির দিন জেলের সামনে আন্দোলন করতে পারে। তাই ব্রিটিশ সরকার আগের দিন সন্ধ্যায় এই মৃত্যু দন্ড কার্যকর করে।
অনেকেই মনে করেন যেহেতু মহাত্মা গান্ধী আর ভগৎ সিং এর মতাদর্শের পার্থক্য ছিল, তাই হয়তো তিনি ভগৎ সিংকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টাই করেননি। কিন্তু সুভাষ চন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে জহরলাল নেহেরু প্রত্যেকেই চেষ্টা করেছিলেন। যারা আসলেই দেশ স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন তাদের মধ্যে মতাদর্শের পার্থক্য থাকলেও একে অপরের প্রতি সম্মান ছিল প্রচুর। তাই আজকের সময়ের হোয়াটস অ্যাপে ফরোয়ার্ডেড ম্যাসেজের উপরে ভরসা না করে বই পড়ুন।
এরকম আরো তথ্যমূলক পোস্ট নিয়মিত দেখতে আমাদের পেজটি ফলো করুন। IndiaVerse ।
আমরা এমন তথ্যমূলক ভিডিও ইউটিউবে পোস্ট করে থাকি। আপনারা সাবসক্রাইব করতে পারেন।
Link- https://youtube.com/-?si=fdZCSqdrl1OxubPS
#ইতিহাস #শিক্ষা #শিক্ষা #বিপ্লবী #স্বাধীনতা #ইতিহাসেরঘটনা #রহস্য