30/09/2023
Ego!! Ego! Ego!!
আমার মধ্যে আছে, আপনার মধ্যে আছে,- সকলের মধ্যেই কম বেশী আছে। যার মধ্যে এই বিষ যত বেশী তার জীবন তত দুর্বিষহ!
' কুয়োর ব্যাঙ" এর মানসিকতায় যে যত অভ্যস্ত তার Ego তত বেশী। তাই মাঝে মাঝে কুয়ো থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের ধারে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। সমুদ্রের বিশালত্ব আর গভীরতার সামনে তখন এই Ego কিছুটা কমে আসে। আচার্য্যদেব হলেন এই সমুদ্র।
তাই মাঝে মাঝে তাঁর সান্নিধ্যে যেতে হয়। তাতে নিজের অহংকার পাতলা হয়।
Ego বিভিন্ন কারনে জন্মাতে পারে,- অনেক সময় কারন ছাড়াও জন্মাতে পারে। উচ্চ ডিগ্রী, উঁচু পদ, বড় ক্ষমতা, অনেক টাকা, হাই স্ট্যাটাস ইত্যাদি প্রায়শই মনের অজান্তে কঠিন Ego সৃষ্টি করতে পারে৷ বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা Ego নামক রোগের একটা অন্যতম কারন। আমি যা নই, যার যোগ্যতা আমার নেই,- সেই সম্মান, সেই পদ হঠাৎ প্রাপ্ত হলে ego অতি অবশ্যই জন্মাবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে শুরু করে শাশুড়ী-বউ এর ঝগড়া অব্দি প্রত্যেকটি ঝগড়া, মনোমালিন্য, মন কষাকষির পেছনে এই ego ই অন্যতম কারন। এই Ego র কারনেই রোজ ভাঙ্গছে কতশত সংসার, নষ্ট হচ্ছে কত কত বন্ধুত্ব, ধ্বংস হচ্ছে মানুষে-মানুষে সুসম্পর্ক।
সবচেয়ে কঠিন সমস্যা হল,- অন্যের ego আমি সহজেই সনাক্ত করতে পারি,- কিন্তু আমার নিজের Ego বুঝতে পারিনা৷ নিজেকে এতটাই ভালবাসি আমি, এতটাই পক্ষপাতদুষ্ট নিজের প্রতি যে,- নিজের ভয়ংকর Ego কে আমি ঠাহর পাইনা। আমার চোখে আমি সর্বদাই নির্দোষ, নিস্পাপ, বিনয়ী, দরদী, মহান। যত্ত দোষ যত পাপ, যত ত্রুটি,- সব শুধু অন্যের। আমি সদা সর্বদা নিতান্ত ভালমানুষ। Ego সবার প্রথমে আমায় অন্ধ করে দেয়।
Ego আমায় ধীরে ধীরে একা করে দেয়, আমায় সংকোচিত করতে করতে ' কুয়োর ব্যাঙ" বানিয়ে দেয়, জীবনের উপভোগ থেকে বঞ্চিত করে, নিরেট গবেটে পরিনত করে।
★আমায় কেউ ভাল একটা পরামর্শ দিচ্ছে,- তা সানন্দে গ্রহন না করে আমি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলাম। পেছনে কারন ঐ Ego.
★ আমি একটা ভুল করছি,- অন্য কেউ চুপিচুপি আমায় ভুলটা শোধরাতে বলল। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ না হয়ে তাকে শত্রু ভাবতে শুরু করলাম। পেছনে কারন ঐ Ego.
★ আমার চেয়ে ছোট কেউ আমার চেয়ে উন্নত হয়ে গেল। আমার আনন্দ না হয়ে মনে বিষাদ সৃষ্টি হচ্ছে। কারন ঐ ego.
★ আমায় সুন্দর বসার স্থানটা দিলনা, উঁচু চেয়ারটা দিল না, গলায় মালা দিল না, কোমড় ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করল না, সবার সামনে বসাল না,- আমার খুব অপমান বোধ হচ্ছে, মন খারাপ হচ্ছে। পেছনে কারন ঐ Ego.
★ আমি ভুল করেছি বুঝতে পেরেও আমি স্বীকার করছিনা, কারো সামনে নত হতে পারছিনা৷ কারন ঐ ego.
★ অফিসের বসের সামনে আমি ভীষণ বিনয়ী, অহংশূন্য। কিন্তু গেইটে দারোয়ানের সাথে হাসিমুখে কথা বলতে আমার অনীহা। আসলে আমার মনে বাসা বেধেছে ঐ ego.
এমনি করে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখি,- আমার ভিতরে গাঁট হয়ে বসে আছে কঠিন Ego.
কিন্তু কি করে তাড়াব এই দুষ্ট ego কে? কি করে হব আমি অহংমুক্ত?
এই Ego বা অহং বিষয়ে পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর বহুবার বহুভাবে আমাদের সতর্ক করেছেন,- তাঁর শ্রীহস্ত লিখিত 'সত্যানুসরন' গ্রন্থে৷
★ " যদি ভাল চাও তো জ্ঞানাভিমান ছাড়; সব্বারই কথা শোন; আর, যা তোমার হৃদয়ের বিস্তারের সাহায্য করে তাই কর।"
★ " জ্ঞানাভিমান জ্ঞানের যত অন্তরায় আর কোন রিপু তত নয়। "
★ " অহংকে যত দূরে রাখবে তোমার জ্ঞানের বা দর্শনের পাল্লা তত বিস্তার হবে।"
★ " অহংটা যখনই মিলিয়ে যায় জীব তখনই সর্বগুনসম্পন্ন-নির্গুন হয়।"
★, " যদি পরীক্ষক সেজে অহংকার নিয়ে সদগুরু বা প্রেমী সাধুগুরুকে পরীক্ষা করতে যাও তবে তুমি তাঁতে তোমাকেই দেখবে, ঠকে আসবে। "
★" অহংকারীকে অহংকারী পরীক্ষা করতে পারে। গলিত অহংকে কি-ক'রে সে জানতে পারবে?"
★ " তোমার শয়তান অহংকারী আহাম্মক আমিটাকে বের করে দাও; পরমপিতার ইচ্ছায় তুমি চল, অদৃষ্ট কিছুই করতে পারবে না। "
,★" অহংকার করো না, জগতে হীন হ'য়ে থাকতে হবে না। "
★" নিজ হাতে গুরুসেবা করলে অহংকার পাতলা হয়, অভিমান দূরে যায়, আর প্রেম আসে।"
★ " দয়া করা হিসাবে দান অহংকারের পরিপোষক।
যিনি কাতরভাবে তোমার দান গ্রহন করেন , গুরুরূপে তিনি তোমার হৃদয়ে দয়াভাবের উদ্ধোধন করেন, অতএব কৃতজ্ঞ হও। "
★" দান ক'রে প্রকাশ যত না কর ততই ভাল, অহংকার থেকে রক্ষা পাবে।"
★ " ধনবান যদি অহংকারী হয়, সে দুর্দশায় অবনত হয়৷
দীনতাহীন অহংকারী ধনী প্রায়ই অবিশ্বাসী হয় ; আর তার হৃদয়ে স্বর্গের দ্বার খোলে না।
অহংকারী ধনী মলিনতার দাস, তাই জ্ঞানকে উপেক্ষা করে। "
★আগে নিরহংকার হতে চেষ্টা কর, পরে সোহহং বল, নচেৎ সোহহং তোমাকে আরও অধঃপাতে নিয়ে যেতে পারে। "
★" অহংকার যেখানে যত পাতলা, ভক্তির স্থান সেখানে তত বেশী। "
★" জাল-ভক্তি মোটা-অহংকার- যুক্ত, আসল ভক্তি অহংকার মুক্ত অর্থাৎ খুব পাতলা-অহংকার-যুক্ত। "
★ " অহংকার যত ঘন, অজ্ঞানতা তত বেশী; আর অহং যত পাতলা, জ্ঞান তত উজ্জ্বল। "
★" অহংকার থেকেই আসক্তি আসে; আসক্তি থেকে অজ্ঞানতা আসে; আর অজ্ঞানতাই দুঃখ৷ "
★" আন্তরিক দীনতার মত অহংকারকে জব্দ করার আর কিছুই নেই।"
★" যদি নেতা হতে চাও, তবে নেতৃত্বের অহংকার ত্যাগ কর। "
★ " যার প্রতি অঙ্গ সঞ্চালনে ঝলকে ঝলকে অহংকার ফুটে বেরুচ্ছে, যার প্রেমে অহংকার, কথায় অহংকার, দীনতায় অহংকার, জ্ঞানে, ভক্তিতে, নির্ভরতায় অহংকার, - সে হাজার পন্ডিত হোক, আর সে যতই জ্ঞান ভক্তির কথা বলুক না কেন, নিশ্চই যেন সে ভন্ড।"
★ " প্রচারের অহংকার প্রকৃত প্রচারের অন্তরায়। "
★" প্রকৃত সত্য প্রচারকের অহংকার তার আদর্শে ; আর ভন্ড প্রচারকের অহংকার আত্মপ্রচারে। "
সবার শেষে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন এই অহংকারকে নিয়ন্ত্রন করার অমোঘ উপায়।..." দেহ থাকতে অহং যায় না,আর ভাব থাকতেও অহং যায় না৷ তবে নিজের অহং আদর্শের উপর দিয়ে, passive ( অক্রিয়) হ'য়ে যে যত থাকতে পারে, সে তত নিরহংকার এবং সে তত উদার। "
" পরমপিতাই তোমার অহংকারের বিষয় হোন, আর তুমি তাঁতেই আনন্দ উপভোগ কর।"
" অসৎ আদর্শে তোমার অহংকার ন্যাস্ত করোনা, তা'হলে তোমার অহংকার আরো কঠিন হবে৷ "
সত্যানুসরন গ্রন্থে সবচেয়ে বেশী উল্লেখ রয়েছে ' বিশ্বাস" শব্দটির,- তারপরেই স্থান দখল করে আছে ' অহংকার ' শব্দটি। অর্থাৎ ধর্মের জগতে টিকে থাকতে হলে ' বিশ্বাস' যেমন সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ বিষয়,- ' অহংকার ' তেমনি সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ক্ষতিকারক বিষয়। কঠিন অহংকার ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
******************
©ডাঃ রাজেশ চৌধুরী।
আগরতলা
২৭-০৯-২৩