19/11/2022
শুদ্ধ ভক্তি কি? কোন দেবতার পূজা করলে কি লাভ করা যায়-ভাগবত।
শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বললেন—“হে মহারাজ পরীক্ষিৎ, যেভাবে আপনি আমাকে মরণোন্মুখ বুদ্ধিমান মানুষদের কর্তব্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছেন, সেই অনুসারে আমি আপনাকে উত্তর দিয়েছি।” “যে ব্যক্তি ব্রহ্মতেজ কামনা করেন, তাঁর বেদপতি (ব্রহ্মা অথবা বৃহস্পতির) আরাধনা করা উচিত।
যিনি ইন্দ্রিয়-তর্পণের পটুতা কামনা করেন, তাঁর দেবরাজ ইন্দ্রের আরাধনা করা উচিত, এবং যিনি পুত্রাদি কামনা করেন, তাঁর প্রজাপতিদের আরাধনা করা উচিত। যিনি শ্রী কামনা করেন, তাঁর প্রকৃতির অধিষ্ঠাত্রী দুর্গাদেবীর আরাধনা করা উচিত।
যিনি তেজ কামনা করেন তাঁর অগ্নিকে আরাধনা করা উচিত, এবং যিনি ধন কামনা করেন, তাঁর অষ্টবসুর আরাধনা করা উচিত। যিনি বল এবং বীর্য কামনা করেন, তাঁর শিবের অংশ রুদ্রের আরাধনা করা উচিত।
যিনি প্রচুর পরিমাণে শস্য কামনা করেন, তাঁর অদিতির আরাধনা করা উচিত। যিনি স্বর্গ কামনা করেন, তাঁর আদিত্যদের উপাসনা করা উচিত। যিনি রাজ্য কামনা করেন, তাঁর বিশ্বদেবের উপাসনা করা উচিত, এবং যিনি জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে চান, তাঁর সাধ্যদেবের পূজা করা উচিত।
যিনি দীর্ঘায়ু কামনা করেন, তাঁর অশ্বিনী কুমারদ্বয়ের আরাধনা করা উচিত, এবং যিনি দেহের পুষ্টি কামনা করেন, তাঁর পৃথিবীকে পূজা করা উচিত। যিনি প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ স্বপদে স্থিত থাকার কামনা করেন, তাঁর অন্তরীক্ষ ও পৃথিবীর আরাধনা করা উচিত।
যিনি রূপ কামনা করেন, তাঁর গন্ধর্বরূপ আরাধনা করা উচিত। যিনি স্ত্রী কামনা করেন, তাঁর উর্বশী-অপ্সরার আরাধনা করা উচিত। যিনি সকলের উপর আধিপত্য কামনা করেন, তাঁর ব্রহ্মাকে আরাধনা করা উচিত।
যিনি যশ আকাঙ্ক্ষা করেন, তাঁর পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা করা উচিত এবং যিনি ধন সঞ্চয়ের অভিলাষী, তাঁর কুবেরের আরাধনা করা উচিত। যিনি বিদ্যালাভের অভিলাষ করেন, তাঁর শিবের আরাধনা করা উচিত, এবং যিনি দাম্পত্য-প্রেম কামনা করেন, তাঁর সতী উমাদেবীর আরাধনা করা উচিত।
পারমার্থিক জ্ঞানের উন্নতি সাধনের জন্য শ্রীবিষ্ণু অথবা তাঁর ভক্তদের আরাধনা করা উচিত। যাঁরা সন্তানাদির কামনা করেন, তাঁদের পিতৃবর্গের আরাধনা করা উচিত, যাঁরা সুরক্ষা কামনা করেন, তাঁদের পুণ্যবান যক্ষসমূহের এবং যাঁরা বল কামনা করেন, তাঁদের বিভিন্ন দেবতাদের আরাধনা করা উচিত।
যিনি রাজত্ব কামনা করেন, তাঁর মনুদের আরাধনা করা উচিত। যিনি শত্রুবিজয়ের আকাঙ্ক্ষা করেন, তাঁর অসুরদের আরাধনা করা উচিত, এবং যিনি ইন্দ্রিয় সুখভোগের বাসনা করেন, তাঁর চন্দ্রদেবের আরাধনা করা উচিত। কিন্তু যাঁর কোন জড় সুখভোগের বাসনা নেই, তাঁর পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা করা উচিত।
যে ব্যক্তির বুদ্ধি উদার, তিনি সব রকম জড় কামনাযুক্তই হোন, অথবা সমস্ত জড় বাসনা থেকে মুক্তই হোন, অথবা জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের প্রয়াসীই হোন, তাঁর কর্তব্য সর্বতোভাবে পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা করা।
বিভিন্ন দেবদেবীর পূজকেরা এই পৃথিবীতে ভগবানের শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গ প্রভাবে পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি যে স্বাভাবিক আকর্ষণরূপ অবিচলিত ভক্তি লাভ করেন, তারই ফলে তাঁদের সর্বোত্তম কল্যাণ সাধিত হয়। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি সম্বন্ধীয় দিব্য জ্ঞান জড়া প্রকৃতির গুণের চক্রকে সম্পূর্ণরূপে নিবৃত্ত করে।
এই জ্ঞান জড়া প্রকৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার ফলে আত্মতৃপ্তি প্রদান করে, এবং অপ্রাকৃত হওয়ার ফলে মহাত্মাগণ কর্তৃক স্বীকৃত। কে এই জ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে থাকতে পারে?” শৌনক বললেন—“ব্যাসদেবের পুত্র শ্রীল শুকদেব গোস্বামী ছিলেন একজন অতি বিদ্বান ঋষি এবং তিনি কাব্যের আকারে সব কিছু বর্ণনা করতে পারতেন।
তাঁর কাছ থেকে এ সব বিষয় শ্রবণ করার পর পরীক্ষিৎ মহারাজ তাঁকে পুনরায় কি জিজ্ঞাসা করেছিলেন?” “হে বিদ্বান সুত গোস্বামী! দয়া করে আপনি আমাদের বলুন তারপর কি হয়েছিল, কেননা আমরা তা শুনতে ঐকান্তিকভাবে আগ্রহী।
ভগবদ্ভক্তের সভায় যে কথা হয় তা নিশ্চয়ই হরিকথা ব্যতীত আর কিছু হতে পারে না। পাণ্ডবদের পৌত্র মহারাজ পরীক্ষিৎ তাঁর শৈশব থেকেই একজন মহান্ ভগবদ্ভক্ত ছিলেন। পুতুল নিয়ে খেলার ছলে তিনি পরিবারের শ্রীবিগ্রহের পূজার অনুকরণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূজা করতেন।
ব্যাসদেবের পুত্র শুকদেব দিব্য জ্ঞানে পূর্ণ ছিলেন এবং তিনি বসুদেব তনয় শ্রীকৃষ্ণের মহান্ ভক্ত ছিলেন। অতএব মহান ভক্তদের সমাগমে শ্রীকৃষ্ণের গুণকীর্তনরূপ উদার কথাই হয়েছিল। সূর্যদেব প্রতিদিন উদিত ও অস্তগত হয়ে সকলের আয়ু হরণ করেন,
কিন্তু যাঁরা সর্বমঙ্গলময় পরমেশ্বর ভগবানের কথা আলোচনা করে তাঁদের সময়ের সদ্ব্যবহার করেন, তাঁদেরই আয়ু কেবল তিনি হরণ করেন না। বৃক্ষসমূহ কি বেঁচে থাকে না? কামারের হাপর কি শ্বাসগ্রহণ ও পরিত্যাগ করে না?
আমাদের চতুর্দিকে পশুরা কি আহার ও স্ত্রী-সম্ভোগ করে না? কুকুর, শুকর, উট এবং গর্দভের মতো মানুষেরা তাদেরই প্রশংসা করে, যারা সমস্ত অশুভ থেকে উদ্ধারকারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্য লীলাসমূহ কখনো শ্রবণ করে না।
যে ব্যক্তি ভগবানের শৌর্য এবং অদ্ভুত কার্যকলাপের কথা শ্রবণ করেনি এবং ভগবানের গুণগাথা কীর্তন করেনি, তার কর্ণরন্ধ্র সর্পের গর্তের মতো এবং তার জিহ্বা ভেকের জিহ্বার মতো।
রেশমের উষ্ণীষ এবং কিরীটির দ্বারা মস্তক শোভিত থাকলেও তা যদি মুক্তিদাতা ভগবানের শ্রীচরণে প্রণত না হয়, তবে তা কেবল অত্যন্ত ভারী একটি বোঝার মতো। আর যে হস্তদ্বয় উজ্জ্বল সুবর্ণ কঙ্কণের দ্বারা অলঙ্কৃত, তা যদি ভগবান শ্রীহরির সেবায় যুক্ত না হয়, তা হলে তা শবের হস্তের মতো।
যে নয়ন শ্রীবিষ্ণুর শ্রীবিগ্রহ দর্শন করে না তা ময়ূর পুচ্ছে অঙ্কিত চক্ষুর মতো, এবং যে পদ পরমেশ্বর ভগবানের লীলাভূমি বা তীর্থসমূহে বিচরণ করে না তা বৃক্ষের মতো স্থাবর। যে ব্যক্তি কখনো তার মস্তকে ভগবানের শুদ্ধ ভক্তের চরণরেণু ধারণ করেনি, সে জীবিত থাকলেও তার দেহটি মৃত।
আর যে ব্যক্তি ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের তুলসীদলের সুগন্ধ আঘ্রাণ করেনি, সে শ্বাস গ্রহণ করলেও তার দেহটি মৃত। হরিনাম গ্রহণ করা সত্ত্বেও যার হৃদয় দ্রবীভূত হয় না, নেত্র অশ্রুপূর্ণ হয় না এবং লোমসমূহ আনন্দে পুলকিত হয় না, তার হৃদয় অবশ্যই ইস্পাতের আবরণে আচ্ছাদিত।”