16/05/2022
আব্দুল ট্রেনে সফর করছে,, পাশের সিটে বসে থাকা পন্ডিতজী তাকে মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন।। আব্দুল কারন জানতে চাইলে,, পন্ডিতজী বলেন - "আপনার মতো সেম টুপি আমার ঠাকুর্দা পরতেন।। একেবারে অবিকল,, মনে হচ্ছে এটা আমার ঠাকুর্দার টুপি।।"
-- "আপনার বাড়ি কোথায় ??"
আব্দুল সবিনয়ে বলে - "অযোদ্ধা।।"
পন্ডিতজী লাফিয়ে উঠলেন,, -" হুম,, আমি ঠিক অনুমান করেছি,, এটা আমার ঠাকুর্দার টুপি।। উনি বহু দশক আগে অযোদ্ধা গেছিলেন,, সেখানে টুপি হারিয়ে ফেলেছেন।।"
আব্দুল বলে --"কিন্তু,, এটা তো আমার আব্বাজানের টুপি,, শেষ স্মৃতি।। উনি এই টুপি পরে জুম্মার নামাজ পড়তেন।।"
পন্ডিতজী বলেন - "হতে পারে আপনার পিতা আপনাকে দিয়ে গেছেন,, কিন্তু,, এটা নিশ্চিত আমার ঠাকুর্দার টুপি।। উনি অযোদ্ধা গিয়ে হারিয়ে ফেলেছিলেন।। একেবারে সেম,, সাদা জালিদার হ্যান্ডলুম টুপি....."
আব্দুল ঘাবড়ে গেলো।।
পন্ডিতজী বলে চলেছেন - "টুপিটা আমার ঠাকুর্দার,, আমাকে ফিরিয়ে দিন।।"
আব্দুল - "কিন্তু......."
পন্ডিতজী - "কোনো কিন্তু নয়।। আমি ইসলাম সম্বন্ধে যথেষ্ট অধ্যায়ণ করেছি।। টুপি ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়।। টুপি ছাড়াও নামাজ পড়া চলে।। সুতরাং,, আমার ঠাকুর্দার টুপি,, আমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে।।"
ট্রেনের কামরায় বসে থাকা,, মিশ্রাজী- পান্ডেজী- চৌবেজী- দুবেজী,, সকলে একবাক্যে বলে চলেছেন - "দেখুন,, 50/100 টাকার একটা টুপি কোনো ম্যাটার নয়।। বিষয়টি আস্থা এবং বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত।। পন্ডিতজীর বিশ্বাস,, এটা ওনার ঠাকুর্দার টুপি,, আপনার উচিত,, পন্ডিতজীর বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করা।।"
শাস্ত্রীজী উঠে দাঁড়িয়ে বলেন - "এক ধাক্কা অউর দো,, টোপি উতার দো।।"
ট্রেন কোচের এক কোনে সাদা পাগড়ি,, সাদা দাড়ি বিশিষ্ট এক মাওলানা বললেন - "দেখুন,, আমরা একই কোচের যাত্রী,, কোচের শান্তি- শৃঙ্খলা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে টুপিটা দিয়ে দিন।। তাছাড়া,, টুপি হলো সুন্নাত,, ফরজ না।। টুপি ছাড়াও নামাজ পড়তে পারবেন।। সবার আগে শান্তি,, সামান্য একটা টুপির কারনে,, অশান্তি করবেন না।।"
আব্দুল নাছোড়বান্দা।। আর যাইহোক,, আব্বাজানের শেষ স্মৃতি এভাবে কারো হাতে তুলে দেওয়া যাবে না।। এদিকে,, গোটা কোচের মানুষ,, আব্দুলের বিপক্ষে,, এমনকি পাগড়ি ওয়ালা মাওলানা,, কোচে উপস্থিত দু-চার জন টুপি ওয়ালা নামাজী,, সবাই আব্দুলের বিপক্ষে।।
এবার পন্ডিতজী আব্দুলের মাথা থেকে টুপি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।। টানাটানির মাঝে মাথার টুপি ট্রেনের মেঝেতে পড়ে যায়।। বেগতিক দেখে আব্দুল ট্রেনের চেন টেনে দেয়।। ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়ে।।
ট্রেনের গার্ড এসে হাজির,, সঙ্গে কয়েকজন রেল-পুলিশ।। সব শুনে তারা প্রশ্ন করে - "আপনাদের দুজনের কাছে টুপির মালিকানা সম্বন্ধীয় কোনো প্রমাণ আছে ??"
টুপি তখন পান্ডেজীর হাতে।। আব্দুল,, পন্ডিতজী দুজনেই নিশ্চুপ।।
রেল পুলিশ বলে - "যথাযথ মালিকানা প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।। সুতরাং,, টুপি মাঝখান থেকে আধাআধি ভাগ করে,, উভয়ের হাতে তুলে দেওয়া হবে।।"
নিজের আব্বাজানের শেষ স্মৃতি এভাবে টুকরো হয়ে যাবে,, আব্দুল সহ্য করতে পারবে না।। তাছাড়া গোটা কোচের হিংস্র পরিস্থিতির অবসান ঘটবে,, একথা ভেবে আব্দুল টুপির দাবী ছেড়ে দেয়।।
সে বলে --"ঠিক আছে,, টুপিটা পন্ডিতজীর হাতে তুলে দেওয়া হোক।।"
ট্রেনের কামরার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখে বিজয়ীর হাসি।। হাসি তখন উন্মাদনার আকার ধারণ করেছে।।
মানুষ সমবেত স্বরে শ্লোগান দিয়ে চলেছে - "টোপি তো ঝাঁকি হ্যায়,, কুর্তা-পাজামা আভি বাকি হ্যায়।।"
শ্লোগান শুনে আব্দুলের মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।।
এবার পান্ডেজী দাবী করেন - আব্দুলের কুর্তার মতো অবিকল কুর্তা,, তার দাদু পরিধান করতেন।। প্রমাণ দেখানোর জন্য,, মোবাইল গ্যালারিতে ষ্টোর করে রাখা,, তার দাদুর কয়েকটি ছবি দেখানো হলো।।"
উপস্থিত জনতা সকলে একবাক্যে মেনে নিলেন - "সেম কাপড়,, সেম ষ্টাইল,, সেম ডিজাইন,, সেম চেক্স,, সুতরাং,, এটা পান্ডেজীর দাদুর কুর্তা।।
কোচের কোনে বসে থাকা ,, সাদা পাগড়ি পরিহিত মাওলানা বলেন-- "একটা কুর্তা দিলে কি এমন ক্ষতি হবে ?? প্রয়োজনে গেঞ্জি অথবা খালি গায়ে নামাজ পড়া জায়েজ রয়েছে।।"
মাওলানার রিজার্ভেশন কনফার্ম ছিলো না।। পন্ডিতজী দয়া করে,, ওনার ছেলের আসনে মাওলানা সাহেবকে জায়গা দিয়েছেন।।
অবস্থা বেগতিক।। অনিচ্ছা সত্বেও,, আব্দুল নিজের পরনের পাঞ্জাবি পান্ডেজীর হাতে তুলে দিলো।।
শাস্ত্রীজী,, ওঝাজী,, দুবেজী,, চৌবেজী,, সবাই নিজের দাবী মতো একের পর এক কাপড়চোপড় ছিনিয়ে নিলো।। আপাতত আব্দুলের সম্বল কেবলমাত্র পাজামা।।
এবার শর্মাজী-র পক্ষ হতে পাজামার দাবী তোলা হলো।। আব্দুল নিরুপায়,, কিন্তু প্রচন্ড রেখে গেলো।। আর যাইহোক,, পাজামা দিয়ে উলঙ্গ থাকা যাবে না।।
কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে আব্দুল সংবিধান পুস্তক বের করে বলে - "অনেক সহ্য করেছি।। আর সহ্য করবো না।। আমার সংবিধান আমাকে কাপড় পরার অধিকার দিয়েছে।।"
মাওলানা বললেন - "ভিতরে জাঙ্গিয়া রয়েছে তো।। নিরুপায় হলে জাঙ্গিয়া পরাও জায়েজ রয়েছে।।"
আব্দুল রাগান্বিত হয়ে পড়ে।।
-- " কোনো ফাতোয়া শুনবো না।। আমার পাজামা যদি শর্মাজীর কাকার হয়ে থাকে,, তাহলে উনি নিজের দাবী নিয়ে কোর্টে চলে যান।। ওখানেই ফয়সালা হয়ে যাবে।।"
এক বজরঙ্গি বাবু চেঁচিয়ে বলেন - "পাজামা দিতেই হবে।। নাহলে তোমাকে হত্যা করা হবে।।"
আব্দুল ব্যাগ থেকে পবিত্র কোরআন বের করে বলে -- "দেখুন,, কোরআনে লেখা রয়েছে,, আপনি জুলুম করুন,, আমি প্রত্যুত্তর দেবো না।। কিন্তু,, আমার ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে আপনারা যদি একের পর এক অত্যাচার চালিয়ে যান,, তাহলে আমিও প্রত্যুত্তর দিতে বাধ্য হবো।।
অনেক মুখবুজে সহ্য করলাম,, এখন আমি অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়ে গেছি।। আর কিছু শুনবো না।।"
আব্দুলের রুদ্ররূপ দেখে উপস্থিত সকলেই ভয়ভীত।। কিছুক্ষণ আগে যে মানুষটি একের পর এক অন্যায্য দাবী মেনে নিয়েছে,, হঠাৎ তার এই পরিবর্তন দেখে সকলে অবাক হয়ে গেলো।।
আব্দুল বলে চলেছে - "কোনো কথা শুনতে চাইছি না।। মরতে হলে মরবো,, কিন্তু,, আমার টুপি,, পাঞ্জাবি,, গেঞ্জী,, গামছা,, চশমা,, সবকিছু ফেরত দিতে হবে।। না দিলে আমি আইনের শরণাপন্ন হবো।। আইন এবং সংবিধান অনুযায়ী,, আমার নায্য দাবী আমি পুরণ করেই ছাড়বো।। সবাইকে জেলে ঢুকিয়ে তবেই ক্ষ্যান্ত হবো।।"
আব্দুল পরিস্কার বুঝতে পেরে গেছে,, টুপি দেওয়াটাই কাল হয়েছে।। সহজে টুপি দিয়ে,, অত্যাচারীদের উৎসাহিত করে ফেলেছে।। তাদের সাহস বেড়ে গেছে।। তাই তারা একের পর এক আবদার করে চলেছে।।
ইশ্,, আগেই যদি টুপি না দিতো,, তাহলে এই দিন দেখতে হতো না।।
সে বুঝতে পারে,, অত্যাচারের প্রতিবাদে করতে অত্যাচার করা যাবে না।। কিন্তু,, অত্যাচারির অনৈতিক ইচ্ছা পূর্ণ করা মানেই,, অত্যাচারিকে প্রশয় দেওয়া।। কারো উপর অত্যাচার করা যাবে না,, আবার,, কেউ অত্যাচার করলে,, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।।
পরের ষ্টেশনে ট্রেন থামলো।। পান্ডেজী,, দুবেজী,, চৌবেজী,, শর্মাজী,, পন্ডিতজী,, সকলে একে একে নেমে গেলেন।। যাওয়ার সময় আব্দুলের পরনের কুর্তা,, পাঞ্জাবি,, গামছা,, চশমা,, টুপি,, সমস্ত কিছু রেখে গেলেন।।।
👍👍👍
©আলম মিদ্দে