19/10/2023
কালো মানুষ
পর্ব-১
প্রাচীন ইন্দো-অষ্ট্রিক দ্রাবিড় মানবগোষ্ঠী গুলির অন্যতম একটি হল অসুর জাতি-গোষ্ঠী। ছোটো নাগপুর,নাগপুর থেকে সূদুর দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত এই গন্ডোয়ানা ভূমিতে অসুরীয় সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল এবং উৎকর্ষ লাভ করেছিল; ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দিচ্ছে।মহিষ মন্ডলের অন্তর্গত অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু পর্যন্ত এই সভ্যতার নিদর্শন মেলে।বঙ্গের দিনাজপুর জলপাইগুড়ি জেলায় "অসুর জনগোষ্ঠী" জীবন্ত কিংবদন্তি। এছাড়াও এই আদি/আদিম অধিবাসী জনগোষ্ঠী মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা,বিহার,ছত্রিশগড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বহিরাগত ইউরেশিয়ান আর্যরা ছলনার দ্বারা প্রবল পরাক্রমী প্রজাপ্রতিপালক মহীয়স অসুর মহিষাসুরকে হত্যা করে। ফলে সমগ্র গন্ডোয়ানাভূমি ও আসুরীয় সভ্যতা বিপর্যস্ত হয়। জানা দরকার এই গন্ডোয়ানা ভূমির সবচেয়ে শক্তিশালী উন্নত আদিম জাতিগোষ্ঠীর একটি অসুর যারা লৌহপাথর থেকে লোহা নিষ্কাশনের প্রক্রিয়া রপ্ত করে আসুরীয় সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছিল।কালের প্রবাহে তারা কোণঠাসা। তথাকথিত সভ্য বাঙ্গালী সমাজে তারা অসভ্য। হীন। তবে শক্তিহীন হলেও ঐ ছলনার হত্যাকে ভুলে নি। শোকগাঁথা দাসাই,প্রমীলা নৃত্যের মধ্য দিয়ে ইতিহাসকে বয়ে নিয়ে চলেছে প্রবহমান জীবনধারায়।।
ঐতিহাসিক নিদর্শন, লৌকিক ইতিহাস ,স্থানের নামকরণ ইতি উতি বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে।কালের অগ্রগতি কুয়াশার চাদর বিছিয়ে দিলেও অনিসন্ধিৎসু চোখে এই সভ্যতার গরিমা গৌরব গাথা ধরা পড়ে। ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ সহ একাধিক সংশোধনবাদী ভাষাতাত্ত্বিক- ঐতিহাসিকদের অভিমত "বস্তুবাদী শ্রমনির্ভর অসুরীয় সভ্যতা আসলে বৌদ্ধবাদী ভারতের পূর্ণাঙ্গ স্ফূরণ। এক এবং অভিন্ন।"
অসুর সভ্যতা ও সংস্কৃতি যে বর্ণবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার তার প্রমাণ যথেষ্ট। অসুরীয় সভ্যতার নিদর্শন পুরী,গয়া,তিরুপতি বালাজী আজ বর্ণবাদীদের কব্জায়। আর যেটুকু বেঁচে আছে তা বর্ণবাদী রাষ্ট্রের উদাসীনতায় পরিত্যক্ত।
ছোটোনাগপুর অঞ্চল থেকে দক্ষিণ ভারতের ইন্দো-অষ্ট্রিক গোষ্ঠী এবং জাতি গুলি এখনো পর্যন্ত অসুরীয় সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে পেরেছে লৌকিক পরম্পরায়।সেক্ষেত্রে শ্রমনির্ভর কৃষিভিত্তিক উৎসবগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। একটি আইডেনটিটির ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম। অসুর সংস্কৃতির অন্তর্গত করম,ওনাম-দক্ষিণে,জিহুড়,জিতা,নাগপূজো,বাঁধনা,জামাই বাঁধনা,ঢেঁকি বাঁধনা,গরু-বাঁধনা,সহরায়,দাঁসায়,গ্রামপূজো,
পাহাড়পূজো ইত্যাদি সবকটি অসুরীয় সংস্কৃতির পরিচায়ক।এই মানবগোষ্ঠীগুলি আজ হাজার জাতিতে বিভক্ত হয়ে গেলেও এদের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে এরা এক এবং অভিন্ন।
"ঝাড়খন্ড,বিহার,ছত্রিশগড়,মধ্যপ্রদেশের গোন্ড,হালওয়া,মুরিয়া,ডোরলা,মুন্ডা,সান্তাড়,বৈগা,অসুর প্রভৃতি মানব জাতি-গোষ্ঠী গুলির মধ্যে অসুরীয় সভ্যতার প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়ে গেছে। এই অধিবাসীরা এখনো মনে করে অসুর সম্রাটরা তাদের প্রাণরক্ষক।প্রাণদাতা। কৃষির রক্ষাকর্তা।ফসল,গবাদিপশুর রক্ষা কর্তা। ছত্রিশগড়ের বস্তার,সারান্ডি,নাগরবেদায় মহীষাসুর দেবতার মর্যাদায় আসীন। এখানে বিভিন্ন গ্রাম ও পাহাড়ের নামকরণ মহিষ রাজার অনুকরণে হয়েছে। গেরালা,বেলডি,উরলা প্রভৃতি অঞ্চলে মহিষ রাজাকে জঙ্গলের রক্ষাকর্তা মানা হয়। রায়পুর, বিলাসপুর,ডামোহ,ডিন্ডরি,সিউনি,বালাঘাট ইত্যাদি অঞ্চলে মহিষাসুর 'ভ্যায়সাসুর/ভৈসাসুর' নামে পরিচিত। বিহারেও তাই।পশ্চিম বিহার উত্তরপ্রদেশ সংলগ্ন এলাকার মহিষাসুর মহোবা নামে পরিচিত। সাতনা জেলায় মহিহার পুলিশ ষ্টেশন মহিষ রাজার নামানুসারে।মহোবা জেলার একটি শহর ভৈসাসুর শহর।ছাত্তারপুরের একটি ড্যামের নাম ভৈসাসুর মুক্তি ড্যাম।বারাণসীর ভৈসাসুর ঘাট এবং মন্দির উল্লেখযোগ্য। বিহারে ভৈসাসুর বাবার স্থান বিখ্যাত এক মন্দির।এরকম অজস্র অসুর সম্রাটদের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে।
দক্ষিণ ভারতেও মহিষ মন্ডলের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল।মাইশুরু/মহীশূর অন্যতম।মহিষাসুরের নামে অসংখ্য রেপ্লিকা,স্মৃতিসৌধ রয়েছে।" linguistic view-Dr.Rajendra prasad
আর্য অনুপ্রবেশ এবং আগ্রাসনের পূর্বে সিন্ধ অঞ্চল থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত এই দেশে শ্রমনির্ভর অসুরীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল তা এক প্রকার নিশ্চিতভাবে বলা যায়। লোক-কাহিনী,পরম্পরা,সংস্কৃতি সেই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
পর্ব-২
অসুর শব্দের linguistic value অর্থাৎ ভাষাগত গুরুত্ব অপরিসীম। প্রচলিত অর্থে আমরা অসুর বলতে অশুভ বা খারাপ কোনো কিছুকে ইঙ্গিত করে থাকি। সম্ভবত বর্ণবাদী আগ্রাসনে বা 'আর্য-অনার্য' মেরুকরণ হেতু এই শব্দটি অপভ্রংশের শিকার। ব্রাহ্মণ্যবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে অসুর গোষ্ঠী সহ 'অসুর' শব্দটি তার প্রাচীন গরিমা হারিয়েছে।
"বৈদিক সাহিত্যে অসুর শব্দটি বহু প্রচলিত শব্দ। 'অসুরাতি দদাতি ইতি অসুরা'। 'অসু'শব্দের অর্থ প্রাণ বা জীবন। যে প্রাণ রক্ষা করে ,তাকে অসুর বলে। (বৈদিক-বিশ্বকোষ) বিখ্যাত সংস্কৃত পন্ডিত ভি এস আপ্তে বলেছেন 'অসুর' শব্দের মূল শব্দ (root word) 'অসু'। অসু হল প্রাণ।
ভাষাতাত্ত্বিক রামচন্দ্র আপ্তে বলছেন অসুর শব্দটি মূলশব্দ 'অসু' থেকে উৎপন্ন হয়েছে।"( linguistic view-R.P.Sing )এক্ষেত্রে সুর বিপরীতে অসুর আলোচনাটি অনর্থক। একারণেই কৃষ্ণকে বৈদিক সাহিত্যে অসুর বলা হয়েছে।
একিভাবে রাক্ষস শব্দটিও বিকৃতির শিকার। রক্ষা করে যে সেই রাক্ষস।অর্থাৎ রক্ষাকারীই রাক্ষস।
"রক্ষাম ইতি ঐক্ত রাক্ষসান্তে ভবন্তু বঃ
যক্ষাম ইতি ঐক্ত রক্ষা এব ভবন্তু বঃ" উত্তর কান্ড,শ্লোক 23
আগের লেখায় বলেছি,ছোটো নাগপুর থেকে মধ্য-দক্ষিণ ভারতে অসুরীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। সম্রাটরা কৃষি,জঙ্গল,গবাদিপশু রক্ষা করে অধিবাসীদের লালন পালন করেছেন।প্রাণ রক্ষা হেতু অধিবাসীরা সম্রাটদের অসুর জ্ঞানে পরম্পরায় পুজো করেন এখনো।
অসুরীয় সভ্যতার সবথেকে শক্তিশালী সম্রাট অসুর মহিষাসুর।। পূর্ব মধ্য,দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন নিদর্শন গুলি প্রমাণ করে দিয়েছে মহিষাসুর কতখানি জীবন্ত ঐতিহাসিক চরিত্র। যদিও প্রাচীনত্বের আড়ালে আজ তা মিথে পর্যবসিত। অপভ্রংশের শিকার 'মহিষাসুর' শব্দের শব্দগত/ভাষাগত মূল্যও অপরিসীম।যদিও আমরা অনেকেই এবিষয়ে সম্যক জানি না।প্রচলিত অর্থে মহিষ কালো রঙের একটি গবাদি পশু।বর্ণবাদী রাষ্ট্রে এই প্রাণীটি ঘৃণার শিকার। পরে আসছি সে বিষয়ে।
মহিষাসুর একটি যৌগিক শব্দ। প্রথমটি মহিষ/মহীয়স ; "দ্বিতীয়টি অসুর। সন্ধিযোগে মহিষাসুর। মহিষ শব্দের অর্থ শক্তিশালী।শব্দটি গুণবাচক 'মহ' থেকে উৎপন্ন হয়েছে। বাংলা শব্দ ভান্ডারে এরকম অনেক শব্দ রয়েছে।যেমন-মহিম,মহিমা,মহাত্মা, ইত্যাদি।পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রচেতনা গড়ে উঠলে এই শক্তিশালীরা দলনেতা বা সম্রাট শব্দের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। এই কারণে প্রাচীন ভারতে সম্রাট বা রাজাদের স্ত্রীকে মহিষী বলা হোত।"linguistic view-R.P.sing
সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ এক বিষম বস্তু। এক্ষেত্রে অল্প সংখ্যক যেমন বহুসংখ্যকে পরিণত হতে পারে, তেমনি শিকারী শিকারকে মনুষ্যতের পর্যায়ে নামিয়ে দেয়।আবার শিকারের অজ্ঞতার পূর্ণ সুযোগে শিকারী পূজিতও হয়। ব্রাহ্মণ্যধর্ম তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাইতো বর্ণবাদী রাষ্ট্রে গরু/গাভী রাষ্ট্রবাদের প্রতীক। কালো চামড়ার অসুর সন্তানরা সহ কালো চামড়ার মহিষ রাষ্ট্রবাদ বিরোধী প্রতীক।তাইতো সাংস্কৃতিক,সামাজিক আগ্রাসনের বিরোধীতা করলে রাষ্ট্রবাদীরা সারান্ডা,কালাহান্ডির ভূমিতে নির্বিচারে মহান অসুর সন্তানদের 'বধ' করে উল্লসিত হয়। উৎসব;মোচ্ছব পালন করে।
Rajiv Mandal ©