17/04/2024
এই দেশে যখন একটা মেয়ের বিয়ে হয়, মেয়ের পরিবার আত্মীয়স্বজন সকলে তাকে বুঝায় "নতুন সংসারে যাচ্ছো, ভালো ভাবে থেকো। যে যা বলে শুনবা। শাশুড়িকে মায়ের মতো সেবা করবা। তার সব কথা মেনে চলবা! ওইটাই এখন তোমার পরিবার!"
এবং আরও কত রকমের আদেশ উপদেশ!
অথচ মেয়েটা নিজের ঘর, নিজের পরিবার ছেড়ে নতুন জায়গায় যাচ্ছে! তারই বরং স্পেশাল ফিল হবার পরিবেশ পাওয়া উচিত!
আমি আমার জীবনে কখনো কাউকে কোনো বিয়েতে ছেলের মা কে বুঝাতে দেখিনি যে "আপনার ছেলের বিয়ে হচ্ছে, এখন থেকে তার জীবনের অনেক সিদ্ধান্ত তার স্ত্রী নিবে। সেখানে আপনি হস্তক্ষেপ করবেন না। একটা মেয়ে নিজের সবকিছু ছেড়ে আপনার বাসায় আসছে, সে যেভাবে চাইবে সেভাবেই সবকিছু করবেন, যেন তার মনে না হয় সে পরিবার থেকে দূরে আছে! তাকে অনেক ভালবাসা দিবেন। নিজের মেয়ের মতোন করে রাখবেন।"
অবশ্য কিছু শাশুড়ি বিয়ের দিনে মেয়ের মা বাবাকে বলে "আপনার মেয়ে আমাদের বাসাতেও মেয়ে হয়েই থাকবে। বউ নিয়ে যাচ্ছি না, মেয়ে করে নিয়ে যাচ্ছি!"
আসলেই কি তাই হয়!?
না কি নিয়ে যাওয়ার পর প্রত্যেকটা পদে পদে বোঝানো হয় "তুমি বাইরের মেয়ে। তুমি কিছুদিন হলো আমার ছেলের জীবনে এসেছো, ছেলের পছন্দ অপছন্দ সব আমি জানি! বউ হয়ে এসেছো, চুপচাপ থাকো, যা সিদ্ধান্ত নেয়ার আমি নিবো!"
"আমি আমার ছেলেকে অনেক কষ্ট করে বড় করেছি" এই হাতিয়ার তো আছেই! কিছু ঘটলেই এই হাতিয়ার চালালেই ব্যস, সবাই শাশুড়ির পক্ষে!
তা ছেলের বউটা কি কারো সন্তান না!? তাকে কি তার মা জন্ম দেয়নি, সে কি নদীর পানিতে ভেসে এসেছে!? না কি তার মা তাকে কষ্ট করে বড় করেনি, বড় হয়েই তার জন্ম হইসে!? কি মনে করে Dear শাশুড়ি রা!?
অভিনেত্রী কারিনা কাপুর খানের উপস্থাপনা করা একটা অনুষ্ঠানে গেস্ট হয়ে আসেন তার শাশুড়ি শর্মিলা ঠাকুর।
সেখানে শর্মিলা ঠাকুরকে কারিনা জিজ্ঞেস করে "একটা মেয়ে আর পুত্রবধূর মধ্যে মূল তফাৎ কি বলে আপনার মনে হয়?"
শর্মিলা ঠাকুর উত্তর দেয় "মেয়ে এমন কেউ যার সাথে মায়ের শুরু থেকে বসবাস। তাই মা জানে মেয়ের স্বভাব কেমন, কি করলে তার রাগ হয়, মন খারাপ হলে কিভাবে সামলানো যায়, কিভাবে তার সাথে ডিল করা যায়"
"অন্যদিকে, ছেলের বউয়ের সাথে যখন দেখা হয় তখন ছেলের বউ অলরেডি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। তাই তার স্বভাব সম্পর্কে খুব বেশি জানা থাকেনা। এইজন্য সময় লাগে তার সাথে সহজ সম্পর্ক তৈরি হতে। একটা মেয়ে যখন তোমার বাসায় ছেলের বউ হয়ে আসে, তোমার উচিত তাকে কম্ফোর্টেবল ফিল করানো। সে যে ধরনের খাবার খেতে অভ্যস্ত সেসবের ব্যবস্থা করা। আমার (শর্মিলা ঠাকুর বলেন) কথা বলি আমি বাঙালি পরিবার থেকে এসেছিলাম, ভাত খেতাম, অন্যদিকে আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই খেতো রুটি। এসব ছোট ছোট বিষয় মনে হলেও দীর্ঘ সময়ের জন্য এইসব অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর এটা ছেলেপক্ষের ই দায়িত্ব মেয়েটাকে কম্ফোর্ট দেয়া। এবং খুব বেশি ইন্টারফেয়ার না করা, যেমন আমার ছেলে এটা পছন্দ করতো ওটা করতো, এসব বলে সম্পর্ক টেকওভার করা উচিত না...বুঝতে হবে ছেলে এবং ছেলের বউ একটা নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছে, তাদের সম্পর্ক টা কে সময় দেয়া উচিত যেন তারা সেটাকে সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে পারে। তাদেরকে তাদের স্পেস দেয়া উচিত।"
কথাগুলো আমার এতোই ভালো লেগেছিলো!
এদিকে আমাদের দেশে কোনো ছেলে যদি বউয়ের সাপোর্টে একটা কথাও বলে তাহলে দেখা যায় ছেলের মা কান্নাকাটি শুরু করে দেয় "ওই ডা ই নি আমার ছেলেকে যাদু করেছে" বলে!
Dear শাশুড়িগণ বুঝতে চান না যে তাদের সেবা করার বা তাদের কথা শুনে চলার কোনো দায়িত্ব ছেলের বউয়ের নাই! ছেলের বউ যদি সেবাযত্ন করে, সেটা আপনার কপাল। কিন্তু সে বাধ্য না।
আপনি আপনার ছেলেকে জন্ম দিয়েছেন, বড় করেছেন তাই তার কাছে সেবাযত্নের আশা করতে পারেন।
ছেলের বউয়ের কাছে তখনি আশা করতে পারেন যখন তার জন্যেও আপনি কিছু করবেন।
আপনি যদি তাকে মেয়ের মতো ভালবাসেন, সেও আপনাকে মায়ের মতো ভালবাসবে।
কিন্তু আপনারা তো ছেলের বউকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে, মনে করেন ছেলেকে কেড়ে নিচ্ছে!
আপনার ছেলেকে সে কেড়ে নেয়ার তো কেউ না, সে আপনার ছেলের জীবনসঙ্গী, জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ! তাকে ছাড়া আপনার ছেলে পরবর্তী জেনারেশন আনতে পারবেনা দুনিয়ায়, তো তার প্রতি কেয়ারিং হবে না!?
আর ছেলেরা, আপনাদের মা আপনাকে জন্ম দিয়েছেন নিজে মা হবার জন্য। এবং জন্ম দেয়ার কারণে আপনার লালন পালন থেকে শুরু করে আপনাকে একটা ভালো জীবন দেয়া তার দায়িত্ব।
উনি উনার দায়িত্ব পালন করেছেন, আপনিও আপনার দায়িত্ব পালন করুন।
তার জন্য যেসব করা প্রয়োজন করুন, নিজে করুন।
আপনার স্ত্রীর কাছে আশা রাখবেন না। আপনার স্ত্রীর জন্য আপনার মা কি করেছে যে উনার জন্য আপনার স্ত্রীকে কিছু করতে হবে!?
আপনি যদি আপনার শাশুড়ির জন্য করতে পারেন, করেন, তখন দেখবেন আপনার স্ত্রীও আপনার মায়ের জন্য করবে।
প্রথম ধাপ টা আপনাকেই নিতে হবে।
এই যে ডায়লগ দেন "বউ গেলে বউ পাওয়া যাবে, মা গেলে মা পাওয়া যাবে না!"
এমন চিন্তাভাবনা থাকলে বউ আনার ই দরকার নাই! মা কে নিয়েই থাকুন।
একটা মেয়ে আপনার জন্য নিজের সবকিছু ছেড়ে চলে আসবে, আপনার সাথে থাকবে, আপনার সাথে সন্তান জন্ম দিবে...আর আপনি ভাবেন সে চলে গেলে আরেকটা বউ নিয়ে আসবেন!? এমন চিন্তাভাবনা করলে বলতেই হয় আপনি কোনো মেয়ের স্বামী হবার যোগ্য না!
শ্বশুরবাড়িতে একটা মেয়ের অবস্থা কেমন হবে এইটা অনেকাংশে নির্ভর করে মেয়েটার স্বামীর ওপর।
স্বামী যদি নিজের পরিবারকে বুঝাতে পারে তার স্ত্রী হয়ে যে আসবে তার যেন কোনো অসম্মান না হয়, তার সাথে যেন সবাই ভালো ব্যবহার করে, তাকে যেন আরামে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে সেই বাসায় মেয়েটা ভালো থাকে।
আফসোসের বিষয় হচ্ছে এই দেশের ছেলেরা নিজের পরিবারের সামনে স্ত্রীর সম্মানের জন্য কথা বলতে পারে না!
আবার যদি কোনো ছেলে বলেও ফেলে তাহলে তাকে কাপুরুষের ট্যাগ দেয়া হয়! বউয়ের আঁচলের নিচে থাকতে বলা হয়!
এসব কথার চাপে দেখা যায় ছেলেটা পরিবার কে কিছু বলেনা, পরিবারও ছেলের বউয়ের সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে...
আর, অশান্তি দেখতে দেখতে ছেলের বউ এর মনও বিষাক্ত হয়ে যায়।
আর, সেই বিষ ছাড়ে নিজে যখন শাশুড়ি হয় তখন...!
কথায় কথায় বলে "আমি শ্বশুরবাড়িতে এত অত্যাচার সহ্য করেছি! আমার ননদ এই করেছিলো, শাশুড়ি ওই করেছিলো!"
অর্থাৎ ঘুরেফিরে ওই একই সার্কেলে ঘুরতে থাকে সমাজ!
অথচ, কোনো শাশুড়ি যদি ভাবে "আমাকে যেসব অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে আমি আমার ছেলের বউকে সেসব সহ্য করতে দিবোনা! তাকে অনেক ভালবাসবো। তাকে যদি ভালবাসি, সেও আমাকে ভালবাসবে!"
এটুকু ভাবলেই কত কিছু সহজ হয়ে যেতো! কত সম্পর্ক সুন্দর হতো! কত মান অভিমান অভিযোগ শেষ হয়ে যেতো...
কিন্তু না, তেনারা এইসব ভাববেন না! শাশুড়ি হয়ে নিজেকে এতোই ক্ষমতাধর মনে করেন যে উনি যা ভাববেন তাই ই সঠিক! উনি যা বলবেন তাই ই করতে বাধ্য!
আর অবাধ্য হলেই ব্যস, অশান্তি...!
Dear শাশুড়িগণ, "শাশুড়ি" কোনো ক্ষমতার নাম না!
আপনি শাশুড়ি হবার ক্ষমতা দেখাতে চাইলে, ছেলের বউও নিজের ক্ষমতা দেখাতে শুরু করবে! সেটা আবার আপনি সহ্য করতে পারবেন না।
তাই, ছেলের বউকে মেয়ের মতো ভালবাসতে না পারলেও তাকে অসম্মান করবেন না বা তুচ্ছ ভাববেন না। সে তার মা বাবার রাজকন্যা, আপনার ছেলের রাজরানী।
তাকে সম্মান করুন, আপনিও সম্মান পাবেন।
শুরুটা আপনাকেই করতে হবে। আপনি না করতে পারলে তারও করার ঠ্যাকা নাই...
সংগৃহীত।