11/08/2024
কিশোর দা এস.ডি. বর্মনকে বললেন - আমি তখনই গান গাইবো যখন হিরোকে দেখবো, তার সাথে কথা বলবো।
বর্মন দা জিজ্ঞাসা করলেন - কেন এমন?
কিশোর দা উত্তর দিলেন - আমি চাই না যে আমি কোনও অযথা অভিনেতার জন্য গান গাই।
বিষয়টি জটিল হয়ে উঠলো।
কিশোর দার শর্ত শুনে রাজেশ খান্নাও চিন্তিত হয়ে গেলেন। সিনেমার জন্য অডিশনের কথা তিনি শুনেছিলেন, কিন্তু একটি প্লেব্যাক গায়ক গান গাওয়ার আগে হিরোর সাক্ষাৎকার নেওয়া এটাই প্রথম ঘটনা ছিল।
কিশোর দা সেই সময়ে ইন্ডাস্ট্রির একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক এবং গায়ক ছিলেন। তার কথা অমান্য করা সম্ভব ছিল না। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে রাজেশকে কিশোর দার সাথে সাক্ষাৎকারের জন্য পাঠানো হবে।
আরাধনা ছিল রাজেশ খান্নার প্রথম বড় ব্রেক। সিনেমার সঙ্গীতের কাজ চলছিল। এস.ডি. বর্মন সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন এবং তার ছেলে আর.ডি. বর্মন সহকারী সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে রাজেশ খান্নার এন্ট্রি গানটি কিশোর কুমারের দ্বারা গাওয়া হবে।
এস.ডি. বর্মন এবং শক্তি সামন্ত কিশোর কুমারের সাথে কথা বলেছিলেন। তারা তাকে সুর শুনিয়েছিলেন। কিশোর দা তার অদ্ভুত শর্তগুলির জন্য পরিচিত ছিলেন। যখন তিনি জানতে পারেন যে সিনেমায় একজন নতুন হিরো আছে, তিনি ওমন আন কমন জেদ ধরে বসলেন।
তা পরে শক্তি সামন্ত এবং বর্মন দা রাজেশ খান্নাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিশোর দার বাড়িতে পাঠালেন।
এখন রাজেশ খান্না এবং কিশোর কুমার প্রথমবার মুখোমুখি হলেন। আধঘণ্টা কেটে গেল। উত্তেজনার কারণে রাজেশের গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল এবং কিশোর দা তাকে জল পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করেননি।
এদিক-ওদিকের কথা চলতে থাকলো। কিশোর দা রাজেশকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখলেন।
তারপর হঠাৎ কিশোর দার থেকে প্রশ্ন এল - সিনেমা করতে চাও কেন?
দুই মুহূর্তের জন্য রাজেশ অবাক হয়ে গেলেন। এটা কেমন প্রশ্ন।
উত্তেজিত রাজেশ উত্তর দিলেন - জি, আমি মানুষের সেবা করতে চাই।
কিশোর দা আবার প্রশ্ন করলেন - সিনেমায় কাজ করে কী ধরনের সেবা করবে?
রাজেশের উত্তর এল - সিনেমায় কাজ করে আমি মানুষের বিনোদন করবো। বিনোদন করাও এক ধরনের সেবা।
রাজেশের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর শুনে কিশোর দা খুশি হলেন।
নৌকরে ডাক দিলেন। রাজেশের জন্য চা-নাস্তা আনো।
কিশোর দাকে খুশি দেখে রাজেশের প্রাণে শান্তি এল। কিশোর দা বললেন - তুমি খুব ভালো কথা বলেছো। আমি তোমার জন্য গাইবো। অনেক গান গাইবো।
এবং এই সাক্ষাৎকারের পর আরাধনার প্রথম গান রেকর্ড করা হয়েছিল, যা সমগ্র দেশে আলোড়ন তুলেছিল এবং রাজেশ খান্নাকে হিরো থেকে স্টার বানিয়েছিল।
গানটি ছিল "মেরে সপ্নো কি রানি কাব আয়েগি তু…"
কিশোর কুমারকে নিয়ে আরো কয়েকটা কথা না বলে পোস্টটা শেষ করতে মন চাইলো না
সুরকার কল্যাণজি আনন্দজি কিশোর কুমারকে নিয়ে একবার একটা গল্প শুনিয়েছিলেন।
'সুহাগ রাত' ছবির একটা গান রেকর্ডিং হচ্ছে। খানিকটা কাওয়ালি আর কিছুটা ভজন মিশিয়ে সুর করা। গানের নাম 'ধরতি কী তরা হর দুখ সহনে।' রিহার্সাল হওয়ার পর নেওয়া হল প্রথম টেক। কিশোর কুমার খুবই ভাল গাইলেন। কিন্তু শেষ হওয়ার পর কিশোর বললেন ঠিক হল না।
সুরকাররা বললেন, কেন? ঠিকই তো আছে। কিশোর বললেন, ধুর৷ গানের আসল মুডটাই আসছে না। এক কাজ করো। তাড়াতাড়ি যেখান থেকে পারো, একটা কুর্তা-পাজামা নিয়ে এস।
কিন্তু তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। কিশোর বললেন, হোক দেরি, গানটাকে ভালো করতে হবে। এত সুন্দর সুর হয়েছে। যাও, যাও কুর্তা পাজামা নিয়ে এসো।
এবারে হুবহু কল্যাণজির বয়ানই তুলে দেওয়া যাক-
"নিয়ে আসা হল কুর্তা পাজামা। কিশোরদা ওই পরে সেকেন্ড টেক নিলেন। গান শেষ হতেই বললেন, কী অনেকটা বেটার হয়েছে না? সত্যিই বেটার হয়েছিল। আমি বললাম, দারুণ হয়েছে কিশোরদা। কিশোর বললেন, 'থার্ড একটা টেক নাও। আর একটা জ্যাকেট আর চপ্পল নিয়ে এস। আমি বললাম, 'জ্যাকেট চপ্পল আবার কী হবে?” 'কুর্তা পাজামার সঙ্গে জ্যাকেট আর মুজরা গায়কের মতো চপ্পল হলে ব্যাপারটা জমমে ভালো।'---বললেন কিশোরদা।
জ্যাকেট, চপ্পল আনা হল। থার্ড টেক শেষ হতেই কিশোরদা লাফাতে লাফাতে বেরলেন 'তোদের এই গান হিট হয়ে যাবে রে।' আমরা তো আনন্দে আত্মহারা, এত ভালো গেয়েছেন, সত্যিই হিট হবে।
বললাম, "দাদা তাহলে পরের গানটা শোনাই?'
অবাক কিশোরদা বললেন, 'সে কি, এই না বললাম যে এই গানটা হিট হয়ে যাবে।"
আমি বললাম, "হ্যাঁ, সে তো হবেই। কিশোরদা বললেন, 'কোথায় হল, আমি তো ফিউচার টেন্সে কথা বলেছি। কুর্তা পাজামা হল, জ্যাকেট হল এবার একটা টুপি হলেই ষোল কলা পূর্ণ হয়। গান হিট। আবার টুপি কিনতে যাওয়া হল। সাদা টুপি এল। ফেজ। কিশোরদা পরলেন। আয়নায় ভালো করে নিজেকে দেখলেন। গান সত্যিই হিট এবং সব থেকে ভালো হল ওই শেষ টেকটাই। এই হচ্ছে কিশোরদা।"
খুব প্রিয় কোনো মানুষকে নিয়ে হুট করে লেখা খুবই কঠিন। যাঁকে নিয়ে প্রায় রোজের দিন রাত কেটে যায়, তাঁকে নিয়ে লিখতে গেলে হয় লেখা আসে না, নয়তো জোর করে নিজেকে কন্ট্রোল করতে হয়। যেমন কেউ আমাকে শিবরাম চক্রবর্তীকে নিয়ে লিখতে দিলে কিংবা আড্ডা মারতে চাইলে ফাঁপরে পড়ি।
সদ্যপ্রয়াত গায়ক প্রতীক চৌধুরী কিশোর কুমারকে নিয়ে খুব দামি একটা কথা বলেছিলেন - 'ভারতীয় সঙ্গীত জগৎকে তিনি অনেককিছু দিয়ে গেছেন। কিন্তু সঙ্গে একটা অপকারও করে গেছেন। প্রথাগত শিক্ষা না পেয়েও গান যে এই পর্যায়ে গাওয়া সম্ভব, এই ধারণাটা উনি দেশের মানুষের মনে গেঁথে দিয়ে গেছেন।'
এই গান না শেখার ব্যাপারটা একেবারে মিথের পর্যায়ে চলে গেছে। ওস্তাদ মৌজুদ্দিন খান ছিলেন কিংবদন্তি। এঁর নামেও শোনা যায় কোনোরকম প্রথাগত শিক্ষা কিংবা তালিম ছাড়াও ভারতবর্ষের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতের এক বড়ো ওজনদার নাম হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি ওস্তাদ ফৈয়াজ খান, ওস্তাদ আব্দুল করিম খানকেও নাকি তিনি প্রভাবিত করেছিলেন।
কিশোরের গান 'না শেখার' ব্যাপারটা একটু ভাবা যাক। এখনকার বহু উঠতি গায়ক যেমন গান তো দূর অস্ত, একটা কথা বলতে গেলে তাতেও সুর-তাল নেই, তবু বিশ্রী কন্ঠে গেয়ে দিচ্ছেন, সফটওয়্যারের জাদুতে সেটাই হয়ে যাচ্ছে একেবারে কোকিল কন্ঠ। গানও হিট।
কিশোর কুমারকে কি এরকম জায়গায় কল্পনা করে নেওয়া যায়? যায় না।
তাঁর একদম গোড়ার দিককার কেরিয়ারে গানের ক্ষেত্রে অনেকটাই তাঁর খামখেয়াল কাজ করেছে। অতটা সিরিয়াসনেস নেই, মজা করে গেয়েছেন।
একবার ‘নৌকরি’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য বিমল রায় কিশোর কুমারকে বাছলেন, ওদিকে সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরী গাওয়ার জন্য ভেবেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। তাঁর তখনকার সিগনেচার গায়ক- নায়ক হতে পারবেন না? ভ্যাবাচ্যাকা কিশোর ছুটলেন আন্ধেরির মোহন স্টুডিয়োয় সলিলের খোঁজে। সলিল সব শুনে বললেন- ‘তোমার গান তো শুনিই নি, গাইতে বলি কোন আক্কেলে’, কিশোর বলতে গেছিলেন ‘নিজেই নিজের গান গাই’, কিন্তু সলিল পাত্তাই দিলেন না।
তখন কিশোরকে সলিল বললেন দু'কলি গেয়ে শোনাতে। সবে গাইতে শুরু করেছেন কি করেননি, সলিল একেবারে সটান বলে দিলেন -' কিশোর তুমি গানের অ আ ক খ-ও বোঝো না, ও হেমন্তই গাইবে, তুমি বরং লিপ দিও।’
কিশোরও ছাড়ার পাত্র নন। বিমল রায়কে বললেন তাঁকে গাইতে দেওয়া হচ্ছে না। বিমলবাবু সাফ জানালেন সলিল চৌধুরী সঙ্গীত পরিচালক, তিনি কাকে দিয়ে গান গাওয়াবেন, সে সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন। কিশোর ফের চেষ্টা করলেন। নিজের গাওয়া ছোট দুটো রেকর্ড নিয়ে আবার গেলেন সলিলের কাছে। সেই গানও সলিলের 'সাবলীল' লাগেনি।
কিশোরের হয়ে তখন কয়েকজন সলিলকে বললেন - ‘বেচারা সবে কেরিয়ার শুরু করেছে, প্লেব্যাকে বাধা পেলে মন ভেঙে যাবে।’ শেষে নিমরাজি হলেন সলিল, কিন্তু বলতেও ছাড়লেন না- ‘আমি কিন্তু আগে থেকে বলে রাখছি, কিশোর ছোকরাটি একেবারেই গাইতে পারে না।’ দুটো গান অবশ্য গাওয়ালেনও। এর ১৭ বছর পরে সলিল একেবারে থমকে যান ‘কোই হোতা জিসকো আপনা’ শুনে। বলেন, একদম গোড়াতেই শচীন কত্তা চিনেছিলেন কিশোরকে, যখন আমরা সবাই বুঝতে ভুল করি।
কিন্তু কিশোর কি তাই বলে চেষ্টা ছেড়ে বসে থাকতেন? যা খুশি গেয়ে দিতেন আর হিট করত? না। শচীনকত্তা, সলিল চৌধুরী বাঘা বাঘা সব মিউজিক ডিরেক্টররা তাঁকে দিয়ে যে যে গান গাওয়াতে চাইতেন সেগুলো একেবারে নাড়া বাঁধার মতো করে শিখতেন, বার বার ফোন করে শোনাতেন।জিগ্যেস করতেন ঠিক হচ্ছে কিনা! প্র্যাকটিস করতেন বারবার। তাবড় তাবড় মানুষদের সঙ্গে কাজ করে করে তিনি একপ্রকার নিজেকে রিবুট করেছিলেন।
তাঁর সবচেয়ে বড়ো জিনিস যেটা ছিল সেটা হ'ল কন্ঠ, আর অসামান্য থ্রো৷ বাঘা বাঘা গায়ক সেটার কাছেই হেরে যাবেন। পন্ডিত ভীমসেন যোশি কিশোরের গান পছন্দ করতেন। পন্ডিত উল্লাস কাসালকর আইটিসি সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন - ' কিশোরের গান যে ভালোবাসেনি, সে আসলে সঙ্গীতকে ভালোবাসেনি। '
আরেকবার কলকাতায় এক বড় মাপের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসেছিল। অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেছিলেন দেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রথী-মহারথীরা। একটা ইন্টারভ্যাল চলাকালীন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী লক্ষ্য করেছিলেন সেইসব রথী-মহারথীরা একমনে 'কুছ তো লোগো কহেঙ্গে' শুনছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি অবাক হয়ে বলেছিলেন 'সেদিন বুঝেছিলাম কত উচ্চ দরের শিল্পী হতে পারলে একজন গায়ক এরকম রথী-মহারথীদের আচ্ছন্ন করে রাখা যায়।'
মান্না দে বলতেন নিজের একাধিক পারফরম্যান্সে তিনি তুষ্ট হননি, কিন্তু কিশোরের মতো সবসময় এত সুরে গাইতে আর কাউকে দেখেননি। বলতেন - ' কিশোর যে গানের মধ্যে কখন কী করে দেবে, কেউ বলতে পারে না। পুরো চেঞ্জ করে দেবে গানের গতি,গানের মেজাজ।একেবারে জিনিয়াস।'
একবার কিশোরেরই প্রযোজিত একটা ছবিতে তাঁরই সুরে মান্না-রফি-কিশোরের একসঙ্গে গাওয়ার কথা। মান্নাবাবু আর রফি সাহেব খুব সিরিয়াসলি রিহার্সাল করেন, কিন্তু কিশোর চলেন খেয়াল খুশিমতো। মান্নাবাবু ভাবেন কিশোরটা না ঝোলায়! কিন্তু ফাইনাল টেকের দিন কিশোর একেবারে জড়তা ছাড়া ঠিকঠাক গেয়ে জমিয়ে দিয়েছিলেন।
খুব সাধারণ,অপ্রচলিত একটা গানের উদাহরণ দিচ্ছি। হরিহরণের সঙ্গে একটা ডুয়েট গেয়েছিলেন কিশোর। গানটার নাম 'ঝটপট ঘুঙ্ঘট খোল। 'এক চতুর নার' এর খুব খারাপ ইমিটেশন। গানটা ছিল ভূপালী রাগে - রবীন্দ্রনাথের 'প্রচণ্ড গর্জনে আসিল একি দুর্দিন' গানের সঙ্গে চলনে বেশ মিল।
গানটা শুনলে অনেক জায়গায় আমি এখনও ধরতে পারি না কোনটা হরিহরণের গলা,কোনটা কিশোরের।
কি সাবলীলভাবে ক্লাসিক্যাল টাচ দিয়ে গেছেন একেকটা।
আমি আমার স্বল্প জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে এটুকু বুঝি যে গানের শ্রোতার কাছে সবচেয়ে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট গায়কের কন্ঠ, তারপরেই মড্যুলেশন আর থ্রোয়িং। এই দুটোর অভাবে বহু সুশিক্ষিত গায়কই কল্কে পাননি। তবে একেবারে গানের ব্যাকরণ গুলে খাওয়া অনেক বড়ো বড়ো মেজাজি সঙ্গীত পরিচালকের খুব ফেভারিট গায়ক কিশোর ছিলেন না, যেহেতু কিশোরের শাস্ত্রীয় শিক্ষা ছিল না। নচিকেতা ঘোষ কিশোরকে পত্রপাঠ একরকম বারই করে দিয়েছিলেন। তবে একটা গান গাইয়েছিলেন - ' বলো হরি হরিবোল'। তাতেই ধুন্ধুমার হয়ে যায়। গানটা সুপারহিট হয়েছিল। নচিকেতা ঘোষ ছাড়াও আরও এক স্বনামধন্য সুরকার সুধীন দাশগুপ্তর সাহায্যও কিশোর সেভাবে পাননি। একবার নচিকেতা’র সুরে কিশোর রেকর্ডিং করতে আসেননি, মেজাজি নচিকেতাও আর কখনও কিশোরের সঙ্গে গান করেননি। নচিকেতা ঘোষের শ্যামবাজারের বাড়ির কাছের এক পাইস হোটেলে উঁকি মেরে কিশোর খদ্দেরদের বলেছিলেন - 'কী মাছ খাচ্ছেন দাদা?'
তারপর নচিবাবুকে বলেছিলেন আপনার সুরে গান চাই। শেষ অবধি তা আর পাননি।
কিশোরের স্বপ্ন ছিল নৌশাদের সুরে গাওয়া। কিন্তু তাঁর সুরে কিশোর গান পান কেরিয়ারের প্রায় ২৭ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর। যদিও ছবিতে সেই গানটা ব্যবহার করা হয়নি।
সলিল চৌধুরীর সুরে কিশোর খুব অল্প গেয়েছেন। কিন্তু যে ক'টা গেয়েছেন একেবারে সোনা। কমল হাসানের একমাত্র বাংলা সিনেমা 'কবিতা' সবাই মনে রেখেছে সলিল চৌধুরীর সুরে কিশোরের ' শুন শুন গো সবে শুন দিয়া মন ' এর জন্যই।
সলিল একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন কিশোর স্রেফ কন্ঠের জোরেই এতকিছু, যদি ক্লাসিক্যাল ট্রেনিংটা থাকত কী না জানি হত। তাঁর আক্ষেপটা সম্ভবত কিশোরের তালিম না থাকার জন্য।
বারাসাতের বিখ্যাত সিঙ্গেল স্ক্রিনের সিনেমাহল 'লালী' তে ছোটবেলায় একবার সিনেমা দেখতে গেছিলাম। সিনেমা শুরুর আগে বাপি লাহিড়ীর সুরে ' ওয়ক্ত কী আওয়াজ ' এর ' লড়কি আকেলি তু ভি আকেলা' গানটা চালিয়েছিল।একদম মধ্যমমানের চটুল গান। আটের দশকের ফসল। কিন্তু স্রেফ কিশোর সেই গানটা এমন ভাবে গেয়েছেন যে পুরো হলের পরিবেশ এক নিমেষে বদলে গেছিল। কী ভরাট আর দরদী গলা!
কিশোরের শেষ দিকের গানগুলো নিয়ে বিশেষ চর্চা হয় না। আটের দশক নাকি মুম্বাই - বাংলা দুই ইন্ডাস্ট্রির পক্ষেই অন্ধকার সময়। কিশোর কুমার কিন্তু একদম হারিয়ে যাননি, প্রচুর খারাপ গীতিকার, সুরকারের হাতে পড়েছেন বটে কিন্তু অনেকে ঠিক এই সময়েই তাঁকে দারুণ ভাবে ব্যবহারও করে নিয়েছেন। বাপি লাহিড়ীর সুরে অজস্র গান সেই সময় গেয়েছেন। অনেকগুলো এখনও নাকি আনরিলিজড।
তার মধ্যেই কয়েকটা গান অসম্ভব কঠিন আর অসাধারণ। বিভিন্ন সুরকারের সুরে বিভিন্ন ইংরেজি গানের ভারতীয়করণ( সবগুলো যে কপি পেস্ট তা নয়) গুলো কিশোর যেভাবে গেয়েছেন অরিজিনালের চেয়ে বহুগুণে তা ভালো। রাহুলদেব বর্মনের সুরে - 'এ মেহেকি মেহেকি' ( হেল্প মি রন্ডা, বীচ বয়েস), 'মিল গয়া হামকো সাথী মিল গয়া' (মামা মিয়া, এবিবিএ), বাপি লাহিড়ীর সুরে 'পাপ কি দুনিয়া ' ছবিতে' চোরি চোরি য়ুঁ জবকো '( ওয়াক লাইক অ্যান ইজিপশিয়ান, ব্যাঞ্জেলস) কিংবা লক্ষ্মীকান্ত -প্যারেলাল জুটির 'ওম শান্তি ওম' ( ওম শান্তি ওম, লর্ড শর্টি) যা ই গেয়েছেন, তাঁর গলার জাদু অরিজিনালগুলোকে ছাপিয়ে গেছে।
অমিতাভ বচ্চন আর মিঠুনের লিপে( যোগিতা বালি কিশোরের সঙ্গে ডিভোর্সের পর মিঠুনকে বিয়ে করেছিলেন) তো গান গাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলেন ইগোর জন্য। পরে অবশ্য প্রচুর গান করেন। একদল বলে আসলে মিঠুনের মতো সুপারস্টারের লিপে গান গাওয়া বন্ধ করে দিলে তিনি নিজে কেরিয়ারের দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়তে পারেন সেটা ভেবেছিলেন। আরেকদল বলে তিনি বাপি লাহিড়ীকে এত সাংঘাতিক ভালোবাসতেন যে বাপির অনুরোধ ফেলতে পারেননি।
কারণ আটের দশক মানেই বাপি আর মিঠুনময়।
রাজেশ খান্না, দেব আনন্দ আর আরডি বর্মনের কাজ একের পর এক ফ্লপ যাচ্ছে তখন। কিন্তু কিশোরের সঙ্গে এঁদের বন্ধুত্ব এতটাই অটুট ছিল যে কিশোর সেই ফ্লপ ছবিগুলোতেই তাঁর সেরা বহু গান গেয়েছেন।
'আরাধনা'য় সব গান শচীনকত্তা মহম্মদ রফিকে দিয়ে গাওয়াতে চেয়েছিলেন কিন্তু রাহুলের পীড়াপীড়িতে গানগুলো পান কিশোর। বাকিটা ইতিহাস। কিশোরের কেরিয়ারের মোড় তাতে ঘুরে যায়। তারপর রাজেশ সব ছবিতেই কিশোরকে চাইতেন। রাজেশ প্রযোজিত ছবি ' আলাগ আলাগ' এ গান গেয়ে তাই এক পয়সাও নেননি কিশোর।
কিশোরের প্রযোজিত শেষ ছবি 'মমতা কি ছাও মেঁ' তে অমিতাভকে একটা গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স করার জন্য অনুরোধ করলে অমিতাভ করেননি, তাই অমিতাভের লিপে গান গাওয়া বন্ধ করে দেন। সেইসময় ডুবে যাওয়া রাজেশ তখন সেই চরিত্রে অভিনয় করেন। পারিশ্রমিক নেন মাত্র এক টাকা। ছবি শেষ হওয়ার আগে কিশোর মারা গেলে রাজেশ এগিয়ে এসে রিলিজে সাহায্য করেছিলেন।
এই কিশোরের একটা গানের জন্য আবার রাজেশ একটা ছবি থেকে বাদ পড়ে যান। ছবিটার নাম ছিল 'সতীন কি বেটি'। ডিরেক্টর প্রথমে নায়কের ভূমিকায় নিয়েছিলেন রাজেশ খান্নাকে। সেই ছবির জন্য বেদপালের সুরে কিশোর একটা গান রেকর্ড করেছিলেন - 'কৌন শুনেগা কিসকো শুনায়ে'। কিন্তু সিচুয়েশন অনুযায়ী গানটা থাকার কথা ছিল সুমিত সায়গলের লিপে। সেই গানে মুগ্ধ হয়ে রাজেশ গোঁ ধরেন তিনিই লিপ দেবেন। কিছুতেই তাঁকে বোঝাতে না পেরে ডিরেক্টর তাঁকে বাদ দিয়ে জিতেন্দ্র-রেখা-জয়াপ্রদাকে কাস্ট করেন।
গানটা অমর হয়ে গেছে কিন্তু সুমিত সায়গলকে কে মনে রেখেছে? কিংবা 'কালাকার' ছবির 'নীলে নীলে অম্বর পর' এ লিপ দেওয়া কুণাল গোস্বামীকে?
রাজেশ খান্না, দেব আনন্দ, ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চন, ঋষি কাপুর থেকে জিতেন্দ্র, মিঠুন, অনিল কাপুর, সানি দেওল সবার প্লেব্যাক করেছেন। সবার লিপ আশ্চর্যভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বহু কচি মুখ তাঁর কন্ঠের ওজনও তুলতে পারে নি।
বাংলাতেও উত্তম কুমার, সৌমিত্র, তাপস পাল, প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জিত, সুখেন দাস, রঞ্জিত মল্লিকের লিপেও তাঁর অনবদ্য একেকটা গান আছে। তিনি সবার খবর রাখতেন। স্টুডিওয় ঢোকার আগে স্রেফ জেনে নিতেন কার লিপে গাইতে হবে। তারপর মুড মিলিয়ে বাজিমাত করতেন।
তাঁর একেকটা গানে একেকজনের কেরিয়ার গ্রাফ উঠে গেছে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ প্রসেনজিৎ এর ' অমরসঙ্গী'।
যে ক'টা প্রসেনজিৎ আর তাপস পালের লিপে গেয়েছেন সবক'টাই দারুণ গান। আমার ব্যক্তিগত পছন্দ 'চোখেতে শাওন গায় গুনগুন','পারি না সইতে না পারি বইতে', 'দু'চোখে রজনী', 'ভালবাসা ছাড়া আর আছে কি', 'ঘুমাও বন্ধু আমার'।
বাংলার কিছু সুরকার কিশোর কুমারের শেষদিকে খুব ভালভাবে তাঁকে ব্যবহার করেছিলেন। কানু ভট্টাচার্য আর সুখেন দাসের ভাই অজয় দাস সবচেয়ে এগিয়ে থাকবেন। 'ওরে মন পাগল তুই', 'আমারও তো গান ছিল', 'ওপারে থাকব আমি', 'কী উপহার সাজিয়ে দেব', 'মিলন তিথির পূর্ণিমা চাঁদ মোছায় অন্ধকার' গানগুলো ছিল একেকটা সুপারহিট। গানের জোরেই সিনেমা চলেছে এমনটাও হয়েছে। এসব গানের বেশিরভাগ সুখেন দাসের লিপে। সুখেন দাসকেও সেজন্য অনেকে মনে রেখেছে। উত্তম পরবর্তী ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচানোর অন্যতম কান্ডারীই ছিল কিশোরের গান।
উদয়শঙ্কর চৌধুরী ওরফে উদয়রাজকে এককালে সবাই চিনতেন। নামকরা কিশোর কন্ঠী ছিলেন তিনি। যতীন দাস পার্ক থেকে কালীঘাট মন্দিরের রাস্তার দিকে তাঁর বাড়ি। তাঁর গাওয়ার মিলে চমকে গেছিলেন স্বয়ং কিশোর। দু'জনে একসঙ্গে অনেক অনুষ্ঠানে গেয়েওছেন। গানের লিরিক কিশোর ভুলে গেলে গড়গড়িয়ে মুখস্থ বলে দিতেন উদয়বাবু। প্রচুর বাংলা ছবিতে কিশোরের গানের ট্র্যাক তাঁকে দিয়ে গাওয়ানো হত। কিশোর নিজে পছন্দ করতেন বলে অজয় দাস উদয়কে দিয়েই সব ট্র্যাক রেকর্ড করাতেন। 'মংলু আমি জংলী আমি পাহাড় দেশে থাকি' র ট্র্যাকে তাঁর ভয়েস শুনে কিশোর চমকে যান।এতটাই মিল! মজা করে বলেন এটায় আমি না গাইলেও হবে। ‘ভালবাসা ছাড়া আর আছে কী’ গানেরও ট্র্যাক-এ গলা দেন উদয়ই৷ কিন্ত্ত বম্বের ওয়েস্টার্ন স্টুডিওতে টেক করার পর কিশোর খেয়াল করেন লয় ঝুলে আছে যান্ত্রিক সমস্যার কারণে৷ উদয়কে বলেন, ‘চলো, রেডিও জেম স্টুডিওতে গিয়ে কারেকশন করে নিই৷’ একটা ১২ তলা বাড়ির নয় তলায় রেডিও জেম-এর অফিস৷ সেদিনই লিফট খারাপ৷ কী করা যায়? অগত্যা কিশোর বললেন চলো আস্তে আস্তে উঠি৷' কারণ, দু’বার তাঁর স্ট্রোক হয়ে গেছে আগে! আরেকবার একটা গানে ক্ল্যাসিকাল পার্টটা অক্লেশে গেয়ে হাঁটুতে থাপ্পড় দিয়ে অজয় দাসকে বলেছিলেন, ‘কী অজয়বাবু, কেমন দিলাম! কিশোরকুমার পারবে না হয়!’
হাল আমলের অভিজিৎ ভট্টাচার্য, অলকা ইয়াগনিক, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, সুরেশ ওয়াদকার, উদিত নারায়ণ,আলিশা চিনয় সবার সঙ্গে গেয়েছেন। কেউ তাঁকে ডুয়েটে হারাতে পেরেছে কেউ বলতে পারবে না। বাঘা বাঘা গায়কের সঙ্গে সমানভাবে গেয়ে গেছেন। ' ফকিরা' ছবির একটা গান ' হাম তো ঝুঁক কর সালাম করতে হ্যায়' তে কিশোর গলা মিলিয়েছিলেন মহেন্দ্র কাপুর, নাকাশ আজিজদের সঙ্গে। কিংবা ' মহব্বত বড়ে কাম কি চীজ ' গানে যেশুদাস আর লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে। তাঁর গলার দাপটে বাকিরা ম্লান। কী অবলীলায় তিনি কঠিন কঠিন জায়গা গেয়ে দিতেন। একাধিক ভার্সনওয়ালা গানে বারবার সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে তাঁর ভার্সনই।
নিজে গান পাওয়া নিয়ে ছেলেমানুষি করেছেন, রাজেশ রোশনের মতো আনকোরা সুরকারের সুরে গাইতেই চাননি, আবার গুণীর প্রকৃত কদর করেছেন, অন্যান্য শিল্পীদের সাহায্য করেছেন প্রচুর।
লতা মঙ্গেশকরের থেকে সবসময় এক টাকা কম পারিশ্রমিক নিতেন, রফি সাহেবকে প্রচন্ড সম্মান করতেন, নিজের দ্বারা কোনও গান হবে না বুঝলে রফিকে দিতে বলতেন, কোনও গান রফির থেকে বুঝেও নিতেন।
'ডিস্কো ডান্সারের' 'ইয়াদ আ রাহা হ্যায়' প্রথমে তাঁরই গাওয়ার কথা ছিল৷ তাঁর আসতে দেরি হচ্ছিল বলে প্রোডিউসারের কথায় বাপি লাহিড়ী একটা রাফ ট্র্যাক গেয়ে রাখেন, যেটা শুনে কিশোর সহজে গাইতে পারবেন। কিশোর শুনে বাপিকে বলেন - 'তোর থেকে ভাল কেউ গাইতে পারবে না।আমি তোর মামা, আদেশ দিচ্ছি তুইই গা'।
তারপর 'গুরুদক্ষিণা' ছবির জন্য বাপি অলরেডি কিশোর মামাকে দিয়ে দুটো গান গাইয়ে ফেলেছেন, প্রোডিউসারের অত বাজেট নেই। তাই নিজেই ' এ আমার গুরুদক্ষিণা ' গাইলেন। সেটা শুনে কিশোর বললেন ' এ গান আমি গাইব, তোর প্রোডিউসারকে গিয়ে বল যা দেবে তাইই নেব '।
কিশোর সোধাকে পাসপোর্ট তাড়াতাড়ি করাতে তিনিই সাহায্য করেছিলেন।
পন্ডিত রনু মজুমদার বলেছেন-
'কিশোরদা আমায় স্নেহ করতেন, আবার একটা দূরত্বও ছিল। আমি হিন্দি বাংলা মিলিয়ে প্রায় শ'দুয়েক গান ওঁর সঙ্গে রেকর্ডিংয়ে বাজিয়েছি।...
একটা গল্প বলি। 'চিঙ্গারি কোই ভরকে' অরিজিনাল গানটায় অন্তরায় পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া বাজিয়েছিলেন। কিন্তু কিশোরদার বহু লাইভ প্রোগ্রামে আমি বাজিয়েছি। একবার একটা অনুষ্ঠানে গানের শেষ অংশটায় বাঁশিতে একটা পিস আছে, সেটা করতে ভুলে গেলাম। অন্য যে কোনও শিল্পী হলে বিরাট রেগে যেতেন। উনি আমার দিকে তাকিয়ে মিচকি হাসলেন, যার অর্থ, কী ভুলে গেলে? ইশারা করলেন, আবার যাচ্ছি। আবার শেষ অংশটা গাইলেন উনি, আমি বাজালাম। এই ঘটনাটায় বুঝেছি উনি কত্ত বড় মানুষ ছিলেন। আমি তো তখন সামান্য এক সহশিল্পী। আর উনি কিশোর কুমার! কিন্তু গানের ব্যাপারে উনি কখনও পারফরম্যান্সে রেগে যেতেন না। হয় হাসতেন, নয় গায়ে ছোট্ট টোকা দিয়ে ইশারা করতেন।
'হাজার রাহে' খৈয়াম সাহেবের সুর, পর্দায় রাজেশ খান্না। গানটায় বাজিয়েছিলাম। সকাল থেকে উনি খোশমেজাজে। একটা চোলা পরে এসেছেন সাঁইবাবার মতো। খৈয়াম সাহেবের টাক মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। এদিকে সিঙ্গার বুথ থেকে সামান্য রেগে লতাজি চশমার উপর দিয়ে তাকাচ্ছেন। কিশোরদা তখন গানের উপর স্কেচ পেন দিয়ে নিজস্ব স্টাইলে দাগ দিয়ে নিচ্ছেন বড় বড় করে। কিন্তু গান যখন শুরু করলেন অন্য মানুষ। অন্তরার একটা জায়গায় লতাজি 'বাহ' করলেন। আমি অনেক সাক্ষাৎকারে বলেছি আমার সবচেয়ে পছন্দের গায়ক কিশোরকুমার। রাগসঙ্গীতের মানুষরা অনেকে হয়তো ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু তাতে আমার কিছু করার নেই।' একবার একটা গানের রেকর্ডিংয়ে অ্যারেঞ্জার মনোহারিদা এমন বকাবকি করলেন যে আমি দুঃখে বাঁশি প্যাক করে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ এক মেসেঞ্জার এসে বলল, কিশোরদা সিঙ্গার বুথে ডাকছেন। গেলাম। উনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, 'আরে কে কী বললো ছাড়ো। তুমি, আমি সবাই তো গানটার কাজ করছি নাকি? সেটা ইনকমপ্লিট রেখে বেরোলে হবে? শিগগির বাজাতে বোসো।' চোখে জল এল। মনে হল প্রণাম করি। কিন্তু অনেকেই জানেন না কিশোর কুমার প্রণাম নিতেন না। এমনকী নিজেকে 'গায়ক' বলে মানতেনও না! "
আমার সবচেয়ে বেশি কৌতূহল সুরকার কিশোর কুমারকে নিয়ে। তিনি মজা করেছেন, ফাজলামি মেরেছেন, মজার গান গেয়েছেন কিন্তু নিজে যখনই সুর করেছেন সেটা দার্শনিকতা আর বিরহে ভরা। গানের সুর শুনলে তাঁর মিউজিক সেন্স অত্যন্ত উঁচুদরেরই মনে হয়। হেমা মালিনীকে দিয়ে বাংলা গান গাইয়েছেন, লতা মঙ্গেশকরের ' কী লিখি তোমায়', নিজের ' আমি প্রেমের পথের পথিক', ' আমার দীপ নেভানো রাত ',' আমার মনের এই ময়ূরমহলে' এগুলো একেকটা অন্য জগতে নিয়ে যায়। ' আমার মনের এই ময়ূরমহলে' তিনি প্রথমে হিন্দিতে করে ছেলে অমিতকে দিয়ে গাইয়েছিলেন - ' দওড় এ খিজা থা'। সেটাও অপূর্ব। আবার রাজেশের লিপে নিজের শেষ গান করেন ' আমি প্রেমের পথের পথিক' এর সুরেই - ' মেরা গীত আধুরা হ্যায়'।
পুজোর গানে তাঁর মতো পরিবেশ তৈরি করে দিতে আর কেউ পারেননি। কেউ না। তাঁর গান ছাড়া পুজো অসম্পূর্ণ। অন্যদের দুঃখের গানে শরীর জুড়ে ঠান্ডা স্রোত সবকিছু জমিয়ে দেয়, কিশোরের দুঃখের গান যেন বরফের টুকরো হয়ে আমাদের পানীয়ে মেশে।
মান্না দে, কিংবা মানবেন্দ্রবাবুদের দুঃখের গান শুনতে হয় একা একা, কেউ এলে রসভঙ্গ হয়। কিন্তু কিশোরের দুঃখের গান লং ড্রাইভ থেকে আড্ডার আসর সব জায়গাতেই খাপ খেয়ে যায়। বাসু- মনোহারি জুটির সুরে অল্প কয়েকটা গান গেয়েছেন কিশোর। তাঁর অন্যসব গান না শুনে এই কটা শুনলেই দুঃখের কিশোর যে কতখানি অতলকে স্পর্শ করতে পারেন বোঝা যায়। অমল পালেকরের লিপে 'চেয়েছি যারে আমি' ছাড়াও
মেগাফোনেই কিশোর গেয়েছিলেন মুকুল দত্তের কথায় আর বাসু-মনোহারির সুরে 'আজ থেকে আর ভালেবাসার নাম নেব না আমি', 'জড়িয়ে ধরেছি যারে, সে আমার নয়', 'মন জানলা খুলে দে না'।
সারাজীবন ভীষণ একাকীত্বে ভোগা কিশোরের নিজের।লিস্ট করা সেরা দশটা গান হ'ল - 'দুখী মন মেরে', ' চিঙ্গারি কোই ভড়কে','কোই হোতা জিসকো আপনা', ' কোই হামদম না রাহা', ' মেরে নয়না শাওন ভাদো', ' ও শাম কুছ আজিব থি', বড়ি শুনি শুনি ', 'মেরে মেহবুব কেয়ামত','হাস ভি হ্যায়', ' জগমগ জগমত'।
বেশীরভাগ গান বিষন্নতার। অনেকেই বলেন তাঁর মতো প্যাথোস বোধহয় আর কারুর গলায় এরকম খোলে না।
লেখা শেষ করব একটা অন্য বিষয় দিয়ে। সবাই কিশোরের অসাধারণ অভিযোজনের নেপথ্যে শচীনদেব-রাহুলদেবের কথা বলেন বটে কিন্তু আরেকজনের কথা বিশেষ বলেন না, তিনিও কিন্তু কিশোরের ভার্সেটাইলিটিকে খুব ভাল চিনতেন, ব্যবহারও করেছেন অসাধারণ। তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
কিশোরের অবিস্মরণীয় গান 'এক পলকে একটু দেখা','ও গো নিরুপমা ', ইংরেজি গান 'ও বাই জিঙ্গো' থেকে নেওয়া 'শিং নেই তবু', 'কী করে বোঝাই তোকে গানের গ জানি না' থেকে ' সরস্বতীর সেবা করি অন্ন তাই জুটলো না', 'হাওয়া পে লিখ দো', 'ও শাম কুছ আজিব থি' এসব কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়েরই সুরে।
সাতের দশকের শেষ দিকে এই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে কিশোরের চারখানা গান বেরিয়েছিল মেগাফোন থেকে। তখন আবার এইচএমভির সঙ্গে গণ্ডগোল চলছে কিশোরের। হেমন্ত তখন অসুস্থ । বয়সও হয়েছে। মেগাফোনের প্রধান কমল ঘোষের অনুরোধে একরকম বিছানায় শুয়েই কিশোরের জন্য মুকুল দত্তের কথায় সুর করে রেখেছিলেন হেমন্ত। কিশোরকে রেকর্ড করে পাঠানোর পর একদম নিজের স্টাইলে ফেলে যে গান গাইলেন কিশোর একেবারে চিরকালীন আর অমর হয়ে গেল। গানগুলো হ'ল -
'আমার পুজার ফুল', 'চোখের জলের হয় না কোনও রং', '
'সে যেন আমার পাশে' আর
'কেন রে তুই চড়লি ওরে বাবুদের জুড়িগাড়িতে'।
মেগাফোনের হয়ে এই গান তৈরির প্রস্তাবের সময় কমল ঘোষ হেমন্তকে বলেছিলেন, একটু চটুল সুরের গান করতে। কিশোরের হিন্দি চটুল গানের বাজার তখন তুঙ্গে বলে এই অনুরোধ। বোদ্ধা আর অভিজ্ঞ হেমন্ত বলেছিলেন কিশোরের গলায় সিরিয়াস গানও দারুণ খুলবে। কমলবাবু সেটা মানতে চাননি। ‘কেন রে তুই চড়লি ওরে’ প্রায় জোর করে বানানো হ'ল কোম্পানির কর্তাদের চাপে। রেকর্ড বেরোনোর পরে যখন হইহই পড়ে গেল কমলবাবু হেমন্তর কাছে বাধ্য হয়ে স্বীকার করেন ‘কেন রে তুই’ যেন দলছুট হয়ে গেছে। সে গানের বদলে একটা সিরিয়াস গান থাকলে বরং ভালে হত।
আমি পরে যখন ইন্টারনেটে হেমন্তর নিজের কন্ঠে ' আমার পূজার ফুল ' আর 'কেনরে তুই চড়লি ওরে' শুনেছি দেখেছি হেমন্ত যখন গাইছেন গানটা যেন একেবারেই তাঁর মতো। আবার কিশোর যখন গাইছেন মনে হচ্ছে সেই অন্তর্লীন ব্যথা যেন কিশোরের একান্ত নিজেরই। গানটা তাঁর ছাড়া আর কারুর নয়।
একটা গল্প শুনেছিলাম। একবার এক লাইভ স্টেজ শো'র জন্য অনেক টাকা নিয়েছিলেন কিশোর। কিন্তু অনুষ্ঠানের দিন সকালে দেখেন তাঁর গলা দিয়ে রক্ত পড়ছে।অগত্যা যেতে পারবেন না। অনুষ্ঠানের কর্মকর্তাদের তো মাথায় হাত! কিশোর তখন বুদ্ধি দিলেন শহরে হেমন্তবাবুও আছেন, তাঁকে আমার নাম করে বলুন।পীড়াপীড়িতে হেমন্তবাবু রাজি হ'লেন। দর্শকরা খুব খুশি। এক মহান শিল্পীর অনুপস্থিতিতে আরেক মহান শিল্পী। হেমন্তবাবু গাইলেন। পরে কিশোর জানালেন তিনি বুঝতে পেরেছেন তাঁর গলা থেকে নয়, জিভ ছুলতে গিয়ে সেখান থেকে কিছুটা ব্লিডিং হয়েছিল। তিনি তক্ষুনি অনুষ্ঠানে যেতে চান। উপরি পাওনা হিসেবে কিশোরও গাইলেন সেই অনুষ্ঠানে।
সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র ছেলে ছিল ভীষণ অসুস্থ। বেশিদিন সে বাঁচেনি। সেই অসুস্থ বালক ছিল গানের পোকা। তাঁর সেই সাধ পূরণ করতেন হেমন্তবাবু। বড় বড় শিল্পীদের এনে তার কাছে হাজির করতেন। স্নেহ আর বিষাদ নিয়ে তাঁরাও আবদার পূরণ করতেন। শোনাতেন একের পর এক গান।
একদিন কিশোরকেও নিয়ে এলেন তার 'হেমন্তকাকু'।
তখন ঘোর দুপুর। ছেলের অনুরোধে তাঁকে গাইতে হয়েছিল বাবার সিনেমার গান-‘সফর’-এর ‘জিন্দেগি কা সফর’। গানটা গেয়ে কিশোর মাথা নিচু করে চুপ করে বসেছিলেন । ফের ছেলের তাড়া খেয়ে সোজা তার চোখে চোখ রেখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে ধরলেন, ‘জীবন সে ভরি তেরি আঁখে’,তারপর ‘মেরা জীবন কোরা কাগজ’। হঠাৎ নিজের রূপে ফিরে বললেন আর একটাও আমি তোর কথামতো গান গাইব না। যত্তসব ‘ইয়ে’ গান। এ বার এটা শোন।
বলেই গলা দিয়ে নানারকম আওয়াজ বার করে, ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ গেয়েই দৌড়। সোজা গাড়িতে। পিছনে হেমন্তবাবু আর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। চোখ মুছতে মুছতে কিশোর বললেন, 'কী যে করেন, এমন জায়গায় আমার মতো মানুষকে কেউ আনে?'
তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন ব্যাকরণ না মেনেও বৈয়াকরণিকদের চমকে দেওয়া যায়।
সংগৃহিত