14/04/2024
ডাকনাম টোটো। আদর করে অনেকে টুকটুক বলে ডাকে। আমি সারাদিন টো টো করে রাস্তায় ঘুরে বেড়াই, সম্ভবত সেই কারণেই আমার নাম টোটো।
আমার স্টপেজ বলে কিছু নেই। যেখানে-সেখানে যখন-তখন আমি দাঁড়িয়ে যাই। কোন প্যাসেঞ্জার বগল চুলকানোর জন্য হাত তুলুক বা গার্লফ্রেন্ডকে টাটা করার জন্য হাত তুলুক, আমি দাঁড়িয়ে যাই। পিছনে এম্বুলেন্স আসুক বা কনভয়, গ্রীন সিগন্যাল হোক বা রেড, তিন মাথা হোক বা পাঁচ মাথা, রাস্তার বামদিকে হোক বা মাঝখান, রাস্তা ফাঁকা থাকুক বা জ্যাম, একবার কেউ আশীর্বাদের স্টাইলে বা নেতা-স্টাইলে হাত দেখালেই ঘ্যাচ করে দাঁড়িয়ে যাই। সেই সময় পিছন থেকে কেউ আমাকে ঠুকে দিলে দিক, আমার কিচ্ছু এসে যায় না।
ফুলশয্যার রাতে বর যেমন প্রথম দফায় আলতো করে বউ এর গালে চুমু দেওয়ার জন্য ঠোঁটদুটো অতি সন্তর্পণে এগিয়ে নিয়ে যায়, ঠিক সেরকম আমিও সামনে স্পিড ব্রেকার দেখলে বেগ কমিয়ে আমার সামনের চাকা আলতো করে এগিয়ে নিয়ে যাই। আর যেহেতু আমি নিউটনের গতিসূত্র পড়িনি, তাই কতটা ভরবেগ সৃষ্টি হলে সামনের বাধা পেরিয়ে মাধ্যাকর্ষণ বল কাটিয়ে সামনের ও পেছনের চাকা সেফলি স্পিড ব্রেকার টপকে যাবে, সেটা ক্যালকুলেশন করতে পারিনা। স্বাভাবিক ভাবেই বেশিরভাগ সময়ই আমি থমকে দাঁড়িয়ে যাই। প্যাসেঞ্জাররা নেমে পিছনে ঠেলা না পারা পর্যন্ত আমি গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। সামান্য গর্ত দেখলেও সেম অবস্থা হয় আমার। এত স্লো করি যে চাকা আটকে গেলে আর উঠতে চায় না। আমি জোরে চলতেই পারি। আমারও বেগ আছে। শুধু আপনাদের কথা ভেবে আস্তে চলি। আপনাদের শিরদাঁড়া পিছন থেকে খুলে গিয়ে রাস্তায় যাতে গড়াগড়ি না খায়, ঠিক সেই কারণেই আমাকে দেখেশুনে পথ চলতে হয়।
আমি সাম্যবাদী যান। সেজন্য রাস্তায় চলার সময় কাউকে ওভারটেক করি না, আবার কেউ পেছন থেকে আমাকে ওভারটেক করতে চাইলে জায়গা ছাড়ি না। মাঝরাস্তা বরাবর ডাঁটসে হেলতে দুলতে চলতে থাকি। চালাকি করে কোন বাইক বামদিকে ওভারটেক করতে এলে আমি বামদিকে ঘেঁষে যাই, ডানদিকে এলে ডানদিকে হেলে যাই।
এমনিতে চারজন প্যাসেঞ্জার নেওয়ার ক্ষমতা রাখি। কিন্তু সাত আট জন হলেও কোনও অসুবিধা হয় না। প্যাসেঞ্জার নিজেরা এডজাস্ট করে বসতে পারলে দশ জনও কোন ব্যাপার নয়। ড্রাইভারের ঘাড়ে, কোলে, পিঠে চেপেও দু'তিন জন আরামসে চলে যেতে পারে। প্যাসেঞ্জার বেশি হলে আমার ব্রেক আর কাজ করে না। লিমিটলেস ভরবেগের দরুন ব্রেক জবাব দিয়ে দেয়। তখন চেষ্টা করেও থামতে পারি না। অগত্যা রাস্তার পাশের হাইড্রেনে গড়াগড়ি খাওয়া কিংবা ইলেকট্রিক পোলে ধাক্কা মারা ছাড়া আমার আর কোন উপায় থাকে না। এই সময় সামনে কোন ফোর হুইলার পড়লে খুব সুবিধা হয় আমার। ঘ্যাক করে গাড়ির পিছনে আমার সামনের চাকা আলতো করে ঠেসে দিই। এতে করে হালকা ঝাঁকুনি খেয়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে যেতে পারি। যদিও এটা অন্য ব্যাপার যে, সামনের গাড়ির ড্রাইভার বেরিয়ে এসে আচ্ছা করে খিস্তি মেরে যায়। পাত্তা দিই না, মোদ্দা কথা হল আমার টার্গেট থামা, যাকে সামনে পাবো তার পিছনেই....
তবে এই বাইক, অটো, চারচাকা এদেরকে দেখলে আমার খুব হিংসে হয়। পাঁচ দশ লিটার পেট্রল/ডিজেল পাঁচ মিনিটে উদরস্থ করে এরা সারাদিন সার্ভিস দিয়ে যায়। আর আমি সারাদিন টো টো করে রাস্তাঘাটে ঘুরে আবার সারারাত জেগে ইলেকট্রিক খাই। ঘুমানোর সময় পর্যন্ত পাই না। সেজন্য একবার ছায়া দেখে কোনও জায়গায় দাঁড়িয়ে গেলে আর যেতে চাই না। প্যাসেঞ্জার আসে, গন্তব্য জানায়, দামদর করে, আমি শেষমেশ 'না' করে দিই।
এমনিতে চলার সময় খুব একটা শব্দ করি না। কিন্তু বয়স বাড়লে দৌড়াবার ক্ষমতা যতই কমে আসে, তখন সাইরেনের মতো শব্দ করি। হ্যান্ডেল, ব্রেক, হর্ন কোনোকিছুই ঠিকঠাক কাজ করে না। শব্দ শুনে লোকে এম্বুলেন্স ভেবে রাস্তা ছেড়ে দেয়।
আমি স্বপ্ন দেখি কোন একদিন গোটা পৃথিবী টোটোময় হয়ে যাবে। টোটো আকাশে উড়বে, জলে ভেসে বেড়াবে, রেললাইনের উপর দিয়ে ছুটবে, গঙ্গার তলা দিয়ে এগিয়ে যাবে। পৃথিবীর জনসংখ্যাকে একদিন আমারা ছাপিয়ে যাব।
সস্ত্রীক আম্বানিকে পিঠে চাপিয়ে একদিন কুম্ভমেলা ঘুরিয়ে আনার বড্ড সাধ আমার!😔
©Santu Saha