09/06/2024
স্টিভ জবস একবার বলেছিলেন, “Innovation distinguishes between a leader and a follower.”। এ কথাটার সুবিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। আজকের এই লেখায় আমরা যখন লাইফলং লার্নিং এবং নতুন স্কিল শেখা নিয়ে আলোচনা করব, তখন ঘুরে ফিরে স্টিভ জবসের বলা এ কথাটা বিভিন্ন সময় আমাদের আলোচনায় চলে আসবে।
লাইফলং লার্নিং-এর দুনিয়া নিয়ে আমার জানা, শেখা এবং দেখার বিষয়গুলোর উপরে আমি নিয়মিত অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং দৃষ্টিভঙ্গি ফেসবুক ও লিংকডইনে লিখে থাকি। খুব সম্ভবত এ কারণেই বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের অনেকে আমাকে ইনবক্সে অথবা ইমেইলে যোগাযোগ করে পরামর্শ চেয়ে থাকেন।
তাদের মাঝে আমি একটা দারুন বিষয় লক্ষ্য করি। তারা শিখতে চায়। নতুন কিছু শেখার এবং নতুন কোন স্কিল ডেভেলপ করার একটা তীব্র ইচ্ছে তাদের রয়েছে। আমার সাথে যোগাযোগ করে তারা হয়তো আশা করেন আমার কাছ থেকে ক্যারিয়ার এবং জীবনের পথচলার বিষয়ে গাইডেন্স পাবেন। সে গাইডেন্স দেওয়ার জন্যে আমি কতটুকু যোগ্য, তা নিঃসন্দেহে আমার কাছেই অনেক বড় প্রশ্ন! তবুও তাদের উদারতা যে তারা আমাকে যোগ্য মনে করে ম্যাসেজগুলো পাঠান।
তাদের সাথে ম্যাসেজ এবং ইমেইল আদান-প্রদানের এক পর্যায়ে আমি নিয়মিত যে প্রশ্নটা পেয়ে থাকি তা হচ্ছে, ‘অমুক কোর্সটা করলে কেমন হবে?’। অস্বীকার করব না, প্রায়ই আমি বিরক্ত হই এ প্রশ্নে। তবে যখন দেখি কেউ আগ্রহ নিয়ে আমাকে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছেন, তাকে সরাসরি আশাহত করতে ইচ্ছে করে না বরং অধিকাংশ সময় আমি ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাকে করা এ প্রশ্নটাই একটা মস্ত ‘ভুল প্রশ্ন’। অনেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, কেন এমনটা হবে? কারণটা মূলত তাদের করা ঐ প্রশ্ন, অর্থাৎ ‘অমুক কোর্সটা করলে কেমন হবে?’ এর মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে।
খুব ভালো কোন কোর্সও কারো কারো জন্যে একেবারেই ‘মূল্যহীন’ হয়ে পড়তে পারে। কারণ, ঐ মানুষটার কাজ এবং ক্যারিয়ারের সাথে ঐ কোর্সের কোনো সংযোগ নাও থাকতে পারে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে হয়তো। আমাকে মাঝেমাঝেই প্রশ্ন করা হয়, ব্লকচেইনের উপর কোর্স করলে কেমন হবে। ব্লকচেইন খুব হট টপিকগুলোর একটা। এ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা ভালো। কিন্তু, যদি কেউ মনে করেন ব্লকচেইনের উপরে কোর্স করলে ক্যারিয়ারে বেশ এগিয়ে যাবেন, দারুণ কোনো সম্ভাবনা এসে ধরা দেবে— তাহলে সেই মনে করাটা ভুলও হতে পারে।
অনেক সময়ই আমি লক্ষ্য করেছি এই শেখার আগ্রহটা অন্যকে অনুসরণ করে আসে যা যেকোনো স্কিল শেখার ক্ষেত্রে প্রথম ‘রেড ফ্ল্যাগ’। কারো ক্যারিয়ারে সে আসলে সৃষ্টিশীলভাবে চিন্তা করছেন নাকি অন্যকে অন্ধ অনুকরণ করার চেষ্টা করছেন, সেটা জানতে হলে নিজের কাছে নিজে যদি প্রশ্ন রাখুন, ঐ স্কিলটা কেন শিখতে চাচ্ছেন। তাহলেই জেনে যাবেন স্টিভ জবসের বলা কথাটার ‘লিডার’ এবং ‘ফলোয়ার’ এর মধ্যে কোন অংশে আপনি রয়েছেন।
কোনো বিশেষ স্কিলে নিজেকে দক্ষ করার ক্ষেত্রে মূলত প্রশ্নটা ব্লকচেইন অথবা ‘অমুক কোর্স’ নিয়ে নয়। প্রশ্নটা হচ্ছে কেউ যখন তার বেল্টে একটা নতুন স্কিল যুক্ত করার কথা ভাববে, তখন তার অবশ্যই প্রথমে চিন্তা করতে হবে ঐ স্কিলটা তার আদৌ লাগবে কিনা। কেউ চাইলে ফরাসি ভাষা শিখে নিতে পারে। কিন্তু, সেটা আদৌ তার কাজে লাগবে কিনা তা নির্ভর করবে তার ক্যারিয়ার গোল এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার উপর। যদি সে কোনো প্রোডাকশন হাউজের হয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসবে মার্কেটিং এর কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাহলে এই স্কিল ভীষণ কাজে লাগবে। কিন্তু, যদি তিনি সৌদি প্রো লিগের মার্কেটিং করার কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাহলে তার আরবি ভাষাটা শেখা থাকা জরুরি, ফরাসি নয়। ব্লকচেইন বা এরকম ‘অমুক’ বিষয়ও একইভাবে তার কাজের সাথে কতটা সম্পৃক্ত সেটার উপর নির্ভর করবে ঐ বিষয়ের উপরে একটা কোর্স করলে সেটা কতটা কার্যকর হবে।
অতএব, একটা বিষয় এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে কোর্স পেলেই কোর্স করার প্রতি যে তীব্র ইচ্ছে, সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বরং আমাদের নজর দিতে হবে কোন স্কিল প্রয়োজন এবং সেটা কখন। আর এটা যদি করতে পারেন, তাহলেই আপনি মূলত স্টিভ জবসের বলা উক্তির মতো একজন ‘ফলোয়ার’ থেকে ‘লিডার’ হয়ে ওঠার পথে হাঁটতে শুরু করবেন।
ক্যারিয়ারে যে স্কিলগুলোর প্রয়োজন হয় সেগুলোকে আমরা মোটা দাগে দুইটা ভাগে ভাগ করতে পারি: সফ্ট স্কিল এবং হার্ড স্কিল। এ দুই স্কিল নিয়ে এই সিরিজে আলাদা দুটো পর্বই রাখা হয়েছে যা পরে প্রকাশিত হবে। আপাতত এতটুকু বলছি যে সফ্ট স্কিল হচ্ছে এমন স্কিল যেটা সরাসরি জব-রিলেটেড বিশেষায়িত স্কিল নয় বরং সামগ্রিকভাবে যেকোনো কাজ করার ক্ষেত্রে এই স্কিল কম-বেশি সকল জবেই লেগে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যোগাযোগ করার দক্ষতা, নেতৃত্ব দেওয়া, কঠিন পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা ইত্যাদি। অন্যদিকে হার্ড স্কিল হচ্ছে বিশেষায়িত স্কিল যা সরাসরি জবের সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেমন, একটা সফটওয়্যার কোম্পানি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার অথবা প্রোগ্রামার হায়ার করে থাকে। এক্ষেত্রে তাকে প্রোগ্রামিংটা পারতেই হবে কারণ ওটাই তার প্রধান কাজ।
যখন কেউ একটা নতুন স্কিল অর্জন করতে চায়, তখন তাকে প্রথমেই বিচার করতে হবে সে কি সফ্ট স্কিল নাকি হার্ড স্কিল অর্জন করতে চাচ্ছে। সাধারণত হার্ড স্কিল অর্জন করাটা কঠিন। এটা বিশেষায়িত একটা জ্ঞানের উপর নির্ভর করছে এবং এই স্কিলের দক্ষতা সরাসরি তার ক্যারিয়ারে সে কেমন করবে, তা নির্ধারণ করে দেবে। তবে, এর অর্থ এই নয় যে সফ্ট স্কিলের গুরুত্ব কম। একজন ক্যারিয়ারের কোন অবস্থানে রয়েছে সেটার উপর নির্ভর করছে ওই সময়ে তার হার্ড স্কিল নাকি সফ্ট স্কিলের দিকে নজর দিতে হবে।
উদাহরণ হিসেবে মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলা এবং গুগলের সিইও সুন্দর পিচাইয়ের কথা বলা যায়। তারা দুজনেই ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ক্যারিয়ারের শুরুতেও তারা ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা আরএন্ডডি নিয়েই কাজ করেছেন। তাদের ক্যারিয়ারের মাঝামাঝি সময়ে তারা মূলত নেতৃত্ব নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। সে সময় সত্য নাদেলা অনলাইন সার্ভিস ডিভিশনের আরএন্ডডি দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর সুন্দর পিচাই অপারেটিং সিস্টেম এবং সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আরও পরে দুজনেই গুগল এবং মাইক্রোসফটের সিইও হয়ে ওঠেন। এ পর্যায়ে সফ্ট স্কিলই তাদের সবচেয়ে বড় স্কিল হয়ে ওঠে।
উপরের উদাহরণ থেকে এতটুকু বোঝা যাওয়ার কথা যে কে তার ক্যারিয়ারের কোথায় রয়েছে সেটা বলে দেবে কোন ধরনের স্কিল ডেভেলপ করতে হবে। এক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় বলে রাখা ভালো যে সফ্ট স্কিল মাত্রই ক্যারিয়ারের মধ্যভাগ থেকে এর প্রয়োজনীয়তা শুরু হবে, এমনটা কিন্তু মোটেও নয়। কেউ ভালো ইংরেজি বলতে পারলে অথবা রিপোর্ট লেখার কাজে বিশেষভাবে দক্ষ হলে সেটা তার ক্যারিয়ারের প্রথম দিন থেকেই কাজে লাগবে। অতএব, কোন সফ্ট স্কিল কখন প্রয়োজনীয়, সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকাও গুরুত্বপূর্ণ।
(যদি ফোন থেকে পড়ার সময় নিচের টেক্সট গুলো এলোমেলো আসে, তাহলে কমেন্ট সেকশনে গেলে ভালো ভাবে পড়তে পারবেন। আমি একটা কমেন্টে এই টেক্সটগুলো শেয়ার করেছি)
লেখাটা শুরু করেছিলাম স্টিভ জবসের একটা উক্তি দিয়ে। শেষ করবো বিল গেটসের বলা আরেকটা দারুন কথা দিয়ে। নতুন প্রজন্মকে উদ্দেশ্য করে বিল গেটস বলেছিলেন, “Don’t compare yourself with anyone in this world. If you do so, you are insulting yourself.”। যখনই আমরা কোন স্কিল শিখতে চাইবো, কোন বিশেষ কাজে দক্ষ হতে চাইবো, তখন অবশ্যই অন্যকে দেখে সেটা শেখার জন্য যেন উৎসাহী হয়ে না উঠি, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা জরুরি।
অন্যের সাথে তুলনা করে নয়, বরং প্রত্যেকের নিজের ক্যারিয়ারের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের সাথে যা সম্পর্কযুক্ত, সেটা করা এবং সে বিষয়ে দক্ষ হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা নেয়া দরকার। অন্যকে দেখে এবং অন্যের সাথে বারবার নিজেকে তুলনা করে ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে আপনি বরাবরই অন্যের পথ অনুসরণ করবেন। নিজেকে আলাদা করে যদি আপনি পৃথিবীকে চেনাতে চান, তাহলে অন্যের থেকে অনুপ্রেরণা নিন, কিন্তু নিজে বেড়ে উঠুন নিজের মতো করে, আত্মবিশ্বাসের সাথে।
আগামী পর্বে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো সফ্ট স্কিল নিয়ে। আশা করি বরাবরের মত আপনাদের সে পর্বেও পাঠক হিসেবে পাশে পাবো।
লিখেছেন: Niaz Chowdhury।
Official page for the literary and non-fictional works of author Niaz Chowdhury